ট্রেনের বাতানুকূল কোচ-এ অনেকক্ষণ বসে থাকলে আজও খুব দমবন্ধ লাগে তানিয়ার। একা সফর করলে মালপত্র রেখে বারবার ওঠা যায় না। কিন্তু উলটো দিকের সিটে বসা মাসিমার সঙ্গে বেশ আলাপ হয়ে গেছে। ওনাকে মালপত্র নজরে রাখার অনুরোধ করে, তানিয়া দরজা ঠেলে বাথরুমের প্যাসেজে এসে দাঁড়াল। দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে পূর্বা এক্সপ্রেস। একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দিল্লি এসেছিল তানিয়া। কলকাতা ফিরছে একাই।
একা শব্দটার তাৎপর্য সে এই দুবছরে খুব ভালো ভাবেই টের পেয়েছে। ট্রেনের অভিমুখের উলটো দিকে যে-ভাবে ছুটে চলেছে বাড়ি-ঘর গাছপালা, তার সমগ্র জীবন! সবই কেমন যেন অন্যরকম হয়ে গেল তানিয়ার ক্ষেত্রে। ট্রেনের দু-পাশের গেট দিয়ে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটায় ভেতরটা খুব ফ্রেশ লাগে তানিয়ার। ছোটোবেলা থেকে তার খুব ভালো লাগে রেল সফর।
বাথরুমের বাইরের বেসিনের আয়নায় সে নিজের মুখটা দেখতে দেখতে, যত ক্লান্তি হাত দিয়ে মুছে নিতে চায়। কিন্তু আয়নায় তাকাতেই একটা চেনা মুখের প্রতিবিম্ব ভেসে ওঠে। চমকে ওঠে তানিয়া! ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে বিনায়ক। সিগারেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
দুবছরে বেশ পরিবর্তন এসে গেছে বিনায়কের চেহারায়। বয়সের তুলনায় যেন বেশি বয়স্ক লাগছে তাকে দেখতে। বিনায়কও একইরকম চমকে গেছে হয়তো তানিয়াকে দেখে। কোনও কথা বলে উঠতে পারে না সে-ও। হতভন্ব ভাবটা কাটতেই, তানিয়া শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে আলতো করে পাশ কাটিয়ে নিজের সিটে এসে বসে। পেছন ফিরে না তাকালেও সে বুঝতে পারে, সম্মোহিতের মতো বিনায়ক তাকে অনুসরণ করেছে তার সিট অবধি। তানিয়া সিটে বসে অনুভব করে তার উপস্থিতি। বিনায়ক দু-এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকে তার বসার জায়গাটির অদূরে, তারপর মিশে যায় কামরার অন্য কোনও খানে।
ঘটনার আকস্মিকতা তানিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছে। একটা চা-ওয়ালা আসছে,তানিয়া দু-কাপ চা নিয়ে একটা এগিয়ে দেয় সহযাত্রী মাসিমার দিকে। তারপর নিজেও চায়ের কাপ হাতে সঙ্গে থাকা একটা ম্যাগাজিনে চোখ রাখে তানিয়া। ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট যে, কিছুক্ষণ সে নিজের মধ্যেই নিমজ্জিত থাকতে চায়।
বিনায়ক মাঝেমধ্যেই টুর-এ দিল্লি যাতায়াত করে। আগেও করত। আগেও মানে, তানিয়া যখন তার বউ ছিল তখনও। তাই খুব যে অবাক হওয়ার সুযোগ আছে তা নয়। কিন্তু দেখাটা না হলেই ভালো ছিল। হৃদয় খুঁড়ে কে আর বেদনা জাগাতে চায়। কিন্তু এ যন্ত্রণা থেকে বোধহয় তার মুক্তি নেই।
ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে উপরের বাংক-এ উঠে খানিক চোখ বুজে শুয়ে থাকার চেষ্টা করে তানিয়া। সে না চাইলেও তার অতীত তাকে তাড়া করবে এটা সে বুঝে ফেলেছে। সত্যিই তো অত সহজে মুছে ফেলা যায় না আস্ত একটা অধ্যায়। সব যেন মানসপটে এক লহমায় ভেসে উঠতে লাগল, ট্রেনের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে৷
চন্দননগরের বাড়িতে তানিয়ার বেড়ে ওঠা। বাবা ল্যান্ড রিফর্মস-এ চাকরি করতেন। তানিয়া জন্মানোর আট বছর পর দ্বিতীয়বার সন্তানসম্ভবা হয়েছিল তার মা। বোন রুমিয়ার জন্মের পর থেকেই হার্নিয়ার সমস্যায় জর্জরিত থাকতেন মা। আট বছরের তানিয়াই তখন অভিভাবকের মতো সামলাত বোনকে। রুমিয়া বাড়ির সবচেয়ে ছোটো বলে, একটু বেশিই আদর পেয়ে এসেছে চিরটাকাল। যখন যা আবদার করেছে দামি ফ্রক, দামি খেলনা, সব সে পেয়েছে। তানিয়া বরাবরই লাজুক স্বভাবের। মুখ ফুটে কিছু চাইবার ক্ষমতা ছিল না তার কোনও দিনই। বোন আসার পর থেকে আরও যেন অবহেলিত হয়ে উঠেছিল তানিয়ার বেড়ে ওঠা।
না ঠিক সে অর্থে অবহেলা বলা যাবে না। বাবা স্বচ্ছল ছিলেন। ফলে পড়াশোনার ব্যাপারে কোনও কম্প্রোমাইজ করেননি। ভালো স্কুলে ভালো রেজাল্ট করে বড়ো হয়েছে তারা দুই বোন। কিন্তু স্বভাবে দুজনে ঠিক উলটো। রুমিয়া যতটা স্মার্ট, তানিয়া ঠিক ততটাই লাজুক। তাকে বাড়ির লোকেরা তাই বিশেষ আমল দেয়নি কোনও দিনই।
তানিয়ার বন্ধু বলতে ছিল পাশের বাড়ির মেয়ে সুপর্ণা। সে ঠিক কীভাবে যেন জেনে নিত তানিয়ার সমস্ত মনের কথা। তানিয়া একটু দুর্বল প্রকৃতির বলেই যেন, খানিকটা তাকে আগলে রাখত সুপর্ণা। বরাবরই একটু ডাকাবুকো, সোজাসাপটা কথা বলা মেয়ে সুপর্ণা, চেষ্টা করত পরিবারের মধ্যে থেকে তানিয়া যেন বঞ্চিত না হয়।
স্নাতক হওয়ার পরে তানিয়া যখন ভাবছে কী করবে, সুপর্ণা কিন্তু ততদিনে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে সিভিল সার্ভিস এনট্রান্স ক্লিয়ার করার। তানিয়া বরাবরই একটু ভিতু। তাই সে চাইল একটাই কাজ। সংসার জীবনে প্রবেশ করে নিশ্চিন্তে জীবন কাটানোর সহজ রাস্তাটা খুঁজে নিতে। বাবাও যেন দায় উদ্ধার করে বেঁচে যান, এই মনোভাব নিয়ে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ পাত্র, বিনায়কের সঙ্গে বিয়ের কথা পাকা করে ফেললেন তানিয়ার।
রুমিয়া তখন সবে তেরো। শরীর একটু একটু করে পাপড়ি মেলছে তার। তানিয়ার মুখশ্রী ভালো হওয়া সত্ত্বেও, চটপটে স্বভাবের জন্য, রুমিয়াই সবার নজর কেড়ে নেয়। তানিয়া কোনও দিনই হিংসে করেনি বোনকে। কারণ সে আগাগোড়াই প্রায় মাতৃস্নেহে আগলে রেখেছে রুমিয়াকে। কনে বিদায়ের সময় তানিয়া যখন কাঁদছে, রুমিয়াও দিদিকে জড়িয়ে ধরে একইরকম ভাবে কেঁদে চলেছে। তানিয়া বোনকে সামলায়, বোকা মেয়ে কাঁদিস না। যখনই মনখারাপ করবে, কলকাতায় চলে আসবি আমার কাছে।
কলকাতায় আসার পর, বিনায়কের সংসারে নিজেকে স্থিতু করতেই বেশ কয়ে মাস কেটে গেল তানিয়ার। বরাবর হোস্টেলে মানুষ হওয়া বিনায়ক যদিও বেশ গোছানো ছেলে। সে রান্নাবান্নাও দারুণ করে। দুজনে মিলে যেন কয়েক মাসেই স্বর্গ রচনা করে ফেলল। সপ্রতিভ তরুণ বিনায়ককে পেয়ে তানিয়ার মনে হল, এ যেন তার সাতজন্মের পুণ্যের ফল। বছর দুয়েক চোখের পলকে পার।
এমনই সুখের বাসরে যখন মগ্ন তানিয়া, হঠাৎই একদিন ঘটে গেল এক দুঃসহ ঘটনা। ভাড়ার গাড়ি করে রুমিয়া এবং মা-বাবা আসছিলেন তানিয়ার বাড়ি। সে সময় রাস্তায় একটা বড়ো ট্রাক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সোজা ধাক্কা মারে তাদের গাড়িটিতে। মা-বাবা স্পট ডেড হলেও কিছু চোট আঘাত সামলে বেঁচে যায় রুমিয়া।
খবরটা পাওয়ার পর থেকে লাগাতার হাসপাতালে দিনরাত এক করে ফেলেছিল তানিয়া আর বিনায়ক। সুস্থ হওয়ার পর চন্দননগরের বাড়িতে বোনকে সেবা যত্নে সুস্থ করে তুলেছিল তানিয়া। মাস কয়েক পরই রুমিয়ার পরীক্ষা। তাই রুমিয়া সুস্থ হলে, পুরোনো পরিচারিকা রেবাদির হাতে বাড়ি ও রুমিয়ার দায়িত্ব দিয়ে নিজের সংসারে ফিরে আসে তানিয়া। এর কিছু দিন পরেই সে অন্তঃসত্ত্বা হয়।
প্রথমে ববি এবং ববির দুবছর পর ভিকি। দু-দুটি পুত্র সন্তানের মা তানিয়ার, দম ফেলার সময় ছিল না বাচ্চা দুটোকে বড়ো করার জন্য। বোনের দায়িত্ব থেকে অবশ্য কখনও-ই হাত গুটিয়ে নেয়নি তানিয়া। বোন একে একে স্কুলের গন্ডি, দ্বাদশ এবং স্নাতক স্তর পাশ করে ফেলল নিজের চেষ্টায়।
সাতটা বছর কেটে গেছে মাঝে। তানিয়া যেন নিজের দিকে তাকানোর সময়ই পায় না। তার নাওয়া-খাওয়াও যেন নিতান্ত এক অভ্যাস। সাজগোজ করার কথা মনেই থাকে না। বাচ্চাদের পড়াশোনা, বিনায়কের জন্য মনের মতো রান্নাবান্না এসব নিয়ে তার দিন কেটে যায়। চন্দননগর গেলে দেখা হয় সুপর্ণার সাথে। পুরোনো বন্ধু তাকে বলে, তানি কী চেহারা করেছিস নিজের! এমএ-টা করলি না, চাকরিও না। কীভাবে কাটাস এই একঘেয়ে জীবন? তানিয়া হেসে বলে, তুই তো এত বড়ো অফিসার হয়েছিস, অথচ বিয়ে করলি না। তুই কী বুঝবি সংসারের মানে।
এভাবেই দুই বন্ধুর পাওয়া না-পাওযার গল্পে কেটে যায় অলস দুপুর। রুমিয়াকে নিয়ে কিন্তু দুশ্চিন্তা বাড়ে তানিয়ার। রেবাদির বয়স হয়েছে, সে প্রায়ই বলে, এবার আমায় মুক্তি দাও তানিদিদি। আমি ছেলের কাছে বসিরহাট চলে যাই।
শেষ পর্যন্ত সুপর্ণাকে বলেই ফেলে তানিয়া কথাটা। কদিন ধরেই এই চিন্তাটা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সুপর্ণা, ভাবছি বোনকে আমার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে রাখব। এই বয়েসি একটা মেয়ে রেবাদি না থাকলে একা একা থাকবে কী করে? আমার বর খুবই ভালোমানুষ, ও নিশ্চয়ই আপত্তি করবে না। আদরেই থাকবে রুমিয়া আমার বাড়িতে।
সুপর্ণা কী ভেবে বলে, তাহলে তো তোরও চন্দননগরে আসার পাট চুকবে তানিয়া। আমিও আর দেখতে পাব না তোকে।
আরে না না, এমন করে বলছিস কেন। তুই আসবি আমার বাড়ি। যখন মন চাইবে চলে আসবি। খুব হইহই করে সময় কাটাব আমরা, দেখিস, তানিয়া আন্তরিক ভাবে বলে।
প্রস্তাবটা রুমিয়াকে দিতে সে রাজি হয়ে যায়। অতএব চন্দননগরের বাড়িতে তালা দিয়ে দুই বোন রওনা দেয় কলকাতার উদ্দেশে। বাচ্চারা ভীষণ খুশি মাসিকে দেখে। রাতে বিনায়ক বাড়ি ফিরতে তার জন্যও সারপ্রাইজটা অপেক্ষা করে ছিল। তাকে দেখে বিনায়ক বলে, আরে কী আনন্দ, শালি সাহেবা যে!
রুমিয়াও কম যায় না। সে বলে, তোমাদের জ্বালাতে পাকাপাকি চলে এলাম বিনায়কদা। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বিনায়ক তানিয়ার দিকে তাকাতেই, ধাঁধাটার সমাধান করে দেয় তানিয়া।
বোনকে পাকাপাকি এখানে নিয়ে এলাম বিনায়ক। যতদিন না একটা ভালো পাত্র দেখে ওর বিয়ে দিতে পারছি, ও আমাদের সঙ্গেই থাকবে। একা একা চন্দননগরের বাড়িতে ওকে রাখতে মন সায় দিল না আমার। তোমার আপত্তি নেই তো?
বিনায়ক অস্বস্তি কাটিয়ে বলে, ছি ছি, কী বলছ তানি। আমার কেন আপত্তি হবে। ও আমাদের সঙ্গেই থাকুক। এটা ওরও বাড়ি। ব্যস এরপর আর দ্বিতীয়বার ভাবার কোনও জায়গাই থাকে না। রুমিয়া, তানিয়া, ববি, ভিকি আর বিনায়ক মিলে জমে ওঠে সংসার।
সত্যি বলতে কী রুমিয়া আসায় তানিয়ার বেশ খানিকটা সুবিধাই হয়েছিল। বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দেওযা, টুকটাক সংসারের কাজে, রুমিয়াকে পাশে পেত তানিয়া। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বোন সংসারের কাজে জড়িয়ে পড়ুক চায়নি সে। তাই এমএ-তে ভর্তি করাল বোনকে। বিনায়ক দিল্লিতে হেড অফিসের কাজে গেলেও আর অসুবিধে হতো না তানিয়ার। দুই বোন মিলে দিব্যি সামলে নিত সব। আর ছুটির দিনে শালি-জামাইবাবু মিলে রান্নাঘরের দখল নিত। নিত্য নতুন রেসিপি তৈরি হতো। সব মিলিয়ে সুখের শেষ ছিল না তানিয়ার।
বাচ্চাদের ক্রিসমাসের ছুটি পড়ে গেছে। বড়োটার হবে ক্লাস থ্রি আর ছোটোটা উঠবে ওয়ান-এ। বাচ্চাদের নিয়ে শপিং করতে বেরিয়েছিল দুই বোন। হঠাৎই সুপর্ণার ফোন, আমি কলকাতায় এসেছিলাম একটা কাজে। রাত হয়ে গেছে, আজ আর ফিরব না। ভাবছি তোর বাড়ি চলে আসি। কী বল তানি?
ফোনটা পেয়ে তানিয়ার খুশি আর ধরে না। বলে, শিগগিরি চলে আয়, আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিউ মার্কেট থেকে বাড়ি ফিরছি।
ওরা ফেরার ঘন্টা খানেকের মধ্যে সত্যি সত্যিই সুপর্ণা এসে হাজির। বিনায়কও দারুণ জমাটি লোক। বলল, শুক্রবার এসেছ, জমিয়ে পার্টি হবে আজ। রবিবার বিকেলের আগে আর তোমায় ফিরতে দিচ্ছি না।
তানিয়াও প্রস্তাবটা লুফে নেয়। ঠিক বলেছে বিনায়ক। দুটো দিন আমাদের কাছে থাক। কতদিন গল্প হয় না। কোনও আপত্তি শুনব না তোর। সুপর্ণার কোনও আপত্তি সত্যি সত্যিই ধোপে টিকল না। তাকে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে তানিয়া, রুমিয়া আর বিনায়ককে রান্নার কাজে লাগিয়ে নিজের হাতে গেস্টরুম পরিষ্কার করতে গেল সুপর্ণার জন্য।
জমিয়ে খাওয়া দাওয়া, পার্টি, হুল্লোড়ে দুটো দিন কেটে গেল। রবিবার ভোরবেলা চা নিয়ে সুপর্ণার ঘরে হাসি মুখে এসে দাঁড়াল তানিয়া। সুপর্ণার পাশে সেই ছোটোবেলার মতো তার গলা জড়িয়ে শুয়ে পড়ল সে। দুই বন্ধু যেভাবে একসময় মনের কথা শেযার করত, সেরকমই একটা অন্তরঙ্গ কথার পর একটু গলা নামিয়ে সুপর্ণা বলে, তানি একটা কথা বলব, কিছু মনে করবি না তো?
তানিয়া একটু অবাক হয়। বলে, এভাবে পারমিশন নিয়ে কথা কবে বলেছিস তুই সুপর্ণা? নির্দ্বিধায় বল।
আসলে দুটো দিন তোদের সঙ্গে থাকতে গিয়ে একটা জিনিস আমার চোখে পড়ল। তুই বরাবরের সরল, তোর চোখে পড়ে না। কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি। বিনায়ক আর রুমিয়ার সম্পর্কটা যেন ঠিক স্বাভাবিক শালি-জামাইবাবুর সম্পর্কের মতো নয়।
প্রায় আকাশ থেকে পড়ে তানিয়া। এরকম কিছু শুনবে বলে সে কল্পনাতেও আনতে পারেনি। সে কাঁপা গলায় বলে, কী বলছিস তুই সুপর্ণা! তোর কিছু ভুল হচ্ছে না তো?
সুপর্ণা জোরের সঙ্গে বলে, না তানি, আমি দেখেছি, ওরা চোখে চোখে কথা বলে। রান্নাঘরে ওরা পরস্পরকে যেভাবে টাচ করে, সেটা খুব স্বাভাবিক আচরণ নয়।
তানিয়া কিছুটা যেন চুপ করে যায়। তারপর উঠে বসে। চোখ মাটির দিকে নিবদ্ধ। একটুক্ষণ কী যেন ভাবে। যেন একটা বহুদিনের না মেলা অঙ্ক, অক্ষমের মতো মেলানোর চেষ্টা করে। সুপর্ণা তার পিঠে হাত রাখে। তানি তুই ভাবিস না যে, দুটো দিনের জন্য থাকতে এসে তোর মনে আমি বিষ দিয়ে যাচ্ছি। আমি শুধু এটুকু বলব, তুই দৃষ্টি সজাগ রাখ। নিজেই সত্যিটা দেখতে পাবি। আমিও তো একটা মেয়ে! রুমিয়া ছোটো থেকে যা চেয়েছে তা হাসিল করে ছেড়েছে। এবার ওর সেই তালিকায় বিনায়ক নেই তো?
সুপর্ণার দিকে চমকে উঠে তাকায় তানিয়া। তার ভেতর একটা কী যেন ঝড় শুরু হয়েছে। সুপর্ণা-কে অবিশ্বাস করার জায়গায় সে নেই। আজ অবধি সুপর্ণা যা যা বলেছে, তার সত্যতা জীবন দিয়ে অনুভব করে এসেছে তানিয়া।
২
সুপর্ণা চলে যাওযার পর দুটো দিন কেটে গেছে। কিন্তু কিছুতেই যেন নিজেকে গুছিয়ে উঠতে পারেনি তানিয়া। সমস্ত কাজকর্ম করছে যন্ত্রের মতো কিন্তু মনের কাঁটাটা বিঁধে আছে। সেই কাঁটাটা সে না পারছে গিলতে না পারছে উগরাতে। যতটা সম্ভব স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করছে, বিনায়ক এবং রুমিয়ার সঙ্গে। বাচ্চারা এসে এটা ওটা আবদার করলে সেটাও মেটাচ্ছে মুখ বুজে। আর ক্রমাগত ভেবে চলেছে, কীভাবে পরীক্ষা করবে সুপর্ণার কথাটা।
এক রবিবার বিকেলে বুদ্ধিটা মাথায় খেলে গেল। বাচ্চারা ভিডিয়ো গেম্স খেলতে ব্যস্ত থাকায় বিনায়ক আর রুমিয়াকে উদ্দেশ্য করে তানিয়া বলল, আমি একটু টুকিটাকি কিনতে বেরোচ্ছি, তোমরা বিকেলের জলখাবারের দাযিত্ব নাও।
তানিয়া মিনিট দশেক মোড়ের মাথায় অপেক্ষা করে ধীর পায়ে ফিরে এল বাড়ির দিকে। দরজার দিকে না গিয়ে কী মনে করে বাগানের পেছনে তার বেডরুমের জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
এটা গলির শেষ বাড়ি এবং পিছন দিক বলে বরাবরই নির্জন। কেউ তাকে দেখতে পাবে না। ক্রমে তার বেডরুমের জানলায় উঁকি দিল। দৃশ্যটা দেখে সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। প্রগাঢ় চুম্বনে ব্যস্ত বিনায়ক এবং রুমিয়া, তাকে দেখতেই পেল না। রাগে, ঘৃণায় থরথর করে কাঁপতে লাগল তানিয়া। আরও কিছুক্ষণ এলেমেলো রাস্তায় ঘুরে, কিছুটা ধাতস্থ হয়ে তারপর বাড়ি ফিরল সে।
খুব সতর্ক ভাবে নিজের আচরণে কোনও পরিবর্তন আনল না তানিয়া। বিনায়কের বোঝার মতো অবকাশ ছিল না। দুটো সন্তানের পর বহুদিনই বিনায়ক শরীরী আকর্ষণ হারিয়েছে। তানিয়ারও আর শরীর সাড়া দেয় না। একই ঘরে একই বিছানায় দুজনে শোয় ঠিকই কিন্তু সম্পূর্ণ নিষ্কাম একটা দাম্পত্য বয়ে বেড়ায় তারা।
সকালে বিনায়কের অফিস বেরোনোর তাড়া থাকে। তার জলখাবার, টিফিন যথারীতি প্যাক করল তানিয়া। বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যাওয়ার দাযিত্ব রুমিয়ার। তারপর সে ইউনিভার্সিটি যাবে। তাকেও খাবার তৈরি করে দিয়ে নিজের সংসারের কাজ সামলাতে লাগল রোজ দিনের মতো। সকলে বেরিয়ে যাওয়ার পর খানিকটা অবকাশ পেল তানিয়া কেঁদে বুক হালকা করার। নিজেকে একটু সামলে ভাবতে লাগল, কী করা যায়।
বিনায়কের অফিসের এক সিনিয়র কর্মী জীবনবাবু, খুবই স্নেহ করেন তানিয়াকে। এর আগে যখন একবার বিনায়কের গলব্লাডার অপারেশন হয়েছিল, জীবনবাবুই সাহায্য করেছিলেন তানিয়াকে কর্পোরেট-মেডিক্লেম ইত্যাদি সামলাতে। আজ বিপদের সময়ে কেন জানি তানিয়ার তাঁর কথাই মনে পড়ল।
স্নান করে সে জীবনবাবুর নম্বরটা ডায়াল করে, তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে চাইল। বিনায়কের অফিসের অদূরে একটা সাধারণ রেস্তোরাঁয় গিয়ে যখন তানিয়া তাঁর মুখোমুখি বসল, তখন যেন বড়ো বিধ্বস্ত বোধ হচ্ছিল। কেমন যেন একটা হেরে যাওয়া অনুভতি নিয়ে সে জীবনবাবুকে সব কথা খুলে বলল।
জীবনবাবু প্রৌঢ় হয়েছেন বটে কিন্তু ঠিক-বেঠিকের বোধ আজও তাঁর লোপ পায়নি। কন্যাসমা তানিয়াকে তিনি বললেন, কিছু মনে কোরো না মা, কথাটা তোমাকে বলব বলব ভেবেও বারবার আটকে গেছি। বেশ কয়েক মাস যাবৎ বিনায়কের সঙ্গে একটি তরুণী দেখা করতে আসে অফিসে। সে এলেই দুজনে একসঙ্গে বেরিয়ে যায়।
মোবাইল-এর লক স্ক্রিন খুলে গ্যালারি থেকে রুমিয়ার একটা ছবি বের করে জীবনবাবুর সামনে মেলে ধরে তানিয়া বলে, দেখুন তো দাদা, এই মেয়েটিই কিনা? জীবনবাবুর প্রাজ্ঞ চোখ এক মুহূর্ত দেখেই চিনে ফেলেন। নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সম্মত হন।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে একটা বিশ্বাসঘাতকতার অনুভূতি ঘিরে ধরেছিল তানিয়াকে। কে বড়ো বিশ্বাসঘাতক? তার স্বামী যার কাছে নিজের জীবনটা সঁপে দিয়েছে তানিয়া, নাকি তার মায়ের পেটের বোন, যার জন্য জীবনের সমস্ত খুশি স্যাক্রিফাইস করেছিল তানিয়া?
দিন সাতেক ভেবে সে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল। সরাসরি ফেস করবে এই ঝড়টাকে।
এক সন্ধ্যায় বাচ্চারা বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে যাওযার ফলে, সুযোগটা এসে গেল। চা নিয়ে খাবার টেবিলে ডাকল বিনায়ক এবং রুমিয়াকে। এমন সরাসরি জেরার মুখে পড়ে বিনায়ক হতবাক। কিন্তু অদ্ভূত বেপরোয়া রিঅ্যাকশন রুমিয়ার। সে হারতে শেখেনি। বরাবর সে দিদির চাইতে বেশি প্রিভিলেজড। তার পছন্দের সমস্ত জিনিস সে হাসিল করেছে। আজও সে ফোঁস করে উঠল দিদি সত্যিটা জেনে ফেলায়। প্রায় আধঘন্টা তর্কবিতর্কের পর হার মানল তানিয়া। রুমিয়া বিয়ে করতে চায় বিনায়ককে। বিনায়কও যে অরাজি নয়, তা তার হাবেভাবে, কথাবার্তায় স্পষ্ট। পথের কাঁটা হয়ে রয়েছে তানিয়াই।
পায়ের নীচ থেকে মাটিটা পুরোপুরি সরে যাচ্ছে, টের পাচ্ছে তানিয়া। সে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে একটা তলহীন গহ্বরে। তার স্যাক্রিফাইস, ভালোমানুষী, তিল তিল করে সুখের বনেদ গড়ে তোলার পরিশ্রমটার কোনও দাম নেই রুমিয়া বা বিনায়কের কাছে। যন্ত্রণায় শরীরটা যেন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। তাও কাঁদতে পারছে না তানিয়া।
এর পরের তিনটে দিন, প্রায় নির্বাক পশুর মতো একঘরে কাটাল তানিয়া। তৃতীয় দিনে তার মন যখন অনেকটা শক্ত, তখন হঠাৎ বিনায়ক ঘরে ঢুকে বলল, তানিয়া এরকম ভাবে থেকো না। সব যখন তুমি জেনেই গেছ, এখন মেনে নেওয়া ছাড়া তোমার গতি নেই। আমি রুমিয়াকে বিয়ে করব, তাই ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। কিন্তু তোমার দায়িত্ব থেকে আমি পালাব না। তুমি এ বাড়িতেই থাকবে, সম্মানের সঙ্গেই থাকবে। এই গেস্টরুমেই তোমার থাকার ব্যবস্থা করব। তোমার সব দায়-দাযিত্ব আমারই থাকবে। তুমি শুধু ডিভোর্স পেপারটায় সই করে দাও প্লিজ। আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি।
বিস্ময়ে অপমানে নির্বাক হয়ে খানিক্ষণ বিনায়কের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল তানিয়া। তারপর বলল, পাঠিয়ে দাও ডিভোর্স পেপার। আমি সই করে দেব। তবে এ বাড়িতে আমি আর থাকব না। বাচ্চাদের তোমাকে প্রয়োজন, ওদের তোমার অর্থের প্রয়োজন, স্বাচ্ছন্দ্যের প্রয়োজন। আমার কিছু লাগবে না। আমি এ বাড়ি ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যাব। মিউচু্য়যাল ডিভোর্স-এ আমি রাজি। কী ভাবে কথাগুলেো বলতে পেরেছিল সেদিন, তা আজও জানে না তানিয়া, কিন্তু আত্মসম্মানটা তার বরাবরই যে প্রবল এ কথা সে জানে৷
বিনায়ক যেন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এত সহজে যে সে মুক্তি পেয়ে যাবে, ভাবেনি। দিন চারেক পরে যখন সব কাগজপত্রে সই সাবুদ হয়ে গেল, উকিলের সামনে দুজনেই বিবাহবিচ্ছেদে সম্মত হল, সেদিনই শেষবারের মতো ও বাড়িতে গিয়েছিল তানিয়া।
সুপর্ণা তাকে নিতে এসেছে। মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে নীচে এসে সে দুটো গয়নার বাক্স এগিয়ে দিল বিনায়কের দিকে। বলল, এ দুটো তোমার নববধূকে উপহার দিও। বিয়েতে আমায় দিয়েছিলে। ফিরিয়ে দিলাম। তোমার কোনও কিছুই আমি এ বাড়ি থেকে নিয়ে যাচ্ছি না। বিনায়ক মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে৷ রুমিয়া বাচ্চদের নিয়ে অন্য ঘরে, সে ঘর থেকে একবারের জন্যও বেরোল না। যাতে চোখ দিয়ে জল না পড়ে প্রাণপণে সেই চেষ্টাই করছিল তানিয়া। কাঁদল একেবারে গাড়িতে বসে, সুপর্ণার কাঁধে মাথা রেখে।
তারপর কেটে গেছে দু-দুটো বছর। চন্দননগরের বাড়ি বিক্রি করে তার অর্ধেক টাকা সুপর্ণার হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল রুমিয়াকে। আর সে একটা এক কামরার ফ্ল্যাটে শিফট করেছিল নিজের ভাগের টাকায়। সুপর্ণার সাহায্যে একটা প্রাইভেট স্কুলে চাকরি জোগাড় করেছিল। খুব স্বচ্ছলতা না থাকলেও, তার একার জন্য যথেষ্ট ছিল। দিন দুয়েক আগে সুপর্ণার মাসতুতো বোনের বিয়ে উপলক্ষ্যে দিল্লিতে গিয়েছিল তানিয়া। সুপর্ণা আরও কটা দিন ওখানে থাকবে বলে সে একাই ফিরছিল ট্রেনে। এবং রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা…
সহযাত্রী মাসিমা নেমে গেলেন বর্ধমানে। তানিয়া নেমে এসে জানলার ধারের সিটটার দখল নিল। ঘন্টা খানেক পর হঠাৎই উলটো দিকের ফাঁকা সিটে বিনায়ক এসে বসল। খুব সাধারণ দুএকটা কথা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলতে হল তানিয়াকে। সত্যিই সে চাইছিল না কথোপকথনটা চালাতে। কিন্তু লক্ষ্য করছিল, তার এই অবজ্ঞা যেন আরও নাছোড়বান্দা করে তুলছিল বিনায়ককে। শেষ পর্যন্ত বিনায়ক বলেই ফেলল, সে ভালো নেই। রুমিয়ার জেদি, স্বেচ্ছাচার, উত্শৃঙ্খল জীবনযাপন তাকে শেষ করে দিচ্ছে প্রতিদিন। তার নিত্য নতুন চাহিদা মেটাতে মেটাতে বিনায়ক ক্লান্ত।
বিনায়ক তানিয়াকে অবাক করে দিয়ে ক্ষমাও চাইল। হেরে যাওয়া বিনায়কের ক্ষমা চাওয়া দেখে আরও বিস্মিত হল তানিয়া। কিন্তু আজ যে বড্ড দেরি হয়ে গেছে। যে-লোকটা, ভেঙেচুরে তার সামনে বসে আছে, আজ তার জন্য আর হৃদয় কাঁদে না তানিয়ার। সে পাথর হয়ে গেছে। বিনায়ক তার হাতটা ধরে যেন অনেক কিছু বলতে চায়।
কী ঠান্ডা হাত বিনায়কের। সরীসৃপের মতো ঠান্ডা। গা-টা কেমন যেন গুলিয়ে ওঠে তানিয়ার। ঠান্ডা রক্তের সরীসৃপটা যেন কিলবিলিয়ে তার শরীর বেয়ে উঠতে চাইছে। সে দ্রুত হাতটা সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ব্যাগ নিয়ে সোজা এগিয়ে যায় গেটের দিকে। তার গন্তব্য আর খুব দূরে নয়।