জাতীয় স্তরে খুব বড়ো করেই এবার প্রতিযোগিতার আসর বসানো হয়েছে। গল্পের প্রতিযোগিতা। দেশের প্রায় সব রাজ্য থেকেই ছোটো-বড়ো বহু গল্প জমা পড়েছিল। তারই মধ্যে পঁচিশজন লেখককে সনাক্ত করা হয়েছে যাদের লেখা পুরস্কার পেতে চলেছে। বিশাল আয়োজন। স্টেজের উপর বেশ কিছু লেখক চেয়ারে বসে রয়েছেন। লেখকদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন রঞ্জন কর্মকার। গল্পটি একটি বাচ্চাকে নিয়ে।

অনাথ একটি বাচ্চা জীবনের সব বাধা অতিক্রম করে কীভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠবে তাই নিয়ে গল্প। গল্পগুলি যারা সিলেক্ট করেছেন সেই বিচারকদের মধ্যেই মাধবীও একজন। তিন বছর আগে এই সংস্থাই মাধবী-কেও বেস্ট রাইটার-এর খেতাবে সম্মানিত করেছিল। মাধবী প্রথম যখন গল্পটি পড়ে, খুবই প্রভাবিত হয় কিন্তু লেখকের নাম দেখে তার কপালে বিস্ময়ের ভাঁজ পড়ে। রঞ্জন কর্মকার… এ সে-ই লোক নয়তো! মনের মধ্যে ঝড় ওঠে মাধবীর।

স্টেজে উপস্থিত একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লেখককে মাধবী জিজ্ঞেস করে, অরুণদা এই রঞ্জন কর্মকারকে আপনি চেনেন? তার কোনও ছবি দেখাতে পারবেন?

মাধবী, তুমি তো জানো প্রতিযোগিতায় ছবি পাঠাবার নিয়ম নেই। নয়তো সংস্থারই বদনাম হয়ে যাবে যে চেনা লোকেদেরই এরা পুরস্কার দেয়।

মাধবী লজ্জিত হল, সরি, আমি ভুলে গিয়েছিলাম।

কী ব্যাপার, বলো তো?

না না, সেরকম কোনও ব্যাপার নয়, জাস্ট কৌতূহল হল বলে জিজ্ঞেস করলাম, কথোপকথন শেষ করতে মাধবী তৎপর হয়ে উঠল। বাড়ি ফিরতে হবে। আজকে এখানকার সব কাজ বসে শেষ করে ফেলেছে মাধবী।

বাড়ি পৌঁছেও মনের উপর একটা ভার চেপে বসেছে অনুভব করল সে। ঝেড়ে ফেলতে চেয়ে কিছুতেই ঠেলে সরাতে পারল না। অদিতি এসে জড়িয়ে ধরল মাধবীকে একটু আদর পাওয়ার আশায়। কিন্তু মাধবীর মন আজ স্মৃতির পাতা উলটে-পালটে দেখতে গিয়ে বর্তমানের পটভূমিকা ছেড়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিল। শুধু একটা নাম, যা মনের মধ্যে সংগোপনে রাখা আগুনের ফুলকিকে উসকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

মাধবী তো ভুলতে বসেছিল সবকিছু কিন্তু ওই একটা নাম আবার অতীতের ক্ষতটাকে খুঁচিয়ে দগদগে করে দিতে চাইল। মাথা ভারী মনে হল মাধবীর, লুকোনো একটা ব্যথা বুকের পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইল। মনে হচ্ছিল এই তো সেদিনকার কথা, যেটা ভুলে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিল ও মনে মনে। না চাইতেও পুরোনো স্মৃতির পাতাগুলো একটার পর একটা খুলে যেতে লাগল চোখের সামনে।

 

দেয়াল ঘড়িতে বারোটার ঘণ্টাটা জোরে বেজে উঠতেই মাধবী দৌড়ে জানলাটার কাছে গিয়ে রাস্তার দিকে দৃষ্টিপাত করল। লোকটা এত রাতে কোথায় কে জানে। এখন তো এটাই মাধবীর জীবনে রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যরাত পর্যন্ত লোকটার অপেক্ষায় ঘড়িতে সময় দেখে কাটানো। অথচ লোকটার এই নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই।

মাধবী প্রথমে ঘড়ি দেখত, তারপর জানলা খুলে রাস্তা, যদি লোকটাকে দেখতে পায়। আজও রাস্তা ফাঁকা, বহুদূর পর্যন্ত একটা মানুষও ওর চোখে পড়ল না।

প্রায় দেড়টা বাজতে যায়, দরজায় ধাক্কা শুনে উঠে এল মাধবী। দরজা খুলতেই টলোমলো পায়ে লোকটা ভিতরে ঢুকে এল।

আজকে তুমি আবার এক গলা খেয়ে এসেছ? রাগে, দুঃখে মাধবীর চোখে জল চলে এল।

হ্যাঁ খেয়ে এসেছি। তোমার বাবার টাকায় তো খাইনি। অশ্লীল ভাষায় আরও দুটো গালমন্দ করে লোকটা থামল।

কেন এভাবে নিজের জীবনটা নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছ?

নষ্ট করতে! পাগলের মতো হেসে উঠল বাহ্যজ্ঞানশূন্য লোকটা। জীবনটা স্বস্তি দিলই কখন? যবে থেকে তুমি আমার জীবনে পা রেখেছ, আমার জীবন নরক হয়ে উঠেছে।

কেন কী এমন করেছি আমি? মাধবী জিজ্ঞেস করেই ফেলে।

তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কী চাই।

কিন্তু সেটার জন্য আমি কী করতে পারি? ক্লিনিকে গিয়ে তো নিজের চেক-আপ করিয়েছিলাম। মা হওয়ার জন্য আমি সব দিক থেকে সক্ষম। ডাক্তার তো বলেই দিয়েছে দুজনের চেক-আপ…

কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা থাপ্পড় এসে পড়ল মাধবীর গালে, তুমি কি মনে করো আমি নপুংসক? সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার?

আমি একথা কখন বললাম? আমি খালি…

নিজেই নিজের ঝোল টানছ? বেয়াদপ মেয়েছেলে, আরও একটা থাপ্পড় এসে পড়ল মাধবীর গালে।

তুমি যদি চাও আমি ঠিকমতো ব্যবহার করি তাহলে আমার যা চাহিদা সেটা পূরণ করো। পাঁচবছর আমাদের বিয়ে হয়েছে, আজ পর্যন্ত বাচ্চার কান্না-হাসিতে বাড়িটার শূন্যতা ভরল না। বন্ধুবান্ধবরা আমাকে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করে। আর আমি সহ্য করতে পারছি না।

তুমি চেক-আপও করাবে না আর আমাকে বাচ্চার জন্য জোরও দেবে! এটা কি আমার একার পক্ষে সম্ভব? মাধবী বোঝাবার চেষ্টা করে।

আমি কিছু শুনতে চাই না, আমি শুধু রেজাল্ট চাই ব্যস, গলার আওয়াজ জোরালো হয়।

শোনো না, আমরা অনাথাশ্রম থেকেও তো বাচ্চা নিয়ে এসে মানুষ করতে পারি, সাহস জুটিয়ে বলে মাধবী।

কী বললে, আর একবার বলো, অনাথাশ্রমের বাচ্চা?

ক্ষতি কী?

মুহূর্তের মধ্যে লোকটা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। লাথি, চড়, ঘুঁসি এসে পড়ে মাধবীর উপর। এতেও লোকটার রাগ শান্ত হয় না। মাধবীর হাত ধরে টানতে টানতে দরজা খুলে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। পিঠে একটা লাথি মেরে মাধবীকে রাস্তায় ফেলে দেয়, আজ থেকে এ বাড়ির দরজা তোমার জন্য বন্ধ। যেখানে যেতে ইচ্ছে করে যাও। তোমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। বাঁজা কোথাকার।

লোকটার মুখের এই অশ্লীল শব্দ, মাধবীর কানের মধ্যে যেন গরম তরল লোহা ঢেলে দিল। রাস্তাতেই পড়েছিল সে, হঠাৎই শরীরে উপলব্ধি করল এক দুর্জয় শক্তি। মুখ থেকে বেরিয়ে এল, বাঃ বাঃ খুব ভালো, ভালো লাগল নারীবাদী লেখকের মুখে এমন কথা শুনে। অথচ নিজের বাড়ির মেয়েদের প্রতি যার মনে এতটুকু সম্মান নেই। যাও যাও বাড়ির এই গল্পটাও লিখে ফেলো। তোমার দুঃখের কাহিনিটা-ও সকলকে জানাও, তবেই না তোমার জয়জয়কার হবে।

আমাদের মতো পুরুষপ্রধান দেশে মেয়েদের নিয়ে গল্পই খালি লেখা হয়। তোমার লেখাটাও আর একটা গল্প যোগ করবে। কিন্তু মনে রেখো রঞ্জন কর্মকার, সন্তানের মুখ তুমি কোনও দিনই দেখতে পাবে না। পারো তো একবার গিয়ে নিজেকে পরীক্ষা করিয়ে নিও। হাজার বার বলব তুমি নপুংসক। আর হ্যাঁ, তুমি আমাকে বাড়ি থেকে কী বার করবে, আমি নিজেই এই নরকের পরিবেশ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি, যেখানে তোমার মতো লোকের ছায়া পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না।

রঞ্জন পাথরের মতো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। মাধবীকে আটকাবার কোনও চেষ্টাই করে না। জনশূন্য রাস্তার নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে মাধবী পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে অজানা এক ভবিষ্যতের দিকে।

 

আজ চোদ্দো বছর পর ওই ফেলে আসা নামটা আবার মাধবীর চোখের সামনে অক্ষর হয়ে এসে দাঁড়াল। এতগুলো বছর মাধবীকে কম লড়াই করতে হয়নি। কত সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, সব মনে আছে ওর, লোকের বাড়িতে কাজ করেছে পর্যন্ত। একটাই ভালো হয়েছে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক অরুণ বসুর আশীর্বাদধন্য হতে পেরেছে মাধবী। তাঁরই উৎসাহে এ কয়েক বছরে বেশ কয়েকটা বই লিখে বেশ নাম করেছে মাধবী। অবশ্য লেখাগুলো সবই মধুমালতী ছদ্মনামে। অরুণ বসুই প্রকাশনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও মাধবী যথেষ্ট জনপ্রিয় লেখিকা এখন। অর্থের কোনও অভাব আর নেই মাধবীর। নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট কিনে অনাথাশ্রম থেকে একটি শিশুকন্যাও দত্তক নিয়েছে সে। বেশ আনন্দেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। কিন্তু রঞ্জন কর্মকারের নামটা ওর চোখের সামনে এসে উপস্থিত হয়ে সব কেমন এলোমেলো করে দিল। মন খালি বলছে, এটা হওয়া সম্ভব নয়। একই নামে বহু লোক আছে এই পৃথিবীতে। সুতরাং এ কিছুতেই অতীতের সেই রঞ্জন নয়।

ফোনটা বেজে উঠতেই চিন্তায় ছেদ পড়ল মাধবীর। অরুণ বসুর নামটা স্ক্রিনে ভেসে উঠল। ফোন তুলতেই অরুণবাবু জানালেন, লেখক সংগঠন থেকে ঠিক করা হয়েছে, রঞ্জন কর্মকারের হাতে প্রথম পুরস্কার তুলে দেওয়ার দাযিত্ব মাধবী তোমাকে নিতে হবে।

অবাক হল মাধবী, যেটাই এড়াতে চায় সেটাই আরও বেশি করে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। ফোনেই মাধবী জানাল, সেদিন ওর পক্ষে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। কিন্তু অরুণবাবু জোর দিলেন, ডাকযোগে লেখকদের জানানো হয়ে গেছে যে, মাধবী-ই সেদিন পুরস্কার দেওয়ার দাযিত্বে থাকবে।

কিন্তু এটা ঠিক করার আগে একবার আপনি কেন আমাকে জানালেন না? বিরক্তির স্বরে মাধবী জিজ্ঞেস করল।

এটা কী ধরনের কথা মাধবী! লোকে জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলোতে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে, আর তুমি কিনা… কথার মাঝেই মাধবী বলে উঠল, সরি অরুণদা, সেদিন আমি কিছুতেই আসতে পারব না।

তার মানে আমার সম্মানটা মাটিতে মিশিয়ে দিতে চাও। এখন তো কার্ডগুলোও সবাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিক আছে, তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ তখন আর আমি কী বলব?

অরুণদার গলাটা শুনে মাধবীর মনে হল, যুদ্ধে হেরে যাওয়া এক সৈনিক। যুদ্ধ করার আগেই হেরে বসে আছেন। ঠিক আছে অরুণদা আমি যাব, নিশ্চিন্ত করে মাধবী।

অরুণ বসুকে মাধবী আদর্শ মনে করে চলে। বড়ো ভাইয়ের স্নেহই পেয়ে এসেছে মাধবী ওনার কাছে বরাবর। সুতরাং আজ সেই মানুষটার মনে আঘাত দেওয়ার মানসিকতা কিছুতেই হল না তার।

ঘড়িতে ঠিক সন্ধে সাতটা। লেখক ও বুদ্ধিজীবীর ভিড়ে হল গমগম করছে। আলো বন্ধ হতেই পিন পতন নিস্তব্ধতা গোটা প্রেক্ষাগৃহে। স্টেজের উপরে মাইকে অরুণ বসু ঘোষণা করলেন, প্রথম পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে লেখক রঞ্জন কর্মকারকে। দয়া করে স্টেজে এসে আসন গ্রহণ করুন।

মাধবী তৈরিই ছিল। স্টেজের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা ব্যক্তিটিকে দেখে মাধবী পাথর হয়ে গেল। রঞ্জনও এক ঝলক মাধবীর মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। এত বছর ধরে যে-মুহূর্তটাকে মাধবী ভুলে যেতে চেয়েছে, এড়িয়ে এসেছে, আজ সেই মুহূর্তটাই এক বুক কষ্টর ঝাঁপি খুলে মাধবীর মনটাকে তাতে ডুবিয়ে দিল।

এতগুলো বছর ধরে রঞ্জনও ভেবে এসেছে, মাধবী ওর থেকে দূরে চলে যাওয়ার পর, মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেছে। গুম হয়ে গেছে, যেখান থেকে সভ্য সমাজে ফিরে আসা আর কখনও সম্ভব নয়। অথচ, অদৃষ্টের কি নিষ্ঠুর পরিহাস যে, সেই মাধবী ওরফে মধুমালতী-র হাত থেকেই তাকে আজ পুরস্কার গ্রহণ করতে হচ্ছে। এর থেকে নিয়তির নিষ্ঠুরতা আর কী হতে পারে?

মাধবীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই রঞ্জনের অহংকার, ভাঙা কাচের মতো গুঁড়ো হয়ে রঞ্জনকেই বিদ্ধ করল। মাধবী অরুণদার হাত থেকে পুরস্কার নিয়ে রঞ্জনের হাতে ধরাল। রঞ্জনও কলের পুতুলের মতো পুরস্কার গ্রহণ করে, কোনও রকমে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু না বলে, স্টেজে রাখা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। দেখে যে-কেউই ভাবতে পারে রঞ্জন কর্মকারকে সম্মানিত করার বদলে জুতোপেটা করা হয়েছে।

এরপর ধীরে ধীরে অন্য লেখকদের পুরস্কার প্রদান পর্ব শেষ হতেই অরুণদাকে বলে হল ছেড়ে বেরিয়ে এল মাধবী। অন্য আরও অনুষ্ঠানগুলো দেখার মতো মানসিকতা ছিল না তার। গাড়ি বাইরেই রাখা ছিল। গাড়িতে উঠে বসল মাধবী।

 

বাড়িতে ঢুকতেই মাধবীর মনে হল একটু কাঁদতে পারলে হয়তো বুকের উপর চেপে বসে থাকা বোঝাটা হালকা হতো। কিন্তু একফোঁটা জলও চোখ দিয়ে বেরোল না। গলার কাছটায় শুধু একটা ঘড়ঘড় শব্দ শুরু হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। দরজায় ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজে মাধবীর ঘোর কাটল।

কে? চোখের জল মুছে নিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল মাধবী কে এসেছে দেখতে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রঞ্জনকে দেখে ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে উঠল ওর।

তুমি কেন এসেছ এখানে? জানলা দিয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল মাধবী।

আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি মাধবী।

মাধবী? কে মাধবী? চোদ্দো বছর আগে মাধবী মারা গেছে। আমার নাম মালতী, মধুমালতী। আমি তোমাকে চিনি না, চলে যাও এখান থেকে। শেষের দিকে মাধবীর গলার স্বর বেশ জোরালো শোনালো।

চলে যাব, শুধু একবার বলে দাও যে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে রঞ্জন বন্ধ দরজার সামনে, গলায় কাকুতি।

বললাম তো আমি তোমাকে চিনি না। ভালোয় ভালোয় চলে যাও নয়তো চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব, বলে জানলা বন্ধ করে দেয় মাধবী।

বহুক্ষণ আর কোনও আওয়াজ নেই, মাধবীর মনে হল রঞ্জন নিশ্চয়ই চলে গেছে। ভালোই হয়েছে। ওর সঙ্গে যখন কোনও সম্পর্কই নেই, তখন ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠছে কোথা থেকে। আমার জীবন নরক করে তুলে আজ আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে!

হঠাৎ-ই নিজের মনেই ধিক্কার অনুভব করল মাধবী। ভিতর থেকে নিজের বিবেকই প্রশ্ন তুলল, বাহ! মালতী এখন তুমি মাধবী থেকে মধুমালতী হয়েছ, নাম বদলে ফেলেছ জনপ্রিয়তা পেয়ে, কিন্তু স্ত্রীধর্ম? তুমি যদি ওকে চেনো না, তাহলে কার জন্য হাতে লোহা, মাথায় সিঁদুর ছোঁয়ানো? হাতের লোহা খুলে ফেলে দাও, মাথার সিঁদুর মুছে ফেলো। রঞ্জন কর্মকারের সঙ্গে জুড়ে থাকা এই বন্ধন আজও কেন বয়ে বেড়াচ্ছ? না মাধবী তুমি এসব কিছুই করতে পারবে না। উপরে উপরে যাই তুমি বলো না কেন, তোমার মন কি কখনও ওকে ভুলতে পেরেছে? না পারেনি। তোমার লেখায় এত দরদ কোথা থেকে আসে? জীবন দিয়ে তুমি উপলব্ধি করেছ বলেই না!

চুপ করো, আমি কিছু শুনতে চাই না, হঠাৎই নিজে নিজেই চেঁচিয়ে ওঠে মাধবী।

মাধবীর গলা শুনে অদিতি জেগে যায়। কোনও ভাবে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয় মেয়েকে কিন্তু নিজে ঘুমোতে পারে না মাধবী। পুরোনো ঘটনাগুলো ঘুরেফিরে চোখের সামনে আসতে থাকে।

রাত প্রায় একটা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মাধবী ঘুমোবার চেষ্টা করে। হঠাৎ ফোনের আওয়াজে তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা ওর কেটে যায়। ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করে না কিন্তু এক নাগাড়ে বাজতে থাকায় বাধ্য হয়ে উঠে আসে মাধবী।

হ্যালো, কে বলছেন?

আমি অরুণ বলছি, শান্ত আওয়াজ ভেসে আসে ওপার থেকে।

এত রাতে অরুণদা… সব ঠিক আছে তো? চিন্তিত হয় মাধবী।

আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার সত্যি উত্তর দেবে? তুমি কি রঞ্জন… মানে রঞ্জন কর্মকারকে চেনো?

চমকে ওঠে মাধবী কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, হঠাৎ এত রাতে ফোন করে এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

আগে উত্তর দাও তুমি ওকে চেনো কি চেনো না?

হ্যাঁ, একসময় আমার স্বামী ছিলেন। ছিলেন শব্দটার উপর বিশেষ জোর দেয় মাধবী।

মাধবী, ছিলেন নয় আজও তিনি তোমার স্বামী কারণ তোমাদের ডিভোর্স হয়নি।

কিন্তু অরুণদা কী ব্যাপার বলুন তো? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মাধবী।

হয়তো রঞ্জন আর বাঁচবে না। কাল যখন তোমাদের বাড়ি গিয়েছিল, তুমি দরজা খুলে না দেওয়াতে ও অনেক্ষণ ওখানেই বসে ছিল। হয়তো ভেবেছিল তুমি দরজা খুলবে। বহুক্ষণ পরে সব আশা ত্যাগ করে ও যখন ওখান থেকে উঠে পড়ে রাস্তায় পা বাড়ায়, তখনও হয়তো মনে ক্ষীণ আশা বাঁচিয়ে রেখেছিল যে দরজা খুলে তুমি নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে। পিছন ফিরে সেটাই দেখতে গিয়ে একটা চলন্ত ট্রাক এসে ওকে ধাক্কা মারে। হাসপাতালে ও এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ও একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

কিন্তু আপনি এত কথা জানলেন কী করে? চোখের জল সামলাতে সামলাতে মাধবী প্রশ্ন করে।

প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পর তুমি যখন হঠাৎ অনুষ্ঠান ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলে, রঞ্জনও তোমার পিছনে পিছনে দৌড়োল। আমার একটু সন্দেহ হয় কারণ যখনই এই নামটা তোমার সামনে আসে, তুমি কীরকম যেন অস্থির হয়ে ওঠো। আমিও বেরিয়ে আসি হল ছেড়ে আর তোমাদের পিছু নিই। তোমাদের বাড়ির কাছে এসেই রঞ্জন ট্যাক্সি ছেড়ে দেয় কিন্তু ততক্ষণে তুমি বাড়ি ঢুকে গেছ। আমিও একটু দূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রতীক্ষা করতে থাকি। রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই ট্রাকটা ওকে ধাক্কা মারে। আমারও কিছু করার ছিল না। ওকে তুলে হাসপাতাল নিয়ে আসি। ডাক্তাররা আশা দিতে পারছেন না।

অরুণদা, আমি এখুনি আসছি, রিসিভার নামিয়ে রাখে মাধবী।

মাথার সিঁদুরের উপর চোখ যায় মাধবীর। মলিন সিঁদুরের রেখাটা খুব কষ্ট করে চোখে পড়ে। তাড়াতাড়ি করে মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে তৈরি হয়ে গাড়িতে এসে বসে। হাসপাতালের দিকে গাড়ি ঘোরায় মাধবী।

মা এত রাতে আমরা কোথায় যাচ্ছি? অদিতি জিজ্ঞেস করে।

তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে।

মিথ্যা কথা, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমিই তো এতদিন বলেছ, আমার বাবা কোথাও হারিয়ে গেছে, চেঁচিয়ে ওঠে অদিতি।

হ্যাঁ বলতাম কিন্তু আজই হঠাৎ ওনার খোঁজ পাওয়া গেছে।

তাহলে এখন থেকে বাবা কি আমাদের সঙ্গে থাকবে?

হয়তো।

তাহলে তো খুব মজা হবে, অদিতি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।

অদিতি, এখন একটু চুপ করো। মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।

হাসপাতালে পৌঁছতেই গাড়ি রেখে রিসেপশনেই অরুণদার দেখা পেল মাধবী। মাধবীদের নিয়ে রঞ্জনের বেড-এর সামনে দাঁড়াতেই চোখ খুলে চাইল ও। এসে গেছ। তোমারই আসার প্রতীক্ষা করছিলাম। এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে রঞ্জনকে। মাধবীদের ঘরে রেখে অরুণ বাইরে এসে দাঁড়ালেন।

রক্তাক্ত শরীরটাকে কোনও ভাবে টেনে তুলে রঞ্জন উঠে বসার চেষ্টা করতেই মাধবী জোর করে ওকে শুইয়ে দিল।

এ কী হাল করছে শরীরের? কাঁদতে কাঁদতেই জিজ্ঞেস করে মাধবী।

সবই আমার কর্মদোষ! আমি তোমার উপর যে-অত্যাচার করেছি, আজ তারই ফল আমাকে ভুগতে হচ্ছে। আমার এই নিয়ে কারও কাছে কোনও অভিযোগ নেই। আর তো কিছুক্ষণের অতিথি আমি। আমার শেষ ইচ্ছা, যেন তোমার সামনেই এই পাপে ভরা প্রাণটা ত্যাগ করতে পারি।

মাধবী রঞ্জনের হাত দুটো নিজের মুঠিতে তুলে নেয়, তোমার কিচ্ছু হবে না, আমি তোমাকে বাঁচাব।

আমাকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। হঠাৎ অদিতির দিকে দৃষ্টি পড়তেই ইশারায় জিজ্ঞেস করে রঞ্জন, এটি তোমার মেয়ে?

হ্যাঁ, আমার মেয়ে, দত্তক নিয়েছি।

ভালো করেছ মাধবী, নয়তো আমার চিতায় কে আগুন দিত? সারা জীবন এই একটাই চিন্তা আমাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে যে, মৃত্যুর পর আমার কী হবে? কিন্তু এখন আর কোনও চিন্তা নেই। এখন আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব, বলে রঞ্জন অদিতিকে স্নেহের স্পর্শে কাছে টেনে নেয়।

 

কী শান্তি! এই শান্তি আগে তো কোনও দিন অনুভব করেনি রঞ্জন। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কে আপন কে পর তার হিসেব কে রাখে? আর তো কিছু মুহূর্ত…

যদি রঞ্জন সেদিন আমার কথা শুনতে, তাহলে আজ আমরা সবাই একসঙ্গে থাকতাম। কিন্তু আ.., মুখের কথা মুখেই থেকে যায় মাধবীর। গলা শুকিয়ে ওঠে। রুদ্ধ হয়ে আসে স্বর।

আমি তোমাকে কখনও হেয় করতে চাইনি মাধবী। কিন্তু কী যে পশু ভর করেছিল আমার মাথায়! সময়, কড়ায় গন্ডায় হিসেব নিয়েছে আমার পাপের! এমন অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে, যেখান থেকে বেরোবার শক্তি আমি জোটাতে পারিনি। তবুও বলব আজ আমি খুব খুশি। মৃত্যুর সময তো আমি তোমাকে কাছে পেলাম। আমার লেখায় আদর্শের ছড়াছড়ি কিন্তু বাস্তবে নিজের জীবনে আদর্শকে কোনও ঠাঁই দিইনি। খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে যদি সুখী রাখতে পারতাম। আমি সত্যিই লজ্জিত মাধবী, ক্ষমা কোরো আমাকে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে মাধবী।

মাধবী কিছু বলার আগেই রঞ্জনের মাথা একপাশে হেলে পড়ল। মাধবী কাছে আসতেই বুঝতে পারল রঞ্জনের যাবতীয় কষ্টের অবসান ঘটেছে।

পরের দিন হাজারো সাহিত্যকারের ভিড়ে অদিতি, রঞ্জনের মুখাগ্নি করল। মাধবী অপলক দৃষ্টিতে চিতার আগুনের দিকে তাকাতেই মনে হল, আগুনের শিখার ভিতর থেকে রঞ্জনের হাসিমাথা মুখটা যেন মূর্ত হয়ে উঠছে। মাধবীকে বলছে, তুমি আমার শেষইচ্ছা পূরণ করে দিয়েছ, যেটা এতগুলো বছর ধরে আমার গলায় ফাঁসের মতো আটকে ছিল, আমার অসম্পূর্ণ গল্প আজ সম্পূর্ণ হল মাধবী। এখন আমি নিশ্চিন্তে চলে যাচ্ছি।

মাধবী শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের শেষ অশ্রুবিন্দুটুকুও জোর করে মুছে নিল। আর কান্না নয়, অদিতির জন্য বাকিটা জীবন তাকে হাসি মুখেই কাটাতে হবে।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...