দোতলার ঝুল বারান্দা থেকে দৃশ্যটা দেখে মামির চক্ষু ছানাবড়া!

– এই হাঁদারাম, কী করছিস, কী করছিস– বলতে বলতে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসেন। তারপর কান ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে ঋজুকে ড্রয়িংরুমে মামার কাছে নিয়ে গিয়ে ঝাঁঝের সঙ্গে বলেন– এই শুনছ, দ্যাখো, একে নিয়ে তো আর পারা যায় না।

– কী, করেছে কী গর্দভটা?

– আর করেছে! শোনো, পুজোর নতুন শার্ট প্যান্টটা একটা ভিখিরি ছেলেকে… সঙ্গে আবার ফ্রিজ খুলে মিষ্টির প্যাকেটটাও!

মামা গর্জে ওঠেন– সে কী! এভাবে দানছত্র করতে কে বলেছে?

ঋজুর কাঁদো কাঁদো স্বর– ও যে চাইল মামা!

গালে এক চড় বসিয়ে চিৎকার করে বলেন– চাইলেই দিতে হবে, অপদার্থ কোথাকার! ক্ষমতা কতটুকু বুঝতে হবে না! এখন যদি কেউ কেঁদে কেটে আমার কাছে বাড়িটা চায়, আমি কি দিতে পারব?

তোতলাতে তোতলাতে ঋজু বলে– না মানে… আমার তো পুরোনো দুটো আছে কিন্তু ওর তো একটাও নেই!

চোখ পাকিয়ে মামা বলেন– খবরদার! আর যেন এরকম না শুনি! ওর কাছে নেই, তুই কি দেখে এসেছিস? এক্বেবারে রাম বোকা! ছোটো ভাইটাকে দেখেও শেখে না! ভাগ এখান থেকে। মনে রাখবি নিজে যখন উপার্জন করবি, তখন যতখুশি দানছত্র করবি। কিন্তু এখন নয়।

আপনমনে গজগজ করেন মামা– হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সংসার ঠেলতে হচ্ছে। তার ওপর আবার দানছত্র করে পুণ্য অর্জন করা! যত্তসব…!

মামি পিঠে দুটো কিল দিয়ে বলেন– আর যদি কোনওদিন এরকম কিছু দেখি, তবে ওদের সঙ্গে তোকেও বাইরে পাঠিয়ে দেব। ঋজু দু’হাতে চোখ মুছতে মুছতে নিজের ঘরের দিকে চলে যায়।

জন্মলগ্নে মাকে হারিয়েছে ঋজু। তার বছর খানেক ঘুরতে না ঘুরতে এক দুর্ঘটনায় বাবাকেও। এই মামা ছাড়া সাতকুলে আর কেউ নেই। মামা নিজে এক ছোটো কারখানায় ছোটো কর্মী মাত্র। বাড়িটা পৈত্রিক সূত্রে। তিনজনের সংসার মামা মামি আর তাদের একমাত্র সন্তান সানু। ভালো নাম সান্নিধ্য। ঋজুর চেয়ে বছর দুইয়ের ছোটো। সব্বার স্নেহ ভালোবাসার সান্নিধ্যে তিলতিল করে বড়ো হয়ে ওঠা বুদ্ধিমান মেধাবী সান্নিধ্য। ঋজু এ’বাড়িতে পরগাছা। পান থেকে চুন খসলে কপালে জোটে কিল চড় ঘুসি। পোশাকি নাম সমৃদ্ধ। অনেক শখ করে বাবা তাঁদের ছোট্ট সংসারের নতুন অতিথির নাম রেখেছিলেন সমৃদ্ধ। আজ কপালগুণে সেই সমৃদ্ধ সব খুইয়ে এ বাড়ির একটা বাড়তি বোঝা।

কালের নিয়মে একসময় বড়ো হয়ে ওঠে সমৃদ্ধ। তবুও খুব সাদাসিধে। আলাভোলা। পরীক্ষার রেজাল্ট বরাবর-ই কোনওক্রমে, টেনেটুনে। এদিকে প্রায় প্রতি ক্লাসে প্রথম দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে সান্নিধ্য এখন ভালো নামজাদা কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আর দু’বেলা সানুর সঙ্গে তুলনার খোঁচা খেতে খেতে একসময় নিজের পায়ে দাঁড়াবার চেষ্টায় ব্যস্ত ঋজু। যদিও মামা-মামি একটা ব্যাপারে একমত যে, এই ছেলে কোনওদিন ভালো কিছু করতে পারবে না। এত ভুলো মনের, হাবাগোবা ছেলের দ্বারা বড়ো কিছু অসম্ভব। এব্যাপারে হয়তো শত্রু মিত্র সব্বাই একমত। মামা মাঝে মাঝে দুঃখ করে বলেন– হঠাৎ যদি আমার মৃত্যু হয়, ঋজুটাকে কে দেখবে?

মামি সায় দেন– আমিও তাই ভাবি, ভবিষ্যতে এই ছেলের কী হবে? আমাদের মৃত্যুর পর এটা সানুর বোঝা হয়ে থাকবে না তো?

মামার গম্ভীর স্বর– মস্তিষ্কের বিশেষ কোনও কোশ বা অনুকোশ অকেজো হয়ে পড়লে, এরকম হয় হয়তো। মামি বলে ওঠেন– কাজ তো করে একটা প্লাস্টিক কারখানায় কিন্তু সেখানেও ক’দিন করতে পারবে কে জানে! মাধ্যমিকের যা রেজাল্ট! উচ্চমাধ্যমিকে পি ডিভিশন ছিল বলে রক্ষে, নইলে…। পাস কোর্সে বি.এ। তা-ও কোনওক্রমে। মামা একটা ছোট্ট স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলেন– যাক তবু তো গ্র্যাজুয়েট।

মামি আবার গজগজ করে ওঠেন– জানো আজও কারখানায় বেরোবার মুখে টিফিন কৌটো নিতে ভুলে গেল! সব গুছিয়ে এলাম, তবুও…! কী যে হবে এর!

মামাও সুর মিলিয়ে বলে ওঠেন– হ্যাঁ, আমিও লক্ষ্য করেছি, দিন দিন যেন এটা বেড়ে যাচ্ছে। এই তো রোববার সকালে দোকানে পাঠালাম একটা ব্লেড আনতে, আর ছেলে কিনা একটা পাউরুটি নিয়ে হাজির। সত্যি ভাবনার বিষয়! মামি আবার বলেন– আর বলো কেন, গত পরশু সানুটার জন্মদিন ছিল, তাই ঋজুকে বললাম, একটু তাড়াতাড়ি কারখানা থেকে ফিরতে, বলেও গেল তাড়াতাড়ি ফিরবে অথচ বেমালুম ভুলে ফিরল সেই রাত দশটায়। এমন ছেলে দেখিনি বাবা! না লাগে হোমে, না লাগে যজ্ঞে।

কারখানায় ক’দিন ধরেই ঝামেলা চলছে। একটা জরুরি ফাইল খুঁজে পাচ্ছে না ঋজু। অথচ গত তিনদিন আগেই দত্ত সাহেব ফাইলটা ওর হাতে দিয়ে বলেছিল– এটা খুব জরুরি। নেক্সট ফ্রাইডে ফ্যাক্টরির বোর্ড মিটিং। অর্ডারটা বড়ো সাহেবকে দিয়ে তখন স্যাংশন করিয়ে নিতে হবে। এটা রাখুন। কাল আমাকে দিয়ে দেবেন। এর আগেও দত্ত সাহেব অনেক জরুরি ফাইল ঋজুর হাতে তুলে দিয়েছেন। ঋজুও সততার সঙ্গে দায়িত্ব নিয়ে, সেই দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছে। কোথাও কোনওরকম ভুল হয়নি। বরং ওর সততা আর দায়িত্ববোধকে সব্বাই বেশ তারিফ করেছেন।

অথচ পরশু দিনের ফাইলটা ওর কাছ থেকে বেমালুম লোপাট হয়ে গেল! এটা কী ওর মনের ভুল না কাজের গাফিলতি? নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দেয়– নাহ্, এটা মোটেই ওর গাফিলতি নয়। কারখানায় এসে কাজে কখনও ফাঁকি দেয় না সে। ফাইলটা নিয়ে, সেটা যত্ন করেই রেখেছিল, তবুও…! চারদিক তন্নতন্ন করে খোঁজা হ’ল। কোথাও নেই…! সেই থেকে কারখানার দত্তসাহেবের কাছে দু’চক্ষের বিষ হয়ে উঠল। এদিকে ওর এক সহকর্মী কমল, নিজের দুঃখ দুর্দশার কথা ওর কাছে সাতকাহন করে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলে ওর মাইনের পুরো টাকাটা নিয়ে কারখানা ছেড়ে কেটে পড়ল। বাড়িতে মামা মামির কাছে কী কৈফিয়ত দেবে ভেবে পায় না ঋজু। মামির বাক্যবাণে প্রাণ ওষ্ঠাগত। ঘরে বাইরে কেমন যেন কোণঠাসা অবস্থা। আপন মনে বিড়বিড় করে ঋজু– ধ্যুস, কিচ্ছু ভাল্লাগে না। কী যে করি! কোথায় যে যাই!

মামি মুখ ঝামটা দিয়ে বলেন– এত বোকা, পৃথিবীতে দু’টো নেই। মামা শুধরে দিয়ে বলেন– না না বোকা নয় ঋজু। তবে খুব নরম মনের ছেলে। কারও দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারে না। মামি আবার চড়া গলায় বলেন– ওই একই হ’ল। নির্বোধ যারা তাদেরই মন নরম হয়, ওসব নরম-ই বলো আর সরল-ই বলো সব এক-ই। নইলে এই তো দু’দিন আগে, পল্টু নামে কারখানার এক ছেলেকে নিজের টিফিন খাইয়ে নিজে সারাদিন ঢোক ঢোক করে জল গিলে রাতে বাড়ি ফিরল। সে নাকি টিফিন আনেনি, খিদেতে ছটফট করছিল তাই…। এমন বোকা কেউ দেখেছে!

মনে মনে ভাবে ঋজু– আর আজ? আজও ভুল হয়ে গেল আবার। মুহূর্তের অন্যমনস্কতায় ফেরার পথে, চেনা ট্রেন ছেড়ে অচেনা ট্রেনে উঠে পড়ল। প্রায় প্রতি রোববার-ই এদিক-ওদিক বেরোয় সমৃদ্ধ। বাড়িতে মন বসে না। মামা-মামির তির্যক কথার চোটে এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়। তাছাড়া সান্নিধ্যটাও হয়েছে সে’রকম। কেবল পড়ার বই-এ মুখ গুঁজে বসে থাকা, আর কেরিয়ার তৈরি করা– এর বাইরে দুনিয়াটা যেন নিরস গদ্যময়।

ধ্যুস কিস্যু ভাল্লাগে না। যেদিকে চোখ যায়, চলে যেতে ইচ্ছে করে সমৃদ্ধের। তাই ফেরার তেমন তাগিদও ছিল না। যাবে শিয়ালদা চলে গেল সোদপুর। ভিড় ঠেলে স্টেশনে নামতেই টনক নড়ল। কোথা থেকে এক সুন্দরী মেয়ে সামনে এসে, একমুখ হাসি নিয়ে বলল– এই তো শান্তনু কোথায় ছিলে এতদিন! চলো চলো আমার সঙ্গে এসো, যেতে যেতে সব শুনব।

ঋজুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে টানতে টানতে সামনের দিকে নিয়ে চলে। ঋজু যখন দিশেহারা, আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছে, মেয়েটি তখন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে, ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে, ঠেলে নিয়ে চলল। কিছুটা গিয়ে একটু থেমে মেয়েটা বলে– হাঁদারামের মতো অমন করে কী দেখছ? আমাকে চিনতে পারছ না, মনে হচ্ছে? আর অভিনয় কোরো না। ধরা পড়ে গেছ। এবার লক্ষ্মী ছেলের মতো চলো তো।

দিশেহারা মন নিয়েও, স্মৃতি হাতড়াবার চেষ্টা করল সমৃদ্ধ। কিন্তু না। চিনতে পারল না। ফলে মনে উঠল দ্বিধা আর সংশয়ের দোলাচল। আপনমনেই প্রশ্নের ঝড় উঠল একসময়– খারাপ মেয়ে নয়তো? রাত তো বেশ হয়েছে। শীতের রাত। চারদিক সুনশান। ঋজু ক্রমশ মেয়েটিকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল। কিন্তু ততক্ষণে মেয়েটি রিকশা ডেকে, নিজে আগে উঠে, হাত ধরে সমৃদ্ধকেও রিকশায় ওঠার জন্য টানাটানি শুরু করে। আশেপাশের কয়েকজন রিকশাওয়ালা, অটোওয়ালা এসে ভিড় জমায়। অগত্যা একসময় সিন-ক্রিয়েটের ভয়ে রিকশায় উঠে বসে ঋজু। কিন্তু মেয়েটিকে সত্যি সত্যি চিনতে পারে না। অথচ আসতে বাধ্য হল। মেয়েটি যেভাবে জড়িয়ে ধরেছে, হাত ধরে টানছে, তাতে গভীর অন্তরঙ্গতা ফুটে ওঠে। প্রতিবাদের ভাষা থাকে না। তাছাড়া প্রতিবাদ করতে গেলে হয়তো মেয়েটি তর্কাতর্কি শুরু করবে, পরে হয়তো কান্নাকাটিও জুড়ে দেবে। লোক জড়ো হবে– এই ভয়েও ঋজু শেষ পর্যন্ত বেশি কথা বলে না।

সমৃদ্ধ তবুও একসময় প্রতিবাদের গলায় মিনমিনিয়ে বলে– দেখুন আপনি বোধহয় কোথাও ভুল করছেন।

– ভুল! না না আমি কোনও ভুল করছি না। তবে মাত্র সাত বছরে তুমি আমাকে ভুলে গেলে? এ-ও কি সম্ভব? আমাদের এত বছরের সম্পর্ক! তবে চিরদিন-ই তুমি ভুলো মনের, হাঁদারাম। এখন-ও সেরকম-ই আছো। কোনও পরিবর্তন নেই। কথা না বলে, মুখ বুজে চলো তো!

এই মুহূর্তে সমৃদ্ধের মনে হল কে যেন তাকে মাদক খাইয়ে বেহুঁশ করে দিয়েছে। হাত পা কেমন যেন আলগা আলগা লাগছে। শরীরটা অবশ। মামা-মামি, ঘরবাড়ি, সব যেন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। শরীরে শরীর ছুঁয়ে ওরা যখন রিকশায় পাশাপাশি বসল, সমৃদ্ধের মন তখন আরও বেশি অসাড়। এই প্রথম একজন অল্পবয়সি মেয়ের ছোঁয়া। মনে ওঠে সাত সমুদ্রের ঢেউ। অনেকটা পথ যাবার পর আমতা আমতা করে বলে সমৃদ্ধ– আচ্ছা আমরা কোথায় চলেছি…?

মেয়েটি হেসে ওঠে ওর প্রশ্ন শুনে। এই হাসির মধ্যে আর যাই হোক, কিন্তু ছলনা নেই। এ যেন বিশ্বজয়ের আনন্দে গর্বিত হাসি। হাসতে হাসতেই বলল– আর পারি না। সত্যি সত্যি তুমি একটা ক্যাবলাকান্ত। কোথায় আর যাব এত রাতে? বাড়ি যাচ্ছি। তুমি আমাদের বাড়ি চেন না? তুমি না আমার বাবার প্রিয় ছাত্র ছিলে? সব ভুলে গেলে? সত্যি তোমার হলটা কী বলো তো? মগজ ধোলাই হয়েছে নাকি? গঙ্গার ধারে আমাদের বাড়ি। তুমি রোজ সে বাড়িতে যেতে, সব ভুলে গেছ? পরীক্ষার পরও নানান ছুতো করে আমাদের বাড়ি আসতে, শুধু একবার আমাকে দেখার জন্য। তবে এতটাই হাঁদা ছিলে বাড়ির সবার সঙ্গে কত কথা, শুধু আমার সঙ্গে কথা বলতে গেলেই তোতলাতে, মনে আছে?

সমৃদ্ধের মুখে কোনও ভাষা নেই। ভাষা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। তেরছা চোখে বারবার মেয়েটিকে দেখার চেষ্টা করছে। আর মনের অতল গহ্বরে, স্মৃতির ঘেরাটোপ থেকে ওর মুখটা তুলে আনার চেষ্টা করছে। কিন্তু যতবার চেষ্টা করছে, ততবার-ই ব্যর্থ হচ্ছে। অগত্যা অসহায় ভাবে ভ্যাবলার মতো চারদিকে তাকাচ্ছে। স্মৃতিকে উস্কে দেবার জন্য প্রকৃতি যদি সামান্যতম সাহায্য করে, এই আশায়। কিন্তু শীতের রাত। বেশিরভাগ বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ। অন্ধকার যেন অন্ধকারকে ছুঁয়ে ঘন হয়ে আছে। কিছু ঠাহর করা অসম্ভব। মনে মনে ভাবে সমৃদ্ধ, মেয়েটি ভালো-ই নাটক জানে। এমনকী ওর বাচনভঙ্গিতে কোনও জড়তা নেই। অভিনয়ে এতটুকু আড়ষ্টতা নেই। কখন কী বলতে হবে, সব মুখস্ত। মুহূর্তে আবার মনে ঝড় ওঠে, সবটাই কি অভিনয়? এই যে শীতের রাতে গঙ্গার ধার দিয়ে রিকশায় যাচ্ছে, তাতে ওর একটু আগে শীত করছিল। মেয়েটি যেহেতু ওর গা ঘেঁষে বসেছিল তাই ওর ঠক ঠক করে কাঁপা বুঝতে পেরে, তক্ষুনি নিজের গায়ের শালটা খুলে, ওর গায়ে জড়িয়ে দিল। বারণ করেও সে আটকাতে পারল না। এটাও কি অভিনয়! ওর চোখ দুটো ছলছল করে উঠেছিল। ভাগ্যিস অন্ধকার ছিল!

সমৃদ্ধ স্মৃতি হাতড়ে সমানে মেয়েটিকে খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু স্মৃতির ঘরে শুধুই ধোঁয়াশা। গাঢ় অন্ধকার। মেয়েটিকে কখনও দেখেছে কিনা সন্দেহ। প্রেম তো বহু দূরের কথা! মেয়েটি কিন্তু তার সবরকমের সুযোগ-সুবিধার প্রতি খেয়াল রাখছে। ব্যাগের চেন খুলে দুটো লজেন্স ওর হাতে দিল। গায়ের শালটা দিল! বারবার জল তেষ্টা পেয়েছে কিনা জানতে চাইছে। এই মুহূর্তে সমৃদ্ধের নরম মনটা একটু একটু করে নিজের বশ হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ছে। ওর এত বয়সের জীবনে এভাবে কেউ কোনওদিন ওর প্রতি নজর দেয়নি। মামা-মামির সংসারে, জ্ঞান বয়স থেকেই ও একটা পরগাছা, আপদ বিশেষ। সেও যে কারও প্রিয় পাত্র হতে পারে, এটা এই প্রথম সমৃদ্ধ অনুভব করল। তবে কী ইদানীং ওর সব স্মৃতি ক্রমশ বিস্মৃতির গহ্বরে চলে যাচ্ছে! হলটা কি তার! একজন মানসিক ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা প্রয়োজন।

এসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই তারা গঙ্গার ধারে একটা পুরোনো বাড়ির সামনে দাঁড়াল। সমৃদ্ধ তাড়াতাড়ি রিকশাভাড়া মিটিয়ে দিল। রিকশাওয়ালা তক্ষুনি উলটোদিকে চলা শুরু করল। মেয়েটি দ্রুত পায়ে এগিয়ে সদরের কড়া নাড়ে। মুহূর্তের মধ্যে বেরিয়ে এলেন বনেদি চেহারার এক প্রৌঢ়া। মুখে চোখে উৎকণ্ঠা। মেয়েটির দিকে এক ঝলক তাকিয়েই বলে ওঠেন– কোথায় গিয়েছিলি সুমি? এত দেরি হ’ল যে!

তারপর পাশে দাঁড়ানো সমৃদ্ধকে দেখে উদ্বেগে দিশাহারা ভাবে ব্যাকুল স্বরে বলে ওঠেন– আবার একজনকে…! সুমি মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলে– এবার ভুল করিনি মা। দ্যাখো ভালো করে দ্যাখো ও শান্তনু। পরক্ষণে একটু চড়া সুরে ডাকে, এই শান্তনু এদিকে এসো। আলোর দিকে মুখ করে দাঁড়াও। এবার দেখে বলো তো মা, আমি ভুল করেছি কি না?

মা জোরে জোরে ঘাড় নেড়ে কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে প্রতিবাদের গলায় বললেন– ওরে সুমি ও শান্তনু নয়। তোকে কতবার বলেছি শান্তনু মারা গেছে। তবুও তুই বিশ্বাস করবি না! তবু এই বার বার ভুল করে…!

ভয়ংকর ক্ষেপে ওঠে সুমি। যে-মেয়েকে কিছুক্ষণ আগেও হাসি খুশি দেখাচ্ছিল, উচ্ছল উজ্জ্বল লাগছিল, মুহূর্তে কে যেন তার মুখে কালি লেপে দিল! মাথা ঝাঁকিয়ে কড়া চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে– বিশ্বাস করো মা এবার আমি ভুল করিনি। ভুল করিনি মা। ও শান্তনু… শান্তনু।

এই সময় ভেতর ঘর থেকে এক যুবক বেরিয়ে এল। সমৃদ্ধের-ই সমবয়সি। বেশ ভালো চেহারা। কাছে এসে উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল– আবারও এক-ই ভুল করলি সুমি?

– না রে দাদা আমি তো কোনও ভুল করিনি। তারপর সমৃদ্ধের দিকে ঘুরে বলে ওঠে, তুমি ওকে চিনবে না শান্তনু। ও আমার মাসতুতো দাদা সুব্রত।

মা বলে ওঠেন– ওকে ঘরে নিয়ে যা সুব্রত।

– না না আমি শান্তনুকে না নিয়ে ঘরে ঢুকবই না। সমৃদ্ধ-র হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে সুমি। কেমন যেন বেপরোয়া ভঙ্গি, উন্মত্ত ক্ষিপ্ত চেহারা। মেয়ের হাত মা কিছুতেই ছাড়াতে পারছেন না। অগত্যা সুব্রত ওর পেশিবহুল শরীরের সব শক্তি প্রয়োগ করে। গর্জে উঠে বলে– শোন সুমি ও সত্যিই শান্তনুর মতো দেখতে, কিন্তু ও শান্তনু নয়। বোঝার চেষ্টা কর। শান্তনু আর নেই।

কিন্তু কে কার কথা শোনে! সুমি তখন-ও চ্যাঁচাচ্ছে– আমি যাব না। শান্তনুকে ছেড়ে আমি কিছুতেই যাব না। নাছোড়বান্দা সুমিকে একসময় জোর করেই টানতে টানতে ভেতরের ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয় সুব্রত। ভেতরে তখন প্রলয় কাণ্ড চলছে। হাতের কাছে যা যা ছিল সব ছুড়ে ছুড়ে ভাঙছে সুমি। কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। বৃদ্ধ বাবা-মা, দাদা, কত বোঝাবার চেষ্টা করছে বাইরে থেকে। যত শান্ত করার চেষ্টা চলছে তত-ই হিংস্র নেকড়ের মতো জিনিসপত্রগুলো তছনছ করছে। ভেতরের ঝড়ের তাণ্ডবে বাইরের সবাই চমকে উঠছে। বেকুবের মতো এককোণে দাঁড়িয়ে আছে সমৃদ্ধ। যেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় এক জড়পিণ্ড।

মা একটু এগিয়ে ওর কাছে এসে ফিস ফিস করে বলেন– এভাবেই চলছে বাবা। এরপরই ও জ্ঞান হারাবে। দেখা ছাড়া কিচ্ছু করার নেই আমাদের। ওরা দু’জনে দু’জনকে খুব ভালোবাসত। বিয়ের দিন-ও ঠিক হয়ে গিয়েছিল। অনেক চিকিৎসা করেছি। কিন্তু…! মনোরোগ! তেমন কোনও তাৎক্ষণিক মেডিসিন নেই। অনেক ধৈর্য ধরে দীর্ঘদিন চিকিৎসা করাতে হবে। কিন্তু আমাদের বয়স হয়েছে। দুজনেই অসুস্থ। সুব্রত চলে যাবে। তখন আমাদের পক্ষে…! কী জানি কী হবে! ডাক্তারের মতে এভাবে চলতে থাকলে একসময় ও সম্পূর্ণ উন্মাদ হয়ে যাবে, বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন মা। ভেতরে তখন হুলুস্থুলু কাণ্ড! দরজার খিল দিয়ে বাড়ি দিচ্ছে আলমারি, ড্রেসিং টেবিলের উপর। ঝনঝন করে কাচ ভাঙ্গার আওয়াজ। সুব্রত তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলতেই দরজার ডাসাটা ছুড়ে মারল ওকে লক্ষ্য করে। তারপর দাঁত কিড়মিড় করে ছুটে এল ওর দিকে। চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে।

সমৃদ্ধ যাবার জন্য পেছন ঘুরেছে। হঠাৎ শুনতে পায় গোঁ গোঁ আওয়াজ। মুখ দিয়ে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। চোখ উলটে ধড়াস করে মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় মেয়েটি। ছুটে আসে সব্বাই। সমৃদ্ধও দ্রুত ঘরে এসে ওর মুখে চোখে জল ছেটায়। পাখার হাওয়া করে জ্ঞান ফেরায়। প্রথমে সুমি কারোকে চিনতে পারে না। চারদিকে চোখ বোলায়। হঠাৎ একসময় সমৃদ্ধের দিকে দৃষ্টি স্থির হয়। শার্টটা দুহাতে চেপে ধরে, টেনে টেনে বলে– আর পালাতে পারবে না। এইতো আমি ধরে রেখেছি। সুমির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে শান্ত স্বরে সমৃদ্ধ বলে– না সুমি আর ভয় নেই। আমি আর কোথাও যাব না। মামা-মামি সান্নিধ্য-র মুখটা এক ঝলক ভেবে নিয়ে ধীরে ধীরে আবার বলে– উঠে পড়ো, তোমার শান্তনু তোমার কাছেই ফিরে এসেছে। সব্বাই একসঙ্গে অপলক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায়। সুমি ফ্যাল ফ্যাল করে অসহায় দৃষ্টি মেলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...