সকাল সকাল উঠে পড়া গীতার বরাবরের অভ্যাস। আজকের দিনটাও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু ঘুম ভাঙার পরেও বিছানা ছাড়তে আজকে কিছুতেই ইচ্ছে করছে না গীতার। কীরকম যেন আলসেমি লাগছে। এপাশ ওপাশ করতে করতে অজয়ের দিকে পাশ ফিরল।

অঘোরে ঘুমোচ্ছে অজয়। গীতার স্বামী। অজয়ের উপর চোখ পড়তেই গীতার মনটা আশ্চর্য রকমের দ্রব হয়ে উঠল।

অজয়ের কপালে তপ্ত ঠোঁটের চুম্বন এঁকে দিয়ে বিছানা থেকে নামবার জন্য পা বাড়াতেই অজয়ের বলিষ্ঠ বাহু এক ঝটকায় গীতাকে নিজের শরীরের উপরে এনে ফেলল। অজয়ের শরীরের উষ্ণতা গীতার স্বাভাবিক বোধবুদ্ধিকে গ্রাস করে নেওয়ার উপক্রম করল। তাও নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল গীতা। অজয়ের বলিষ্ঠ বাহুর বন্ধন থেকে গীতা নিজেকে আপ্রাণ ছাড়াবার চেষ্টা চালাতে চালাতে কপট রাগ দেখাল।

‘আঃ কী করছ কী? সকাল হয়ে গেছে খেয়াল নেই?’

‘তো কী হয়েছে? আমি নিজের বউয়ের সঙ্গে প্রেম করছি সেটাও দোষের?’ অজয়ের চোখে দুষ্টুমির হাসি চিকচিক করে ওঠে।

‘না, ছাড়ো আমাকে। আজকে থেকে আমাকে মর্নিং ওয়াকে যেতেই হবে। বুঝতে পারছি অসম্ভব ওয়েট পুট অন করছি।’

‘তাই জন্যই তো তোমার শরীরের এ টু জেড আমাকে মেপে রাখতে হবে নয়তো বুঝব কী করে যে সত্যি সত্যি হাঁটতে যাচ্ছ নাকি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরে চলে আসছ।’

‘তাহলে সঙ্গে যাচ্ছ না কেন আমার উপর নজর রাখতে?’

‘এক বছর আগে যখন এই বাড়িতে তুমি নতুন বউ হয়ে এসেছিলে, তখনই কোনওদিন তোমাকে সন্দেহ করিনি তাহলে আজকে নতুন করে কেন শুরু করব?’

‘হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি’, গীতা নিজের আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে অজয়ের বুকে মুখ লুকোয়।

‘গীতা, আমি প্রমিস করছি আমাদের বিবাহিত জীবনের সুখ, আনন্দ আমি কোনওদিন এতটুকুও ফিকে হয়ে যেতে দেব না। সারাজীবন আমি তোমাকে সুখে রাখবার চেষ্টা করে যাব।’

আনন্দে গীতার চোখে জল চলে আসে। পাছে অজয় এই আনন্দাশ্রু দেখে ফেলে, লজ্জায় গীতা অজয়ের বুকে মুখ গুঁজে রাখে।

গীতা হাতের ঘড়ির দিকে তাকায়। একঘণ্টা কেটে গেছে। ঘামে শরীর চপচপ করছে। বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিল তখন আকাশ সবে ফরসা হতে শুরু করেছে। এখন ভালো রোদ উঠে গেছে। গীতা বাড়ির দিকে পা বাড়ায়।

বাড়ি পেৌঁছোতেই অজয় লেবু মধুর জল এগিয়ে দেয় গীতার দিকে। অজয়ের এই ছোটো ছোটো জিনিসের খেয়াল রাখার স্বভাবটা গীতার বড়ো ভালো লাগে। গীতা চেয়ারে বসে লেবু মধুর জলের গেলাসে ঠোঁট লাগায়।

অজয় চোখ দিয়ে গীতাকে খানিকটা মেপে নেয়, ‘বাঃ, একদিনেই তো তোমাকে বেশ খানিকটা রোগা লাগছে।’

‘মিথ্যা কথা বোলো না তো। একদিনে কেউ আবার রোগা হয় নাকি?’

‘কথাটা আজকে তোমার মিথ্যা মনে হলেও, এক মাস বাদে কিন্তু আমার কথা যে সত্যি হবেই এটা আমি এখনই বুঝতে পারছি।’

‘না গো, তোমার চোখে নিজেকে সুন্দর রাখার জন্য তো বটেই, নিজের শরীর স্বাস্থ্যের কথা ভেবেও আমাকে যেমন করে হোক রোগা হতেই হবে।’

‘গুড। আচ্ছা এখন বলুন তো ম্যাডাম, তৈরি হয়ে বেরোতে আপনার কতটা সময় লাগবে?’

‘তার মানে তুমি বলতে চাও, আজকের এই বিশেষ দিনে আমার সাজতে-গুজতে কতটা সময় লাগবে?’

‘ঠিক ধরেছ, বিশেষ দিনের বিশেষ সাজ তো।’

‘তুমি সবসময় অভিযোগ করো সাজতে আমি একটু বেশি সময় নিই। দেখো আজ তুমি অভিযোগ করার সুযোগই পাবে না।’

তৈরি হয়ে দুজনে দোতলা থেকে একতলায় নেমে আসে। সত্যি ওদের দুজনের দিক থেকে চোখ ঘোরানো যাচ্ছিল না। ভগবান যেন দুজনকে বানিয়েছেন একে অপরের জন্যে। একতলায় গীতার শ্বশুর শাশুড়ি, ভাসুর-জা আর এক ননদ থাকে।

প্রথমেই গীতার জা অলকা দুজনকে ‘হ্যাপি ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি’ উইশ করে। গীতা নিজের পার্স থেকে জা-য়ের পছন্দের একটা চকোলেট বার করে ওর হাতে ধরিয়ে দেয়।

কয়েক সপ্তাহ ধরেই গীতার ননদ শিখা ওদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিল না। সামান্য কারণে ও, অজয় আর গীতার উপর রেগেছিল। কারণ কী ঘটেছিল গীতার জানা নেই কিন্তু এক-দুবার চেষ্টা করেছিল দিদির রাগ ভাঙানোর, কিন্তু শিখা যেন প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছিল কথা না বলার।

আজ যখন ওরা দুজন একসাথে বসার ঘরে এসে ঢুকল দেখল শিখা সোফায় বসে টিভি-তে খবর দেখছে। ওদেরকে দেখে শিখা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়াতেই, গীতা এসে শিখার পথ আগলে দাঁড়াল।

ঘটনার আকস্মিকতায় শিখা খানিকটা হকচকিয়ে গিয়েছিল। গীতার দিকে দৃষ্টি দিতেই গীতা বলল, ‘দিদি, তুমি আজ আমাদের আশীর্বাদ করবে না? আজ আমাদের বিয়ের একবছর পূর্ণ হল।’ এই বলে গীতা শিখার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল। অজয়ও এগিয়ে এসে দিদির পা ছুঁয়ে প্রণাম করল।

গীতা দিদির হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘দিদি, আমরা যা অন্যায় করেছি সেটা ভুলে গিয়ে আমাদের ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আজকের দিনে মুখ ঘুরিয়ে থেকো না।’ হঠাৎ-ই কান্নায় গলা রুদ্ধ হয়ে আসার ফলে গীতার গলা দিয়ে আর একটা শব্দও বেরোয় না।

গীতার হঠাৎ করে ক্ষমা চাওয়ায় দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠা দেয়ালটা এক ঝটকায় ভেঙে যায়। শিখা একটা কথাও মুখ ফুটে বলতে পারে না। শুধু নিজের ভাইয়ের বউকে দুই হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নেয়। দুজনের মনের যত অভিমান সব চোখের জলে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। শিখা দুজনকে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানিয়ে বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়।

শিখা বেরিয়ে যেতেই অজয়ের মা-বাবা ঘরে এসে ঢোকেন। গীতার কান্নাভেজা চোখ দেখে ভুল ধারণা করে বসেন। অজয়ের মা নির্মলা বউমার দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, ‘কী বউমা, আজকের দিনেও তোমরা ঝগড়াঝাঁটি করছ? একটা দিন তো অন্তত আমার ছেলেটাকে শান্তিতে থাকতে দাও। কী পাও বলো তো এইসব করে?’

গীতার চোখে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ মুহূর্তের জন্য দেখা দিয়ে আবার মিলিয়ে যায়। অজয়ের মুখে হাসি দেখে নিজেকে সামলে নেয় গীতা।

‘আমাদের মধ্যে তো কোনও ঝগড়া হয়নি, মা। তুমি ভুল বুঝেছ,’ অজয় ঝুঁকে মা আর বাবার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে।

অজয়ের দেখাদেখি গীতাও শ্বশুর-শাশুড়িকে প্রণাম করে। ওর শ্বশুরমশাই প্রকাশবাবু চুপ করে থাকেন। শাশুড়ি নির্মলা আশীর্বাদ করেন ঠিকই কিন্তু মেশিনের মতো হাতটা বাড়িয়ে শুধু গীতার মাথাটা একবার ছুঁয়ে নেন। এর পরেও উনি নিজের বিরক্তি চাপতে পারেন না, ‘আজ সকাল সকাল দুজনে সেজেগুজে কোথায় চললে? একটা দিনও কি বাড়িতে থাকা যায় না? তোমাদের জন্য লুচি, তরকারি আর পায়েসের ব্যবস্থা করছিলাম। এখন ওগুলো কে খাবে বলো তো?’ নির্মলার প্রশ্নবান যে গীতাকে উদ্দেশ্য করেই নিক্ষেপ করা সেটা কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না।

‘আঃ নির্মলা, বলতে শুরু করলে তুমি যে আর থামতেই চাও না। কী হবে এসব বলে? এরপর দেখবে বউমা রাগ করে দুই-তিন মাসের জন্য বাপের বাড়ি চলে গেছে।’ প্রকাশবাবুর কথার তীর্যক ভঙ্গী গীতাকে আঘাত করে।

অজয়ের মৃদ্যু হাতের স্পর্শ নিজের কাঁধে অনুভব করে গীতা মনে খানিকটা বল পায়। ধীর মৃদু স্বরে উত্তর করে, ‘না বাবা, ভবিষ্যতে এরকম ভুল আর কখনও করব না।’

‘আমিও আজ একটা প্রতিজ্ঞা করেছি বাবা।’ অজয়ের গলা শুনে সকলের চোখ গিয়ে পড়ে অজয়ের উপর।

প্রকাশবাবু জিজ্ঞেস করেন, ‘কী প্রতিজ্ঞা করেছ তুমি?

‘এই যে তুমি সবসময় আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলো, আমি আর গীতা ঠিক করেছি সিরিয়াসলি ব্যাপারটা নিয়ে নিজেদের মুড আর খারাপ করব না।’

‘অজয়, এই বাড়িতে থাকতে হলে এখানকার নিয়মকানুন তো তোমাকে মেনে চলতেই হবে।’

‘বাবা প্লিজ, আজকের দিনে এইসব কথা কি তোমার না বললেই নয়? আজ এসব ভালো লাগছে না,’ এই বলে অজয় বাবাকে জড়িয়ে ধরে। ‘আজ আমরা ঠিক করেছি বাইরে কোথাও ঘুরেফিরে একটা ফিল্ম দেখব, তারপর বাইরেই কোথাও খেয়ে নেব। সন্ধেবেলায় সিদ্ধার্থর ওখানে পার্টি রয়েছে। বন্ধুরা সবাই মিলে আমাদের পার্টি দিচ্ছে। ওরা তোমাদেরও নেমন্তন্ন করতে আসবে। প্লিজ তোমরা ঠিক সময় পেৌঁছে যেও আর আমাদের গিফট্-টা আনতে ভুলো না কিন্তু।’

এইবলে অজয় গীতার হাতটা চেপে ধরে সদর দরজার দিকে পা বাড়ায়।

‘সকাল সকাল ছেলেটা কোনও নেশা-টেশা করেছে নাকি? দেখলে ছেলের ব্যবহারটা?’ নির্মলার কথার মধ্যেই ফুটে উঠল অজয়ের প্রতি বিরিক্তির মনোভাব।

পনেরো কুড়ি মিনিট বাদে অজয়ের মোটরবাইকটা যেখানে এসে দাঁড়াল সেটা একটা দশতলা ফ্ল্যাটবাড়ি। অজয়ের সঙ্গে গীতাও বাইক থেকে নেমে লিফটের দিকে এগোল। ‘তুমি দশ মিনিট বাদে উপরে এসো। আমি আগে গিয়ে পরিস্থিতিটা সামলাই নয়তো শুধুশুধু তোমাকে আবার অপমানিত হতে হবে,’ এই বলে গীতার গালে একটা আলতো টোকা মেরে অজয় লিফটের ভিতরে ঢুকে গেল।

আটতলায় উঠে যে-ফ্ল্যাটটার সামনে গিয়ে অজয় কলিংবেল বাজাল, তার দরজাটা একটু পরেই খুলে সামনে এসে দাঁড়াল অর্চনা। অর্চনা অজয়ের অফিসেই কাজ করে। সকলেই জানে টানা তিনবছর অজয়ের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল অর্চনার। অনেক বছর আগেই স্বামীর সঙ্গে অর্চনার ডিভোর্স হয়ে গেছে। অজয়ের থেকে বয়সেও দুবছরের বড়ো অর্চনা।

‘আরে তুমি। আজ তোমাকে এখানে দেখব আশা করিনি। যাক তোমাকে দেখে অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে’, এই বলে অজয়ের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে সোফাতে বসিয়ে দিল অর্চনা।

অর্চনার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অজয় সোফাতে গুছিয়ে বসল, ‘কী করছিলে?’

‘এই ঘরদোর পরিষ্কার করছিলাম। কেন কোথাও বেড়াতে যাবার কথা ভাবছ? তাহলে বলো তৈরি হয়ে আসি।’

‘আগে এক কাপ কফি তো খাওয়াও, তারপর দেখছি।’ অজয়কে দেখে মনে হচ্ছিল আজ ওর কাছে অফুরন্ত সময় রয়েছে।

‘গীতা কি এখনও বাপের বাড়িতেই রয়েছে?’

‘না, গতকাল সকালেই বাড়ি ফিরে এসেছে।’

‘বাবা, শেষমেশ মাথা নীচু করতে রাজী হয়েছে?’

‘সময়, অনেক মানুষকেই বদলে দেয় অর্চনা।’

‘গীতার পক্ষে বদলানো অসম্ভব। তোমাদের দুজনের এতদিনে ডিভোর্স নিয়ে নেওয়া উচিত ছিল। না তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো আর না তোমাদের চরিত্রগত কোনও মিল রয়েছে। স্বভাবেও তোমরা একদম আলাদা।’

‘ধরো ডিভোর্স হয়েও গেল, কিন্তু আমার একাকিত্ব কীভাবে কাটবে?’

‘কেন আমি তো আছি।’ অর্চনা সোফায় বসে অজয়ের গলাটা জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে ওকে টানার চেষ্টা করে।

‘কিন্তু তুমি তো দ্বিতীয়বার বিয়ের রাস্তা মাড়াবে না বলে প্রতিজ্ঞা করেছ।’

‘প্রথম বিয়ের পরে যা বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছে, এখন বিয়ের নাম শুনলেই ভয় লাগে। তাই বলে তুমি চিন্তা কোরো না। প্রেমিকার ভূমিকা যে আমি ভালো ভাবেই পালন করতে পারব সে বিশ্বাস আমার নিজের ওপর আছে। কী বলো অজয়?’

‘উত্তরটা কফি খাওয়ার পরেই দেব।’

অজয়ের গাছাড়া ভাবটা ইচ্ছে করেই উপেক্ষা করে অর্চনা রান্নাঘরের দিকে প্রস্থান করে।

কফি বানিয়ে আনতে আনতে ফ্ল্যাটের কলিংবেলটা আর একবার বেজে ওঠে। কফির কাপটা অজয়ের সামনে নামিয়ে রেখে অর্চনা সদর দরজাটা খুলে দেয়।

সামনে গীতাকে দেখেই অর্চনার মেজাজটা চড়াক করে গরম হয়ে ওঠে। কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই পিছন থেকে অজয়ের গলা ভেসে আসে, ‘ওঃ তুমি এসে গেছো। ভেতরে চলে এসো।’

অর্চনা সামান্য সরে দাঁড়িয়ে গীতাকে ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকতে দেয়। ফ্ল্যাটে ঢেকার দরজাটা বন্ধ করে অর্চনা অজয়ের শরীর ঘেঁসে সোফার উপর বসে পড়ে।

‘অজয়, ওকে বলে দাও লাস্ট টাইমের মতো অশান্তি করে একটা সিন না ক্রিয়েট করে। সেদিন ওরকম চ্যাঁচামেচির পর প্রতিবেশীদের সামনে চোখ তুলে দাঁড়াতে পর্যন্ত লজ্জা করছিল।’ অর্চনার কথায় শুধু রাগ নয় একটা ভীতিও ফুটে উঠছিল।

‘আমি অশান্তি করতে এখানে আসিনি। কিন্তু সেদিনও আমার যা প্রশ্ন ছিল আজও সেই প্রশ্নই আমি তোমাকে করতে চাই। অজয় বিবাহিত জেনেও কেন তুমি ওকে পেতে চাইছ?’ গীতা নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ না হারিয়েই অর্চনাকে প্রশ্নটা করে।

‘তোমাকে তো সেদিনই অজয় এর পরিষ্কার উত্তর দিয়েছিল। আমরা দুজন পরস্পরকে ভালোবাসি। তোমাদের দুজনের সম্পর্কটা যে ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে, তার জন্য আমি নই, তুমিই পুরোপুরি দায়ী।’

অজয় এতক্ষণ চুপচাপ ওদের কথা শুনছিল, এবার মুখ খোলে, ‘অর্চনা সত্যিটা গীতার কাছে লুকোবার চেষ্টা কোরো না। স্বীকার করো যে গত তিনবছর ধরে আমাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।’

অর্চনা চমকে অজয়ের দিকে তাকায়। চোখে মুখে ওর স্পষ্ট ফুটে ওঠে রাগ।

‘অর্চনা, বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা অনুচিত। সমাজের নিয়মের বাইরে এটা। এছাড়াও তোমার এই জেদের জন্য আমাদেরও বিবাহিত জীবনের সুখশান্তি নষ্ট হতে বসেছে। তুমি প্লিজ অজয়ের জীবন থেকে সরে দাঁড়াও।’ গীতার ধীর কণ্ঠস্বরে শুধু অর্চনা নয়, অজয়ও বেশ আশ্চর্য হয়। ভোররাত্রে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ গীতার সঙ্গে এখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গীতার কোনও মিল খুঁজে পায় না অজয়।

‘আমাকে অজয় ভালোবাসে। ওর জীবনে আমার প্রয়োজন আছে। সেই জন্যই আজও আমাদের সম্পর্ক অটুট রয়েছে। তোমাদের অসফল বিয়ের জন্য আমাকে দোষী ঠাওর করার কোনও অর্থ হয় না।’ রুক্ষভাবে অর্চনা উত্তর করে।

‘তাহলে তো অজয়কেই ঠিক করে নিতে হবে আমাদের দু’জনের মধ্যে থেকে ও কাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে চায়। ও যদি তোমাকে বেছে নেয়, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি চিরজীবনের মতো তোমাদের দু’জনের জীবন থেকে আমি সরে দাঁড়াব।’

‘আগের বারও অজয় নিজের ইচ্ছে তোমাকে জানিয়ে দিয়েছিল। তুমিই জেদ করে একলাই এখান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। আজকের দিনটা অজয়ের আমার কাছে আসা এটাই প্রমাণ করে যে, ও আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।’

‘ঠিক আছে। আমি না হয় এখনই অজয়ের কাছ থেকে জেনে নিই এখন ও কী চায়।’

‘জিজ্ঞেস করো।’

‘আর ও যদি জীবনসঙ্গী হিসেবে আমাকে বাছে তাহলে তোমাকে কথা দিতে হবে তুমি ওর জীবন থেকে সরে দাঁড়াবে।’

‘এটা কখনওই হবে না।’ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে অর্চনা উত্তর দেয়।’

‘আর যদি এরকমই হয়, তাহলে?’

সম্মুখ সমরে আহ্বান করার গীতার এই ভঙ্গিমা অর্চনা-কে মনে মনে দুর্বল করে তোলে।

দু’জনেই অজয়ের দিকে ঘোরে। অজয়ের মুখে লেগে থাকা হাসি কাউকেই বুঝতে দেয় না কাকে ও জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছে।

খানিকক্ষণ চুপ থেকে অজয় অর্চনার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে অর্চনার চোখেমুখে ফুটে ওঠে বিজয়ীর অভিব্যক্তি।

‘গতবার তোমাদের দু’জনের ঝগড়ায় আমি তোমাকে সাপোর্ট করেছিলাম কিন্তু আজ আর সেটা সম্ভব নয় অর্চনা। আমি যদি দ্বিতীয়বার আবার এই একই ভুল করি তাহলে সারা জীবনের জন্য গীতাকে হারিয়ে ফেলব। তোমার সঙ্গে আমার পথ চলা এতদূর পর্যন্তই ছিল। গীতার সঙ্গে নতুন জীবন শুরু করতে হলে তোমার থেকে তো আমাকে দূরে যেতেই হবে।’ অর্চনার হাতে সামান্য চাপ দিয়ে অজয় নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে গীতার দিকে ফেরে।

‘আমার মনে হয় তোমার জীবন থেকে অজয়ের সরে যাওয়াই ভালো। আর সেটা তোমার মঙ্গলের জন্যই। অর্চনা, অতীতের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে না পারলে নতুনকে কীভাবে আমন্ত্রণ জানানো যাবে?  মনে রেখো, এটাই ভালো হল তোমাদের জন্য’, এই বলে গীতা অজয়ের হাত ধরে অর্চনার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আসে। অজয়কে আটকাবার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় অর্চনার।

দোকানে বসে দু’জনেরই পছন্দের ঢাকাই পরোটা, আলুর তরকারি আর মিষ্টি খেয়ে বেরিয়ে এসে সোজা ওরা পা বাড়ায় গীতার বাপের বাড়ির দিকে। বাপের বাড়ির সামনে বাইক থেকে নেমে দাঁড়াতেই গীতা যেন আবেগে ভেসে যেতে থাকে।

‘কী হল, দাঁড়িয়ে পড়লে যে। ভেতরে যাবে না?’

‘এই এক সপ্তাহ আগে যখন মায়ের কাছে এসেছিলাম তখন কেমন একটা নিঃসঙ্গ একাকিত্বে ভুগছিলাম। সবসময় মনে হচ্ছিল সবাই যেন আমার মনের ভিতরটা স্পষ্ট পড়তে পারছে। আমার ব্যথার জায়গাটা সকলের যেন জানা হয়ে গেছে। আজ মনটা খুব ভালো লাগছে জানো। আমি এই আনন্দের মুহূর্তগুলো আর হারাতে চাই না।’

‘আমরা আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে চলেছি গীতা। কথা দিচ্ছি, আনন্দ খুশিতে তোমার জীবন ভরিয়ে দেব।’ অজয় গীতার কাঁধটা জড়িয়ে ধরে শ্বশুরবাড়ির দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়।

গীতার মা-বাবা, দাদা-বউদি এসে ওদের দু’জনকে প্রথম বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়। এতদিন পরে জামাই বাড়ি এসেছে অথচ কীভাবে ওদের দু’জনকে স্বাগত জানাবে, গীতার বাড়ির লোকেরা বুঝে পায় না। এক সপ্তাহ আগে পর্যন্ত ওদের জানা ছিল জামাই আর মেয়ের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। এর মধ্যে যে সব ঠিক হয়ে গেছে তা ওদের ধারণাও ছিল না।

সবাই একসঙ্গে বসবার ঘরে বসে গল্পগুজব করতে করতে গীতার মা বন্দনা মেয়েকে নিয়ে ভিতরের ঘরে চলে যান। গীতার বউদিও রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়। অজয় শ্বশুর এবং শ্যালকের সঙ্গে বসেই গল্প করতে থাকে।

প্রায় কুড়ি মিনিট পর গীতা মায়ের সঙ্গে বসবার ঘরে এসে ঢোকে। গীতা মাকে চেয়ারে বসিয়ে অজয়ের পাশে এসে বসে।

‘শুনছ, মা না আমায় নিয়ে খুব চিন্তায় রয়েছে। আমি কীরকম আছি, সুখে আছি কিনা এই নিয়ে নানা দুশ্চিন্তা আর কী! আমি তো বুঝিয়েছি, এখন তুমিই পারো মায়ের চিন্তা দূর করতে।’ বন্দনা মেয়ের কথা শুনে জামাইয়ের সামনে লজ্জায় পড়ে যান।

‘মা, গীতাকে নিয়ে কী এত চিন্তা করছেন?’ অজয় খুব সিরিয়াস হয়েই শাশুড়িকে প্রশ্নটা করে।

‘না-না বাবা, সেরকম কিছু নয়। একটাই মেয়ে। চিন্তা তো হয়ই।’

এরই মধ্যে গীতা বলে ওঠে, ‘মা, শুধু তো চিন্তা নয়, আমি কীভাবে ভালো থাকতে পারি সেই পরামর্শগুলোও আমার সঙ্গে সঙ্গে অজয়কেও দাও। দ্যাখো না ও কী বলে।’

মেয়ের কথা শুনে বন্দনা যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। মেয়েকে থামাবার প্রয়াস বিফল হলে মুখের হাসি বজায় রেখেই অজয়কে বলেন, ‘গীতা বরাবরই একটু বোকা, মনের কথা গুছিয়ে বলতে পারে না। তোমাদের দু’জনেরই জীবনে যাতে খুশি বজায় থাকে তাই আমি গীতাকে বলেছিলাম, সংযুক্ত পরিবারে থেকে যখন তোমাদের দুজনের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে তখন উচিত হচ্ছে ওই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও দু’জনের আলাদা করে সংসার পাতা উচিত। এক বছর ধরে তোমাদের সম্পর্কের টানাপোড়েনের ঘটনা তো সকলেরই জানা। মা হয়ে এটুকু চাওয়াটা কি অন্যায়?’

‘না মা, অন্যায়টা আসলে আমার,’ গম্ভীর ভাবে অজয় শাশুড়ির কথার উত্তর দেয়। ‘তবে বিবাহিত জীবনের দ্বিতীয় ধাপের শুরুতে আমরা দুজনেই অতীতকে ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করার প্রতিজ্ঞা করেছি। আপনাদের আশীর্বাদটুকুই এখন শুধু দরকার।’

‘মা তোমাকেও একটা প্রমিস করতে হবে। এবার থেকে কিছু বোঝাবার হলে আমাকে একলা নয়, অজয় সঙ্গে থাকলে তবেই বলবে।’ গীতাও কিছুটা সিরিয়াস হয় কারণ মায়ের স্বভাব তার অজানা নয়।

‘আর একটা কথা’, অজয় বলে, ‘এটাও আমরা ঠিক করেছি সকলের কথাই আমরা শুনব। কিন্তু আমরা দু’জন মিলে যা ডিসিশন নেব সেটাই মেনে চলব। এটাতে কেউ ব্যথা পেলেও আমাদের কিছু করার নেই।’

‘আমি তো গীতাকে যা বলেছি, সবই ওর ভালোর জন্যই। ও যদি সেটা না মানে তাহলে সেখানে আমার কিছু বলার নেই।’

‘মা প্লিজ। এখন থেকে আমার জন্য নয়, আমাদের ভালো কীসে হবে ভাবতে শুরু করো।’

বন্দনা কথা না বাড়িয়ে, মেয়ের দিকে তীর্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ান।

এতক্ষণ গীতার বাবা সুব্রতবাবু এবং দাদা সৌম্য দু’জনেই মুখ বন্ধ করে বসে সব শুনছিলেন। বাড়ির গৃহিনী ভিতরে যেতেই দুজনে উঠে এসে অজয়কে জড়িয়ে ধরেন। দুজনের চোখেই আনন্দ যেন উপচে পড়ছিল।

‘অজয়, আমার মনের বোঝা আজ তোমরা দুজনে মিলে হালকা করে দিলে। আশীর্বাদ করি তোমাদের এই সদ্বুদ্ধি আজীবন বজায় থাকুক।’ সুব্রতবাবুর গলা রুদ্ধ হয়ে আসে।

হাসিঠাট্টার মধ্যে দিয়ে ওদের চারজনের আড্ডা জমে ওঠে। দুপুরে সকলে একসঙ্গে খেতে বসলে গল্পগুজবের মধ্যে দিয়ে সকালের টেনশন অনেকটা সহজ হয়ে আসে। বিশ্রামের পর অজয়, বন্ধু সিদ্ধার্থর বাড়ির পার্টিতে সকলকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে গীতাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।

অজয়ের চারজন বন্ধু মিলে সিদ্ধার্থর বাড়িতে গীতা আর অজয়ের বিবাহবার্ষিকীর পার্টিটার আয়োজন করেছিল। সিদ্ধার্থর বউ সুচেতা গীতাকে সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছিল। গীতাকে সাজিয়েগুজিয়ে যখন বার করল সত্যিই ওর দিক থেকে চোখ ফেরানো যাচ্ছিল না।

অজয় আর গীতারই পার্টিটা দেওয়া উচিত ছিল কিন্তু প্রায় ভেঙে যাওয়া দু’জনের বিবাহিত জীবন নতুন করে জোড়া লাগার আনন্দে বন্ধুরাই পার্টিটার আয়োজন করেছিল। নিমন্ত্রিত সকলেই প্রায় উপস্থিত ছিল পার্টিতে। হাসি, আড্ডা আর সকলের শুভেচ্ছায় পার্টি জমে ওঠে। হইচই মিটতে মিটতে রাত প্রায় বারোটা। অতিথিরা সকলেই তখন চলে গেছেন। শুধু পাঁচ বন্ধু আর তাদের ফ্যামিলি তখনও গল্পে মশগুল।

হাতঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই অজয় উঠে দাঁড়ায়, ‘আর না, এইবার বাড়ি যাওয়া দরকার। অনেক রাত্তির হল। তোদের সকলকে অনেক ধন্যবাদ এত ভালো একটা পার্টি আয়োজন করার জন্য। চলো গীতা, এর পরে গেলে বাড়িতেও আর ঢুকতে পারব না।’

সকলকে শুভরাত্রি জানিয়ে অজয় আর গীতা যখন বাড়ি ঢুকল তখন রটা বেজে গিয়েছে। শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতেই গীতা অজয়ের কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। হাতের বেষ্টনী এতটুকুও আলগা না করে অজয় জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন কাটল আজকের দিনটা?’

‘অসম্ভব ভালো। এই দিনটার কথা কোনওদিনও ভুলতে পারব না।’

‘আমিও না। আমি প্রমিস করছি কোনওদিন তোমাকে আর দুঃখ দেব না। অতীতটা আজ আমার কাছে স্বপ্ন। আমার বাস্তব এখন তুমি। ভুল করেছি আর ভুল ভেঙেও গেছে। আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলাম, অর্চনা আর আমার সম্পর্ক আসলে কোনও পরিণতিতে পেৌঁছোবে না। কারণ ও কখনও চায় না আমার বউ হয়ে সংসার করতে। ক্ষণিক সুখের চাহিদা মিটে গেলেই ও খুশি। দাম্পত্য মানে যে আগলে রাখা, আঁকড়ে থাকা, এই আবেগটা ওর মধ্যে দেখিনি। দেখেছি শুধু তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার, যেন কোনও বাজি জেতার আনন্দ। আমার ভুল আমি বুঝতে পেরেছি। আমি শুধু প্রায়শ্চিত্ত-ই করতে চাই না গীতা, তোমার জীবনটাও ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলতে চাই। আমাকে সেই সুযোগটুকু দেবে তো গীতা?’

উত্তর না দিয়ে গীতা অজয়ের বুকের কাছে আরও ঘন হয়ে আসে। টের পায় অজয়ের উষ্ণ নিঃশ্বাস নিজের ঠোঁটে এসে লাগছে। ঘরের আলোটা কখন নেভানো হয়েছে গীতা টের পায় না। শুধু ওদের উষ্ণ ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে থাকে ঘরের নাইট বাল্বটা।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...