‘রাধা কৃষ্ণ। রাধা কৃষ্ণ। কই গেলি রে রাধাকৃষ্ণ। চলে আয়। আমি এসেছি।’

বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেলিঙের ভেতর থেকে হাত বের করে বিস্কুটের ভাঙা টুকরো ছড়িয়ে দিচ্ছিল প্রতুল। কিন্তু ওদের দেখা নেই। প্রতুল চায়ের কাপে চুমুক দিল। চার-পাঁচটা ঝগড়ুটে কাক আর কয়েকটা শালিক উড়ে এসে বিস্কুটের দখল নিল। চড়ুইয়ের দল নিম গাছের মাথায় চ্যাঁচামেচি করছে। বাউন্ডারিওয়াল বা পেয়ারা-নিমের ডালে কোথাও রাধাকৃষ্ণের দেখা নেই। ওরা কি আজ আসবে না! প্রতুল ভাবল, ওরা এখন এলেও কাকের দলের সাথে পেরে উঠবে না। কাক ভীষণ চালাক আর বুদ্ধিমান, শালিকও।

সেই মারাত্মক দুর্ঘটনার দুদিন পরের কথা। প্রতুল সকালে চায়ের কাপ হাতে বসেছিল বারান্দায়। একটা জড়পদার্থের মতো, নিস্তেজ হয়ে। চুমুক দিতে ভুলে গেছে। তখনই ছোট্ট বাগানের এককোণে লম্বা ঘাস আর লজ্জাবতীর আড়ালে পাখিদুটোকে নজর পড়ল। ধূসর রঙের দুটো ঘুঘু। মেয়ে পাখিটার গলায় বাদামি গোল দাগ, মনে হয় গলার হার। ঘাসের মধ্যে থেকে কিছু খুঁটে খাচ্ছিল ওরা। ছেলে পাখিটার ডান পায়ে খুঁত আছে। পা-টা ভাঁজ হয় না, হাঁটার সময় একপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। মেয়ে পাখিটা বেশ চালাক-চতুর মনে হয়। খাবারের টুকরো বা শস্যদানা খুঁজে দিচ্ছে সঙ্গীকে। ছেলেটা ডান পা পালকে ঢেকে মাথা নীচু করে সেই শস্যদানা গিলে নিচ্ছে।

প্রতুলের মনে পড়ল ওর ভাঁজ-করা বাঁ-পা চেয়ারের ওপর, ডান-পা লম্বা করে ছড়িয়ে রেখেছে মেঝেতে। সুলেখার মৃত্যুর পর থেকে জটিল নার্ভের অসুখে ভুগে ভুগে এখন ওর দুটো হাত কাঁপে, ডান পা-টা হাঁটু থেকে ভাঁজ হতে চায় না। ছেলে পাখিটার সাথে ওর মিল আছে। একটা বিস্কুট ভেঙে বাগানে ছড়িয়ে দিতেই পাখিদুটো এগিয়ে এল। প্রথমে ও ভেবেছিল পায়রা। পরে ভালো করে দেখে বুঝল পায়রা নয়, ঘুঘু পাখি। গলা আর পেটের দিকে সামান্য সাদা, মাথার ওপরে আর ডানায় বাদামি-খয়েরি রঙের ছিটে। মেয়েটার গলার চারপাশে বাদামি গোল দাগ, রিং-এর মতো।

প্রতুল ওদের নামকরণ করল, রাধাকৃষ্ণ। সেই থেকে প্রায় তিনমাস হতে চলল ওরা নিয়মিত ওর বারান্দার সামনে আসছে। ওদের জন্য দুটো বিস্কুট বরাদ্দ। আগে কখনও ভোরবেলা এসে হাজির হতো। অত সকালে প্রতুল উঠতে পারে না।

দুটো কাক ওর দিকে তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে, বো-কা-কা, বো-কা-কা। হদ্দ বোক্বা, হদ্দ বোক্বা। বো-কা-কা।

চায়ের কাপটা এককোণে রেখে প্রতুল ভাবল, কে বোকা! কাকে বোকা বলছে ওরা! কাকগুলোও কি জেনে গেছে, প্রতুল একটা হদ্দ বোকা। ওই ঘটনার আগে ও নিজেকে বুদ্ধিমান বলে ভাবত। বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, শিক্ষিত এবং ভদ্র। বিশেষ বিশেষ সময়ে অন্যের চেয়ে নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবতে ভালোও লাগত। এখন ওর আত্মবিশ্বাসের পারদ শূন্যে নেমে গেছে। নিজের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে।

কাকগুলো উড়ে গিয়ে বসেছে রাস্তার ওপারে সরকারদের বাড়ির ছাদের কার্নিশে। ওরা উড়ে যেতেই কয়েকটা চড়ুই কিচিরমিচির করে প্রতুলের সামনে এসে রীতিমতো অভিযোগ শুরু করে দিল। আমরা ফেলনা নাকি। আমাদের ভাগেরটা কই। সারাদিন তো আমরাই তোমার বাড়ির বারান্দায় হুটোপাটি করি। পাশে নিমের ডালে ঠোঁট ঘষি, সুখ-দুঃখের কথা বলি, বসে বিশ্রাম নিই। বাউন্ডারি ওয়ালের ওপর দিয়ে হুলোটা যখন নিঃশব্দে দৌড়ে যায়, রান্নাঘরের জানালার ভেতর উঁকি দেয়, আমরাই চ্যাঁচামেচি করি। প্রতুল ঘরে গিয়ে আবার বিস্কুট নিয়ে আসে। গ্রিলের বড়ো বড়ো ফাঁক দিয়ে চড়ুইগুলো বারান্দায় চলে আসে। একেবারে প্রতুলের হাতের কাছাকাছি। ওরাই এখন ওর বন্ধু, সময় কাটাবার, নিঃসঙ্গতা দূর করার সাথি। কিন্তু রাধাকৃষ্ণ আজ গেল কই? ওদের কি শরীর খারাপ? নাকি অন্য কিছু?

অর্চনা মোবাইল হাতে বারান্দায়, ‘অ্যাই তোমার ফোন। দ্যাখো, সুভাষদা আবার কী বলবে। টাকা-পয়সার কথা বলতে পারে। তুমি রাজি হবে না কিন্তু। আর ব্যাপারটা ভালো করে শুনে নিও। যদি সেরকম মনে করো, টাকা পয়সা কিছু দিতে হবে, তাহলে আপ-ডাউন ভাড়াটা শুধু দিয়ে দিও। কাজ শেষ করে ফিরে আসলে ফিজটা দিও।’

অর্চনা মোবাইলটা প্রতুলের হাতে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ও এখন গতকালের এঁটো বাসন মাজবে, বালতির জলে ডিটারজেন্ট মিশিয়ে বাসি কাপড় ভেজাবে, তারপর সবজি কুটতে বসবে। দুপুর একটা বেজে যাবে তাও অর্চনার কাজ শেষ হবে না।

কাঁপতে কাঁপতে একসময় ছোট্ট যন্ত্রটা থেমে গেল। প্রতুল ফোনটা রিসিভ করল না। কী বলবে ওই প্রান্ত থেকে সুভাষদা, প্রতুল অনুমান করতে পারে। অর্চনার দূর সম্পর্কের মাসতুতো না পিসতুতো দাদা, সুভাষ ঘোষ, বার অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র উকিল। হয়তো আরেকবার ফোন করবে। প্রতুল রিসিভ না করলে ল্যান্ড-লাইনে ফোন করবে। শেষে স্কুটারে চেপে নিজেই হয়তো চলেই আসবে এ বাড়িতে। লোকটাকে গত দুমাস ধরে দেখছে ও। ওর চাকরিজীবনে সেই মারাত্মক ঘটনাটা ঘটে যাবার পর, অর্চনাই পরামর্শ দিয়েছিল সুভাষদাকে ধরতে। ফোন করে এবাড়িতে ডেকে নিয়ে এসেছিল অর্চনাই। আইনি পরামর্শ পেতে। এর আগে প্রতুল কখনও লোকটাকে দেখেনি, নামও শোনেনি। লোকটির কথাবার্তা শুনে প্রথমদিনই প্রতুল বুঝে গিয়েছিল উকিলের ছোঁয়া মানেই ছত্রিশ ঘা। শুধু পুলিশে ছুঁলে তাও হয়তো বাঁচতে পারত।

এপর্যন্ত ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করেছে ও। প্রথমে অ্যান্টিসিপেটরি বেল-এর জন্য আবেদন করেছিল লোকাল কোর্টে। সেই আবেদন নাচক করে দিয়েছে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট। এর বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আবেদন জানাতে হবে। সেই ব্যাবস্থাও পাকা করে ফেলেছে সুভাষদা। এখন কলকাতায় যাবে কেসটাকে মুভ করাতে। প্রতুল ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল ভস্মে ঘি ঢালা হচ্ছে। ও চাইছিল না হাইকোর্টে কেসটা মুভ করুক। কিন্তু সুভাষদা জোঁকের মতো ওর রক্ত খেয়েই চলেছে।

আশিস, নির্মল, কল্যাণ, টিকালাল কেউ উকিলের খপ্পরে পড়েনি, একমাত্র ও ছাড়া। ভয় তো সকলেরই ছিল, এখনও আছে। সকলেই আত্মীয়-বন্ধুদের চেনাজানা উকিলদের কাছ থেকে আইনি পরামর্শ নিয়েছে, কিন্তু জড়িয়ে পড়েনি। সবাই ভয়ে ভয়ে আছে, কী হয় কী হয়। ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারিতে নাকি প্রতিদিনই নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে।

যাদের জেল হাজত হয়েছে, ওদের কথা আলাদা। একজনের জায়গায় দুজন উকিল নিয়োগ করেছে কেউ কেউ। একের পর এক হেয়ারিং-এর ডেট পড়ছে, ম্যাজিস্ট্রেট আসছেন, রায় দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু জেল হাজত থেকে মুক্তি মিলছে না। স্থগিতাদেশ দিয়ে চলে যাচ্ছেন ম্যাজিস্ট্রেট। কখনও পুলিশের জোগাড় করা নথিপত্র যথেষ্ট নয়, কখনও জেলা আদালত থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানের ভিডিও রেকর্ডিং হাতে আসেনি– এইসব অজুহাতে একের পর ডেট পেরিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে। এখন জানা যাচ্ছে, সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত পার্টির বয়ান এখনও শেষ হয়নি, প্রতিদিন নাকি নতুন নতুন পার্টি আসছে, পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাচ্ছে। জেলা আদালতের নির্দেশে সেইসব ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের বয়ানের ভিডিও রেকর্ডিং হচ্ছে মহকুমা কোর্টে। জেল হাজত থেকে মুক্তি পেতে সেইসব বয়ান খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফলে কিছুতেই জামিন হচ্ছে না চারজনের। মূল জালিয়াত বৃন্দাবন মণ্ডল সহ তিনজন আধিকারিক। দুজন সহকারী ম্যানেজার, একজন হেড ক্যাশিয়ার।

ব্যাংকের এক কোটি সাত লাখ টাকার জালিয়াতির ঘটনায় সিনিয়ার ম্যানেজারসহ ব্রাঞ্চের তেরোজন স্টাফ, সবাই সাসপেন্ড হয়েছে। ঘটনার পর প্রায় তিন মাস হতে চলল। প্রতুলের কাছে এখনও মনে হয় সবটাই স্বপ্ন। চোখের সামনে দিনের পর দিন চার ফুট দশ ইঞ্চির রোগা-পটকা একটা ছেলে কাস্টমারের লক্ষ লক্ষ টাকা জালিয়াতি করে হজম করে ফেলল, ব্যাংকের কেউ কিচ্ছুটি টের পেল না! অসংখ্য কাস্টমারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে হাতে লেখা ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপ্ট দিয়েছে ছেলেটা, যথাযথ জায়গায় সই-সাবুদ করা রিসিপ্ট। মান্থলি ইনকাম স্কিম যাদের, তাদের অ্যাকাউন্টে মাসের প্রথমে নিয়মিত টাকা জমা পড়েছে। কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেনি।

দৈনিক একশো কুড়ি টাকা মজুরির অস্থায়ী কর্মী বৃন্দাবন দুবছরের মধ্যে কয়েকটি গাড়ির মালিক হবার পরেও কেউ কোনওরকম সন্দেহ করল না। প্রতুল সামান্য সিঙ্গল উইন্ডো অপারেটর। কাজ শেষ হলেই বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করত। কে কী করছে এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাত না। ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু যারা ব্যাংকের চার দেয়ালের মধ্যে বসে থেকে গাড়ির ব্যাবসা করে, শেয়ার বাজারে টাকা খাটায়, এমনকী ঠিকাদারি পর্যন্ত করে, তারা? বিকেল পাঁচটার পর যারা বোতল খুলে বসে, বৃন্দাবনকে দিয়ে কাজুবাদাম, ভুজিয়ার প্যাকেট আনায়, তারা? কারও মনে কোনও প্রশ্ন জাগল না?

বারান্দায় বসে প্রতুলের খুব মনে হয়, এরা সব কাকের দল। এ মার্ডার অব ক্রোস। ঠুকরে ঠুকরে মাংস খেল, ঠোঁট মুছে উড়ে পালাল। আর ভয়ংকর ধূর্ত সেইসব নেকড়ে আর শেয়ালের দল! ওরাই তো ব্যাংকের দণ্ডমুন্ডের কর্তা। জোনাল ম্যানেজার, চিফ অফিসার, এমনকী জেনারেল ম্যানেজার পর্যন্ত বৃন্দাবনের এসি গাড়িতে বিভিন্ন সময়ে টুর করেছে দিনের পর দিন। এয়ারপোর্টে গাড়ি পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে দার্জিলিং-গ্যাংটকে লাক্সারি হোটেল বুক করা সবটাই হতো বৃন্দাবনের সৌজন্যে। অত বড়ো মাপের কোনও অফিসার কেউ কখনও প্রশ্ন তোলেনি এই ছেলেটির আয়ের উৎস কী? বিলাসবহুল হোটেলে দামি খাদ্য-পানীয় ইত্যাদিতেই মজে থাকত। কেউ কখনও কোনও সন্দেহ করল না। অফিসে অডিটর এলে খাতা-পত্র এগিয়ে সামাল দিত বৃন্দাবনই। ‘বৃন্দাবনজি আপ’ বলে সম্বোধন করত জোনাল ম্যানেজার, প্রতুল নিজের কানে শুনেছে। তিন বছরের মাথায় বিশাল দুটি ফ্ল্যাটের মালিক। পরের বছর যাত্রীবাহী লাক্সারি বাস, নামে-বেনামে অসংখ্য জমির প্লট– এসব দেখেশুনে খোদ সিনিয়র ম্যানেজার পর্যন্ত বৃন্দাবনের সাথে সম্ভ্রমের সাথে কথা বলত। প্রতুল কিছুটা দূর থেকে এসব লক্ষ্য করত, কিন্তু কখনও ভেতরে ঢুকত না। এখন মনে হচ্ছে, প্রতুল সত্যিই ভীষণ বোকা, কমবুদ্ধির মানুষ।

বৃন্দাবনের ছুড়ে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খেয়ে শেয়াল-নেকড়ের দল মুখ মুছে ফেলল। ওদের দোষ দেখার তো কেউ নেই। অথচ ওরাই অফিসসুদ্ধ সবাইকে সাসপেন্ড করল। প্রতুলরাই নাকি বৃন্দাবনের সাথে মিলেমিশে ব্যাংকের টাকা জালিয়াতি করেছে। ভিজিলেন্স অফিসারের সাথে চিফ অফিসার যখন ইন্সপেকশান করছিলেন, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছিলেন কর্মীদের বাবা-মায়ের নাম তুলে।

গ্যারাজের একটা ছেলে সেদিন রাস্তায় প্রতুলকে দেখে জোরে জোরে বলছিল, ‘ওই যে লোকটা যাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ব্যাটা। এখন চাকরি গেলেই বা কী! কেমন গরুচোরের মতো মুখ করে চুপচাপ হাঁটছে লোকটা, দ্যাখ।’ প্রতুল বাজারে যাচ্ছিল সামান্য মাছ আর সবজি কিনতে। দুজন লোকের জন্য কতটুকুই আর বাজার লাগে। তবু সপ্তাহে একবার বাজারের জন্য বাড়ি থেকে বের হতেই হয়। কথাটা শুনে দপ করে মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। সেই রক্ত সহজে মাথা থেকে নামল না।

অর্চনা বলেছিল, ‘শরীর খারাপ লাগছে? ছাতা নিয়ে বাজারে যেতে পারো না? প্রেশার-সুগার চেক করিয়ে নেবে কাল-পরশু। এখন শুয়ে থাকো। একদম উঠবে না বিছানা থেকে।’

ওদের ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনাটা গোটা শহরে হইচই ফেলে দিয়েছিল। ওই ঘটনার পর থেকে সারাদিন বারান্দায় বসে, নয়তো শুয়েই দিন কাটছে ওর। সকালে খবরের কাগজ, বিকেলে অর্চনার সাথে বসে টিভি সিরিয়াল, নিউজ দেখা। এর বাইরে ওর কোনও কাজও নেই। অফিস কলিগদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়েছে বহুদিন। বিরাট একটা সামাজিক কলঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতা মাথায় নিয়ে ও ধীরে ধীরে একটা কেঁচোর মতো মাটির নীচে চলে যেতে চাইছিল। এই শহরেই ওর রক্তের সম্পর্কের মানুষ আছে তিনজন। ওদের বাড়ি যাওয়াও বন্ধ হয়েছে বহুদিন। অর্চনাকে বিয়ের পর থেকে।

থানা থেকে ফোন করে ওকে দেখা করতে বলেছিলেন আইসি। এমনিতে ও দুর্বল মনের মানুষ, থানা-পুলিশের নাম শুনলে ভয় পায়, ঝুটঝামেলার মধ্যে নিজেকে জড়াতে চায় না। ফোনটা পেয়ে ও কাঁপতে শুরু করল। অর্চনা বার-দুই বমি করে অজ্ঞান হয়ে গেল। সুভাষদা এসে পরিস্থিতি সামাল দিল। থানার ঝামেলাটা মিটতে না মিটতেই ব্যাংকের চার্জশিট এসে হাজির প্রতুলের নামে। অন্যদের একপাতা, নয়তো দুপাতা। প্রতুলের তিনপাতা। কাজে মারাত্মক গাফিলতি, নিয়ম বহির্ভূত লেনদেনে যুক্ত থাকা, মূল অভিযুক্ত বৃন্দাবনের সঙ্গে সরাসরি লক্ষাধিক টাকার লেনদেন– চার্জশিটে এরকম চব্বিশটা অভিযোগ আছে ওর নামে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওর নামে।

প্রতুল ভাবছিল এবার ও কী করবে? বাঁচার বোধহয় আর কোনও রাস্তা নেই। চাকরিটা গেলে ও খাবে কী? এত খারাপ কপাল কারও হয়? ছোটোবেলা থেকেই ও দেখছে, ওর পোড়া কপাল। পৈতৃক দোতলা বাড়ি ভাড়াটে দখল করে নিল। আর ও বছরের পর বছর ভাড়া বাড়িতে কাটিয়ে দিল। দুর্ভাগ্য নিয়েই বোধহয় ও জন্মেছিল। নইলে সুলেখার সাথে ওর বিয়েটাও কেন সুখের হল না। ষোলো বছর ঘর করার পরও, সুলেখা একটা সন্তানের জন্ম দিতে পারল না। শেষদিকে ওর দুটো কিডনিই খারাপ হয়ে গেছিল, চার মাস ডায়ালেসিস-এর পর মারা গেল। আর ও মারা যাবার পর যেন দুর্যোগের ঝড়টা সাইক্লোন হয়ে দেখা দিয়েছে।

সুলেখার মৃত্যুর বছর না ঘুরতেই ও আবার বিয়ে করে বসল। প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ির লোকজন, অফিস কলিগ, পাড়ার দুচারজন ছ্যা-ছ্যা করল। প্রতুল পাত্তা দিল না। অর্চনা মাধ্যমিক পাশ, শরীর-স্বাস্থ্য ভালো, বয়স ওর বয়সের প্রায় অর্ধেক। প্রতুল ভেবেছিল, সুলেখা ওকে যা দিতে পারেনি, অর্চনা সেটা পারবে। এবার নিশ্চয়ই একটা সন্তান আসবে। বিয়ের চার বছর হতে চলল। কিন্তু এখনও কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। দুবার ডাক্তার দেখিয়ে টেস্ট করা হয়েছে। অর্চনার কোনও গন্ডগোল নেই, সবকিছুই স্মুথ। তাহলে কি দোষটা ওর? নাকি ওর ভাগ্যের!

সুলেখা বেঁচে থাকতে এই নিয়ে কম তরজা হয়নি। সুলেখার বোন সুরেখা তো একদিন রীতিমতো ঝগড়ার ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘প্রতুলদা, দিদিকে দোষারোপ করার আগে, নিজের দোষটা দেখুন। ভুল ট্রিটমেন্ট আর ওষুধ খেয়ে খেয়ে দিদির শরীর এখন না-হয় ভেঙে গেছে। প্রথম থেকে আপনি যদি নিজের ট্রিটমেন্টটা করাতেন, তাহলে দিদিকে আজ ভুগতে হতো না।’

নিমের ডালে বসে দুটো কাক মন্থর গলায় ডাকছে, বো-কা-কা, বো-কা-কা। তাকিয়ে আছে প্রতুলের দিকেই। হদ্দ বোকা, অপদার্থ, অলস, ভীতু আর আর…? সুরেখা একদিন রেগে গিয়ে ওকে বলেছিল, ‘প্রতুলদা আপনি নিজের দোষ ঢাকতে দিদির ওপর অত্যাচার করছেন। শুধু ষাঁড়ের মতো উচিয়ে গেলেই হয় না। ভেতরে কিছু থাকতে হয়, বুঝলেন! নপুংসক একটা!’ আরও বোধহয় কিছু বলতে চেয়েছিল সুরেখা। সুলেখা ওকে থামিয়েছিল।

ইউনিয়ন চার্জশিটের সব অভিযোগের উত্তর লিখে দিয়েছে। কাগজপত্রের ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশন শেষ হতে লাগল তিন মাস। তারপর চলল স্ক্রুটিনি, ক্রস এক্সামিনেশন। কখনও ব্রাঞ্চে, কখনও জোনাল অফিসে ওকে ছুটতে হল। সঙ্গে ইউনিয়নের লিডার, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পরমেশ লাহিড়ি। কলকাতার লোক। এই করতেই বছর ঘুরে গেল। এখন অর্ধেক নয়, পুরো মাইনেটাই পাওয়া যাচ্ছে।

হেয়ারিং শেষ। পরমেশদা এবার কলকাতা ফিরবে। প্রতুল পরমেশদাকে একান্তে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আচ্ছা পরমেশদা, আমার বিরুদ্ধে এতগুলো মারাত্মক অভিযোগ, বাঁচার কোনও রাস্তা সত্যি আছে?’

‘ম্যানেজমেন্ট বৃন্দাবনের সাথে তোমার, তোমাদের ইনভলভমেন্টের অনেকগুলো প্রমাণ পেয়েছে। এতসব তুমি অস্বীকার করবে কী করে?’

‘কিন্তু, পরমেশদা, সত্যি বলছি, আপনি লোকাল লিডারদের কাছেও এর প্রমাণ পাবেন। অন্যদের সাথে বৃন্দাবনের যেমন ওঠাবসা ছিল, আমার সাথে কিছুই ছিল না। অন্যরা ওর গাড়ি ভাড়া নিয়ে ঘুরতে চলে যেত, টাকা ধার নিয়ে সময়মতো ফেরত দিত না, বৃন্দাবনের পয়সায় হোটেলে খেত। আমি কিন্তু কখনও ওর গাড়ি ভাড়া নিইনি, টাকাও ধার নিইনি।’

‘তার মানে এদের চোখে তুমি বোকা। সবাই তোমাকে ইউজ করেছে। বৃন্দাবনের সাথে তোমাদের স্টাফদের মধ্যে লেনদেনগুলো এমন হয়েছে যাতে পরিষ্কার ইউ আর ভেরি মাচ ইনভলভড। এনিওয়ে, এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না। এখানে একটা কথা তোমাকে বলি, ট্রেড ইউনিয়ন লড়াই করে, জিততেও পারে, হারতেও পারে। হারা-জেতাটাকে আমরা গুরুত্ব দিই না। গুরুত্ব দিলেই লড়াইটা থেমে যাবে। দরকার হলে আমরা আরও বড়ো আন্দোলনে যাব।’

রাধা-কৃষ্ণ এখনও ওর ছোট্ট বাগানে আসে বিস্কুট খেতে। কৃষ্ণের ডান-পাটা ভাঁজ হয় না, টেনে টেনে চলে। প্রতুলের মতো। ওদেরও হয়তো ছেলেমেয়ে নেই। ওদের জীবনে কি হারা-জেতা আছে? প্রতুল ভাবল, ওর চাকরিটা চলে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। চাকরিটা চলে গেলেও ও না খেয়ে মরবে না। কারণ পেনশন, গ্র্যাচুইটি নিশ্চয়ই পাবে। রেকারিং, ফিক্সড ডিপোজিটে বেশ কিছু টাকাও আছে। দুটো মানুষের আর কত চাই। দিব্যি ঘুরে ঘুরে বেড়াতে পারবে। রাধা-কৃষ্ণের মতো এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু সোশ্যাল স্টিগমা! কলঙ্কচিহ্ন মুছবে কেমন করে! পাখিদের সমাজে কি কলঙ্কচিহ্ন আছে! ডানা ঝাপটালেই সব ক্লেদ-কলঙ্কচিহ্ন ঝরে পড়বে না!

প্রতুল ভাবল, মানুষের সমাজ মানে কী? বৃন্দাবন মণ্ডল তিন মাস পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। ওর বিরুদ্ধে জালিয়াতি-প্রতারণা-সরকারি টাকা নয়ছয় সহ যতগুলি ভারী ভারী কেস ছিল সেগুলি এখন তুলোর মতো হালকা। প্রতুল শুনেছে, এজন্য বৃন্দাবন সাত লাখ টাকা ছড়িয়েছে। শকুন-কাকের দলে পাউরুটি ছুড়ে দেবার মতো– ওর উকিল, অখিল ঝা-র হাত দিয়ে। আন্ডার-লাইন পাইপের জলের মতো এই টাকা ছড়িয়েছে থানার ইন-চার্জ থেকে কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত। অথচ থানার এই ইন-চার্জ প্রতুলকে মুখোমুখি বসিয়ে ঠান্ডা গলায় কী সাংঘাতিক হুমকি দিয়েছিল সাত-আট মাস আগে।

বৃন্দাবন এখন লাইন-হোটেল খুলেছে বড়ো রাস্তার পাশে। মাত্র পনেরো কিলোমিটার দূরে। বেশ ভালো ব্যবস্থা। অনেক যুব-নেতা, পুলিশের ছোটোবাবু, মেজোবাবু সন্ধে নাগাদ এই লাইন-হোটেলে বসে খানা-পিনা করেন, কিছুটা সময় কাটান। বেশি রাতে নাকি একদুজন উর্বশী-অপ্সরা আসে সেখানে, বিনোদনের অঢেল আয়োজন। এছাড়া বিরাট এক স্টেশনারি দোকান খুলেছে বৃন্দাবন পাশের শহরে।

প্রতুল বুঝতে পারল, আমাদের সমাজটাও বেশ সুশৃঙ্খল, পাখিদের মতোই। কাক-শালিকদের রুটির টুকরো ছড়িয়ে দিলেই আর সমস্যা থাকে না। ওরা দুয়ারের সামনে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করে না, ছাদের মাথায় ঝামেলা করে না। পাড়ার সবচেয়ে মস্তান কুকুরটাও দুয়ারের সামনে পাহারা দেয়, যদি নিয়মিত দুবেলা এঁটো-কাঁটা পায়। বৃন্দাবন সুন্দর বুঝেছে এই সমাজ আর তার মানুষগুলোকে। তাই আজ ওর লাইন-হোটেলের রমরমা। এই কথাগুলো বুঝতে প্রতুলের অনেকসময় লেগে গেল।

কিন্তু ইউনিয়ন লিডার পরমেশ লাহিড়ি। সে তো এই গ্রহেরই মানুষ। পরমেশদা যা পারে, প্রতুল তার একাংশও পারে না কেন? ও একজন দুর্ভাগা লোক, হেরো লোক, এটাই কি একমাত্র কারণ? দুর্ভাগ্যের ভাবনাটা নিয়েই যে ও অনেকগুলি বছর কাটিয়ে দিল। শেষবারের মতো কলকাতা ফিরে যাবার আগে পরমেশদা ওকে কী বোঝাতে চেয়েছিল? হেরে-যাওয়াটাকে গুরুত্ব দিলে সব থেমে যাবে? কিন্তু ও তো লড়াইটা শুরুই করতে পারেনি।

সামাজিক কলঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতার বোধমুক্ত রাধা-কৃষ্ণ কীভাবে ওর ছোট্ট বাগান থেকে উড়াল দেয় কাল সকালে, দেখতে হবে মন দিয়ে।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...