ঘন্টা তিনেক পর কনফারেন্স রুম থেকে মিটিং শেষ করে বের হয় আদিত্য। মোবাইলটা হাতে নিয়েই ঘাবড়ে যায়। মায়ের মোবাইল থেকে এগারোটা মিসড্ কল। তড়িঘড়ি ফোন করে। অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে পরমা-র কণ্ঠস্বর। পরমা আদিত্যর ছোটোপিসি। ‘আদিত্য, ছোটোপিসি বলছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আয়। তোর মায়ের অবস্থা একেবারেই ভালো না।’ মায়ের ফোনে পিসির গলা শুনেই বুঝতে পেরেছিল আদিত্য, কিছু একটা হয়েছে। তার আশঙ্কাই ঠিক হল।

‘কী  বলছ পিসি! কী এমন হল? সব তো ঠিকই ছিল?’

‘সকালে সবে ঠাকুরঘরে ঢুকেছি, ঠিক সেই সময়তেই কাজলের ফোন.. পিসিমা তাড়াতাড়ি চলে আসুন, জেঠিমা অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে। আমরা পৌঁছোনোর আগেই ক্লাব থেকে কয়েকজন ছেলে মিলে গ্রিনল্যান্ড নার্সিংহোমে ভর্তি করেছে।’

একটু শ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করে পরমা। ‘দিনকয়েক সময় নিয়ে আসিস। কখন যে কী হয়।’ বলতে বলতে আবার থেমে যায় পরমা।

‘ঠিক আছে। জানি বলতে হবে না, তবু আমি না যাওয়া অবধি মায়ের একটু খেয়াল রেখো। আর টাকাপয়সার জন্য যেন কোনওরকম ভাবে চিকিৎসা না আটকে থাকে সেটা একটু দেখে নিও। আমি গিয়ে সমস্ত ক্লিয়ার করে দেব। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসার চেষ্টা করছি।’ বলে ফোনটা কেটে দেয় আদিত্য। আর একটা ১০ ডিজিটের নাম্বার প্রেস করে ফোনটা কানে দেয় আদিত্য। ‘শ্রী, অ্যাজ আরলি অ্যাজ পসিবল আমার নামে একটা কলকাতার ফ্লাইটের টিকিট বুক করে আমাকে মেসেজ করে দাও। আমি ছুটির জন্য বসের সাথে কথা বলতে যাচ্ছি।’

‘আরে হঠাৎ কী হল সেটা তো বলবে।’ চিন্তিত শোনায় শ্রীয়ের স্বর।

‘মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। ডাক্তার-রা প্রেডিক্ট করছেন, ইট্স অ্যা ব্রেন হেমারেজ।’ বলতে বলতেই চোখে জল চলে আসে আদিত্যর। কোনওমতে নিজেকে সামলে নেয়। ‘শ্রী প্লিজ, পরে সব বলব। তুমি টিকিট-টা কেটে আমাকে একটা কল করে দিও।’ আদিত্যর কষ্টটা ফিল করতে পারে শ্রী। মনে মনে ভাবে এ-অবস্থায় আদিকে কিছুতেই একা ছাড়া যাবে না। তার মা যে তার মনের কতটা জায়গা জুড়ে রয়েছে সেটা শ্রী ভালোমতোই জানে। আদিত্যকে সে ভালোমতো জানে ও বোঝে। আর কারও কাছে নিজেকে ধরা না দিলেও শ্রী-কে ফাঁকি দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। শ্রী-য়ের কাছে ধরা তাকে পড়তেই হবে। ভালোবাসার বন্ধনটা বোধকরি এমনই হয়। জেদ ধরে বসে, ‘আমিও সঙ্গে যাব।’ ফোনটা কেটে দিতেই যাচ্ছিল আদিত্য। শ্রীয়ের কথা শুনে থমকে গেল।

‘সব কিছু জেনেও তুমি একথা বলছ? ভুলে গেছ সবকিছু? তুমি জানো না, মা আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে কতটা আপসেট? যদি তোমাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, সেটাও তো মায়ের শরীরের জন্য ঠিক নয়, না। তাছাড়া আমি চাই না তোমাকে কেউ ঘৃণার চোখে দেখুক।’

আদিত্যর মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নেয় শ্রী। ‘কী যাতা বলছ বলো তো? উনি পছন্দ করেন না বলে কি এই বিপদের সময়তেও আমি ওনার কাছে থাকতে পারি না? তাছাড়া এখন এসব ভাববার সময় নয় আদি।’

‘ভেবে দ্যাখো কী করবে।’

‘ভাবার কিছু নেই। আমি যাচ্ছি এটা ফাইনাল।’

‘ঠিক আছে তাহলে তোমার যা নেওয়ার নিয়ে নিও। আমারও কয়েকটা জামাকাপড় প্যাক করে নিও। থ্যাংকস্ শ্রী, তুমি সাথে থাকলে একটু মনের জোর পাব।’

বসের সাথে কথা বলার পর সোজা এয়ারপোর্ট-এর উদ্দেশ্যে রওনা দেয় আদিত্য। পূর্বনির্ধারিত সময় মতো শ্রী-ও লাগেজ নিয়ে পৌঁছে যায় এয়ারপোর্টে। পথে যাবতীয় ফোনাফুনি সেরে নেয় আদিত্য। দিদি অন্বেষাকে মায়ের অসুস্থতার কথা জানানো থেকে শুরু করে ঘন্টায় ঘন্টায় পিসির থেকে মায়ের শরীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেওয়া চলতে থাকে।

ট্যাক্সি থেকে নেমেই শ্রী-কে দেখতে পায় আদিত্য। এয়ারপোর্টের বাইরে একটা কোণে লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে ছিল সে। শ্রী-কে দেখে তার দিকে এগিয়ে যায় আদিত্য। লাগেজটা নিয়ে নেয় শ্রী-র থেকে। আদিত্যর চোখেমুখে তখন বিষণ্ণতার স্পষ্ট ছাপ। চোখটা টকটকে লাল। আদি কাঁদলেই ওর চোখ-মুখের অবস্থা ঠিক এমনটাই হয় সেটা জানে শ্রী।

সান্ত্বনা দিতে ওর হাতটা চেপে ধরে বলে, ‘চিন্তা করছ কেন, আন্টি ঠিক হয়ে যাবে। এত ভেঙে পোড়ো না।’

একটু মনোবল সঞ্চয় করতে শ্রীয়ের হাতটা চেপে ধরে আদিত্য। ‘চলো চলো ঘন্টা দেড়েক পরেই ফ্লাইট। চেক-ইন করতে হবে তো।’

শ্রীয়ের সঙ্গে সম্মতি প্রকাশ করে দুজনেই ঢুকে পড়ে এয়ারপোর্টের ভেতরে। সমস্ত ফর্মালিটির পর পাশাপাশি সিটে বসে দুজনে। আদিত্য-র হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে রাখে শ্রী। আদিত্য চোখ বুঝে ফেলে। মুহূর্তেই পুরোনো স্মৃতিগুলো চোখের সামনে এসে ভিড় করে। মা অসুস্থ এটা যেন সে ভাবতেই পারে না। মা-কে তো কোনওদিন এভাবে দেখেনি সে। বরং মায়ের দৃঢ়চেতা স্বভাবই দেখে এসেছে সে। যেমন ভালোবাসা, মমত্ব উজাড় করে দিয়েছে, তেমনি প্রয়োজনে পিঠে বেত কষাতেও বাকি রাখেনি। চিরকাল মাকে এভাবেই দেখে এসেছে সে। শত বাধা-বিপত্তিতেও মায়ের চোখে জল দেখেনি। শুধু একবার বাবার মৃত্যুর সময় মাকে ভেঙে পড়তে দেখেছে সে। ব্যস সেই দিনকতক। তারপর আরও নানা স্মৃতি আনাগোনা করতে থাকে।

আদিত্য আর শ্রী লিভ-ইন করছে প্রায় বছর তিনেক। এর মাঝে বার-চারেক শ্রী-কে নিয়ে কলকাতাতে মায়ের কাছে ঘুরিয়ে নিয়ে গেছে আদিত্য। বার বার উনি ছেলেকে বুঝিয়েছেন শ্রী-কে বিয়ে করে নেওয়ার জন্য।

‘একসাথে যখন থাকছ। সংসার করছ, তাহলে বিয়ে করতে অসুবিধেটা কোথায়? কীসের ভয় তোমাদের? বাঁধা পড়ার?’ প্রত্যেক বার এই নিয়ে মায়ের সাথে বচসা বেধে যেত আদিত্যর। এবার সেটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায়। অশান্তি এমন জায়গায় পৌঁছে যায় যে, আদিত্য মুম্বই ফিরে যাবার সময় মাকে বলে যায়, এরকম করলে মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখা নাকি তার পক্ষে মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। তার লাইফ, সে কীভাবে লিড করবে এটা একান্ত ভাবেই তার সিদ্ধান্ত। তারপর মাস ঘুরতে না ঘুরতেই এই ঘটনা ঘটে গেল। কোথাও গিয়ে তার মনে হয়েছে, মায়ের অসুস্থতার জন্য সে-ই দায়ী। অপরাধবোধ কাজ করতে থাকে তার মধ্যে। ঘন্টা তিনেকের পথ এভাবেই কেটে যায়। ফ্লাইট ল্যান্ড করার পর ট্যাক্সি নিয়ে সোজা পৌঁছে যায়

নার্সিংহোমে। রাত তখন এগারোটা। নার্সিংহোমে ঢুকেই চোখে পড়ে বেঞ্চের এককোণে মাথাটা হেলিয়ে দিয়ে বসে আছে ছোটো পিসি। আর পিসেমশাই পায়চারি করে চলেছে। তাদের দিকে এগিয়ে যায় আদিত্য। সঙ্গে শ্রী-ও এগিয়ে আসে।

‘মা,  এখন কেমন আছেন পিসেমশাই?’

‘ব্লাডপ্রেশার বেড়ে যাওয়ার কারণে ব্রেন হেমারেজ হয়েছে। ৭২ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাবে না। ডাক্তাররা তো এমনটাই বলছেন।’

আইসিইউ-তে ঢোকার পারমিশন না মেলায় দরজার কাচ দিয়েই মায়ের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে আদিত্য। মায়ের মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো, হাতে কতগুলো চ্যানেল করা, একটা মেশিনে কী-সব আকিঁবুঁকি রেখা ছুটে চলেছে, অথচ সাদা বিছানায় মা অচেতন হয়ে পড়ে রয়েছে। সহ্য করতে পারে না সে। পরমাকে জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।

‘ছোটোপিসি,  মা ঠিক হয়ে যাবে তো, বলো না?’

‘নিজেকে শক্ত কর আদি।’

পাশ থেকে পিসেমশাই বলে ওঠেন, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে। সারাদিন অনেক ধকল গেছে তোমাদের, যাও বাড়িতে গিয়ে একটু বিশ্রাম নাও। তোমাদের দেখেই মনে হচ্ছে তোমরা দুটিতে সারাদিন কিচ্ছুটি খাওনি। যাও যাও। আর দেরি কোরো না, সঙ্গে পিসিকেও নিয়ে যাও। সারাদিন ওইভাবেই বসে আছে, আর টেনশন করছে। ওকেও কিছু খাইয়ে দিও।’ বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীয়ের মাথায় স্নেহের হাত রাখেন, ‘যাও মা যাও, তুমিও যাও।’

আদিত্যর পিসেমশাই বরাবরই একটু দাপুটে স্বভাবের। ওনার কাছে কোনওকিছুই ধোপে টেকে না। আদিত্য নার্সিংহোমে থাকার জন্য  জেদ ধরেছিল ঠিকই, কিন্তু পিসেমশাইয়ের কাছে হার মানতে বাধ্য হল।

‘যা বলছি তাই শোনো। এমনিতেই আজ আর কাউকে বউদির কাছে যেতে দেবে না। যদি কিছু লাগেও তার জন্য তো আমি

রইলাম-ই। বরং কাল সকাল থেকে মায়ের কাছে থেকো। ডাক্তারের সাথেও কথা বলে নিও।’

‘কিন্তু..’ নার্সিংহোমে থাকার জন্য পিসেমশাইকে বোঝানোর চেষ্টা করে আদিত্য।

‘আর কোনও কিন্তু নেই। যাও, কাল সকাল সকালই চলে এসো।’

ইচ্ছে না থাকলেও একপ্রকার বাধ্য হয়েই বেরিয়ে যেতে হল তিনজনকে। নার্সিংহোম থেকে বাড়ির দূরত্ব খুব বেশি হলে মিনিট দশেকের। ট্যাক্সিতে মিনিট কয়েকের মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যায় তারা। দরজা খুলেই সোজা মায়ের ঘরে ঢুকে যায় আদিত্য। ঘরের আলমারি, বিছানা, আলনা, সব জায়গাতেই মায়ের পরশ অনুভব করে সে। একটু করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে। হঠাৎই চোখ আটকে যায় দেয়ালে টাঙানো মায়ের ফোটোফ্রেমটার দিকে। যেটা সে একদিন নিজে হাতে রঙ-তুলির টানে সৃষ্টি করেছিল। আর ছেলের আঁকা বলে তার মা সেটা সযত্নে বাঁধিয়ে দেয়ালে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। ছবিটা আদ্যোপান্ত ধুলোয় ঢেকে গেছে। ঠিক করে মায়ের মুখটা দেখা যাচ্ছে না। একটা চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে সেটাকেই নামানের চেষ্টা করতে থাকে আদিত্য। দেয়ালে পেরেকের সঙ্গে ফ্রেমের পিছন দিকে আটকানো তারটা এমনভাবে জড়িয়ে বাঁধা রয়েছে যে, সহজে নামিয়ে আনতে পারে না সে। খুলে আনার জন্য টান দিতে থাকে।

খাবার জন্য ডাকতে আসা ছোটোপিসির চোখ এড়ায় না পুরো ঘটনাটা। আপনা-আপনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরমা।

‘ওটা  কী করছিস আদিত্য?’

‘এই যে মায়ের ছবিটা পিসি। একেবারে ধুলো পড়ে গেছে।’

একটা বাঁকা হাসি হাসে পরমা। ‘এরকমই বোধহয় হয় রে আদি, লোক দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বোঝে না। পড়ে গেলে তবেই বোঝে।’

পিসির খোঁচাটা বুঝতে পেরে বিরক্ত লাগে আদিত্যর।

‘কী যা-তা বলছ পিসি।’ মুহূর্তেই চোখ লাল হয়ে যায় তার।

‘খুব  কি কিছু ভুল বলছি? কী পেয়েছে বল তো মানুষটা? আজ তোদের জন্যই তো বৃন্দা বউদির এই হাল। এর জন্য তোরাই দায়ী।’ মাথা নীচু করে শুনতে থাকে আদিত্য।ঠোঁটে রা কাড়ে না সে।

পরমা তার মতো করে বলে চলে, ‘নিজের দাদা বলে বলছি না, তিনি তো সমস্ত দায়ভার তোমার মায়ের কাঁধের উপর দিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন। খুব যে কিছু রেখে গেছেন তাও তো বলতে পারব না। তৎসত্বেও তো তোমাদের কোনও অভাব রাখেনি তোমার মা। এক এক করে সব গয়না খুইয়েছে তোমাদের পড়াশোনার জন্য। এমনকী তোমার দিদিকে সিম্বায়োসিসে ল’ পড়ানোর জন্য বাড়িটা পর্যন্ত বন্ধক দিয়েছে। বদলে তোমরা কী করেছ, শুধু মায়ের মুখে চুনকালি মাখিয়েছ। তোমার দিদি পড়াশোনা চলাকালীন তার থেকে বাইশ বছরের বড়ো একটা মুসলিম ছেলেকে বিয়ে করে বসল। আর এখন তুমি  লিভ ইন করে ওর মুখে কালি লেপছ।  একসাথে থাকবে অথচ বিয়ে করতেই যত ওজর-আপত্তি। আর কত সইবে সে। ওর কি মান-সম্মান বলে কিছু নেই? ঠিকই আছে, বউদির মরে যাওয়াই ভালো।’

কথাগুলো শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে আদিত্য। পিসির হাত দুটো চেপে ধরে বলে ‘প্লিজ ছোটোপিসি, এভাবে বোলো না।’

‘কেন বলব না, বলতে  পারো। সমাজে মুখ দেখানোর বাকিটা কী রেখেছ তোমরা। লজ্জায় মানুষটা একেবারে একঘরে করে ফেলেছিল নিজেকে। সে-সব যাবে কোথায়? কাঁহাতক একটা মানুষ একলা থাকতে পারে, নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে? চোখ বুজলে যদি একটু শান্তি পায়।’

পিসির গলার আওয়াজ পেয়ে এক-পা এক-পা করে আদিত্যর মায়ের ঘরের সামনে এসে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকে শ্রী। পিসি-ভাইপোর মাঝে কথা বলার দুঃসাহস সে দেখায় না। সেই শিক্ষাও তার নেই। তাকে একঝলক আপাদমস্তক দেখে নেয় পরমা। তারপরে আবার বলতে শুরু করে ‘বৃন্দা তো তোদের খুশিতেই খুশি থাকতে চেয়েছিল। ও চেয়েছিল তোদের চারহাত এক করে দিতে। কিন্তু তোদের মাথায় কী ওই লিভ-ইনের ভূত চেপে বসে রয়েছে। শিক্ষিত হয়েছিস, ভালো চাকরি করছিস, এখন আর মায়ের কথা শুনবি কেন? এখন যেভাবে খুশি থাক, আর কেউ বলতে আসবে না। এটা মনে রাখিস আমাদের সমাজ এখনও এতটা উদার মানসিকতার হয়নি যে, এটাকে ভালো ভাবে নেবে। কর, যা মন চায় কর।’ আদিত্য তখন পিসির হাত দুটো ধরে একেবারে মাটিতে বসে পড়েছে। চোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ছে।

‘আমার ভুল হয়ে গেছে পিসি, মা যে এভাবে নেবে আমি বুঝতে পারিনি। শুধু ভগবান আমার মাকে সুস্থ করে দিক, মা যা বলবে আমি তাই করব। শুধু একটা সুযোগ।’

আশ মিটিয়ে বলার পর খানিকটা নরম হয় পরমা। ভাইপোর হাতটা ধরে বলে, ‘আরে ওঠ ওঠ। চল রাগের মাথায় কত কী-ই না শোনালাম তোকে। আসলে কী জানিস তো, সেই তোর মায়ের বিয়ে হয়ে আসা থেকে আমাদের বন্ধুত্ব। সারাজীবন ওকে শুধু কষ্ট পেতেই দেখলাম। আমি চাই ও একটু ভালো থাকুক রে।’ বলতে বলতে চোখ ভিজে যায় পরমার। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নেয়। ‘আরে যা যা, অনেক রাত হল, তোরা দুটিতে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেতে চলে আয়। কিচ্ছু ভালো লাগছে না-রে, কী যে দেখব কাল…।’

চোখ মুছতে মুছতে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায় আদিত্য। পরমা-ও ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শ্রীয়ের মাথায় স্নেহের হাত রেখে বলে, ‘চল, কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। মুখে কিছু দিয়ে নিবি চল।’

কারওর-ই গলা দিয়ে খাবার নামল না। শুধু প্রয়োজনের তাগিদে কোনওরকমে দু-এক গাল মুখে দিয়েই যে-যার ঘরে শুতে চলে গেল। সকলের একটাই চিন্তা, কীভাবে বৃন্দা ভালো হয়ে উঠবেন।

দিনের আলো ফোটার আগেই আদিত্য তৈরি হয়ে নিল। রুম থেকে বেরিয়ে দেখে, ছোটোপিসিও রেডি। পিসেমশাইকে নিয়েও খানিক চিন্তায় ছিলেন, ওনার যে আবার হাই-ব্লাডপ্রেশার। সারারাত জাগা। শ্রী-ও তাদের সাথে যাবার প্রস্তুতি শুরু করেছিল। বাধ সাধে আদিত্য।

‘শ্রী, তুমি দুপুরে এসো। তোমাকে দেখে যদি আবার মা উত্তেজিত হয়ে ওঠে।’ সংশয় প্রকাশ করে আদিত্য।

‘ঠিক আছে। তাহলে আন্টিকে কী খাবার দিতে হবে ডাক্তারের থেকে জেনে নিয়ে আমায় বোলো। সেইমতো বানিয়ে নেব।’

‘যা লাগে কাজলকে দিয়ে তাহলে আনিয়ে নিও।’

‘ঠিক আছে, চিন্তা কোরো না। আমি সব সামলে নেব।’

‘ওকে’, বলে বেরিয়ে যায় তারা।

দিনতিনেক পর আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফ্ট করা হল বৃন্দাকে। এখন আউট অফ ডেঞ্জার, তবে শরীরের একটা দিক পড়ে গেছে। কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। আদিত্যকে দেখে চোখের কোণা দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু সেটা এতটাই ক্ষীণ আর অস্পষ্ট যে বোঝার উপায় নেই। এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করেন বৃন্দা। তারপর ইশারায় শ্রীয়ের কথা জানতে চান। আদিত্য আঙুল দিয়ে দরজার বাইরের দিকে দেখিয়ে দেয়। বৃন্দার চোখ চলে যায় দরজার বাইরে থাকা শ্রীয়ের দিকে। জড়োসড়ো ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চোখের ইশারায় ডেকে নেয় শ্রীকে। আদিত্য একটু ভয় পেয়েছিল বটে, তবে মায়ের আচরণ দেখে সে খানিকটা আশ্বস্তই হয়। বুঝতে পারে শ্রীয়ের উপস্থিতিতে মা খুশিই হয়েছে।

তবে মায়ের শারীরিক অবস্থা বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল আদিত্যকে। মা-কে সবসময় কিছু না কিছু কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখেছে, সেই মায়ের এই অবস্থা মেনে নেওয়াটা তার পক্ষে কষ্টদায়ক তো বটেই। এর আগে সে কখনও এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি। বুঝে উঠতে পারছিল না কী করলে তার মা আবার আগের মতো হেঁটেচলে বেড়াবে।

বৃন্দার সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল শ্রী। খাবার বানানো থেকে শুরু করে খাওয়ানো পর্যন্ত খুব যত্নের সঙ্গে সামলাচ্ছিল সে। কখন কী লাগে এই ভেবে সবসময় তাঁর পাশে পাশে থাকত শ্রী। বৃন্দাও আস্তে আস্তে তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে তাকেই খুঁজে বেড়াত বৃন্দার চোখ। পিসি, পিসেমশাই মাঝে মাঝে এসে শ্রীয়ের যত্ন দেখে খুশিই হতেন।

বিপত্তির মাঝে আর এক বিপত্তি। অফিস থেকে পত্রাঘাত। কোম্পানি তাকে ইউএসএ পাঠিয়ে দিচ্ছে। এটা আদিত্যর অনেক দিনের স্বপ্ন। ভবিষ্যৎ গড়ার এরকম সুবর্ণ সুযোগ আর সে কোনওদিনও পাবে না। এত আনন্দের খবরটাও তার কাছে আজ নিরানন্দের-ই সমান। কী করবে সে? এই অবস্থায় মাকে ফেলে যাওয়াটা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বারবার দিদি অন্বেষাকে ফোন করছে আসার জন্য, কিন্তু তার ওই এক কথা, মা তাকে পছন্দ করে না। তাকে দেখলে মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তবু সে চেষ্টা করে দেখবে।

অবশেষে আরও দু-দিন পর পুনে থেকে আদিত্যর দিদি অন্বেষা উপস্থিত। তাকে দেখে খানিক স্বস্তি পেয়েছিল আদিত্য। ‘তোকে দেখে খানিক স্বস্তি পেলাম রে দিদি। যদিও মা এখন আগের তুলনায় অনেকটাই ভালো আছে, অ্যাটেনডেন্টও রয়েছে, তবুও দেখাশোনার জন্য নিজেদের লোকজন পাশে থাকাটাও জরুরি। এতে মা-ও খানিক ভরসা পায়। তা কয়েকদিন ছুটি নিয়ে এসেছিস তো?’

‘না, না।  তুই তো জানিস আমার জব-টা কী? এখন আবার এক্সাম চলছে। হুট করে এভাবে বিনা নোটিশে ছুটি নেওয়া যায় নাকি? তবুও তো প্রিন্সিপাল-কে বলে কয়ে দিন দুয়েকের ছুটি পেয়েছি।’

বেশ হতাশ হয়ে যায় আদিত্য।

‘এবাবা আমি তো ভেবেছিলাম তুই থেকে একটু মায়ের সেবা-শুশ্রুষা করবি।’

‘জানিস-ই তো, হাসপাতালের নাম শুনলে বরাবরই আমি নার্ভাস হয়ে যাই। হাত-পা কাঁপতে থাকে আমার। এই গন্ধটা কিছুতেই নিতে পারি না।’

অন্বেষার কথা শুনে আদিত্য রীতিমতো শকড হয়ে যায়। বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকে দিদির দিকে। কেমন অচেনা লাগে নিজের দিদিকে। কিছু বলার ভাষা হারিয়ে যায় তার। এদিকে ডাক্তারের সঙ্গেও কথা হয়ে গেছে। উনি বলেছেন, ‘এবারে আপনারা আপনার মা-কে বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন। তবে মনে রাখবেন নিয়মিত ফিজিয়োথেরাপি-টা মাস্ট। এখন ওনার সুস্থ হওয়াটা পুরোটাই ওনার সেরে ওঠার ইচ্ছাশক্তি আর আপনাদের সেবা শুশ্রুষা-র উপরই নির্ভর করবে।’

‘কিন্তু ডাক্তারবাবু ওনার কথাগুলোও তো এখনও জড়িয়ে যাচ্ছে, তাহলে এত তাড়াতাড়ি…’ সংশয় প্রকাশ করে আদিত্য।

‘আপনাকে তো আগেই বললাম, আমাদের যা করার আমরা করে দিয়েছি। এখন যা ওষুধ চলবে তাতে ধীরে ধীরে কাজ হবে। জেনারেলি এসব কেসগুলোতে দীর্ঘকালীন ট্রিটমেন্ট চলে। পেশেন্টের মনোবল থাকলে অনেকে কিওর হয়ে যায় আবার অনেকের…। থাক ওসব কথা।’ বলে ডাক্তারবাবু রাউন্ডে চলে যান।

সেসব নিয়েই আদিত্যর মাথায় নানারকম দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। সেই কারণেই অন্বেষাদিকে দেখে একটু চিন্তামুক্ত হতে চেয়েছিল সে। কিন্তু উলটোটাই হল। দিদিকে আরও একবার কনভিন্স করার চেষ্টা করল আদিত্য।  ‘কোনওভাবেই কি কয়েকটা দিন ম্যানেজ করা যায় না? কয়েকটা দিন? এই মুহূর্তে আমার ইউএস যাওয়াটা ভীষণ জরুরি। আমি ওখানে জয়েন করার পরে পরেই এসে মাকে নিয়ে চলে যাব। মা-কে নিয়ে যাব তার জন্য তো আমাকে কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ। জাস্ট কয়েকটা দিন।’

‘না, কোনওভাবেই সম্ভব নয়। এক্সামের ডিউটি না থাকলে…। তাছাড়া কালই আমার ফ্লাইটের টিকিট।’ দিদির কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদিত্য। অন্বেষা কী একটা ভাবে। তারপর হুঠ করে কথা প্রসঙ্গে বলে বসে, ‘তুই তো একটা অ্যাটেনডেন্ট রাখলেই পারিস।

সে-ই তো মায়ের দেখাশোনা করতে পারে।’ অন্বেষার ভাবটা এমন যেন সে ভাইয়ের কাঁধ থেকে দায়িত্ব অনেকটা কমিয়ে দিতে পেরেছে।

‘একজন অচেনা মানুষের দায়িত্বে পুরো বাড়িতে মা একা?’ ভাবতে পারে না আদিত্য।

‘কেন সঙ্গে কাজলদিকে থাকতে বল। ও-তো বিশস্ত। অনেকদিন ধরে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে।’

‘নিজের কেউ একজন পাশে থাকাটাও জরুরি দিদি। ওসব তুই বুঝবি না। স্পর্শ- চিকিৎসা বলেও একটা ব্যাপার আছে জানিস তো।’

‘ছাড় তো, যত সব ফালতু ব্যাপারস্যাপার। তোর যদি এতই সমস্যা তাহলে ভালো কোনও ওল্ড এজ হোমে রেখে যা। কয়েকদিনেরই তো ব্যাপার।’

‘বাঃ দিদি বাহ্, এটা তোর পক্ষেই সম্ভব। একটু বাধল না, না রে? সব ভুলে গেছিস, মা সারাজীবন আমাদের দুই ভাইবোনের জন্য কী করেছে। আর এখন যখন তার আমাদেরকে প্রয়োজন, আমরা পিঠ বাঁচাচ্ছি।’

‘আমাকে  কর্তব্য শেখাতে আসিস না। যেটা বাস্তব সেটাই বলেছি। আর কী বলছিস মা এই করেছে, সেই করেছে। হোস্টেলে রেখেছে, ফিজ দিয়েছে এই তো। এগুলোর মধ্যে নতুনত্ব কী আছে? প্রত্যেকটা বাবা-মা-ই তাই করে। আমার মা-ও তাই করেছে।’

দিদির কথাগুলো সহ্য করতে পারে না আদিত্য। ভাইবোনের মধ্যে রীতিমতো তর্কাতর্কি চলতে থাকে। রাগে ফুঁসতে থাকে আদিত্য। সে ভুলে যায় যে তার মায়ের ঘরে মায়ের চোখের সামনে এই সমস্ত ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা। কথার মাঝে শ্রী  মায়ের কেবিনে ঢুকে পড়ে। তখন আদিত্যর সম্বিৎ ফেরে। শ্রীয়ের দৃষ্টি মায়ের দিকে, কিন্তু বিষ্ফারিত চোখে চেয়ে আছে শ্রী৷ সঙ্গে সঙ্গে মায়ের দিকে ফিরে তাকাতেই চমকে ওঠে আদিত্য । মা ওঠার চেষ্টা করছে। ডান হাতটা নাড়াচাড়া করে কিছু বলার চেষ্টা করছে। দু-চোখ জলে ভেজা। মায়ের কাছে ছুটে যায় শ্রী। শান্ত করার চেষ্টা করে ওনাকে। আদিত্য বোকার মতো একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বুঝতে পারে কত বড়ো ভুল সে করেছে।

‘তোমাদের  মুখগুলো এরকম লাগছে কেন? আমি কি তোমাদের কথার মাঝে ঢুকে পড়লাম? মা-ই বা হঠাৎ এত উত্তেজিত হয়ে উঠল কেন?’, জানতে চায় শ্রী৷ কোনও উত্তর দিতে পারে না আদিত্য। ফ্যালফ্যাল করে কেবল মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।

শ্রী, আদিত্য আর অন্বেষাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘তোমাদের তো খুশি হওয়া উচিত যে আন্টি কাল বাড়ি ফিরছে। উলটে তোমাদের মুখগুলো কেমন ফ্যাকাশে লাগছে।’

এইবার উত্তর দেয় আদিত্য। ‘ভাবছি মাকে কে দেখবে। ২২ তারিখে আমার ফ্লাইট। তার আগে দিল্লির অফিসের সমস্ত কাজ আমাকে মিটিয়ে নিতে হবে। সেইজন্য দুদিন আগে যাওয়াটা জরুরি। দিদিও থাকতে পারবে না বলছে।ওর ফ্লাইট কাল ।’

‘এই নিয়ে এত দুশ্চিন্তা করার কী আছে? আমি থেকে যাচ্ছি আন্টির কাছে। আমি দেখাশোনা করব ওনার। আমি তো একটু আগেই একজন ফিজিয়োথেরাপিস্টের সঙ্গে কথা বললাম। একটা অ্যাটেনডেন্ট-এর ব্যবস্থা করে নেব, সে আমার হাতে হাতে সাহায্য করবে, তাহলেই হবে। তাছাড়া কাজলও রইল। ও-ও সাহায্য করবে।

‘আর  তোমার অফিস?’

‘আমার অসুস্থতা দেখিয়ে একটা মেল করে দিচ্ছি। মানলে ভালো, না মানলে আর কী করা যাবে। চাকরি চলে যাবার ভয়ে তো আর আন্টিকে একা ছাড়তে পারি না।’

আদিত্যর কপালে চিন্তার ভাঁজ মুহূর্তেই পরিস্কার হয়ে গেল। শ্রীয়ের এই সিদ্ধান্তে সে-যে খুব কিছু অবাক হয়েছে তা-ও নয়। কারণ সে শ্রী-কে চেনে। জানে, ও এইরকমই একটা পাগলি মেয়ে। কিন্তু অন্বেষার চোখে-মুখে বিস্ময়ের স্পষ্ট ছাপ ফুটে উঠেছে।

পরদিন কাউন্টারে বিল মিটিয়ে ডিসচার্জ পেপার নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল আদিত্য। সেই ফাঁকে শ্রী, বৃন্দার সমস্ত কাজকর্ম গুছিয়ে নিল। বৃন্দার জামাকাপড় গোছানো থেকে শুরু করে তার চুল বেঁধে দেওয়া পর্যন্ত, সমস্ত নিজে হাতে মনের মতো করে সেরে নিল। সমস্ত ফর্মালিটি পূরণের পর ওয়ার্ডবয় আর নার্সের সাহায্যে মা-কে হুইলচেয়ারে বসিয়ে গাড়ি নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল তারা।

বাড়ি ফেরার পর থেকেই অন্বেষাকে ভীষণ ভারাক্রান্ত লাগছিল। সবার থেকে দূরে ঘরের এক কোণে দুই হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে বসেছিল সে। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে ঘরে ঢুকে, অন্বেষাকে ওই অবস্থায় দেখে প্রশ্ন করে বসে শ্রী– ‘দিদি তোমার কি মাথাব্যথা করছে নাকি? বাম দেব?’

মাথাটা তুলে জবাব দেয় অন্বেষা, ‘নারে, ঠিক আছি আমি।’ অন্বেষার চোখ দেখে ঘাবড়ে যায় শ্রী। রক্তজবার মতো লাল টকটক করছে চোখদুটো।

‘এমা  তুমি কাঁদছ? কিছু যদি মনে না করো, তোমার মনের কথা আমায় খুলে বলতে পারো। জল দেব, একটু জল খাবে?’

‘না রে, লাগবে না।’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস নেয় অন্বেষা।

‘জানিস আজ তোকে সব বলতে ইচ্ছে করছে। তুই ভেবে অবাক হচ্ছিস না, মেয়ে হয়ে আমি কীভাবে মায়ের সাথে এত খারাপ ব্যবহার করছি। ভাবাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বাস কর আমি ইচ্ছা করে কিছু করছি না রে। মাকে দেখলেই না আমার ছোটোবেলার খারাপ স্মৃতিগুলো চোখের সামনে এসে পড়ে।’

‘খারাপ স্মৃতি’! একটু অবাক হয় শ্রী।

অন্বেষা তার মতো করে বলে চলে ‘মায়ের সাথে আমার এমন দুর্ব্যবহারের কারণ হল, রমেশ কাকা আর মায়ের সম্পর্ক। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই ওনার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক। বাবার জায়গায় অন্য কেউ, এটা আমি কখনওই মানতে পারিনি। ভাবলেই এখনও গা-টা কেমন যেন রি-রি করে ওঠে। আদি তো ছোটো ছিল, সেই কারণে ও কিছু বুঝত না। আমি বুঝতাম বলে সবসময় আমাকে বকাঝকা করত। সেই কারণেই আমি পুনেতে হোস্টেলে চলে গিয়েছিলাম। থাকতে চাইনি এই পরিবেশে, বিশ্বাস কর।’

অন্বেষার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা  দেওয়ার চেষ্টা করে শ্রী। দু-চোখ দিয়ে অঝোরে জল নেমে আসে তার। কাঁদতে কাঁদতেই শ্রী-র হাতটা চেপে ধরে সে। ‘বিশ্বাস কর, শ্রী, আমি চেষ্টা করি মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার করতে। যখন দুরে থাকি ভাবি মায়ের সাথে আর এরকম ব্যবহার করব না, কিন্তু সামনাসামনি দেখলেই সব ভাবনাচিন্তাগুলো কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। তখন শত চেষ্টা করেও নিজেকে আটকাতে পারি না।’

অন্বেষার কষ্টটা খানিকটা হলেও বুঝতে পারে শ্রী। তার দিকে এক গ্লাস জল বাড়িয়ে দিয়ে ধীর কণ্ঠে বলে, ‘দিদি তোমার কষ্টটা আমি ফিল করতে পারছি। কিন্তু একটা জিনিস কখনও ভেবে দেখেছ কি? সারাজীবন কাঁহাতক একটা মানুষ একা থাকতে পারে? ওনারও তো একটা লাইফ আছে। উনি তো চাইলে আবার বিয়েও করতে পারতেন, কিন্তু তোমাদের কথা ভেবে সেটা তো করেননি। নিজের সবটুকু দিয়ে তোমাদের মানুষ করেছেন। পরিবর্তে তিনি যদি কোনও কিছু নিয়ে একটু খুশি থাকেন তাহলে ক্ষতিটা কোথায়? তোমায় শিক্ষা দিয়েছেন, ভালোভাবে মানুষ করেছেন, কোথাও কোনও খামতি রাখেননি। তাহলে তোমরা মায়ের খুশির জন্য এইটুকু কেন মানতে পারছ না। ভেবে দেখেছ কখনও? যদিও এখন আর এসব ভেবে লাভ নেই। আমি যতদূর জানি বছর দুয়েক হল রমেশকাকা নিরুদ্দেশ।’ বিষণ্ণ হয়ে ওঠে শ্রী।

শ্রী-র মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে অন্বেষা। অবলীলায় মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘কী বলছিস? এসবের তো আমি কিছুই জানি না। অবশ্য কোনওদিন জানার চেষ্টাও করিনি। শুধু স্বার্থপরের মতো নিজের কথাই ভেবে এসেছি। মায়ের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছি নিজেকে।’ বলে চুপ করে যায় অন্বেষা।

শ্রী আবার বোঝায়, ‘দিদি, আজ রাতেই তো তোমার ফ্লাইট। এই যে যাবে, আবার কবে আসবে জানি না। যাও না, একটু মায়ের পাশে গিয়ে বসো না। দেখবে তোমারও ভালো লাগবে আর মায়েরও ভালো লাগবে।’

এরপর বেরোনোর আগে পর্যন্ত অন্বেষা মায়ের সাথে সুখ-দুঃখের অনেক কথা বলেছে। যাওয়ার আগে খুব শিগ্গির আসার ইচ্ছাও প্রকাশ করে গেছে।

দিনদুয়েক পরে আদিত্যও মাকে শ্রীয়ের ভরসায় রেখে ইউএস রওনা দিল। এখন বাড়ির সদস্য বলতে বৃন্দা আর শ্রী। মানসিকভাবে দৃঢ় হলেও বৃন্দা আন্টিকে নিয়ে একটু চিন্তাতেই ছিল শ্রী। কীভাবে সুস্থ হবে? কতদিন লাগবে? আদিত্য থাকতে মনের একরকম জোর ছিল, কিন্তু ও চলে যাওয়াতে এখন একটু নার্ভাস বোধ করছে। নিজের বাবাকে দীর্ঘ পাঁচ বছর পক্ষাঘাতে পড়ে থাকতে দেখেছে সে। কী যে কষ্টের আর যন্ত্রণার তা সে চাক্ষুস করেছে। তাই সে যে ভাবেই হোক, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার আন্টিকে আবার আগের মতো হেঁটে-চলে বেড়াতে দেখতে চায়। তার জন্য যা করতে হয় তাই করতে সে রাজি।

নার্সের জন্যও অপেক্ষা করত না শ্রী। আদিত্যর মাকে পট বাড়িয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে গা স্পঞ্জ করে দেওয়া, কোনও কিছুতেই তার কোনও দ্বিধা নেই, ঘেন্না নেই। অবলীলায় হাসতে হাসতে সেইসব কাজ করে সে। টাইমে ওষুধ খাওয়ানো, মাসাজ করা, এক্সারসাইজ করানো সবকিছুর মধ্যেই ভীষণ আন্তরিক ভাব।

বৃন্দা আন্টিকে সারিয়ে তোলার জন্য শ্রীর আপ্রাণ চেষ্টা সত্যিই কাজে দিয়েছিল। মাত্র দিন কুড়ির মাথাতেই হঠাৎই আন্টির বাঁ-হাতের আঙুলগুলো নড়ছে দেখে খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠেছিল শ্রী। আনন্দ ভাগ করে নিয়েছিল আদিত্য এবং দিদির সঙ্গে। বাড়িতে রুটিন চেক-আপে এসে ডাক্তারও রীতিমতো আশ্চর্য হয়েছেন। ছোটোপিসি তো হাত উজাড় করে আশীর্বাদ করে গেছে তাকে।

এভাবেই কেটে যায় আরও কয়েকটা দিন। এখন বৃন্দা ডান হাতে ভর দিয়ে নিজেই বসতে পারেন। শ্রী ধরে ধরে দু-এক পা হাঁটায়ও। মাঝে মাঝে একা থাকলে পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে পড়ে তাঁর। স্বামী মারা যাওয়ার পরে পরেই তাঁকে বিজনেস জয়েন করতে হয়েছিল। যদিও তখন ব্যাবসার সাতপাঁচ বুঝতেন না বৃন্দা। এক অর্থে প্রথম প্রথম পুরো বিজনেসটাই দেখাশোনা করতেন রমেশ।  প্রায় ভরাডুবি অবস্থা ছিল তখন ব্যাবসার৷ আস্তে আস্তে সবকিছু বুঝে নিতে সময় লেগেছিল বৃন্দার। নির্ভরতার মাঝে  কখন যে রমেশের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন, তিনিও বোধকরি নিজেও বুঝতে পারেননি। তবে বরাবরই ছেলেমেয়েদের প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন বৃন্দা। তাদের কখন কী লাগবে, কীসে ভালো থাকবে, চিরকাল এটাই তাঁর ভাবনা ছিল। এমনকী যখন ব্যাবসায় রীতিমতো টালমাটাল অবস্থা তখন যেমন জলের দরে কোম্পানি বেচে দিয়ে কর্মীদের পাওনা-গন্ডা বুঝিয়ে দিয়েছেন, তেমনি ছেলেমেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে কোনও কমপ্রোমাইজ করেননি। মেয়েকে পুনেতে সিম্বায়োসিস-এ ভর্তি করানোর জন্য বাড়িটাকে পর্যন্ত বন্ধক রেখেছেন। অথচ এই দুঃসময়ে ছেলে-মেয়ে কেউ নেই তার পাশে। জীবিকার প্রয়োজনে হলেও, আছে তো দূরেই।

মনে মনে হাজারো রকম প্রশ্ন ঘুরতে থাকে তাঁর। ভাবতে বাধ্য হন তাঁর রক্তের সম্পর্ক কার সাথে– আদিত্য, অন্বেষা নাকি শ্রী-য়ের সাথে। কত আন্তরিক ভাবে তাঁর সমস্ত কাজ করে দেয় শ্রী, একটুও বিরক্ত হয় না। শ্রীয়ের জন্যই তো আজ সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। অথচ এই মেয়েকেই একদিন সে কতই না অপমান করেছে।

ভাবনায় বাধ সাধে পরমা। প্রায় রোজই একবার করে ঘুরে যায় সে। একগাল হাসি নিয়ে ঘরে ঢুকে বলে– ‘কী রে, শুনলাম দৌড়োচ্ছিস।’ কাছাকাছি বয়সের হওয়ায় পরমা বরাবরই বৃন্দাকে ‘তুই’ বলেই সম্বোধন করে।

‘হ্যাঁ, সবই শ্রী-র দৌলতে। আজও কয়েক পা হাঁটিয়েছে আমাকে।’ হেসে জবাব দেন বৃন্দা।

‘হাসপাতালে তোর অবস্থা দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম রে। ভেবেছিলাম তুই বোধহয় আর…’ চোখ জলে ভরে আসে পরমার।

পরমাকে দেখে বৃন্দারও চোখ ভিজে যায়। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘এত তাড়াতাড়ি তোমাদের ছেড়ে যাচ্ছি না বুঝেছ। এখন ছেলের বিয়ে দেব। নাতি-নাতনির মুখ দেখব। তবেই আমার যাবার পালা।’ হেসে ফেলে পরমাও।

‘যাও তো, আলমারিটা খুলে মায়ের দেওয়া বালাগুলো এনে দাও।’

‘ওটা  তো তুই তোর বউয়ের জন্য রেখেছিলিস?’

‘আরে হ্যাঁ, আগে আনো তো।’ বলে চাবির গোছাটা পরমাদির দিকে বাড়িয়ে দেন বৃন্দা।

মিনিট কয়েকের মধ্যেই বালাজোড়াটা এনে বৃন্দার হাতে দেয় পরমা। ঠিক সেই সময়তেই শ্রী চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢোকে।

‘এদিকে শোন তো। কাছে বস।’ আদর করে শ্রী-কে পাশে বসান বৃন্দা।

‘এখনও তোমার খাবার বানানো হয়নি। তারপর আবার অতগুলো ওষুধ।’ বকবক করে চলে শ্রী।

বকবকানি থামাতে ধমকে দেন বৃন্দা। ‘বস তো তুই। সারাদিন শুধু কাজ। হাতটা বাড়া।’

‘কেন?’

‘আবার প্রশ্ন করে। যা বলছি তাই শোন।’

কথা মতো হাতটা বাড়াতেই বৃন্দা শ্রীয়ের হাতে বালাজোড়া পরিয়ে দেন। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শ্রী। একটাও কথা বলতে পারে না।

শ্রী-র হাত দুটো তুলে ধরে বৃন্দা বলেন– ‘কী দিদি দারুণ মানিয়েছে না?’

‘খুব মানিয়েছে। আমাদের আদিত্যর জন্য ও-ই যথার্থ।’

শ্রীয়ের চোখ জলে ভিজে আসে। তাকে বুকে টেনে নেন বৃন্দা। আর মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ‘ওরে এখনই কেঁদে ভাসাচ্ছিস, জানিস তো শাশুড়িরা বউদের খুব জ্বালায়। আমি ট্র্যাডিশনের বাইরে কী করে যাব বল! আমি তো একটু হলেও জ্বালাব, তখনকার জন্য একটু বাঁচিয়ে রাখ। সামনের সপ্তাহে বাবু এসে তো আমাদের নিয়ে চলে যাবে।

তখন থেকে তো একসাথেই থাকতে হবে বল।’ বলে একসঙ্গে হেসে ওঠে সকলে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...