কথা হচ্ছিল ঘুঘুডাঙার দিঘির পাড়ে প্রাচীন বটগাছের সিমেন্ট বাঁধানো চত্বরে বসে গুটি পাঁচেক মাতব্বরের মধ্যে। ঘুঘুডাঙা গাঁয়ে সনাতন হাজরা হ’ল গিয়ে লায়েক। গলা খাঁকারি দিয়ে সে-ই কথাটা পেড়েছিল। ওহে মেয়েমানুষ তো লয় চামার। দজ্জাল মেয়েছেলে। ধম্মকম্ম বলে কিস্যু নাই। গলা তুলে গাল পাড়া মন্দ কথা বলা, এর বাইরে…। বাকি কথাটা লুফে নিল ভজন সামন্ত, কিস্যু নাই কিস্যু নাই। দিনকাল বদল হইচে গো, নইলে এমন মেয়েছেলেকে গাঁয়ে রাখাও কাজের কথা নয়। অমনি বাকি তিনজন তালে তাল মেলাল। হরিহর সামন্ত, শুধু এক কদম এগিয়ে বলল, বাপটা আর সোয়ামিটা কী অমনি অমনি ধেনো খেয়ে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। সনাতন ঘুরে বলল, ওই ঘরজামাইটার কথা বলতিছ? ও তো ক্লীব, শ্বশুরের সম্পত্তির লোভে বউ-এর লাথিঝ্যাঁটা খায়। আর ওকে তাল দেয় বিষ্ণু হাজরা মানে শ্বশুরটা। হরিহর অমনি গলা তুলে বলল, সে গুড়ে বালি। ওই খান্ডারনি বউয়ের হাত থেকে সম্পত্তি গ’লে ওর হাতে যেতে যেতে মাধব মানে মেধো এমনিই অক্বা পেয়ে যাবে।

শীতের দুপুরে রোদ্দুর যেন পালাব পালাব করে। দিঘির ও’পারে তালবনে সুয্যি ঠাকুর জাল গুটোচ্ছে। সেদিক পানে চেয়ে থাকতে থাকতে সনাতন বলল, চল হে একটু পরেই হিম পড়বে। এই বুড়োবেলায় সব সইতে পারি হিম সইতে পারব না।

যাকে নিয়ে এত কথা সেই রজনি তখন সাঁঝের আকাশের দিকে চেয়ে গাল পাড়ছে, একবার ঘর এসো, মুখে নুড়ো জ্বেলে দেব। হাটে যাবার নাম করে সেই সকালে দুটিতে বেইরেছে, এতখানি বেলা পার হয়ে সুয্যি পাটে বসল, ফেরার নাম নেই। হেঁসেলের উনুনে দুটোকেই পুড়িয়ে মারব। গঙ্গাজলে ভাইস্যে দেব ওই বুড়োটাকে আর পোড়ামুখো জামাইটাকে। খিড়কির চৌকাঠে একটা ছায়া চুপিসারে ঢুকতে গিয়ে কেমন থমকে দাঁড়াল। রজনি আকাশমুখো, ভাগ্যিস। কে জানি রজনিকে বলেছিল, আকাশমুখো সব কথা বহু দূর তক্ শোনা যায়। ছায়া আরও এক পা রাখতেই খড়ের গাদার ওপর রাখা কাটারিটা টিউবওয়েলের বাঁধানো শানে পড়ে ঠনঝন শব্দ করে উঠল। সেদিক পানে চেয়ে রজনি তিরিক্ষি চেঁচিয়ে বলে উঠল, এসো ওই কাটারিতে তোমাদের টুকরো টুকরো করব।

ছায়া এবার ফুটফুটে চাঁদের আলোয় দাঁড়াল। বিষ্ণু হাজরা। একটু টাল খেয়েছিল। ধেনোটা বুকের ভেতর থেকে তখনও পেট অবধি নামেনি। এইসময় মেয়েটা এমন তেড়ে উঠল যে চমকে আবার পিছু হঠতে গিয়ে প্রায় কাটারিতে পা দিয়ে ফেলেছিল। সামলাতে গিয়ে টিউবওয়েল-এর হাতলটা ধরে ফেলল। রজনি খানিক থমকে গিয়ে আবার সুর তুলল, বলি ল্যাজটা কোথায়?

বিষ্ণু হাজরা অমনি যেন খানিক ফুরসত পেয়ে একরকম নীচু গলায় বলল, মেধো সেই কোন দুপুরে আমার সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে কোথায় যে গেল, বলল তো হাটে যাচ্ছি…।

কোথায় গড়াগড়ি দিচ্ছে? তুলে আনতে পাল্লে না? এবার তুমি এসো, তোমায় দেখি খানিক। মেয়ের রণচণ্ডী মূর্তি দেখে নেশা ছুটে গেছে বিষ্ণু হাজরার। মনে খানিকটা বল সঞ্চয় করে বলল, একটু ঠান্ডা হ মা। হাট তো এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। ঠিক ফিরে আসবে। তুই বরং উনুনে আঁচ দে। বিষ্ণু হাজরা মনে মনে আওড়াল, আঁচ দেবে কী, মেয়েটা তো নিজেই আঁচ হয়ে আছে।

তারপরেই মনে হ’ল, তাই তো ছোঁড়়াটা গেল কোথা! সে কী সত্যি-ই হাটে গেছে! ধেনোর ঠেকেও তো যায়নি। তাহ’লে!

মেধো তখন অনেক দূরে। আশমান গাঁ আর চাঁপাডাঙা ছাড়িয়ে ফুলটুসি গাঁয়ের মখমল বাজারের থেকে পোয়া মাইল দূরে এক সাধু আসন গেড়েছে। তাতেই লোক হামলে পড়েছে। সাধুর নাকি মোক্ষম দিব্যদৃষ্টি। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ– সব গড়গড়িয়ে বলতে পারে। এত ভিড়ের মধ্যে সাধুর নাগাল পাওয়া কঠিন। বেশ খানিক পিছনে দুটো থান ইটের ওপর দাঁড়িয়ে মেধো ঠাওর করতে চাইছে। এই সাধুর খবর সে পেয়েছিল তার ছেলেবেলার বন্ধু পঙ্কার কাছ থেকে। পঙ্কা বলেছিল, একবার গেলেই টের পাবি। স্বয়ং বিশ্বনাথের চ্যালা।

তোর যা দুঃখ, যা গিয়ে বল। কিছু একটা তো হবেই। ধেনো খেয়ে তো আর সাধুর কাছে আসা যায় না, তাই ধেনোর ঠেকে যাবার আগেই বাবা শ্বশুরকে বলেছে, হাটে যাচ্ছে। তবে ভেবেছিল সাধুর সঙ্গে দেখা করে বাজার থেকে আনাজপত্র কিনে ফিরবে। কিন্তু এত ভিড় ভাবনার বাইরে ছিল। ইতিউতি দাঁড়িয়ে কোনওভাবেই যেন তার দর্শন মেলে না। তেমন একটা গাছও নেই যার ওপর চড়ে সাধুর দর্শন পাওয়া যায়। অনেকে দূর দূর থেকে এসেছে। কারও মানত ফলেনি, কারও ব্যাবসা মন্দগতিক– হাজারও সমস্যা। পঙ্কা বলেছিল, সব তুড়ি মেরে সমাধান করে দেবে সাধুবাবা। অগত্যা বেশ খানিক দূরে মোটা গুঁড়ির একটা তেঁতুল গাছের আড়ালে বসে থাকে ঠায়। তাছাড়া সব কথা তো সবার মাঝে বলাও যায় না। কথাগুলো পেরাইভেট কিনা।

সন্ধের পর একটু একটু করে ফাঁকা হচ্ছে। ইয়াব্বড়ো একটা চাঁদ ফুলকো লুচির মতো আকাশে ফুটে উঠল। শাল্লা মশার ভনভন, পোকামাকড়, সাপও থাকতে পারে। তারমধ্যেই একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে। চোখদুটো রাবারের মতো চিপসে যাচ্ছে। তন্দ্রা তন্দ্রা ভাবটা একটু কাটতেই হঠাৎ কেউ কোথাও নেই। সাধু একলা বসে। বুক পর্যন্ত সাদা কাশফুলের মতো দাড়ি, কাঁধ থেকে বুক পিঠ পর্যন্ত নেমে এসেছে সাদা জটা। সাধু মহারাজ একটা কল্কেতে সুখটান দিতে দিতে চোখ বুজে আছে। ধুনির আলো আর চাঁদের আলোতে সাধুর পদ্মাসন থেকে পা দুটো খুলে ছড়িয়ে বসে থাকার কায়দাটা খুব চেনা ঠেকল। আরে ভুতোদা না! এই বসার ধরনটা এই গাঁ ছাড়িয়ে আরও দশ গাঁয়ের পর মেধোর জন্মভিটে হরিশপুরে কে না চেনে! আর ওই দাড়ি গোঁফের আড়ালে মুখটাও তো…! এইরকম আয়েশ করে বসতে আর কাউকেই জানে না মেধো। শুধু সে নয়, গাঁয়ের সব্বাই…।

হামাগুড়ি দিয়ে খানিকটা এগোতেই জলের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। ভুতোদা-ই তো। ভুতোদা বলে ফসকা গলায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠেছিল। কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিল। শুধু শুধু বেমক্বা সব কেঁচিয়ে দিলে হয় না। এখনও বাজারের লোক হয়তো সব ঘরমুখো হয়নি। কিন্তু ফসকে যাওয়া ওইটুকুতেই ভুতোদা এদিক-ওদিক চাইতে চাইতে চাপা গলায় বলল, কে কে বটে?

বুনো গাছগাছালির ওপর হামাগুড়ি দিতে গিয়ে হাঁটু দুটোর নুনছাল উঠে গিয়েছিল। জ্বালা করছে। তবু শেষবার চেষ্টার মতো করে শরীরটা একরকম ছুড়ে দিল মেধো।

আমি গো আমি। চিনতে পাচ্ছো ভুতোদা? আমি হলেম গে হরিশপুরের মাধব হুই। বাপের নাম কেষ্টচরণ হুই। মায়ের নাম…।

বলতে হবে না। তো এ তল্লাটে কি কচ্ছিস?

আমি হলেম গ্যে ঘুঘুডাঙা গাঁয়ে বিষ্ণু হাজরার ঘরজামাই গো।

ছ্যাঃ ঘরজামাই। পুরুষ মানুষের কলঙ্ক।

মেধো এবার গুছিয়ে বসে ঘনিষ্ট গলায় শুধাল, তুমি সাধু হলে কবে থেকে? বে থা করনি এ’কথা জানি। কিন্তু তাই বলে সাধু!

কল্কেতে টান দিয়ে খানিক ধোঁয়া উগরে দিয়ে ভুতো বলল, আমি হলেম ভূতানন্দ স্বামী। গৃহীর নাম সাধুর হয় না। তো বল তোর সমিস্যি কী।

সমিস্যি তো একটাই। বউটা বড়ো দজ্জাল। উঠতে বসতে গাল পাড়ে। আগে অমনটি ছেল না। ছেলেপুলে হ’লনি তো। তাতেই এমন তিরিক্ষি হয়ে গেল।

শুধু তোরেই গাল দেয়?

না গো ওর বাপটারেও দেয়। দোষের মধ্যি আমরা পুরুষ মানুষ তো বটে, একটু আধটু…।

কথা শেষ হবার আগেই ভুতো বলে, মেয়েছেলের দোষ আছে? মানে খারাপ বাড়িতে যাস নাকি? তা হ’লে তো…।

ছিঃ কী যে বলো। তুমি না সাধু। এই যেমন ধরো গিয়ে তুমি কল্কেতে টান দাও আর আমরা সারাদিন পরে একটু ধেনো খাই। সেটা কি খুউব দোষের?

দোষ? দোষ গুণের বিচার করার আমি কে রে। সবই ওই ওনার– বলে একটা হাত তুলে আকাশের দিকে তর্জনী তুলে দেখাল ভুতো। তোর ছেলেপুলে?

হয়নি। আর তার জন্যই তো এত গোল। হাকিম বদ্যিও কম হয়নি। তো ওই যে বললে না সবই তেনার ইচ্ছে। এবার গলাটা খাদে নামিয়ে বলল, দাও না।

কী? ছেলেপুলে?

না গো। ওতেও শান্তি হবে না। তোমার পায়ে ঠাঁই দাও। কথাটা বলে ভুতোর ছড়ানো পা দুটো ধরতে যাবে অমনি দ্রুত পা সরিয়ে নিয়ে ভুতো বলল, অত সোজা। সাধু হব বললেই সাধু হওয়া যায় নাকি? মেধো দ্বিতীয়বার শরীরটা ছুড়ে দিয়ে ভুতোর দুটো পা-ই ধরে ফেলল।

আঃ ছাড় ছাড়, সাধু হলে শ্বশুরের ভিটে জমি পুকুর এ’সব যে হাতছাড়া হয়ে যাবে রে।

হাতছাড়া হয়েই আছে ধরে রাখো। অমন দজ্জাল বউ না-মরা ইস্তক কিচ্ছুটি পাবার যো নেই। সংসারে ঘেন্না ধরে গেছে। তারপর আর একটু এগিয়ে ভুতোর পায়ের পাতা থেকে হাঁটু অবধি দলাই মলাই করতে করতে মেধো কেমন যেন আবেশ বিভোর গলায় বলল, তোমার সেবা করব। আমারে দীক্ষে দাও।

সেবা করবি? তা হ’লে কর। কল্কেটা একটু সাজিয়ে দে। বাবা বিশ্বেশ্বর কী বলেন দেখি। মেধো অমনি হাত বাড়িয়ে কল্কেটা নিল।

দু’টান মারতেই ভুতোর কেমন ফুরফুরে উদার হয়ে গেল মনটা। তোকে আমার চ্যালা করে দিলাম যাঃ। ক’দিন এ’ধার ও’ধার আমার সঙ্গে ঘুরে দেখ, তারপর না হয় দেখা যাবে। সংসারের এঁটেল মাটি গা থেকে আগে খসুক, দীক্ষা হবে।

মেধো গদগদ গলায় বলল, হবে বইলছ। তাইলে এট্টু পেসাদ…। ভুতো কল্কেটা বাড়িয়ে দিল। মেধো চোখ বুজে এক দমে খানিক টেনে বুকের মধ্যে ধরে রেখে তারপর ধোঁয়া ছাড়ল। ব্যাস হয়ে গেল, পাপ তাপ সব ছাড়িয়ে ভেতরটা কেমন যেন উদাস বাউল পারা। কোথায় পড়ে রইল রজনি, জমি জমা ভিটে– সব কেমন শূন্যে মিলিয়ে গেল। শুধু ধোঁয়ার কুন্ডলীর ভেতর যেটুকু দেখা যায়, ভূতানন্দ স্বামী।

দুই

রাতে ঘুম হয় না বিষ্ণু হাজরার। ঘোলাটে চোখ দুটো পেঁয়াজের পাতলা খোসার মতো যেন ভাসছে। ছেলেটা যে কর্পূরের মতো উবে গেল। আকাশপটে বাসি কদমফুলের মতো তখন শুকতারাটা ফুটেছে। আপন মনে বিড়বিড় করে বিষ্ণু হাজরা, তোমায় বইলছি তো সব তোমার নামে নেকাপড়া করি দিব, তা বুঝি বিশ্বাস হ’লনি। তোমার হলি তো মেয়েটারও হ’ল নাকি! তারপরেই মনে হ’ল বেবাক কোথাও নেশার ঘোরে পড়ে নেই তো! তবে নেশার ঠেকগুলো তো এ’কদিন ঘুরে দেখে নিয়েছে। তো সে কোথায়! তাহ’লে কী…! বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে।

পাশের ঘরে শুয়ে অমনি এ’পাশ ও’পাশ করে জেগে আছে রজনি। মানুষটা গেল কোথা! যা গাঁয়ের ছিরি ফুঁসলিয়ে নিয়ে গেল না তো! কথাটা মনে হতেই ধড়মড় করে উঠে কপাট খুলে দাঁড়ায়। আকাশে চাঁদ ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছে। জ্যোৎস্না গলে গলে পড়ছে উঠোনের মাটিতে। রাগে জ্বলে ওঠে রজনি, রঙ্গ হচ্ছে! তামাশা! তারপরেই কেমন যেন ভেঙে পড়ল, কোথায় খুঁজবে মানুষটাকে। বাপটা কি ঘুমে নিঃসাড়, না তারই মতো…! ভেতরের কপাট আবজানই ছিল।

পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছ? ভাবো কি আমি তোমায় ছাড়ি দিব? মানুষটাকে কোথায় রাখি এয়েচ? দিনরাত মদ গিলেও শান্তি হয়নি? শেষে বেচি দিলে মানুষটারে! বিষ্ণু হাজরা হাতের মুদ্রায় জানান দেয়, সে জানে না। এমন কাণ্ড কোনও বাপে করতি পারে!

তারপরেও সব যেমন চলছিল তেমনি সব ঠিকঠাক। সকালের প্রথম রোদ্দুর উঠোনে চুঁয়ে পড়েছে। রজনি তখন কোমরে আঁচল গুঁজে অন্য মূর্তি। পারলে রাঙা রোদ্দুর ঝাঁটা দিয়ে উপড়ে ফেলে। বিষ্ণু হাজরা এক পা দু’পা করে খানিকটা এগোতেই রজনি রণং দেহী ভঙ্গিতে সামনে এসে দাঁড়াল, ভেবেছ কী? ওই আবাগির ব্যাটার সঙ্গে খালাস হই যাতি পাল্লে না। হাড় জুড়োত।

আঃ, আমি কী তার জানি! আমায় কি বলেকয়ে গেছে?

এমনি এমনি হাওয়ায় গায়েব হয়ে গেল? কেমন করে ভূত ছাড়াতি হয় তোমাদের আমার জানা আছে।

তারে খুঁজতি গেলেও তো যাতি হয়।

তো যাও। সঙের মতো দাঁইড়ে না থেকে খুঁজি আনো। মানুষটারে না নিয়ে ফিরলি তোমার একদিন কি আমার একদিন।

চিন্তায় বিষ্ণু হাজরার ভ্রূ কুঁচকে ওঠে, বাগদিপাড়া, দুলেপাড়া, মালাপাড়া কোনওটাতেই তো বাদ দেয়নি। তাহ’লে! মাথা নাড়তে নাড়তে বিষ্ণু হাজরা বেরিয়ে যেতেই ভজন সামন্তের ছোটো ছেলে পটলা হাঁফাতে হাঁফাতে হাজির। সববনাশ হই গ্যাছে। গাঁয়ের কে যেন দেখেছে, মানুষটা এক সাধুবাবার সঙ্গে বাঁকা নদী পার হয়ে কোথায় যেন…!

তা কেউ বারণ করলে না?

বারণ করবে কিগো। সাধুবাবা যে তখন বাণ মারিছে। সব বেবাক দাঁইড়্যে…!

রজনির মুখ থেকে কথা সরে না। কোথা গেল মানুষটা! কতদূর!

বিষ্ণু হাজরা ফিরল বেশ খানিক রাতে। সারাদিন খুঁজে বেরিয়েছে। একে তাকে জিগ্যেস করেছে। ফুলটুসি গাঁয়ের কয়েকজন অবশ্য সাধুর কথা বলেছে। কিন্তু তাতে কি হদিস মেলে! দু’একজন হেসে তামাশা করে বলেছে, তা তোমরা বাপ-বেটি মিলি মানুষটারে খেদানোর ভালো কল ঠাউরেছ তো! এখন হাপিত্যেস করার যাত্রা নাই বা করলে। বিষ্ণু হাজরা কোনও উত্তর দেয়নি। কী-ই বা উত্তর দেবে!

ঘরে ফিরতেই রজনির সামনাসামনি। পাল্লে না সাধুটারে পুঁতি রাখতি? ভণ্ড আমার সংসারটারে তুক করিছে, আর তুমি বেবাক ঘরে ফিরলে? যাও না কেনে বাঁকা নদী পার হই তারে খুঁজে আনতি।

বিষ্ণু হাজরা চুপচাপ দাওয়ায় মাদুর পেতে শুয়ে পড়ল। মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছে। এত শোক কি ও সইতে পারে! বাইরের কপাট ধরে তখনও রজনি দাঁড়িয়ে।

পরের দিন পুলিশ চৌকিতে হাজির বাপ-বেটি। সব শুনে বড়োবাবু হাসল, তো আমি কী করব। জামাই পালিয়েছে নিজের ইচ্ছেয়। নিজের ইচ্ছেয় সংসার ত্যাগ করেছে, তো আমি কী করব? এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল, হঠাৎ জ্বলে উঠল রজনি, তাই তো পুলিশ তো হাবাগোবা, শুধু ঘুষ নিবে, সাধুকে জেলে পুরবে আর চোরকে ছেড়ে দিবে। বড়োবাবু হুঙ্কার দিয়ে বলল, খবরদার মুখ সামলে।

চোপ, বিষ নেই তো কুলোপানা চক্বর। ঝাঁটা মারি অমন আবাগির ব্যাটাকে।

হনহন করে বেরিয়ে এল রজনি, বাপটা পেছু পেছু একরকম ছুটতে ছুটতে পাঞ্চেত বিডিও আপিস ঘুরেও কোথাও কোনও হদিস পেল না।

ঘরে ফিরে রজনি কেমন যেন থিতিয়ে গেল। চুপ করে দাওয়ায় খুঁটি ধরে বসে রইল।

তিন

এতসব কাণ্ড যখন তখন হর-কী পাউরির ঘাটে বসে কল্ কল্ জল দেখছে মেধো। পাশে বসে গুরু ভূতানন্দ স্বামী। দীক্ষান্তে মেধো এখন তার চ্যালা।

কেমন লাগছে তোর?

ভালোই, তবে…।

কী তবে?

নিরামিষ এত ভাল্লাগে না।

এ তো দেবস্থান। এ’সব কথা বলাও পাপ। এরপর তো তোর গেরুয়া বসন হবে।

ও যখন হবে, হবে। তাই বলে…।

চুপ করে থাকে ভূতানন্দ। চোখ বুজে মনে মনে বলে, সংসারের গন্ধ গা থেকে খসতে তো সময় লাগবেই। মুখে বলল, তাঁর ভজনা কর। তিনিই পথ দেখাবেন।

শাল্লা ঠিক সেইসময়-ই দজ্জাল বউটার কথা মনে হ’ল। বউটার জন্য কেমন যেন দুঃখ হচ্ছে। কেন হচ্ছে এমনটা! এমনটা কি সবার হয়! সংসার কি এমনিই পেছন থেকে টানে! কথাগুলো শুধোতে গিয়েও শুধোল না। শুধোলে তো সেই ওপরের ওনাকেই দেখিয়ে দেবে ভুতোদা, থুরি ভূতানন্দ।

তারপর কংখল। মা আনন্দময়ীর আশ্রম। ভজন, গীত, স্তোত্র, খাওয়া বলতে মালসায় খিচুড়ি ভোগ। বাকি সময়টা মাধুকরী– ভিক্ষে চেয়ে পেট ভরা। শাল্লা পেট চটকে ঠাকুর ঠাকুর। নিকুচি করেছে ঠাকুরের। একবার মনে হয়েছিল ফিরে যায় গাঁয়ে। অমনি মনে হ’ল রজনির কথা। যা খান্ডারনি হাত-পা ভেঙে নুলো করে দেবে। শাল্লা জলে কুমির তো ডাঙায় বাঘ। মাঝেমধ্যে কোনও গাঁয়ে গিয়ে আসন পাতলেও তো হয়। কলাটা মুলোটা ফলটা কম তো হয় না।

চাঁদ দেখছিল ভূতানন্দ। মেধো শুধিয়েই ফেলল, কবে যাবে?

কোথায়?

এই কোনও গাঁয়ে।

বোশেখের আগে নয়। তার আগে এলাহাবাদ। মাঘী স্নান।

মাঘী স্নান!

সারা মাঘ মাস স্নান চলবে আর ঠাকুরের নাম সংকীর্তন সঙ্গে মাধুকরী।

এই হয়েছে এক গেরো। দুটো কথা সহ্য করে গাঁয়ে থাকলে ভালো হতো। ভূতানন্দ ওর দিকে ফিরে চাইল। তারপর গুনগুন করে গেয়ে উঠল, পাগলা মনটারে তুই বাঁধ…। ঝুলি থেকে একটা কল্কে বের করে বলল, নে সাজ তো।

দুটো টান দিতেই গুরু খুশ্ তো চ্যালা খুশ্।

চার

সময় যেন ডাকহরকরা। নিদানের চিঠি তার হাতে ধরা। কখনও বা সে গাঁয়ের চপলা শ্যামলাবরণ মেয়ে। ঘণ্টা বাজে দ্বিতীয় প্রহর থেকে তৃতীয় প্রহর।

শূন্য ঘরে রজনি একা। তার শরীরেও সময় কখন গুটিগুটি প্রবেশ করেছে। গত বিশ বছরের জোয়াল এখন তার কাঁধে। বিষ্ণু হাজরা দেহ রেখেছে তা-ও দশ বছর পার। আনমনা বসে থাকতে থাকতে শোনে কোথায় যেন কোনও বৈরাগী গান ধরেছে, এ জীবন নদীর পারা যতই ভাবো যায় না ধরা। হবে হয় তো। শূন্য ঝাঁপি শূন্যই থেকে যায়, কেউ তো এক আনিও দিল না।

রাত্রে মোহন এল। মোহন রজনির জ্যাঠতুতো ভাইয়ের ছেলে। বলল, পিসি হয় না।

কী হয় না?

খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা যায়? যায় না। সব ধম্মস্থানই তো খুঁজলে, পেলে?

রজনি মোহনের দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বলল, হয় কী না হয় সে আমি বুঝব। তোকে যেতে হবে না।

আমি কি তা-ই বলেছি?

গেলে যাবি না গেলে যাবি না। কারও জন্য কিছু…। এই যে একটা গোটা মানুষ হারিয়ে গেল তার জন্য…! রজনি থেমে গেল।

তারপর শুধু চলা আর চলা। কখনও হূষিকেশ কখনও এলাহাবাদ আবার কখনও মথুরা। কোথাও নেই। রুদ্রপ্রয়াগ। মন্দিরে গান হচ্ছে, হ্যায় জীবন কি নৈয়া তুমহারে হাওয়ালে, জিধার চাহো হম কো উধর লে চলো তুম। গানের সুর, নদীর আবিরগোলা জল– সব একাকার।

মোহন পিছন থেকে ডাকল, পিসি। রজনি সাড়া দিল না। ও তখন অনেক দূরে। মানুষ হারিয়ে যাবার সুলুক সন্ধান যেন এখন ও জানে। মোহন বলল, যাবে পিসি?

কোথায়?

সাধুভান্ডারা। ভক্তের ভোগ দান সাধু বিলিয়ে দেবে সবার মধ্যে। যাবে? রজনি অস্ফুটে বলল, যাব।

সার বেধে ভক্তের দল। ডিমের কুসুমের মতো সূর্য তখন পুব আকাশে। পিসি-ভাইপো সেই সারে দাঁড়িয়ে। একজন একজন করে এগিয়ে যাচ্ছে। ধীর পায়ে রজনি এগিয়ে এসেছে। এক ব্রহ্মচারী। শ্বেত শুভ্র বসনের সঙ্গে পক্ব কেশ শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখমন্ডলী একাকার। চোখদুটো যেন দূর পারের কান্ডারি। তন্ময় হয়ে দেখছে রজনি। চেনা মুখটা কত যেন অচেনা। মনে মনেই বলল, কে তুমি?

একেবারে সামনে এসে দাঁড়াল রজনি। করজোড়ে আঁচলের কাপড় গলায় জড়িয়ে প্রণতভঙ্গিতে রজনি মাথা নীচু করল। ব্রহ্মচারী কেঁপে উঠল। অস্থির এক ভাব। হাত তুলতে গিয়েও যেন থমকে গেল।

দেব দর্শন। রজনি মনে মনেই বলল, তোমায় মুক্তি দিলাম ঠাকুর। মোহন কিছুই টের পায়নি।

বিহান তখনও ফুটেছে কী ফোটেনি। ব্রহ্মচারী এসে দাঁড়িয়েছেন মন্দির লাগোয়া ধরমশালার দোরগোড়ায়। কেয়ারটেকার বাবুটি আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে সব শুনে বলল, উ লোগ তো চলা গিয়া।

অস্পষ্ট অন্ধকারে ব্রহ্মচারী দাঁড়ালেন নদীর সঙ্গমস্থলে। পুব পাড়ে তখন সূর্য ওঠার প্রস্ততিপর্ব। দু’হাত বুকের ওপর প্রণামের ভঙ্গিতে রেখে তিনি মন্ত্র উচ্চারণের মতো বললেন, এবার গেরুয়া বসনের অধিকার দাও হে প্রভু।

অন্তরালে স্বামী ভূতানন্দ হয়তো হাসলেন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...