মাথা যখন আছে, যন্ত্রণা হতেই পারে। সারা জীবনে একবারও মাথা যন্ত্রণা হয়নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। এখন বিষয়টা হচ্ছে, মাথা যন্ত্রণা কেন হয়? মাথা যন্ত্রণা হলেই অনেকে পেইন কিলার খেয়ে নেন। যা একেবারে স্বাস্থ্যবিরুদ্ধ। হতে পারে কোনও সাধারণ কারণে আপনার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু যদি মাথা যন্ত্রণা কোনও কঠিন রোগের উপসর্গ হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে উপযুক্ত চিকিৎসার প্রয়োজন। ডা. হাসিব হাসান এই প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন সম্প্রতি।
কী ধরনের মাথা যন্ত্রণার ক্ষেত্রে ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ জরুরি?
হঠাৎ হঠাৎ তীব্র, অসহ্য মাথা যন্ত্রণা,জ্বর, বমি, তন্দ্রাচ্ছন্নতা বা শরীরের কোনও অংশের দুর্বলতার সঙ্গে যুক্ত মাথা যন্ত্রণা, ক্রমশ বাড়তে থাকা মাথা যন্ত্রণা, ঘুম থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মাথা যন্ত্রণা, মাথা যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টির সমস্যা, চোখ বেঁকে যাওয়া, একটানা মাথা যন্ত্রণা, মাথা ঘোরার সঙ্গে সঙ্গে মাথা যন্ত্রণা, তিন মাসের বেশি সময় ধরে চলা যে-কোনও ধরনের মাথা যন্ত্রণা প্রভৃতি।
মাথা যন্ত্রণা মানেই কি ব্রেন টিউমার?
না। মাথা যন্ত্রণার কারণ বহুবিধ। তার মধ্যে সব থেকে প্রধান হল মাইগ্রেন। এটা একটা ভুল ধারণা যে,শুধু টিউমার থেকেই মাথা যন্ত্রণা হয়। মাথা যন্ত্রণা যাদের হয়, তাদের মধ্যে ১ শতাংশেরও কম জনের ব্রেন টিউমার থাকে।
মাইগ্রেন কী?
মাইগ্রেন একটি অবস্থা যেখানে ব্রেনের কিছু রাসায়নিক অসামঞ্জস্যের কারণে মাথা যন্ত্রণা হয়। শারীরিক ধকল, বেশিক্ষণ রোদে থাকা, চকোলেটের মতো কিছু বিশেষ খাবার এবং খিদে চেপে থাকা মাইগ্রেনের যন্ত্রণা বাড়ায়। মাথার একদিকে বা মাথার সামনের দিকে হালকা যন্ত্রণা থেকে এর সূত্রপাত এবং ক্রমশ তা বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিশক্তির সমস্যাও দেখা দিতে পারে। মাথা যন্ত্রণা বাড়তে শুরু করলে বমিও হতে পারে। সাধারণত দিনে কয়েক ঘন্টার জন্য এই মাথার যন্ত্রণা হয় এবং পেইন কিলার খেয়ে এবং ঘুমিয়ে তা সেরেও যায়। কখনও এই ব্যথা টানা দু-তিন দিনের জন্যও স্থায়ী হতে পারে। সাধারণত অনিয়মিত ভাবে এই মাথা যন্ত্রণা হয়। তবে তীব্র মাইগ্রেনের ক্ষেত্রে প্রতিদিনই মাথা যন্ত্রণা হতে পারে।
কোন বয়সে মাইগ্রেন হয়?
যে-কোনও বয়সেই মাইগ্রেন হতে পারে। তবে কৈশোরে বা প্রাপ্তবয়সে মাইগ্রেন হতে বেশি দেখা যায়। আবার পুরুষদের থেকে মহিলাদের মধ্যে মাইগ্রেনে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি।
মাইগ্রেনের সঙ্গে হরমোনের যোগাযোগ কী?
পরিবর্তনশীল পরিবেশে শারীরবৃত্তীয় ভারসাম্য বজায় রেখে হরমোন আমাদের বিভিন্ন শারীরিক ক্রিয়ার সূচনা এবং নিয়ন্ত্রণ করে। মাসিকের সময়, গর্ভাবস্থায় বা মেনোপজের সময় শরীরে হরমোনের ভারসাম্যহীনতা হলে তা থেকেও মাইগ্রেন হতে পারে।
বাস্তবে দেখা গিয়েছে, মাইগ্রেনে আক্রান্ত মহিলাদের তিন চতুর্থাংশের ক্ষেত্রেই মাইগ্রেন তাদের ঋতুচক্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
মাইগ্রেনের চিকিৎসা হয় কি?
একটা প্রচলিত ভুল ধারণা আছে যে মাইগ্রেনের কোনও চিকিৎসা হয় না। ঘটনা হল, চিকিৎসার মাধ্যমে মাইগ্রেন সারানো যায়। তবে কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দীর্ঘায়িত চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। সাধারণত ৬-১২ মাসের চিকিৎসাই যথেষ্ট।
মাথা যন্ত্রণা হলে পেইন কিলার খাওয়া কি ঠিক?
মাঝে মাঝে হওয়া মাথা যন্ত্রণার ক্ষেত্রে (তিন মাসে একবারের মতো) নিজে থেকেই ওষুধের দোকান থেকে পেইন কিলার খেয়ে নিলে অসুবিধা নেই। তবে নিমুসোলিড এবং ডিসপিরিন খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। আর মাথা যন্ত্রণা যদি ঘন ঘন হয় তাহলে অবশ্যই নিউরোলজিস্টকে দেখান।
মাইগ্রেনের ক্ষেত্রে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়?
মাইগ্রেন সারানোর জন্য তিনটি পদ্ধতি নিতে হবেঃ
১) খিদে চেপে থাকা, নিদ্রাহীনতা এবং শারীরিক ধকল ইত্যাদি যেসব কারণে মাইগ্রেন হয় সেগুলি এড়িয়ে চলা। যদি রোদের কারণে মাইগ্রেন হয়, তাহলে বাইরে বেরোনোর আগে রোদ-চশমা, ছাতা বা টুপি নিয়ে বেরোন।
২) তীব্র মাথা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য পেইন কিলার এবং ট্রিপটান বর্গের কোনও ওষুধ খাওয়া যেতে পারে।
৩) ঘন ঘন মাথা যন্ত্রণা কমানোর জন্য সাধারণত প্রতিদিন ওষুধের দরকার হয়। কম করে ৬ মাসের জন্য রোজ ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা, প্রয়োজনে ২-৩ বছরও এই ভাবে চিকিৎসা চলতে পারে। এই সব ওষুধ পেইন কিলার নয় এবং টানা খেয়ে গেলে মারাত্মক কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার আশঙ্কাও নেই।
সব মাথা যন্ত্রণার কারণই কি মাইগ্রেন?
না। মাথা যন্ত্রণার বহুবিধ কারণ আছে। মাইগ্রেন ছাড়াও আরও একাধিক রকমের মাথা যন্ত্রণা আছে এবং মাথা যন্ত্রণার ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়াটাও জরুরি। সাধারণত বছর খানেকের বেশি সময় ধরে চলা মাথা যন্ত্রণার কারণ হয় মাইগ্রেন, না হলে ক্রমাগত দুশ্চিন্তা। দুশ্চিন্তাজনিত মাথা যন্ত্রণাও খুব সাধারণ ঘটনা। যেহেতু তার চিকিৎসা প্রক্রিয়া আলাদা তাই তার যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন। সাধারণত এই ধরনের মাথা যন্ত্রণা দীর্ঘমেয়াদী মানসিক চাপ থেকে সৃষ্টি হয়। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে তার কারণ শুধুমাত্রই মানসিক চাপ নয়। তাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ কাউন্সেলিং খুবই জরুরি। মানসিক অবসাদ কাটানোর জন্যে যেসব ওষুধ প্রয়োগ করা হয়, সেগুলি এই মাথা যন্ত্রণার চিকিৎসাতেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
সাইনাসের মাথা যন্ত্রণা কী? কী থেকে এটা হয় এবং কী ভাবে এর চিকিৎসা করা যায়?
কোনও অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া কিংবা কোনও সংক্রমণ থেকে যখন সাইনাস প্রদাহ হয়, তখন এই প্রদাহ থেকে কাছাকাছি অংশে যন্ত্রণার সৃষ্টি হয়। যদি প্রকৃত অর্থে সাইনাস ব্লকেজ থেকেই কারও মাথা যন্ত্রণা হয় তাহলে একই সঙ্গে তার জ্বরও হতে পারে। এক্স-রে করে সাইনাস ব্লকেজ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। চিকিৎসক সে ক্ষেত্রে অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে সঙ্গে সংক্রমণ নিরাময়ের জন্য অ্যান্টিবায়োটিকও দেবেন।
যদি হঠাৎ মাথা যন্ত্রণা হয় তাহলে কী করা উচিত?
যদি মাথা যন্ত্রণা খুব তীব্র হয় কিংবা মাথা যন্ত্রণার সঙ্গে বমি, জ্বর, অনিদ্রা, শরীরের এক দিকের দুর্বলতা কিংবা কথা বলতে সমস্যা হয়, তবে তা স্ট্রোক বা মস্তিষ্কে সংক্রমণের মতো গুরুতর বিষয় হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে অতি দ্রুত জরুরি ভিত্তিতে কাছাকাছি ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
মাথা যন্ত্রণার পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চিকিৎসার জন্য কোন স্পেশালিটির চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত ?
যদি মাথা যন্ত্রণা তীব্র হয় এবং হঠাৎ হয় তাহলে কাছাকাছি কোনও ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আর যদি তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে মাথা যন্ত্রণা চলতে থাকে, তাহলে নিউরোলজিস্ট বা মাথা যন্ত্রণার বিশেষজ্ঞ কোনও চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।