দ্যাখ শৈবাল, তোর বিয়ের মেয়ে দেখার জন্য আর আমাকে বলবি না।

তার মানে? তুই আমার পোশাক পরতে শেখার আগের স্টেজের বন্ধু। তুই দেখবি না তো কে দেখবে!

না, তোর মনের মতো সুন্দরী, সর্বগুণসম্পন্না রমণী আমি খুঁজে বের করতে পারব না ভাই।

আরে, সর্বগুণসম্পন্না তো বলিনি। রাঁধতে না জানলেও চলবে, চুল বাঁধতে না জানলেও ক্ষতি নেই। শিক্ষিত হওয়ার সাথে আমি চাই শুধু উদার আর সংস্কৃতিমনস্ক, যার রাজনীতি-বোধ আছে, এমন মেয়ে

উফফ…। সেই উদার, উদার, উদার…

প্রাণ হাঁসফাঁস করা গরমের বিকেলে আমি আর নির্মল ফিরছিলাম বাইকে করে। নির্মল আমার ছেলেবেলার বন্ধু। জীবনের প্রথম সবকিছুর সাক্ষী। তাই আমার বিয়ের মেয়ে দেখতে যাওয়া নির্মলকে ছাড়া হতেই পারে না। চাকরি পাওয়ার পর থেকেই মা আর দিদি বিয়ের জন্য চাপ দিয়ে চলেছে। আর আমি ওদের কাছে আসা সব সম্বন্ধ একের পর এক নাকচ করে চলেছি। কারণ, আমার মনের মধ্যে যে-মানসকন্যার ছবি আঁকা আছে, তারা তার ধারেকাছে কেউ নয়। সেদিনও টাকিতে একটা মেয়েকে দেখে ফিরছিলাম। সেই সম্বন্ধটা অবশ্য এনেছিল নির্মলের বউদি। যথারীতি সে মেয়েকেও আমার পছন্দ হল না। অনেক কারণে আমি বিভিন্ন মেয়েকে রিজেক্ট করেছি। সে সব গোপন কথা কাউকে বলিনি। আমার নিজস্ব একটা হিসাব ছিল, আমি পাঁচ দশ। বউ হবে মিনিমাম পাচঁ আট। সামনে দাঁড়িয়ে কপালে চুমু খেতে পারব আমি। ঝুঁকতে হবে না।

অনেকগুলো মেয়ে রিজেক্ট করার পর নির্মলের জেরায় আমি সেই কথাটা বলে ফেলি। ফলত ও আমাকে হেলমেট দিয়ে মারতে যায়। বলে, শালা, বাংলাদেশে অমন তালগাছ খুঁজে বার করা আমার সাধ্য নয়। থাক তুই আইবুড়ো হয়ে৷

এছাড়া আমার আরও একটা থিওরি ছিল। কথায় কথায় কায়দা করে জেনে নিতাম, মেয়ে খবরের কাগজ পড়ে কিনা, নিউজ চ্যানেল দেখে কিনা। কারণ কাজের লোক আর বাচ্চার মা হওয়ার কম্বিনেশন নয়– আমি খুঁজতাম মনের সঙ্গী। আমার কবিতা, আমার গল্প, আমার রাজনৈতিক বিশ্বাস আর সংস্কৃতির আঙিনায় একসাথে হাত ধরে হাঁটার জন্য আর একটা হাত। যে হবে উদার, খোলা হাওয়ার মতো। যে হবে বন্ধু কাম বউ।

চট করে খুঁজে পাব না জানতাম। কারণ আমি কোনও রাজনীতি সচেতন মেয়ে দেখিনি। টিভি বা খবরের কাগজে দেখার কথা বলছি না। আমার বাস্তব জীবনে যাদের দেখেছি সবাই সিরিয়াল দেখা মেয়ে কাউকে ভুল করেও নিউজ পেপার পড়তে বা নিউজ চ্যানেল দেখতে দেখিনি কোনও দিন। রাজনীতি করা না হোক, সচেতন হলেই হবে। হঠাৎ সেটাই একদিন দেখে ফেললাম।

নির্মল তো আমাকে ‘ওরকম করে বউ খোঁজা যায় নাকি!’ এইসব বলে গালাগাল দিয়ে, আমার সাথে আর মেয়ে দেখতে যাবে না বলে হুমকি দিল। কিন্তু যার কেউ নেই তার ভগবান আছে। হুমকি দেওয়ার আধ ঘন্টা পরেই ওর চা তেষ্টা পেল। ও বলল দাঁড়া, বিরাটি মোড়ের এই দোকানটায় চা খুব ভালো বানায়।

যশোর রোডের একধারে বাইক দাঁড় করিয়ে দুজনে চা খাচ্ছি। কানে আসছিল একটা ছাত্র সংগঠনের স্ট্রিট কর্নার থেকে করা এক মহিলা কন্ঠের বক্তৃতা। আমার কান হঠাৎ আটকে গেল সেটায়। আমি মোহিত হয়ে শুনতে লাগলাম। গলা শুনে মনে হল, অল্প বয়েসি। মিষ্টি গলা। চা শেষ হতেই তাড়া লাগাল নির্মল। আমি দ্রুত চুমুক মেরে আমার চা শেষ করে বললাম, দাঁড়া তুই, আমি একটু আসছি।

এই বলে আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম রাস্তার মোড়ের জমায়েতের দিকে। উজ্জ্বল, শ্যামবর্ণ, বয়স এই তেইশ-চব্বিশ হবে। বাতাসে চুল উড়ছিল। হাইটটা পাঁচ ছয় কি সাত…

ঘোর কাটল নির্মলের ফোনে, আরে, আসছি বলে কোথায় চলে গেলি…

দুই 

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে আর এক প্রস্থ চা খেয়ে আমি বসে গেলাম আমার লেখালিখির টেবিলে। লিখতে নয়। মেয়েটাকে খুঁজতে। অহনা লাহিড়ি। ল্যাপটপ খুলে ফেসবুকে ঢুকেই সার্চ শুরু করলাম। গোটা দশেক অহনা লাহিড়ি পেরিয়ে পেলাম আমার অহনাকে। দলের একগাদা পতাকার মাঝে তার উজ্জ্বল হাসিমুখ। মুখখানা ছোটো। আর ফিগার এক্কেবারে স্লিম। যাকে সোজা কথায় বলা চলে রোগা। আমার অবশ্য তাতে অসুবিধা নেই। গোটা দুনিয়া এখন স্লিম মেয়েদের জন্য পাগল।

মেয়েটির বক্তৃতা শেষ হবার পরেই ঘোষক তার সমন্ধে দু-চার কথা বলেছিল। ছাত্র-যুবর নেত্রী শুনেই আমার মনে আশা জেগে উঠেছিল। কলেজ বা ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট হলে আইবুড়ো থাকার সমূহ চান্স। শুধু জানতে হবে একা নাকি। আর বোঝাতে হবে, একা একা এভাবে আর থাকা সত্যি যায় না!

আগেই বলেছি, যার কেউ নেই তার ভগবান আছে। নির্মল আমাকে হুমকি দিয়েছিল, আমার জন্য আর মেয়ে দেখতে যাবে না। এই তো স্ট্যাটাস দেওয়া সিংগল! আর বায়ো-তে লেখা, উয়োম্যান উইথআউট আ মেক-আপ বক্স। উফফ, কী কুল…!

আগাপাস্তলা অ্যাকাউন্ট ঘাঁটাঘাঁটি শেষে দিলাম ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে তারপর নিজের কাজ করতে লাগলাম।

ঘন্টা দুয়েক পর মোবাইলে ফেসবুক খুলে দেখি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করেছে অহনা। মেসেজ পাঠিয়েছে আমাকে!

বন্ধু হবার আহ্বান জানানোর জন্য ধন্যবাদ।

একজন লেখক আমার বন্ধু, কী সৌভাগ্য!

আমি কবিতা বুঝি না, তবে গল্প খুব পড়ি, সময় পেলেই।

আপনার বাজি গল্পটা অসাধারণ!

আর আপনার আয়না গল্পটা তো আমাকে কত রাত ঘুমোতে দেয়নি৷

 

আমি কোন নীল আকাশের পেঁজা তুলোর মাঝে হারিয়ে গেলাম…

তিন 

ঠিকানা ফোন নাম্বার চালাচালির পর মাত্র চারদিন দেখা করেছি। আমি স্পষ্ট করে বলিনি আমার উদ্দেশ্য। তবে ও কী বোঝে? বোঝে নিশ্চয়। মেয়েরা হয়তো আলাপের প্রথম দিনেই বুঝে যায়, কে কী চায়। আমরা ছেলেরা বোকার মতো সেই কথাটাই বুঝে উঠতে পারি না।

পঞ্চমদিন আমি কথায় কথায় বললাম, দিদির বিয়ে হয়ে গেছে, আমি আর মা বাড়িতে। আমি অফিস চলে গেলে মা একা। তাছাড়া মায়ের বয়স হয়েছে, রান্নাবান্না…

এমা, মাসিমাকে দিয়ে রান্না করাচ্ছেন কেন? রান্নার লোক রাখুন…

খুঁজে দিন না একটা। খুঁজে পাচ্ছি না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল অহনা। আমার মনে হল কথাটা বলা ঠিক হল না। আমি একজন লেখক। আমার গল্প ও কবিতা দুটোই প্রথম সারির সব পত্রিকায় ছাপা হয়। আমি ইংরেজি কাগজেও লিখি। তরল মন্তব্য আমাকে মানায় না।

এতদিন সালোয়ার কামিজ পরতে দেখা অহনা সেদিন শাড়ি পরে ইকো পার্কে এসেছিল, আমার সাথে দেখা করতে। আমার কথা শুনে ও ঘাসের উপর বসে নিজের শাড়ির আঁচল আঙুলে জড়াতে লাগল। আমি ভাবলাম এই কী সেই জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেওয়া মেয়ে! মনে হল, ও রাগেনি। ঝট করে এমন কথা বলায় ও ঘাবড়ে গেছে। লজ্জা পেয়েছে।

ঠিক আছে, চেষ্টা করব খুঁজে দিতে। তার আগে তো জানতে হবে কেমন কাজের লোক আপনার পছন্দ…

এই ধরুন আপনার মতো– কথাটা মুখে এসেও আটকে গেল।

ওকে, পরে মেসেজ করে বলে দেব। বললাম আমি। ছেলে বলে কি আমার লজ্জা নেই!

বিএ পাস মেয়ে চলবে?

হুম, চলবে। তেমন কারও সন্ধান আছে নাকি?

দেখি, আছে একজন। পরদিন বলব।

বুকের মধ্যে ফল্গুধারার মতো তিরতির করতে থাকা আনন্দের অনুভূতিটা বেশিক্ষণ থাকল না। যখন শুনলাম, দুদিন পর সে ওদের ছাত্রদলের সর্বভারতীয় সম্মেলনে হিমাচল প্রদেশ চলে যাচ্ছে।

চার

ওকে কাছে পেয়ে হঠাৎ আবার হারিয়ে ফেললাম। ফোনে প্রলাপ বকতে লাগলাম আমি।

আমার কাজের মেয়ে খুঁজে পেলেন?

হুম, খুঁজছি। পেলেই জানিয়ে দেব।

আপনি খুঁজে না দিয়ে তো চলে গেলেন।

কী করব বলুন, সব আগে থেকে ঠিক করা ছিল। নাহলে…

আপনি খুব নিষ্ঠুর।

কেন? নিষ্ঠুর কেন?

কেন জানি না। বুঝে নিন।

আচ্ছা আপনার কাজের মেয়েকে মাইনে কত দেবেন? হাসে অহনা।

মাইনে নেই…বিনা পয়সার কাজের লোক চাই। আর রাখঢাক করতে না চেয়ে বলে ফেলি আমি।

ও, বিনা পয়সার লোক খুঁজছেন…

আমার আবদার মেনে ও রোজ আমাকে তার ছবি পাঠাতে থাকে। আর তার ছবি দেখে আমি কেমন যেন ওর জন্য একটু একটু করে পাগল হয়ে উঠতে থাকি। ওকে দেখার জন্য খুব মন ছটফট করতে থাকে। ওর শাড়ি, সালোয়ারে তোলা সব ছবি দেখেই, ওকে যেন রাজকন্যা মনে হয়। আমি মনে মনে ওর নাম দিই হিমাচলের রাজকুমারী।

অহনা মিটিং হল থেকে ছুতোয়-নাতায় বেরিয়ে আমাকে রিং করতে থাকে। আমিও বুঝতে পারি ও আমার ফোনের প্রতীক্ষায় বসে থাকে। বুঝতে পারি শুধু আমি নই, ও নিজেও প্রেমে পড়ে গেছে।

পাঁচ

অহনা ফিরে আসার পর দেখা না করে থাকতে পারছিলাম না। যেদিন ফিরল সেদিন সন্ধ্যাতেই গেলাম। ওদের দমদম পার্কের বাড়ির কাছে গিয়ে এক রেস্টুরেন্টে বসে কফি খেয়ে এলাম। কথা হল রবিবার বিকেলে ইকো পার্কে যাচ্ছি আমরা।

আপনি থেকে নেমে যাই তুমিতে। বেশিরভাগ কলই আর সিমে নয়, হয় হোয়াটস অ্যাপ, ডুয়ো কিংবা মেসেঞ্জারের ভিডিয়োতে করি আমি। অহনা অনেক সময় ভিডিয়ো কল ধরে না, রিং ব্যাক করে অডিয়ো কল করে। আমি মানি না। ও বলে, যাহ, নাইটি পরে আছি কিংবা এখন স্নানে যাচ্ছি। আমি জোর করি। যেমন আছো, আমি তেমনই দেখতে চাই। ভিডিয়ো রিসিভ করতেই হবে।

আমার সব আবদার আস্তে আস্তে সে মেনে নিতে থাকে। আমি প্রথমে তার মরালীর মতো মসৃণ গ্রীবার প্রসংশা করি। তারপর গাউনের রঙের প্রশংসা করি। তারপর গলায় ঝুলতে থাকা গোল্ড চেনের পেন্ডেন্ট কোথায় হারিয়ে গেছে জানতে চাই। দেখতে চাই পেন্ডেন্ট-টা। ও গাউনের ভিতর থেকে বের করে এনে দেখায়। আমি বলি, ঝুলন্ত অবস্থায় দেখতে চাই। রাজনীতি সচেতন, জ্বালাময়ী বক্তৃতাতে বিপক্ষকে শুইয়ে দেওয়া নারীও, আমার কাছে প্রেমের কথা শুনে সিডিউসড হয়ে যায়। আমি বলি, স্বর্গের বাকিটুকু সৌরভ আমি আপাতত কল্পনা করে নিচ্ছি।

ও বলে, যাহ, তুমি খুব বাজে…

শনিবার সন্ধ্যায় মাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বললাম, মা, একটা মেয়ে.. আমার বন্ধু… না মানে, বন্ধু ঠিক না…

কী নাম?

অহনা।

বাহ, বেশ মিষ্টি নাম। নিয়ে আয় একদিন আমার কাছে।

রবিবার ইকো পার্ক থেকে ঘুরে ওকে নিয়ে বাড়িতে চলে এলাম। ওকে দেখে মার পছন্দ হয়ে গেল। ওরও পছন্দ হল আমাদের বাড়ি। যাওয়ার সময় বলে গেল, এই, আমাদের বাড়ি কিন্তু তোমাদের মতো এত সুন্দর নয়।

আমার তো হিরের আংটি-টা চাই, শোকেস নয়। আমার এই কথা শুনে কিছুটা নিষ্প্রভ অহনার মুখে আবার হাসি ফুটে উঠল।

ওর বাবা কৈখালির একটা প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। রিটায়ার করার পরের বছরই মারা গেছেন। ওর মা আলিপুর পোস্ট অফিসের সর্টিং অ্যাসিস্ট্যান্ট। ওর কাছেই শুনেছি। তাতে ওদের আর্থিক অবস্থা কিছুটা আন্দাজ করতে পারি। আমার বাবা ডাক্তার ছিলেন। যথেষ্ট পসার ছিল। হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যাওয়াতেও পথে বসতে হয়নি। কারণ বাবার যা সঞ্চয় ছিল তা যথেষ্ট। বাবার মৃত্যুর পরের বছরেই অবশ্য আমি কমার্শিয়াল ট্যাক্সের ইন্সপেক্টর পদে চাকরি পেয়ে যাই। তবে আমি অহনাকে কোনও মতেই হাতছাড়া করতে চাই না। সে আর্থিক অবস্থা ওদের যেমনই হোক। মা দেখে পছন্দ করার পরের দিনই আমি ওদের বাড়ি শীঘ্রই যাব বলে জানাই।

এম্মা, এত তাড়াতাড়ি…

কোনও অপূর্ব জিনিস বেশিদিন হাতের বাইরে রাখতে নেই…

তাই? ইনসিকিওরড!

হ্যাঁ, তাই ধরো…। তাছাড়া আমি কেন তোমাকে কাছে পাওয়ার জন্য এতদিন ওয়েট করে থাকব? তুমি তো আমার বউ হতে রাজি হয়ে গেছ…

লেখক মশাই, আলাপ কবে হল মনে আছে? একমাসও গড়ায়নি…

তো? তাতে কী। ইতিহাসে অনেক কাপলেরই প্রথম দেখার এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে। অ্যান্ড দে লিভড হ্যাপিলি দেয়ার আফটার।

আরে মশাই আমাকে এমএ-টা তো কমপ্লিট করতে দিন।

না হবে না। বিয়ের পর পড়বে…

অহনা চুপ করে যায়। এই জেদ মেয়েরা পছন্দ করে বলেই আমার লেখক মনের ধারণা। কোনও মেয়ে এমন চাপ দিলে কোনও ছেলেরও খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু অহনা কেমন যেন একটা মিইয়ে যায়।

আমার একটা অসুবিধা আছে। তুমি কিছুদিন ওয়েট করো…

কী অসুবিধা বলো। আমি দূর করার চেষ্টা করছি।

সেটা পরে কখনও বলব। তবে দূর করা তোমার বা আমার হাতে নেই।

আরে, বলো তো আগে। আমি অধৈর্য হয়ে উঠি শোনার জন্য।

পরে বলব, পরে… বলে ফোন কেটে দেয় অহনা।

ছয়

 তার পরদিন অফিসের কাজের চাপের মধ্যেও সময় করে ফোন করি অহনাকে। প্রশ্নটা শোনার পরেই ওকে কেমন ডিপ্রেসড লাগতে থাকে। সেদিনও সে প্রশ্নটার জবাব দেয় না।

পরদিন সকাল থেকে ওর ফোন সুইচড অফ।

দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড ইজ আইদার সুইচড অফ অর আউট অফ নেটওয়ার্ক কভারেজ এরিয়া। সকাল থেকে সন্ধ্যা, যান্ত্রিক গলাটা শুনতে শুনতে আমার কান পচে যায়। কয়েকশো বার চেষ্টা করেও ফোনে পাই না ওকে। ভিডিয়ো কল, অডিয়ো কল, সিম কল কিছুই বাদ দিই না। সব চেষ্টা বৃথা। আমার তখন পাগল হওয়ার মতো অবস্থা। কোনও কমন ফ্রেন্ড নেই যে খবর নেব। একদিন ওদের বাড়ির কাছাকাছি এক রেস্টুরেন্টে গেছি যদিও কিন্তু ওদের বাড়ি যাইনি, চিনিও না। অসহ্য ছটফটানিতে আমার ঘুম হয় না।

আমি হিমাচল থেকে পাঠানো ওর ছবিগুলো দেখতে থাকি। ওর ছবিতে যতগুলো ছেলে বন্ধুকে দেখতে পাই সবাইকে ওর গোপন প্রেমিক বলে মনে হতে থাকে। শুধু মনে হতে থাকে, আমি বুঝি অহনাকে হারিয়ে ফেললাম। বুঝি কেন, নিশ্চিত হারিয়ে ফেললাম। মনে হয় ওর কাছাকাছি থাকা সবকটা ছেলেকে খুন করে ফেলি। ও কার জন্য সুইচ অফ করে দিল! কোন ছেলের সাথে কোথায় চলে গেল!

চোখের জলে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। সকালে ঘুম ভাঙতে আবার শুরু করলাম ডায়াল করা। বারবার একই কথা বাজতে লাগল, ডায়াল কিয়া গয়া নাম্বার আভি সুইচড অফ হ্যায়। অফিসের সব কাজে ভুল হতে লাগল। আমার আন্ডারে যে-ছেলে ও মেয়ে এসআই-রা আছে তাদের সবাইকে আচ্ছা করে ঝাড় দিতে লাগলাম। তার মধ্যে অতনু আর রেশমি ব্যাচমেট। প্রেম করে, বিয়ে করবে। ওদেরকে আরও বেশি করে থ্রাশিং করলাম।

এক সপ্তাহ আমি মরে বেঁচে রইলাম। মেয়েটা যে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর জীব, সে সম্পর্কে আমার আর কোনও সন্দেহ রইল না।

এক সপ্তাহ পর দেখি আমার ফোনে কোম্পানির মেসেজ। number 983…..is available now…

ধুকপুক করা বুকে ফোন করলাম।

হ্যালো…

হ্যাঁ বলো, কেমন আছো…

তার মানে? কী ব্যাপার? এক সপ্তাহ ফোন সুইচ অফ করে রাখলে কেন? কার সাথে কোথায় গেছিলে?

শেষ প্রশ্নটা করার ইচ্ছা ছিল না। ওটা ঠিক আমার চরিত্রের সাথে মানানসই নয়। তবে আঘাত লাগলে চরিত্রের উপর সব প্রলেপ হয়তো এক লহমায় খসে পড়ে। আমিও রাগ কন্ট্রোলে রাখতে পারলাম না।

কোথায় আবার, দিদির বাড়ি গেছিলাম। বাঁকুড়ার একটা গ্রামে। ওখানে ঠিক টাওয়ার থাকত না। লোডশেডিং-এ ফোন চার্জ দেওয়াও সমস্যা ছিল।

ফ্যাঁসফেসে দুর্বল গলায় কথাগুলো বলে অহনা। বুঝতে পারি মিথ্যা বলছে বলে গলায় জোর নেই। আর আমি সারা জীবন মিথ্যাকে ঘৃণা করে এসেছি। মিথ্যা বলার জন্য আমি সবচেয়ে কাছের বন্ধুকেও এক লহমায় ত্যাগ করে দিয়েছি।

তুমি এমন জানতাম না… বলে ফোন কেটে দিই আমি।

অহনা দুবার ফোন করে। আমি ধরি না।

অফিসে গিয়ে নিজের সাথে লড়াই করি। দ্বন্দ্ব চলে নিজের ভিতরে।

একদিন, দুদিন কথা হয় না। তারপর আমিই ফোন করি। বুঝি আমি ওকে ছেড়ে থাকতে পারছি না। স্বাভাবিক ভাবে আগের মতোই কথা বলা শুরু করে অহনা। ভালো করে না জেনে কার সাথে কোথায় গেছিলে কথাটার জন্য লজ্জিত বোধ করি। ঠিক করি আস্তে আস্তে পরে জেনে নেব। এখনই আর খোঁচাব না।

আবার দেখা হতে থাকে নিয়মিত। ছুটির দিনে ইকো পার্ক, নিক্কো পার্ক, মোহর কুঞ্জ, প্রিন্সেপ ঘাট, জু। উইক ডেজে দমদম পার্ক, চিনার পার্কের রেস্টুরেন্টে।

তাহলে বিয়েটা কবে করছ?

প্রশ্নটা শুনেই নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে অহনা।

তুমি একটু ওয়েট করো, আমাকে কিছুটা সময় দাও…

কিছুটা মানে কতদিন?

এই ধরো দুবছর?

এবার আমার নিষ্প্রভ হয়ে পড়ার পালা।

এদিকে নির্মল আমাকে অ্যাটাক করেছে অহনার কথা শুনে। বলেছে, শালা তোর বউ পার্টি করবে, না সংসার করবে? সম্মেলনে, কনভেনশনে আজ হিমাচল, কাল দিল্লি, পরশু চেন্নাই করে ঘুরে বেড়াবে। আর তুই বাচ্চাকে ফিডিং বটলে করে দুধ খাওয়াবি! যা ভালো বুঝিস কর।

তবে আমি ওর ভড়কি দেওয়াতে কান দিইনি। এত সুন্দর একটা মেয়েকে বউ হিসেবে পেতে গেলে, কিছু অ্যাডজাস্ট করতে হয় করব। তবু সিরিয়াল দেখা বউ-এর চেয়ে রাজনীতি বোঝা বউই আমার চাই।

দুবছর কীসের জন্য অপেক্ষা, এড়িয়ে যায় অহনা।

আমার নেশা লেগে যায়। জানতেই হবে, কেন। মনে নানা প্রশ্ন প্রতিনিয়ত এসে ভিড় করে। ওর কি কোনও বয়ফ্রেন্ড আছে?

আবার মাস ঘুরে যায়। দিদি আসে আমাদের বাড়ি। মা একদিন ওকে আবার নিয়ে যেতে বলে। আমি খুশিতে ভিডিয়ো কল করি। বলি, কাল একবার এসো, দিদি এসেছে… মা বলেছে তোমাকে নিয়ে আসতে…

কাল! শুনে কিছুটা যেন ঘাবড়ে যায় অহনা।

কেন? কাল কী আছে? কোথাও যাবার আছে?

না, তা না… আচ্ছা দেখি, যাব…

সাত

পরদিন সকাল থেকে ফের ওর ফোন সুইচড অফ।

ডায়াল কিয়া গয়া নাম্বার আভি বন্ধ হ্যায়। সকাল থেকে সন্ধ্যা, একই সুর বাজতে থাকে। কয়েকশো বার চেষ্টা করেও ফোনে পাই না ওকে। ভিডিয়ো কল, অডিয়ো কল, সিম কল কিছুই বাদ দিই না। সব চেষ্টা বৃথা। আমার তখন আবার পাগল হওয়ার মতো অবস্থা।

দু-দিন অপেক্ষার পর আর থাকতে পারি না। ঠিক করি ওর নাম বলে, ওর বাবা-মার নাম বলে, খুঁজব গোটা দমদম পার্ক। যা থাকে কপালে।

পরদিন ছিল শনিবার। আমার অফিস বন্ধ। মর্নিং ওয়াক করতে বেরিয়ে আর ফিরলাম না। ট্রাউজারের পকেটে মানিব্যাগ নিয়ে বেরিয়েছিলাম। দুটো অটো পালটে পৌঁছে গেলাম ওদের পাড়ার মোড়ে। কিন্তু খুঁজে পাওয়া অত সহজ হল না। সবাই রাস্তার নাম, নাম্বার জানতে যায়, বাড়ির নাম, হাউজিং কমপ্লেক্স জানতে চায়। ওদের নিজেদের বাড়ি, এটুকু জানি। বছর দশেক আগে ওরা এখানে উঠে এসেছে। তার আগে ওরা ছিল ভাঙড় পাওয়ার গ্রিডের দিকে। দেশের বাড়ি। এখানে ওদের খুব বেশি লোকে তাই চেনেও না, বুঝলাম।

আমি নিজেই এদিক ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে থাকলাম। নিজের আহাম্মকির জন্য নিজেকেই গাল দিতে ইচ্ছে করল। প্রথমবার অমন হওয়ার পর কেন পুরো পোস্টাল অ্যাড্রেসটা নিয়ে রাখলাম না। আসলে ভাবিনি আবার এমন সুইচ অফ করে দিনের পর দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবে।

দুটো বড়ো হাউজিং কমপ্লেক্সের সামনে একটা চায়ের দোকান দেখলাম। একজন বৃদ্ধ লোক সেই দোকানে তখন চায়ের জল বসাচ্ছিল। তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, অহনা… এমএ পড়ে…।

অহনা… ও-ও, কুমুদ লাহিড়ির মেয়ের কথা বলছেন তো? ওই যে পুকুর পাড়ের ওই বাড়িটা। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় চা দোকানি।

সেই দোতলা বাড়ির রাস্তার দিকের ব্যালকনিতে তাকাতেই দেখতে পেলাম অহনাকে। সাদা সালোয়ার আর লাল কামিজ পরা। গায়ে একটা হালকা চাদর জড়ানো। কিন্তু আমাকে দেখেই ও তড়িৎ গতিতে ভিতরে ঢুকে গেল। আমি ওর মোবাইলে রিং করলাম। সেই সুইচড অফ। বাড়ির বাইরে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। যদি আবার বাইরে আসে। কিন্তু না। ও আর এল না। আমিই গেলাম ওদের বাড়ির দরজায়। দোতলা বাড়ি, সাদা রং করা। জায়গায় জায়গায় রঙের ছাল চামড়া উঠে গেছে। বাইরের কলিং বেল টিপলাম। বেল খারাপ মনে হল। বাজার শব্দ পাওয়া গেল না। দরজায় কড়া নাড়লাম। কিছুক্ষণ পর দরজা খুললেন এক ভদ্রমহিলা। সম্ভবত ওর মা। এত সকালে আমাকে দেখেও অবাক হলেন না। পরিচয়ও জিজ্ঞেস করলেন না।

অহনা আছে…? ওকে কদিন ফোনে পাচ্ছি না।

না, মানে ও তো বাড়ি নেই…। ওর পিসির বাড়ি গেছে। ঘটকপুকুর।

ওহো, ওটা কি গ্রামের দিকে? টাওয়ার থাকে না বা লোডশেডিং-এর সমস্যা…?

হ্যাঁ বাবা, দুটোই। আমিও ফোনে পাচ্ছি না।

ফেরার সময় বাড়ির পিছন দিকের জানলার নীচে ঘাসময় জায়গাটায় চোখ চলে যায়। অনেক ওষুধের খালি স্ট্রিপ, ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ পড়ে আছে। দুপা এগোই। এদিক ওদিক তাকাই। তারপর ঝপ করে নীচু হয়ে তুলে নিই দুটো নমুনা। Pause-MF 250 ট্যাবলেট আর Vitamin-K ইঞ্জেকশন। নতুন, পুরানো, মাটিতে মিশে যেতে থাকা শতশত স্ট্রিপ পড়ে আছে।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমি মোবাইল বের করে গুগলে ওষুধের নাম দুটো সার্চ করতে থাকি। বুঝে যাই, মেয়েদের জীবনে অস্বস্তিকর দিনগুলো ওর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক নয়। অবিরাম স্রোতস্বিনী, বড্ড বেশি যন্ত্রণাময়! যা ঠেকাতে ওকে ইঞ্জেকশন নিতে হয়। বাইরে কোথাও না বেরিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হয় চার দেয়ালের মধ্যে…

 

আট

বাড়ি ফিরে আসি বিমর্ষ মনে। নিজের মধ্যে যন্ত্রণা শুরু হয়। একটা মন ওকে পাত্রী হিসাবে নাকচ করে দিতে থাকে। বলে কেন তুমি জীবনের শুরুতেই একটা সমস্যাকে ইনভাইট করে আনবে? যুক্তিবাদী মন তাকে বোঝাতে থাকে, ওটা একটা রোগ, হয়তো চিকিৎসায় সেরে যাবে। কিন্তু প্রতি ঘন্টায় আমার শিক্ষা, আমার চেতনা, আমার সংস্কৃতির প্রলেপ আমারই ভিতরে খসে পড়তে থাকে। আমি সেই পতনের আওয়াজ শুনতে পাই। বুঝতে পারি, ও এখন সামনে আসতে পারবে না বলেই, দূরে কোথাও যাওয়ার অজুহাত দিয়ে মিথ্যে বলছে। রোগটা সারিয়ে ও আমার জীবনে আসতে চায়। কিন্তু প্রতিটা মানুষের ভিতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা আদিম সুবিধাবাদের কাছে, আমার শিক্ষা আমার উদারনীতি হেরে যায়। আমি হেরে যেতে দিই।

 

সেদিন সন্ধ্যায় নির্মল আসে আমার বাড়িতে।

কি রে, কী ঠিক করলি? তাহলে নেত্রীকেই বিয়ে করবি?

নাহ।

তাহলে?

দ্যাখ, আমি নেত্রী বা রাজনৈতিক কর্মী তো চাইনি। রাজনীতি সচেতন একজন কাউকে চেয়েছিলাম। উদার আর একটু সংস্কৃতিমনস্ক…

তো কী ঠিক করলি?

ভেবে দেখলাম, বুঝলি, তোর কথাটাই ঠিক। আজ দিল্লি কাল মুম্বই করে বেড়াবে আর আমি বাড়ি বসে রান্না করব, বাচ্চা ফিড করাব, সেটা সম্ভব নয়…!

নির্মল আমার ছেলেবেলার সব গোপন কথার বন্ধু। কিন্তু বড়ো হয়ে গেলে বোধহয় আর সবাইকে সবকথা বলা যায় না। আমিও তাই আসল সত্যটা ওর কাছে চেপে যাই। আমার লেখা গল্প উপন্যাসের প্রতিবাদী, উদার, সংস্কৃতিবান চরিত্ররা আমার দিকে আঙুল তুলে হা-হা-হি-হি করে হাসতে থাকে সারারাত। ঝড় ওঠার আগে, মেঘ দেখেই, আমার উদারতার নৌকা একটু একটু করে মাঝসমুদ্রে ডুবে যেতে থাকে।

সাদা সালোয়ার আর লাল কামিজ পরা অহনার বিষণ্ণ মুখটা আমি আমার মন থেকে সুবিধাবাদের ইরেজার দিয়ে একটু একটু করে মুছে ফেলতে থাকি। আমি জানি ও সেরে উঠলেই আবার ফোন করবে, আগের মতো। বলবে, দিদি কি মাসির বাড়ি, অনেক দূরের কোনও গ্রামে…

 

ঠিক সাতদিন পর বেজে ওঠে আমার ফোন। অহনা।

হ্যালো, কী খবর? কেমন আছো? বেশ স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ও।

কে? অচেনা স্বর আজ আমার গলায়।

আরে, আমি…। আজ বিকালে মায়ের কাছে যাচ্ছি তাহলে…

সরি, রং নাম্বার।

মাই জান বলে সেভ করা নাম্বারটা ব্লক লিস্টে ফেলে দিই আমি…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...