পরম হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ পৌঁছে গিয়েছে। আরও কিছুটা গেলেই গন্তব্যে পৌঁছে যাবে। বনপথে হাঁটতে বেশ ভালোই লাগে। রেলস্টেশনে নেমেছে ভোরের আলো ফোটার আগেই।

ট্রেন থেকে নেমেই হনহন করে হাঁটতে শুরু করে। স্টেশনের পিছন থেকে একটা পথ বনের দিকে চলে গিয়েছে। মানুষের পায়ে পায়ে ক্ষয়ে কী দারুণ পথরেখা তৈরি হয়েছে। আর এই চেনা পথটা ধরে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে আপন ঘরে ফেরার অনাবিল আনন্দে চলতে থাকে সে। বহু বছর পর বাড়ি ফেরার একটা আনন্দ আছে বইকি!

শ্রাবণের ভরা বর্ষায় পথঘাট ভিজে। কচিসবুজ পাতা গাছের ডগায় ডগায়। পাখির কিচিরমিচির। বৃষ্টিভেজা পাখির ঝাঁক, ডানা ঝাপটাতে থাকে গাছের ডালে ডালে। সামনে একটা ভাঙা সাঁকো রয়েছে। কয়েকটা বাঁশ দিয়ে নদী পারাপার করা যায় এই পথে। সাঁকোটা পার হলেই একটা মেঠো পথ চলে গিয়েছে বনের দিকে।

ভোরের আলোয় এখন বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সব কিছু। নিস্তব্ধতা চারিদিকে। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টিতে পথ ধুয়ে গেছে। ধুলো মাটিতে বনের সর্বত্র পলির আস্তরণ পড়েছে। পরমের পায়ে ছাপ পড়ছে সেই নরম বনপথে। বেশ কিছুটা হাঁটার পর হাঁপিয়ে গিয়েছে। তাই একটা আধশোয়া গাছের ডালে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম। হয়তো গাছটা গত রাতের ঝড়ে নুইয়ে পড়েছে। আরও কয়েক কিলোমিটার পথ পার হলেই ছোটো নদী।

ভরা বর্ষায় জল থইথই নদী পার হওয়া খুব কঠিন। এই সময় স্রোতের প্রবল টান থাকে। আবার হড়পা বানে বিপদ অবশ্যম্ভাবী। যখনই নদীর জলে পা রাখে পরম, স্রোতের টানে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। জলের গভীরতা খুব বেশি, আবার কোথাও হাঁটুজল। আবার কিছুটা পিছিয়ে নদী পার হতে যায়। কিন্তু পিছলে যায় বারবার। ভয় ভয় ভাব কাজ করছে। এবার কিছুটা হতাশ হয়ে বসে পড়ে। নদীর দিকে চেয়ে থাকে অপলক। আর ভাবতে থাকে অতীত দিনের কথা। বেলা গড়িয়ে এখন দুপুর। মধ্য-গগনে গনগন করছে সূর্য‌্য। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে যেন আলোর রশ্মি চুঁইয়ে পড়ছে।

বনচরী রোজ নদীর তীরে আসে গরু চরাতে। বর্ষায় লকলকে ঘাস নদী অববাহিকায়। এখানেই গরুর বাথান। গরুর পাল আপন মনে চরতে থাকে। নদীর ওপারে তাদের বসতি। সাতসকালে যখন গরুর পাল নিয়ে এসেছিল তখন নদীতে স্রোত ছিল না। সহজেই পার হয়ে এপারে এসেছে। অতিবৃষ্টিতে বর্ষায় ফুলে ফেঁপে ওঠে নদী। বৃষ্টির পরিমাণ বাড়লেই হড়পা বানে নদীর জল বেড়ে যায়। আর দুই পাড়ের মানুষ নদীর দিকে চেয়ে থাকে। বৃষ্টি কিছুটা ধরলে আবার নদী পারাপার করে।

শীতের সময়ে নদীর কঙ্কাল বেরিয়ে আসে। নুড়িপাথর আর বালি বোঝাই হয় নদীগর্ভ। বনচরী সকালেই নদী পার হয়ে গিয়েছে। আজ সকালে বৃষ্টি ছিল না। পরিষ্কার আবহাওয়া, কখন যে দিন গড়িয়ে গেছে! রোজ কিছু খাবার নিয়ে আসে বনচরী। গ্রামের আরও কয়েকজন এই বনাঞ্চলের ঘাস জমিতে গরু ছাগল নিয়ে আসে। শীতের মরশুমে এই নদী চরে পিকনিক পার্টির মোচ্ছব বসে।

ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল আবার। প্রচণ্ড বৃষ্টির ছাঁট। ছিটছিট রঙের প্রজাপতির মতো ছাতাটা মেলে নিজেকে আড়াল করছে বনচরী। গরুর পাল আর তার সঙ্গীরা বেশ কিছুটা দূরে। বনচরী ঘরের গাই-বাছুর সঙ্গে নিয়ে আসে। ছোট্ট চঞ্চল বাছুরটা হঠাৎ দলছুট হয়ে গিয়েছিল। আর সেই বাছুরের পিছনে ছুটতে ছুটতে নদীর তীরে এসে পৌঁছোয় বনচরী।

একটা দমকা হাওয়া আর সঙ্গে এলোমেলো বৃষ্টি শুরু হল। বনচরীর ছাতাটা উড়ে এক্কেবারে পরমের কাছে। পরম তখন বৃষ্টির থেকে রক্ষা পেতে একটা ঝাঁকড়া গাছের তলায় আশ্রয় নিচ্ছিল। এমন সময় রঙিন ছাতাটা তার পায়ে কাছে লাগে। সযত্নে তুলে নিয়ে বনচরীর হাতে দেয়। লাজুক মুখে ছাতাটা নিয়ে ঘুরছে সে অন্যপথে।

পরম সাহস করে জিজ্ঞাসা করে, তোমার গ্রাম কোথায়? নদীর ওপারের দিকে হাত তুলে দেখায় বনচরী। ছাতাটা মুঠোতে শক্ত করে ধরে বৃষ্টি আটকাতে থাকে। অচেনা দুজন একই ছাতার তলায়। এলোপাথাড়ি বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছে বনচরীর শঙ্খশুভ্র হাতের কবজি। বৃষ্টি কিছুটা কমেছে এখন। মেঘলা আকাশের বুক চিরে সূর্য‌্যের রশ্মি। রামধনু ওঠার সম্ভবনা প্রবল।

বেশ কিছুক্ষণ নীরবতা কাটিয়ে পরমকে ইশারায় বনচরী তার সঙ্গে যেতে বলে। ফিক ফিক করে মুচকি হেসে রাস্তার দিক নির্দেশ করে সে। বনপথে আরও কিছুটা গভীর অরণ্যে একটা বনদেবীর মন্দির। আর মন্দিরের চাতালে গবাদী পশু নিয়ে যারা রোজ আসে, তারা ঝড়-ঝঞ্ঝায় আশ্রয় নেয়। সকলেই অপেক্ষায় নদীর জল কমলে ওপারের বনবস্তিতে ফিরে যাবে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে তখনও। একই ছাতার তলায় হাঁটছে দুজন, পরম ও বনচরী।

পশুপালকরা মন্দির চত্বর ছেড়ে ফিরছে। নদীর হাঁটুজল বেশ খানিকটা কমে গিয়েছে। মাঝপথে ওদের দুজনকে দেখে বেশ হতবাক বনচরীর সঙ্গী-সাথিরা। সকলেই নদী পার হতে থাকে পশুর দল সঙ্গে নিয়ে পরম বহুদিন এই ভাবে নদী পার হয়নি। পা পিছলে যায়। বনচরী কখনও আলগোছে পরমকে ধরতে যায়। আবার এদিক ওদিক তাকিয়ে নেয়। মধ্যনদীর গর্ভে দুটো হাত যেন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই ধরে ফেলে।

নদীর জল ছুঁই ছুঁই গাছের ডালগুলো নুইয়ে পড়ছে। আঁধার নেমে আসছে রাতের গভীরে। হৃদয়ে উথলে ওঠে ভালোবাসার ফল্গুধারা। নদী পার করে এখন বনবস্তির পথ ধরেছে পরম। বাকিদের সঙ্গেও আলাপ হয়ে যায় পরমের। গোধূলির রং মেখে এখন সবার ঘরে ফেরার পালা। বেশ টুকটুকে দেখতে বনচরী। পথ চলতে চলতে যেন ইশরায় কত কথা হয়। ভালোবাসা হয়ে যায় চোখে চোখে। আর কিছুটা গেলেই বনচরীরা সামনের বনবস্তিতে ঢুকবে। তাদের নিজেদের মধ্যে আঞ্চলিক ভাষায় হাসি ঠাট্টা চলছে।

এই অঞ্চলের উপজাতি মেয়েরা খুব প্রাণ চঞ্চল হয়। কোনও ভনিতা পছন্দ করে না। সহজ সরল জীবনবোধ আর পরকে আপন করে নেবার সহজাত প্রবৃত্তি এদের। কিছুটা গেলেই বনপথটা দুভাগে ভাগ হয়ে গেছে। পরম হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছে।

চেনাপথ পরমের যেন খুব অচেনা লাগছে। বহুবছর পর ঘরে ফিরছে। পথের সবুজ বনের পথের বাঁকে মোচড় দিয়ে ওঠে মন এক অনাবিল আনন্দে। দিগন্ত রেখায় মিলিয়ে যায় বনচরীদের দল। বেশ কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায় সে। আকাশ ঘিরে মেঘ করেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝিলিক আর মেঘের ডাক।

মনে পড়ে, বেশ কয়েক বছরের পুরোনো কথা। তখন ক্লাস নাইনে পড়ত। সে ছিল এক বৃষ্টি বাদলের দিন। মনিবের ঘরে হাল চাষ করত বাবা সত্যাপির। হঠাৎ কালো মেঘে ছেয়ে যায় আকাশ। সঙ্গে বজ্রবিদ্যুৎ। বিদ্যুতের ঝলসানো আলোয় সব কিছু নিমেষে শেষ হয়ে যায়। চরম দারিদ্র নেমে আসে তাদের সংসারে।

দিনমজুর বাবার মৃত্যুতে মনিবের ঘরে মায়ে একটা কাজ জুটলেও, সংসারে টানাটানি অবস্থা। কয়েক মাস পর শহরের এক ঠিকাদারের অধীনে পরম কাজ পায়। এই সূত্রে দক্ষিণ ভারতে যাওয়া। বহুবছর পর বর্ষার মরশুমে কিছুদিন ছুটি নিয়ে তার ঘরে ফেরা। বহুদিন পর শাঁখ, ঝিঁঝিঁর শব্দ শুনতে শুনতে আলো-আঁধারি পথে গ্রামে ঢুকছে পরম।

পথ হাঁটতে হাঁটতে এখন কালো পিচ ঢালা রাস্তাটা সামনে এসে পড়ল। এই পথে শহর থেকে বাস এসে ঢুকছে বনাঞ্চলের শেষ ঠিকানায়। সন্ধ্যার আলো-আঁধারি পথে বাসের হেড লাইটে বনপথটা আঁধারের বুক চিরে চলে গেছে।

গ্রামে ঢোকার মুখেই তাদের ঘর। টিমটিম করে পাওয়ারের লাইট জ্বলছে। ছোট্ট বোন খুশি, বই পড়ছে। দাদাকে দেখে জাপটে ধরে। রান্নাঘর থেকে পরমের আসার খবর পেয়ে ছুটে আসে মা। বেশ কয়েক বছর বাইরে থাকায় একটা আধুনিকতার ছাপ পরমের চোখে মুখে। তবুও পরমকে যেন আনমনা লাগছে খুব। হাত মুখ ধুয়ে ছুটে যায় মনসা মন্দিরের সান্ধ্য আড্ডায়। বাল্য বন্ধুদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ কিছুক্ষণ গল্প করে ফের বাড়ি ফেরা।

বনচরীর সঙ্গে দেখা হয়েছে কয়েকদিন। প্রথম দেখার পর থেকেই পরম একটা ঘোরের মধ্যেই ছিল। সাতসকালে বনচরীকে দেখত গাঁয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে। গ্রামের শেষে সেচ বাঁধের পাড় ঘেঁসে বনচরীদের বস্তি। যেন দুটো যমজ গ্রাম। রেশন থেকে মুদির দোকান সবই পরমদের ঘরের সামনে। দুবেলা এই গ্রামেই আসতে হয় তাদের।

লাজুক স্বভাবের পরম। ইচ্ছে থাকলেও সময় সুযোগ করে আর সেরকম কথা হয়নি। বিভিন্ন ছলে কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে মাত্র। কখনও বনচরী হাতের তালুতে মুখ ঢেকে চলে গিয়েছে। একমুখ প্রাণোচ্ছ্বল হাসি, পরমের মনের গহীনে ভালোবাসার প্লাবন বইয়েছে। কয়েকটা মাস যে কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারেনি।

নুন আনতে পান্তা ফুরায় বনচরীদের সংসারে। কোনও দিন একশো দিনের কাজ জুটলে তাতেও পরিবারের সঙ্গে হাত লাগায় বনচরী। কিংবা সাপ্তাহিক গ্রামীণ হাটে, মুরগীর ডিম নিয়ে বিক্রি করতে যায়। আর প্রতিদিন গাঁয়ে গরু, ছাগল নিয়ে সঙ্গীদের সঙ্গে যেতে হয় বনবাথানে। নিজ ঘরের গাই-বাছুরটিও তখন তার সঙ্গী হয়। পরমদের ঘরের পাশ দিয়ে একটা মেঠো পথ ধরে ধুলো উড়িয়ে চলে

গরু-ছাগলের পাল। কিছুটা ঢালু জমি, পগার পেরোলেই ঘন অরণ্য।

চঞ্চল ছটফটে বাছুরটা দৌড়োতে দৌড়োতে চলছে। কখনও রকেটের গতিতে গভীর বনাঞ্চলে ঢুকে যায়। আবার ফিরে আসে। বনচরীর সাথিরা বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে যায়। সে থমকে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। জানে রোজকার মতো হারিয়ে যাওয়া বাছুরটা আবার ফিরে আসবে। এমনটাই নিয়ম হয়ে গিয়েছে। বনের পথের নির্জনতায় একাকী আকাশ কুসুম ভাবতে থাকে বনচরী।

কয়েকটা মাস গ্রামীণ শ্যামলিমায় কাটিয়ে এবার কর্মস্থলে ফিরতে হচ্ছে পরমকে। ঠিকাদারের অধীনে কাজ করে। হঠাৎ চেনা মানুষের মুখ দেখে হকচকিয়ে ওঠে বনচরী। মন ছুঁয়ে যাওয়া মানুষের মুখটা দেখেই যেন মন ভালো হয়ে যায়। নির্জন বনপথে আচমকা পরমকে দেখে অজানা উল্লাসে সারা মন ভরে ওঠে। কর্মস্থলে এই পথে আজ ফিরছে সে।

হাত নাড়তে নাড়তে খুব কাছে চলে এসেছে। লজ্জা ভেঙে গড়গড় করে না বলা অনেক কথা বলতে থাকে পরম। মাথা নুইয়ে মিহি মাটির বন্য উঠোনে একটা শুকনো কাঠি দিয়ে আঁকিবুঁকি আঁকতে থাকে বনচরী। লজ্জায় বনচরীর চোখ-মুখ লাল হয়ে গিয়েছে।

চোখ-মুখে একটা অব্যক্ত বেদনা। অনেক কিছুই তো বলতে চায় সে! বাছুরটা খুঁজতে খুঁজতে বনচরী তার চেনা বনপথে লাজুক হরিণীর মতো যেন হারিয়ে যায় সবুজ বনের বাঁকে।

পরমের বুঝতে মোটেই আর অসুবিধা হল না যে, কথা বলতে পারে না বনচরী। কয়েকটা মাসের বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা, পরমের বুকে ভালোবাসার সিন্ধু তৈরি করেছে। কথা বলতে না পারা মেযো যে বহু কথা বলে দিয়েছে। মায়ার এক অদ্ভুত বাঁধনে বনচরী তাকে পিছন থেকে অহরহ টানে। বন্য সুবাসের মতো তার শরীরের গন্ধ বনাঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...