একদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গভীরতা আর অন্যদিকে মাউন্ট ফুজির গগনচুম্বী বরফঢাকা শিখর। দু’পাশে প্রকৃতির সবুজ গালিচাকে সাক্ষী রেখে ছুটে চলেছে শিনকানসেন– জাপানি বুলেট ট্রেন। অসম্ভব গতির জন্য জানলার বাইরের সমস্ত দৃশ্যই যেন ঘষা ছবি। যেন একটা সদ্য জলরং করা ছবি অনবরত কেউ ঘেঁটে দিয়ে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে মন চাইল না সার্থকের।
সংরক্ষিত আসনের বিলাসী ব্যাকরেস্ট পিছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে, সে তার ক্লান্ত চোখদুটি বন্ধ করল। একটু-একটু তন্দ্রা মাঝেমধ্যে তাকে আচ্ছন্ন করে যাচ্ছে। খানিকটা তার অজান্তে আর খানিকটা সচেতনে তার মন বুলেটের চেয়েও দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে অতীতে। মুহূর্তে আশেপাশের রঙিন প্রকৃতি চোখের সামনে থেকে উধাও। তার বদলে ফিরে এল অন্য সময়, অন্য পরিপ্রেক্ষিত।
বছরখানেক আগে সেই মেয়েটির সঙ্গে তার আলাপ। গ্র্যাজুয়েশনের রেজাল্ট দেখে এসে আর একমুহূর্তও খামোখা নষ্ট করতে চায়নি সার্থক। বাবা রাগারাগি করেছিলেন। মা কেঁদেকেটে একশা হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই টলানো যায়নি সার্থককে। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা সে নিয়ে ফেলেছিল আগেই। সম্ভবত তার ছেলেবয়সেই। বাবা বলেছিলেন, ‘পড়াশোনা করতে না চাস তো সমবায় থেকে লোন নিয়ে ছোটোখাটো একটা দোকান করে দিচ্ছি। তিনটে তো পেট
সংসারে। ঠিক চলে যাবে–!’
সার্থক বাবাকে বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করেনি। গররাজি মুখ করে চুপ করে গিয়েছিল। বাবা এই মফসসল শহরে বসে কী করেই বা বুঝবেন, তাঁর সীমাবদ্ধ ভাবনা আর সার্থকের লাগামবিহীন স্বপ্নের মধ্যে দূরত্ব কত যোজন! ছোটোবেলা থেকেই সে ঠিক করে রেখেছে বিদেশে তাকে যেতেই হবে। উন্নতির একমাত্র ঠিকানাই বিদেশ।
অনেক আগে এ কথাটা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল তাদেরই পাড়ার ছেলে সুধন্য। বছরতিনেক আগে কীসব পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়ে সেও কেটে পড়ল আমেরিকায়। প্রথম প্রথম মাঝেমধ্যে ফোন করত। আইএসডি। সেই উৎসাহ স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তীকালে বজায় থাকেনি। কিন্তু সুধন্যর কথাগুলো মনে আছে সার্থকের। সুধন্য গল্প করেছিল, কীভাবে জাহাজের খালাসি হয়ে একজন পৌঁছে গিয়েছিল আমেরিকাতে। এখনও কত লোক প্রতিদিন ভারত-বাংলাদেশ থেকে ভাগ্যের সন্ধানে সেখানে গিয়ে পৌঁছোয়! তাদের বেশিরভাগের আবার ভিসা-পাসপোর্ট কিছুই নেই।
সেইদিন থেকে সার্থক একটাই লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে। বেসরকারি অফিসের অল্প মাইনের কেরানি তার বাবা। সামান্য মাইনেয় তিনজনের পরিবার টানতেই তাঁর প্রাণান্ত দশা হয়। সে তো চোখের সামনে দেখেছে, দিনের পর দিন কত কষ্টে অতিবাহিত হচ্ছে! একটা ছোটো সাইজের জামাকে অনেক বড়োসড়ো বপুতে গলানোর চেষ্টা করতে করতেই জীবন কেটে গেল বাবার। একই ভবিতব্য তার জন্যও অপেক্ষা করে আছে, এ কথা ভাবতে গেলেই সে শিউরে ওঠে। বিএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পরেই সে যেন মরিয়া হয়ে উঠল।
সার্থককে বুঝিয়ে যখন হার মানলেন মা, খুব উদ্বিগ্ন আর হতাশ গলায় জানতে চাইলেন, ‘কলকাতায় গিয়ে কী করবি?’
‘প্রথমে একটা চাকরির চেষ্টা করব।’
‘মেসে কষ্ট করে থাকতে পারবি তো বাবা?’ মা চোখের জল মোছেন আঁচলে।
‘নিশ্চয়ই পারব। কেন পারব না?’ সার্থক কঠিন গলায় বলে।
বৈশাখের কড়া রোদেলা শহর। সারাদিন ব্যস্ত মানুষ রাস্তা পারাপার করে। পথে কাটাকুটি খেলে অসংখ্য বাস-ট্রাম-ট্যাক্সি-রিকশা। সবাই যে কলকাতার, তা তো নয়। আশেপাশের জেলাশহর থেকেও প্রতিদিন কত মানুষ আসছে ক্ষুধার অন্ন জোটাতে।
একটা চলনসই গোছের চাকরি জুটে গেল অল্পদিনেই। এক ছোটোখাটো কোম্পানির সেলসম্যানের কাজ। মাইনে সামান্য। কিন্তু ঘুরে বেড়িয়ে শহরটাকে আবিষ্কারের নেশাটা পেয়ে বসল তাকে অচিরেই।
এমনই একদিন সে বসে ছিল জাপান দূতাবাসের উলটো দিকে ফুটপাথের এক চায়ের দোকানে। দুপুর রোদে একটু ছায়া উপভোগ করছিল। গ্রীষ্মের দুপুর বলেই শহরটা একটু নিস্তরঙ্গ, নিস্তেজ। জাপান দূতাবাসের মূল দরজা পেরিয়ে ছোটোখাটো চেহারার এক জাপানি মহিলাকে সে অলস চোখে রাস্তা পেরোতে দেখল। জাপানি মেয়েদের গায়ের রং পার্ক স্ট্রিটে দেখা ফরাসি কিংবা বেলজিয়ান মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি লালচে ফরসা এবং ত্বকও অনেক বেশি মসৃণ।
মেয়েটি রাস্তা পেরিয়ে এসে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়াতে, সার্থক আন্দাজ করল মেয়েটির বয়স তার মতোই হবে। হয়তো এই প্রথমবার কলকাতায় এসেছে। চোখমুখের উৎকণ্ঠিত ভাব সে কথাই বলছে। ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে সে বোধকরি ফাঁকা ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
মেয়েটি কি ইংরেজি বোঝে? সার্থক থেমে থেমে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। কিন্তু ট্যাক্সিওয়ালা কি বুঝবে মেয়েটির ভাষা? কিংবা মেয়েটি তার? অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটিকে দেখে তার মনে হচ্ছে বিদেশবিভুঁইয়ে, অপরিচিত পরিবেশে সে যেন খানিকটা হতচকিত, থতোমতো!
তার চা খাওয়া হয়ে গেছিল। সঙ্গে প্রজাপতি বিস্কুট।
চা-ওয়ালাকে দাম মিটিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে গিয়েও কী ভেবে সে থমকে তাকাল। মেয়েটি তেমনই বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ইতস্তত পায়ে মেয়েটির পাশে গিয়ে সার্থক জিজ্ঞেস করল, ‘মে আই হেলপ ইউ?… আপনি কি ইংরেজি বলায় স্বচ্ছন্দ?’
মেয়েটি স্মিত হেসে নাতিদীর্ঘ গ্রীবা হেলাল, অর্থাৎ, জানে।
সার্থক আশ্বস্ত হয়ে জানতে চাইল, ‘কোনও সাহায্য করতে পারি?’
‘আসলে, কাল রাতেই আমি কলকাতায় এসেছি। কাল সকালের ফ্লাইটে জয়পুর চলে যাব। ভাবছি যতটা সময় পাচ্ছি, তার মধ্যে শহরটাকে একটু দেখে নেব। শুনেছি, কলকাতা ইজ আ বিউটিফুল সিটি। অনেক কিছু দেখার আছে–!’
এ’কদিনের শহরবাসে কলকাতা শহরটাকে পায়ে হেঁটে ভালোই চিনে ফেলেছে সার্থক। তার পেশাটাও অবশ্য এ ক্ষেত্রে খুবই সাহায্য করেছে।
সে তাই বলল, ‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, অ্যান্ড ফিল কমফর্টেব্ল, আমি কিন্তু শহরটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারি আপনাকে–!’
মুহূর্তের জন্য জাপানি তন্বী চুপ করে রইল। স্বাভাবিক, যে এ শহরটাকে চেনেই না, সংস্কৃতিটাকে জানেই না, সে কীভাবে তক্ষুনি এক অপরিচিত পুরুষের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলে দেয়! তার পক্ষে সহজ নয় ব্যাপারটা।
মেয়েটির হ্যাঁ ও না-এর সম্ভাবনার দোলায় খানিকক্ষণ দুলল সার্থক নিজেও। অনেক সাহস করে প্রস্তাবটা দিয়ে বসেছে সে, প্রত্যাখ্যানে মন ভেঙে যাবে তার। হঠাৎ-ই মেয়েটি বলল, ‘শিয়োর। কিন্তু আপনি সব জায়গা চেনেন তো?’
হ্যাঁ-বাচক ঘাড় নেড়ে একটা চলতি ট্যাক্সিকে থামাল সার্থক। শিভালরি দেখিয়ে পিছনের দরজা খুলে ধরল জাপানি মেয়েটির জন্য। নিজে গিয়ে বসল ড্রাইভারের পাশের সিটে।
শহরের রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটল ময়দান, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, লালদিঘি, যাদুঘর, সিটি সেন্টার…। জাপানি তরুণী অবাক চোখে দেখছিল। প্রতিটি ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা উপভোগ করছিল। হুইলার স্টল থেকে একগোছা গোলাপি ক্যান্ডিফ্লস কিনে সেটি কী করে খেতে হয়, শিখিয়ে দিল সার্থককে। সার্থক অবশ্য জানত। ‘বুড়ির মাথার পাকা চুল’ নামে এ জিনিসটাই ফেরিওয়ালার কাঁধে চেপে প্রায়ই আসত তাদের মফসসল শহরে। এখন সেই জিনিসটাই জাপানি মেয়ের মসৃণ, চকচকে গোলাপি ঠোঁটে মিশে যাচ্ছে।
জাপানি যুবতির সান্নিধ্য খুবই ভালো লাগছিল সার্থকের। কিন্তু দেখতে দেখতে দিনটা ফুরিয়ে এল। খিদে পেয়েছিল ওদের। জাপানি কন্যে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার খিদে পায়নি সার্থক?’
সার্থক সলজ্জে বলল, ‘হুঁ।’ কাউকে খিদের কথা জানাতে তার ভারি লজ্জা হয়। ছোটোবেলার অভ্যেস।
যুবতি বলল, ‘তাহলে একটা ভালো রেস্তোরাঁয় চলো–!’
সার্থক ওর চেনা একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকল। এর আগে মাত্র একবারই এসেছে। সেই অর্থে চেনা নয়। তবে জানে, এটা তার পকেট এবং মধ্যবিত্ত ম্যানারের মাপেমাপে। আরও বড়ো রেস্তোরাঁয় ঢোকার সাহস পেল না সার্থক।
জাপানি তরুণী যে-কোনও বিষয়েই তার উপর বড়ো নির্ভরশীল। সার্থকের সব কথাতেই তার হ্যাঁ। খাওয়াদাওয়ার পরে রাস্তায় এসে তার কী মনে হল, জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, সার্থক, তোমাদের শহরে কোনও নদী নেই?’
‘আছে তো। গঙ্গা। বিশাল নদী।’
‘নদীতে নৌকো চলে?’
‘চলে।’
‘আমায় নিয়ে যাবে?’
শহরের গঙ্গায় শেষ লঞ্চ অনেক আগেই চলে গেছে। যে-কটি আলো জ্বলছে বাতিস্তম্ভে, তাতে অন্ধকারটাই যেন আরও গাঢ় হয়েছে। কেবল কালো গঙ্গার বুক ভেসে যাচ্ছে হলুদ জ্যোৎস্নায়। ইতিউতি কয়েক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা ছায়ার মতো পরস্পরের লগ্ন হয়ে আছে। দূরে কয়েকটি নৌকো দেখা যায়। হ্যারিকেনের ম্লান আলো তাদের প্রায়-অনস্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলছে।
সেদিকে আঙুল দেখিয়ে যুবতি বলল, ‘সার্থক, ওই নৌকোগুলোয় চড়া যায়?’
মুখের কাছে দু’হাতের তালু জড়ো করে সার্থক ডাক দিল, ‘মাঝিভাই, ও মাঝিভাই, নেবে নাকি?’
খানিক পরে নৌকো ঘাটে লাগলে, ওরা উঠে বসল ছইয়ের ভিতর। মাঝির হাতে দাঁড়ের প্রথম টানে দুলে উঠল নৌকো। আর, যুবতির শরীরও যেন টলে পড়ল সার্থকের গায়ে। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল বিদেশিনি। সার্থকের একটি হাত নিজের হাতে বন্দি করে আনমনা গলায় বলে উঠল, ‘আমি অনেক দেশে ঘুরেছি সার্থক। দেশে দেশে কত বন্ধু হয়েছে। কিন্তু তারা একজনও তোমার মতো নয়। তোমার শহর থেকে অনেক সুখস্মৃতি নিয়ে যাচ্ছি।’
বুক ভর্তি করে খোলা হাওয়া নিল তরুণী। সার্থকের হাতে অল্প চাপ দিয়ে বলল, ‘জাপানে চলে আসছ না কেন? ওখানে অনেক সুযোগ। যদি আসতে চাও, আমায় জানিয়ো। কাল সকাল পৌনে নটায় আমার ফ্লাইট। সাতটা নাগাদ একবার হোটেলে এসো। আমার কার্ডটা তোমায় দিয়ে দেব।’
মিষ্টি হাওয়া বইছে। নৌকো কি এখন মাঝগঙ্গায়? ঘাট দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারে। মেয়েটি গুনগুন করে কোনও জাপানি সুর গাইছে। সুরটা অনেকটা ভাটিয়ালির মতোই। যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে গঙ্গায়। আশ্চর্য তৃপ্ত আর ভরাট লাগছে মেয়েটির মুখ। সে যেন সার্থকের ভালোবাসায় লীন হয়ে যাচ্ছে।
মেয়েটির মুঠো থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সার্থক অস্ফুটে বলল, ‘মাঝিকে ঘাটে নৌকো ভেড়াতে বলি? অনেক রাত হল।’
মেয়েটিও যেন তন্দ্রা ভেঙে উঠে বসল। হোটেলে তাকে পৌঁছে দিল সার্থক। বিদায়ের মুহূর্তে হাত নেড়ে সে বলল, ‘কাল সকালে দেখা হচ্ছে।’
রাস্তায় নেমে সার্থকের মনে পড়ল, মেয়েটির নাম-ই জানা হয়নি। সে পিছন ফিরে ডাকবে তাকে, ভাবল। কিন্তু মেয়েটি চলে গেছে। তাকে আর দেখতে পেল না সার্থক।
অনেক রাতে সার্থক ফিরে এল মেসে। খাওয়াদাওয়ার পাট ছিল না। কেন-না রেস্তোরাঁয় খেয়ে তখনও পেট ভর্তি। সে সরাসরি বিছানায় শরীর ছুড়ে দিল। শরীর জুড়ে ক্লান্তি, তবু তার ঘুম এল না। সন্ধের সুখস্মৃতি তাকে ঘুমোতে দিল না। রোমন্থনে জাগিয়ে রাখল। মনে হল, তার হাতটি যেন এখনও নিজের উষ্ণ করতলে ধরে রেখেছে সেই বিদেশিনি, যার নাম সে জানে না। ইস, কী ভুলটাই না সে করেছে! সার্থক ভাবে।
ঘুম না আসার অবশ্য আরও এক কারণ ছিল। সেটা তার উদ্বেগজনিত। ভোরবেলা উঠতে হবে। না উঠতে পারলে, হোটেলে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে যেতে দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু অতিরিক্ত সতর্কতায় অনেকসময় ভুল হয়ে যায় বেশি।
কখন তার চোখদুটো লেগে এসেছে সার্থক জানে না। ধড়ফড় করে জেগে উঠে, বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িটায় দেখল, আটটা বাজে। হোটেলে গিয়ে এখন জাপানি যুবতিকে দেখতে পাওয়া একরকম দুরাশাই। পৌনে নটায় তার ফ্লাইট, সার্থক জানে। তবু, বড়ো আশায় বুক বেঁধে সে হোটেলের দিকে রওনা দিল।
সকালে হোটেলে তেমন ব্যস্ততা নেই। হাতেগোনা কয়েকজন চেক আউট করা বোর্ডার, বাক্স-ব্যাগ নিয়ে বড়ো দরজার কাছে অপেক্ষা করছে ট্যাক্সির জন্য।
রিসেপশনের সদ্য ঘুমভাঙা ডাগর চোখমুখের মেয়েটি বলল, ‘কাল সন্ধেয় আপনি যাকে পৌঁছে দিলেন হোটেলে, তার কথা জানতে চাইছেন তো? উনি তো অনেকক্ষণ চেক আউট করে গেছেন। বোধহয় আপনার জন্যই লবিতে অনেকক্ষণ বসে ছিলেন। কেন-না, ওর চোখমুখ দেখেই মনে হচ্ছিল, কাউকে খুঁজছেন। তারপর চলে গেলেন।’
সার্থকের বুকের মধ্যেটা হঠাৎই ফাঁকা হয়ে গেল। সব হারানোর যন্ত্রণা কুরে কুরে খেতে থাকল তাকে। তার সব আশা যেন ভেঙে গেছে। সব ভাবনা যেন মিশে গেছে ধুলোয়। কিন্তু এই যন্ত্রণা থেকেই তার মধ্যে আর-এক ধরনের শক্তিপুঞ্জ তৈরি হচ্ছে, টের পেল সার্থক। সেই শক্তি তাকে বেঁধে দিল এক কঠিন অঙ্গীকারের রজ্জুতে। একদিন নিশ্চয়ই সে তাকে খুঁজে বের করতে পারবে।
সামান্য হোঁচট খেয়ে শিনকানসেন থেমে যেতে, ভাবনার গতিপথেও বাধা পড়ল। ট্রেনের স্বচ্ছ কাচের জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখল সার্থক। নিরিবিলি স্টেশন। দু-চারজন মানুষ চলাফেরা করছে। একটা বোর্ড আছে বটে, কিন্তু জাপানি ভাষায় লেখা বলে, স্টেশনের নামটা পড়তে পারল না সার্থক। পাশের সিটের প্রৌঢ় সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করে সার্থক জানতে পারল, স্টেশনের নাম হমামাতসুচো। একটা হাঁফ ছাড়ল সে। তার মানে, অর্ধেক পথ আসা গেছে এতক্ষণে। এবার সে স্টেশনটিকেই একটু ভালো করে ঠাহর করে দেখতে থাকল। ভারতের যে-কোনও স্টেশনের থেকে কত ফারাক! কোনও চ্যাঁচামেচি নেই, ব্যস্ততাও কত ব্যক্তিগত ও নীরব, প্ল্যাটফর্মটা এতই সাফসুতরো যে, জুতো পরে হাঁটতে সংকোচ হয়।
ট্রেন সামান্য সময়ের জন্য থেমেছিল। কিছু যাত্রী নেমে গেল, আবার অনেকে উঠল। কোনও তাড়াহুড়ো নেই। ধাক্বাধাক্বি নেই। অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেন আবার তীব্র গতিতে ছুট লাগাল। অমনি বাইরের যাবতীয় ছবি ঘেঁটে একশা। ফের চোখ বন্ধ করে ফেলল সার্থক। এত গতি তার অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়।
সার্থকের আবার মনে পড়তে থাকল, জাপানি যুবতির সেই পর্বটি মিটলে, সেলসম্যানের কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল সার্থক। পরিশ্রম আর উপার্জনে সামঞ্জস্য হচ্ছিল না কিছুতেই। এবার সে চাকরি নিল শহরের এক নামি রেস্তোরাঁয়। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার। মাইনে ভালোই, উপরন্তু দুপুরে ও রাতে খাওয়াটা ফ্রি। পেটের চিন্তা অনেকটা মিটল। কিন্তু তবু যেন কীসের অমোঘ টানে সে এখনও মাঝেমধ্যেই নিয়ম করে জাপানি দূতাবাসের উলটোদিকের ফুটপাথে, গাছতলার চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। বৃদ্ধ দোকানিটি মরে গেছে। এখন তার ছেলে চা বানায়। তাগড়া যুবক।
রেস্তোরাঁর কাজে ছুটিছাটা কম। সন্ধেগুলোতেই ভিড় বেশি। তার উপর সাধারণ ছুটির দিনেও খদ্দেরদের সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। কেবল দুপুরটায় কাজের চাপ একটু কম থাকে। তখন রসুইঘরে খাবার তৈরির আগের পর্যায়ের কাজ চলে।
এই সময়টাতেই মাঝেমধ্যে ফুটপাথের সেই চায়ের দোকানে চলে আসে সার্থক। এক কাপ চা নিয়ে একঘণ্টা বসে থাকে। সঙ্গে দুটো প্রজাপতি বিস্কুট।
একদিন একটা কাণ্ড ঘটল।
দুপুরে রাস্তা এমনিতে ফাঁকাই থাকে। একটা অটোরিকশা তীব্র বেগে এগিয়ে এসে, ঠিক চায়ের দোকানের সামনে ফুটপাথ ঘেঁষে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক জাপানি যুবক নেমে জিন্সের পিছনের পকেট থেকে পার্স বের করে ভাড়া মেটালেন। তারপর পার্সটিকে আবার পিছনের পকেটে চালান করে দিয়ে, দূতাবাসের দিকে হাঁটা দিলেন। দেখে মনে হল যুবকের খুব তাড়া।
অলস চোখে তাকে লক্ষ করছিল সার্থক। এও তার চোখে পড়ল, তাড়াহুড়োয় পার্সটি যুবকের জিন্সের পকেটে না ঢুকে সশব্দে পড়ল রাস্তায়। ব্যস্ততায় যুবক তা খেয়াল করল না। এক সেকেন্ডের ব্যবধানে সার্থক যে তাকে ডেকে উঠল, সেটাও কানে গেল না তার। লম্বা পা ফেলে, সে দূতাবাসের অন্দরে সেঁধিয়ে গেল।
রাস্তা থেকে পার্সটা কুড়িয়ে আনল সার্থক। খুলে দেখল তাতে একগোছা দুই হাজার টাকার নোট। এত টাকা কোনওদিনও একসাথে দেখেনি সে। হাত কাঁপছে তার। কাউকে বলতেও পারছে না। পার্সটা বন্ধ করে, দুহাতের করতলে শক্ত করে ধরে রেখে সে ভাবতে থাকল, এখন কী করণীয়!
একঝলক দেখে সার্থকের মনে হয়েছে, অন্তত পঞ্চাশটা দু’হাজার টাকার নোট রয়েছে সেই গোছায়। মুহূর্তের জন্য চকচক করে উঠল তার চোখদুটো। এই টাকাগুলো বাবা পেলে, বাড়ির অনেকগুলো অসমাপ্ত কাজ করে ফেলত। রান্নাঘরটা মেরামত করত। ছাদের যে-জায়গাগুলো দিয়ে জল পড়ে, সারাত সেগুলোও। মাকে কয়েকটা নতুন শাড়িও হয়তো কিনে দিত। আর স্যাকরার দোকানে মায়ের কানের যে দুলটা বাঁধা রেখে টাকা নিতে হয়েছিল সেবার মায়ের অসুস্থতার সময়, সেটাও হয়তো ছাড়িয়ে আনত।
পার্সটা একবার খুলল সার্থক। একগোছা কাগজের টুকরো। অথচ কী অসীম ক্ষমতা তাদের। পরমুহূর্তেই পার্স বন্ধ করে সে নিজের মনেই বলল, ছি। সে এসব কী ভাবছে?
তখনই উদ্ভ্রান্তের মতো সেই জাপানি যুবককেও রাস্তা পেরিয়ে এপাশে আসতে দেখা গেল। তার চেহারা ইতিমধ্যেই বেশ পালটেছে। চুল এলোমেলো। চোখে উদ্বেগের স্পষ্ট ছাপ। কিছু খুঁজছে যেন।
সার্থক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যুবকের মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘এক্সকিউজ মি, আই হ্যাভ ইয়োর ওয়ালেট। ইউ ড্রপ্ড ইট হিয়ার।’
যুবকটি সার্থকের হাত থেকে খপ করে পার্সটি কেড়ে নিয়ে ভিতরটা আঁতিপাঁতি করে দেখল। তারপর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ঠায় সার্থকের দিকে।
সার্থক ম্লান হাসল। যুবক নিজের অভিভূত ভাবটা সামলে নিয়ে বলল, ‘আই অ্যাম ভেরি মাচ ইমপ্রেসড। মে আই ডু সামথিং ফর ইউ?’
সার্থক যেন বহুযুগ ধরে অপেক্ষা করছিল এই প্রশ্নটার জন্য! উত্তরটা সাজানোই ছিল জিভের ডগায়, এমনভাবে সে বলে ফেলল, ‘আমি আপনার দেশে যেতে চাই। শুনেছি ওখানে কেরিয়ার তৈরির অনেক সুযোগ–!’
জাপানি যুবক হঠাৎ কিছুক্ষণ থেমে গিয়ে কী যেন ভাবল। তারপর সার্থকের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কাছাকাছি কোনও রেস্তোরাঁ আছে? আমার খুব খিদে পেয়েছে!’
কাছাকাছি সত্যিই একটা রেস্তোরাঁ আছে, জানে সার্থক। যুবকটি নিজেই অর্ডার করল। সার্থকের যদিও খিদে ছিল না, তবু অল্পস্বল্প কিছু নিতে হল। খেতে খেতে যুবকটি প্রশ্ন করে জেনে নিতে থাকে সার্থকের জীবনের নানা কথা। কেবল শোনেই না, নিজের কথাও বলে।
যুবকের নাম হারুকি। সম্প্রতি সে বিয়ে করেছে। পেশায় সে ব্যবসায়ী। এক বছর আগে হারুকির বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। উত্তরাধিকার সূত্রে হারুকি এখন তাঁর প্লাস্টিক কারখানাটির মালিক। ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজেই এবার সে ভারতে এসেছে। তার সদ্যপরিণীতা স্ত্রী অবশ্য এর আগে অনেকবারই এদেশে এসেছে। ভারতের সংস্কৃতি নিয়ে সেসময় রিসার্চ করছিল সে।
গত বছর হারুকির কোম্পানি অপ্রত্যাশিত লাভ করেছে। জাপানি ভাষায় কোম্পানিকে বলে ‘খায়শা’। হারুকির খায়শা এখন রমরম করে চলায়, সে কিছুদিনের জন্য তার স্ত্রীর হাতে দায়িত্ব সঁপে ভারতে এসেছে।
হারুকি বলল, ‘সব কিছু ঠিকঠাক চললে আগামী কয়েক বছরে কোম্পানি আরও বড়ো হবে সার্থক! কারখানা করার জন্য জমিও কিনেছি। অনেক কর্মীরও দরকার হবে। তুমি যদি আমার সঙ্গে কাজ করতে চাও, তাহলে আমার কোম্পানিতে একটা চাকরি তোমায় দিতে পারি। শর্ত দুটো। এক, পাকাপাকিভাবে জাপানেই থাকতে হবে। নাগরিকত্বের ব্যবস্থা আমি করে দেব। আর দুই, মন দিয়ে কাজ করতে হবে। জাপানে সকলকেই কিন্তু খুব পরিশ্রম করতে হয়।’
খানিকটা সময় থেমে থেকে হারুকি আবার বলল, ‘তুমি রাজি থাকলে বলো–!’
সার্থক যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেছিল। হারুকির প্রশ্নে চমকে উঠে বলল, ‘কী বলে আপনাকে ধন্যবাদ দেব জানি না। আমি যাব।’
হারুকি উঠে পড়ে বলল, ‘আজ রাতের ফ্লাইটে আমি মুম্বই উড়ে যাচ্ছি। দু’দিন ওখানে থাকব। তারপর ফিরে যাব জাপানে। ওখান থেকে যাবতীয় জরুরি ডকুমেন্টস তোমায় পাঠিয়ে দেব। আমার চিঠির জন্য অপেক্ষা কোরো।’
একটা ট্যাক্সি ডেকে হারুকিকে তুলে দিয়ে, বাস ধরে নিজের রেস্তোরাঁয় ফিরে এল সার্থক। সন্ধে নেমে গিয়েছিল। মানুষের ভিড়ও বাড়ছিল। আজ ক্রেতারা তার কাছ থেকে পেল একটু বাড়তি হাসি। একটু বেশি সৌজন্য। তখন এক আশ্চর্য ভালোলাগায় ভেসে যাচ্ছে সার্থক। আর মাত্র কয়েক দিন, বন্ধু। ওগো চেনা মুখ, তোমাদের বড়ো মিস করব জাপানে।
হারুকি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়নি। সে জাপানে ফিরে যাওয়ার পনেরো দিনের মাথায়, সার্থকদের রেস্তোরাঁর ঠিকানায় তার নামে একটা প্যাকেট এল। নিজের মেসে গিয়ে কাঁপা হাতে প্যাকেটটা খুলল সার্থক। ভিসা সংক্রান্ত যাবতীয় জরুরি কাগজপত্র, সেইসঙ্গে একটা ওপন ডেটেড এয়ার টিকিট। তার উপর সরু ক্লিপে আটকানো এক টুকরো কাগজ। তাতে স্বহস্তে হারুকি লিখেছে, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাপানে চলে আসার চেষ্টা করো!’
চোখে হঠাৎই জল চলে এল সার্থকের। সেই কোন ছোটোবেলার অধরা স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে। পরের কয়েক দিন কেটে গেল দূতাবাসে ভিসা সংক্রান্ত কাজকর্মের ব্যস্ততায়। তার কয়েক দিন পরেই তার উড়ান নামল অশোকা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। এয়ারপোর্টে ক্লিয়ারেন্সের যাবতীয় কাজ মিটে যেতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। হারুকি যেভাবে বলে দিয়েছিল, ঠিক সেভাবে অশোকা স্টেশন থেকে টোকিয়োগামী বুলেট ট্রেনে উঠে বসেছিল সার্থক।
শিনকানসেন এখন সাঁঝবেলার কুয়াশামাখা অন্ধকার ভেদ করে ছুটছে। দূরে দূরে ছোটো ছোটো জনপদ টের পাওয়া যায় মিটমিট করে জ্বলা আলো দেখে। পিছনে পড়ে রইল তার দেশ। ক্রমশ দূরত্ব বাড়ছে। দেশের বাড়ি, বাবা-মা…। চোখ জ্বালা করে উঠল সে কথা মনে পড়তে। প্রৌঢ় সহযাত্রীটি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই বললেন, ‘টোকিয়ো স্টেশন আসছে। আর দশ মিনিট।’
সত্যিই তাই! চোখেমুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসবে বলে টয়লেটে ঢুকেছিল সার্থক। বেরিয়েই চমকে গেল। অন্ধকার উধাও। মিটমিট করে জ্বলা আলোরাও বিগত অতীত। তার বদলে মসৃণ এক শহর আলোয় আলোয় খিলখিল করে হাসছে। সিটে ফিরে আসতে বৃদ্ধ সহযাত্রী একগাল হেসে বললেন, ‘টোকিয়ো এসে গেছে।’
আগেই ফোনে কোথায় সার্থকের জন্য অপেক্ষা করবে বলে দিয়েছিল হারুকি। সেইমতো, পশ্চিমের দরজা দিয়ে স্টেশনের বাইরে বের হয়ে, রিজার্ভেশন কাউন্টারের কাছে যেতেই সে হারুকিকে দেখতে পেল। হেসে হাত বাড়িয়ে দিল হারুকি। বলল, ‘কোনও অসুবিধা হয়নি তো?’
সার্থক মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’
গাড়িতে উঠে নিজে ড্রাইভারের সিটে বসল হারুকি। গাড়ি চলতে শুরু করল ফ্লাইওভার ধরে। এমন শহর সার্থক কেবল ছবিতে দেখেছে। আকাশে থেকে থেকে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে রংবেরঙের ফুল হয়ে যাচ্ছে।
অবাক চোখে সেদিকে তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হারুকি বলল, ‘খুব কাছে সুমিদা নদী। প্রত্যেক বছর এই দিনে নদীর পারে আতশবাজির প্রদর্শনী হয়। তুমি খুব ভালো সময়ে এসেছ। আমরা নদীর পার ধরেই যাব। দেখতে পাবে–!’
‘তোমার বাড়ি কি কাছেই?’
‘ফ্ল্যাট…। হ্যাঁ কাছেই।’
আধঘণ্টার মধ্যে গাড়িটা বাঁক নিয়ে একটা বড়ো লোহার গেট পেরিয়ে খানিকটা গিয়ে থামল। সেখানে আরও অনেক গাড়ি রয়েছে। সার্থক বুঝতে পারল, এই অ্যাপার্টমেন্টের কোনও ফ্ল্যাটেই থাকে হারুকি ও তার বউ। সাজানো ফ্ল্যাটে ঢুকে, ড্রয়িংরুমে বসার পর, হারুকি বলল, ‘তুমি কি টয়লেটে যেতে চাও?’
সত্যিই শরীর এখন চাইছে স্নান। দ্রুত হাতে ব্যাগ থেকে রাতপোশাকটা বের করে টয়লেটে ঢুকল সার্থক। আহা, স্নানের ঘর যে এমন হয়, সে কি জানে দেশে তার পরিচিত মানুষরা? কত বড়ো বাথটাব! দেয়ালে কতরকম কলের প্যাঁচ। কোনটার কী কাজ কে জানে! জেনেই বা কী দরকার! দেশে তো বাড়ির বাইরের টিপকল থেকে বালতি বালতি জল টেনে এনে ছাদখোলা টিনের দরজাওয়ালা বাথরুমে স্নান করত তারা।
বাথটাবের কল ছেড়ে দিয়ে, সার্থক আক্ষরিক অর্থে গা ভাসাল। টয়লেটের বাইরে বের হয়ে দেখল ড্রয়িংরুমে পানীয় হাতে নিয়ে একাই বসে আছে হারুকি।
তাকে দেখে বলল, ‘একটু বোসো। আমার বউ এইমাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। ওকে খবরটা দিয়ে আসি।’
সোফার নরম গদিতে প্রায় পুরোটাই ডুবে যায় সার্থক। সামলে নিয়ে সতর্ক হয়ে বসে। মাথাটা হেলিয়ে দিতেই বুজে আসে ক্লান্ত চোখদুটো। আর তখনই চোখের পর্দায় ভাসে সেই আশ্চর্য সুন্দর মুখটা। তার দেশের কেউ নয় সে, তার দেশের কারু মতো দেখতে নয় তাকে। তবু, সেদিন যখন সন্ধেবেলা গঙ্গার বুকে ভাসা নৌকোর ছইয়ের মধ্যে সে চেপে ধরেছিল সার্থকের হাতদুটি, তাকে দেখতে লাগছিল প্রতিমার মতো। সে মুখ ভোলার নয় কখনও। শুধু তাকে একটিবার দেখবে বলে, সে গিয়ে বসে থাকত দূতাবাসের উলটোদিকে চা-দোকানের ভাঙা চেয়ারে। শুধু জীবনধারণ নয়, তাকে খোঁজার জন্যও জাপানে আসা তার। তার নামও যে জানা হয়নি সেদিন।
হারুকির ডাকে ভাবনার সূত্রটা ছিঁড়ে গেল সার্থকের। হারুকি ফিরে এসেছে ঘরে।
‘সার্থক, এই হচ্ছে আমার বউ, মিকা–!’ তার পাশ থেকে কেউ রিনরিনে গলায় বলে উঠল, ‘হ্যালো!
জবাবে ‘হ্যালো’ বলতে গিয়ে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ল সার্থক। সেই মুখ। নরম দুটো চোখ। একবার সার্থকের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি যেন মেঝেয় গেঁথে ফেলেছে মেয়েটা। তার মানে, সার্থককে সে আগেই চিনেছে। ধরা দিতে চায় না। সার্থকের কাছেও না, তার স্বামীর কাছেও না।
মিকা বলল, ‘আমি যাই। খুব ক্লান্ত। কাল কথা হবে–।’
সে চলে যেতে, নিজের মনেই একচোট হাসল সার্থক। তারপর অকম্পিত গলায়, ‘সি ইউ’ বলে সোফার নরম ঔদার্যে ডুবিয়ে দিল শরীর।
তার এখন জব্বর ঘুম পাচ্ছে।