অফিস থেকে বাড়ি ফিরেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন প্রণববাবু। মেয়ে বলেছিল, চা-টা অন্তত খেয়ে যাও।

–এসে খাচ্ছি। বলে বাইরের ঘেমো পোশাক না ছেড়েই শুধু জুতোটা খুলে চটি গলিয়ে বেরিয়ে এসেছেন। নিজের অক্ষমতা ঢাকতেই এত তাড়াহুড়ো। অফিসে বসে ফোন পেয়েছিলেন মেয়ের। বলেছিল, বাবা, মায়ের জ্বরটা বেড়েছে। একশো চার। মাথা তুলতে পারছে না। কী করব?

প্রণববাবু বলেন, তোর দাদাকে বল ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। তাকে যদি না পাস, তুই-ই নিয়ে যা।

–ঠিক আছে। বলার পর মেয়ে জুড়ে দিল, আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরো।

ফেরা হয়নি। মেয়েও জানে প্রাইভেট কোম্পানির কেরানি বাবা, ইচ্ছে থাকলেও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারবে না। মায়ের শরীর খারাপটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাওয়াতে ঘাবড়ে গিয়ে আকুতিটা জানিয়েছিল।

প্রণববাবু বাড়ি ফিরে শুনলেন ছেলে তার মাকে নিয়ে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে। খুব সংকটজনক অবস্থা ছাড়া ডাক্তারকে কল দেওয়া হয় না। প্রণববাবুর সামর্থ্য কম। মেয়ে পিউ দাদাকে ফোন করে ডেকে রিকশাভাড়া, ডাক্তারের ফিজ আর অল্প কিছু টাকা ওষুধের জন্য দিয়েছিল। ছেলে সমু বেকার। পার্টিঅফিস অথবা পাড়ার ক্লাবই তার আস্তানা। খেতে শুতে আসে বাড়িতে। বাবাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলে সমু। প্রণববাবু কাছাকাছি এসে পড়লে ওর চেহারায় কেমন একটা যেন অসন্তোষ ভাব ফুটে ওঠে। বাবার প্রতি সমুর কীসের এত বিরাগ, প্রণববাবু বুঝে উঠতে পারেন না। ছেলেকে লেখাপড়ার ব্যাপারে কখনও চাপ দেননি। যা দেওয়ার দিয়েছে ওর মা। গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর ছেলে দিনের পর দিন বেকার বসে আছে। কোনও গঞ্জনা করেননি প্রণববাবু। বলেননি, সংসারের হালটা এবার ধর। বোনের বিয়ে দিতে হবে। অনেক খরচা আছে সামনে…। প্রণববাবু জানেন এই কথাগুলো ছেলেকে বলার কোনও দরকার নেই। এ-টুকু দায়িত্ববোধ সমুর আছে। সে নিশ্চয়ই সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছে স্থায়ী কোনও রোজগারের। তাই তো পার্টিটা করে। ক্লাবে পড়ে থাকে যদি পাড়ার কোনও ব্যাবসাদার ওকে কোনও কাজ-টাজ দেয়। স্বাধীনভাবে ব্যাবসা করার জন্য সমু বাবার থেকে মূলধন চাইতে পারে না। সামান্য মাইনেতে বাবা যে কী ভাবে টেনেটুনে সংসার চালায়, সে ভালো মতোই জানে। ছেলের মা, মানে মিত্রা বারকয়েক প্রণববাবুকে বলেছেন, তোমার অফিসেই সমুর জন্য একটু চেষ্টা করে দেখো না। এতদিন ধরে কাজ করছ! একে তাকে ধরে যদি কোনও ভাবে ওকে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়।

রক্ত জল করে খাটা নিজের ওঁচা কোম্পানিতেই ছেলের চাকরির জন্য ইউনিয়ন, ছোটো-মেজো কর্তাদের ধরেছিলেন প্রণববাবু, সুবিধে করতে পারেননি। কয়েকজন সহকর্মী কিন্তু পেরেছে, নিজের ছেলে, এমনকী নিকট আত্মীয়কে ঢুকিয়ে দিতে। প্রণববাবুর দ্বারা কেন হল না, কে জানে! ধরা-করায় কোথাও একটা খামতি থেকে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। খামতিটা কী, জানতে চেয়েছিলেন স্ত্রীর কাছে। মিত্রা বলেছে, তুমি তো তেমন চালাক-চতুর নও। ঠিকঠাক তেল মারতে পারো না কাউকে। বড্ড গোবেচারা, মিনমিনে টাইপের।

সমু গোবেচারার সন্তান হওয়া মেনে নিতে পারে না, তাই বাবার প্রতি এত অসন্তোষ। কিন্তু জন্ম তো একটা অ্যাক্সিডেন্ট, কিছুই করার নেই মানুষের। তবে সমু যে আজ মা-কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল, এই ব্যাপারটাতে খুশি হয়েছেন প্রণববাবু। ছেলে বাড়ির প্রতি উদাসীন হয়ে পড়েনি। সমস্যা হয়েছে একটাই, এত দামি ওষুধ লিখেছে ডাক্তার, সমু দু’ডোজের বেশি কিনতে পারেনি। বোন গোনাগুনতি টাকা দিয়েছে তাকে। এর জন্য প্রণববাবুই দায়ী। বাড়ির ওষুধপত্র তিনিই কেনেন। সেবা মেডিকেল স্টোর থেকে টোয়েন্টি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট পান। এখানে সব দোকানে এখন টেন চলছে। সেবা-র মালিক বিদ্যুৎকে প্রণববাবু এককালে টিউশন পড়াতেন। সেই সম্মান এবং কৃতজ্ঞতা থেকে বিদ্যুৎ প্রণববাবুকে এক্সট্রা টেন পার্সেন্ট দেয়। তার সঙ্গে এটাও জানিয়ে রেখেছে, স্যার, টোয়েন্টি নিতে হলে আপনাকেই আসতে হবে। অন্য কাউকে দিয়ে পাঠালে দিতে পারব না। বাড়ির লোকের হাতেও না। ছাড়টা জানাজানি হলে বাকি কাস্টমারও ডিমান্ড করবে।

সেই কারণে বেশি টাকার ওষুধ কেনার হলে প্রণববাবুকেই আসতে হয় বিদ্যুতের দোকানে। বাড়ির লোক ব্যাপারটা জানে বলেই পিউ তার দাদাকে ওষুধ কেনার জন্য বেশি টাকা দেয়নি। আন্দাজ করে একদিন চলার মতো দিয়েছিল। ওষুধ দামি হওয়ার কারণে দু’প্রকার ট্যাবলেট দুটো করে হয়েছে। এক জোড়া খাওয়া হয়ে গেছে, সন্ধের দিকে খেতে হবে এক ডোজ। রাত থেকে ওষুধ নেই। এ-ছাড়া জ্বর বাড়লে যে ট্যাবলেটটা দিতে বলেছে ডাক্তার, সেটাও কিনতে পারেনি সমু। …বাড়ি ফিরে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝে নেওয়ার পর প্রণববাবু চা খেয়ে সময় নষ্ট করেননি। সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। জ্বর আয়ত্ত্বে আনার ওষুধটা হাতের কাছে থাকা খুবই জরুরি।

জিটি রোড ধরে এতক্ষণ সাইকেল চালাচ্ছিলেন প্রণববাবু। শোভনা বস্ত্রালয়ের পাশের গলিটা এবার ধরতে হবে। রাত হতে চলল, গলিতে আলো কম। বয়সের কারণে অন্ধকারে সাইকেল চালাতে একটু সমস্যা হয়। তার জন্য এই শর্টকাটের রাস্তাটিকে এড়ানোর কোনও মানেই হয় না।

গলিতে ঢুকে কিছুটা যেতে না যেতেই বাধা। বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটছে, একটা ছেলেকে পাঁচ-ছ’জন মিলে বেদম মারছে। মার খাওয়া ছেলেটা মনে হচ্ছে বিদ্যুতের দোকান থেকেই ওষুধ কিনে ফিরছিল। প্ল্যাস্টিকের ছোটো ক্যারিব্যাগটা এখন রাস্তায়, ছড়িয়ে পড়েছে ট্যাবলেটের ফয়েল। এসব ঝুট-ঝামেলা একদম সহ্য করতে পারেন না প্রণববাবু। বুক ধড়ফড় করে। গলি সরু, তবু ব্রেক কষে সাইকেলের গতি কমাননি প্রণববাবু, মারধরের জটলার পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, এমন সময় শুনতে পেলেন আর্তস্বর, কাকু বাঁচান! বাঁচান আমাকে!

গলি শুনশান। প্রণববাবু বুঝতেই পারলেন আর্তিটা তাঁর উদ্দেশ্যে। আবছা আলোতে ছেলেটাকে যতটুকু দেখেছেন, অচেনাই ঠেকেছে। গলাটাও কোনওদিন শুনেছেন বলে মনে করতে পারলেন না। প্রণববাবুর বয়সি যে কেউ এখন এই রাস্তা দিয়ে গেলে, ছেলেটা একই ভাবে বাঁচাতে বলত। যারা মারছে, তারাও যেন প্রণববাবুকে চিনে না রাখে। প্যাডেলে বাড়তি চাপ দিয়ে প্রণববাবু এগোতে লাগলেন। ছেলেটা চেনা হলেও মার আটকাতে যেতেন না। পাঁচ-ছ’জন মারমুখি জোয়ান ছেলে, যাদের হাতে লাঠিসোঁটাও আছে, তাদের বিরুদ্ধে এই বয়সে খালি হাতে দাঁড়ানোটা মূর্খামি হতো। তবে প্রণববাবুর মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। তাঁদের এই মফস্সল শহরটা বছর দশেক আগেও কত নির্ঝঞ্ঝাট, শান্ত-শিষ্ট ছিল। যত দিন যাচ্ছে দুর্গানগরে অশান্তি বাড়ছে। লেগেই আছে মারপিট, চুরি-ছিনতাই। যে-ছেলেটা মার খাচ্ছে, তার কেনা ওষুধগুলো রোগীর কাছে পৌঁছোবে না। ছেলেটারই চিকিৎসার দরকার পড়বে। হয়তো ওর বাড়ির কেউ অসুস্থ, মা অথবা বাবা, নিকট আত্মীয়ও হতে পারে। ছেলেটার অপেক্ষায় বসে থাকবে তারা।

গলি শেষ হতে চলল। মোড়ের মুখে আলো ঝলমলে ‘সেবা মেডিকেল’, কাস্টমারের ভালোই ভিড়। মন খারাপটা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে গেলেন প্রণববাবু। দোকানের সামনে রাখা বেশকটা সাইকেলের পাশে নিজের সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে চাতালে উঠে পড়লেন। তাঁর বাড়িতেও একজন অসুস্থ, ওষুধ নিয়ে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি।

ভিড়ের কারণে একটু সময় লাগল ওষুধগুলো পেতে। এক সপ্তাহের প্রেসক্রিপশন করেছিল ডাক্তার, প্রণববাবু চারদিনের মতো নিলেন। মিত্রার একটা বদভ্যাস, শরীর একটু সামলে গেলেই ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। মিছিমিছি টাকা নষ্ট। দু’দিন ওষুধ খেয়ে রিপোর্ট করতে বলেছে ডাক্তার, তখন আবার কোনও ট্যাবলেট বদলে দিতে পারে। আগে থেকে বেশি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই।… ফেরার পথে গলির দিকে গেলেন না প্রণববাবু। ব্যানার্জিপাড়ার চওড়া রাস্তাটা ধরে মেন রাস্তার উদ্দেশ্যে এগোচ্ছেন। স্পিডে চালাতে চাইছেন সাইকেল, ঠিক মতো চলছে না। একটু টাইট আর টাল লাগছে সাইকেলটা। যখন ওষুধ কিনতে ঢুকেছিলেন দোকানে, কারওর অসতর্ক ধাক্বায় সাইকেলটা কি পড়ে গিয়েছিল? সেই কারণেই কি হ্যান্ডেল, প্যাডেল টাল খেয়ে গেল? এখন চেক করার সময় নেই, বাড়ি গিয়ে দেখবেন।

মেন রাস্তায় খানিকক্ষণ চালানোর পর প্রণববাবু টের পেলেন অস্বাচ্ছন্দ্যটা হ্যান্ডেল, প্যাডেলের নয়, গোটা সাইকেলের চলনটাই আলাদা ধরনের। বসার সিটটারও অনুভূতি অচেনা। তা হলে কি ওষুধের দোকান থেকে বেরোনোর পর ভুল করে অন্য কারওর সাইকেলে চেপে বসেছেন?

রাস্তার ধারে চলে গেলেন প্রণববাবু। সাইকেল থেকে নেমে দেখলেন, যা ভেবেছিলেন তাই! এটা তাঁর সাইকেল নয়। কোম্পানি আলাদা, সিটকভার কালো রঙের। তাঁরটা ছিল নীল। এত বড় ভুল হল! এইটা তাঁর সাইকেলের চেয়ে খানিকটা নতুন। কী করবেন এখন? বিদ্যুতের দোকানে গিয়ে দেখবেন, তাঁরটা আছে কিনা? যদি না থাকে? বিদ্যুৎ তাঁকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করবে, কী ব্যাপার মাস্টারমশাই, ফিরে এলেন!

সত্যিটা বলতেই হবে এবং রেখে আসতে হবে সাইকেলটা। বিদ্যুৎ হয়তো বলবে, নিয়ে যান। বোঝাই যাচ্ছে বদলাবদলি হয়েছে। আপনার সাইকেলটা কেউ ফেরত নিতে এলে আপনাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দেব।

এতটা দূর অবধি তবু ঠিক আছে। কিন্তু বদলাবদলির বদলে প্রণববাবুর সাইকেল যদি চুরি হয়ে থাকে, ফেরত পাওয়ার চান্স নেই। ভদ্রতাবশত এই সাইকেলটা রেখে আসতে হবে। এমনটা হওয়াও অসম্ভব নয়, এর মালিক সাইকেল হাপিশ হওয়া নিয়ে দোকানের সামনে এখন হই-চই করছে। প্রণববাবু পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গে নিজের সাইকেল ছিনিয়ে নেবে। হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে প্রণববাবুকে। শুধু তাই নয়, কাল অফিস যাওয়ার সময় সাইকেল ছাড়াই পৌঁছোতে হবে স্টেশনে। নতুন সাইকেল কেনার বিলাসিতা করা যাবে না এখন। সাইকেল সারাইয়ের দোকানগুলোয় পুরোনো সাইকেল বিক্রি আছে কিনা খোঁজ নিতে হবে। তার মানে ততদিন পা দু’টোর উপর ভরসা। অফিস, দোকান-বাজার সব জায়গাতেই সময় লাগবে বেশি।

এর চেয়ে ভালো ক’টা দিন অপেক্ষা করা যাক। বদলাবদলির সম্ভাবনাই বেশি। এই সাইকেলের মালিক প্রণববাবুরটা দোকানে নিয়ে আসবে, বিদ্যুৎ চিনতেও পারবে। প্রণববাবুর সাইকেলের স্ট্যান্ডটা গোলমেলে, দাঁড় করাতে সমস্যা হয়। সেটা দেখে বিদ্যুৎ এক-দুবার বলেছে, স্যার, সাইকেলটা এবার পালটান। অনেকদিন তো হল। …আর একদিন বলল, স্ট্যান্ডটা অন্তত নতুন লাগিয়ে নিন।… সাইকেল ফেরত এলে বিদ্যুৎ লোকটাকে পাঠাবে প্রণববাবুর বাড়ি। তখনই যে যার নিজেরটা পেয়ে যাবে। এটা ঘটার হলে কালকের মধ্যেই ঘটবে। যদি চুরির ঘটনা হয়, ঘটনাটা ঘটবে না। যত দ্রুত সম্ভব একটা সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেল কিনে, এটা বিদ্যুতের দোকানে দিয়ে আসবেন প্রণববাবু। ফেরত দিতে দেরির কারণ হিসেবে বলবেন, কাজে আটকে পড়েছিলাম। আসতে পারিনি।

ফের সাইকেলে উঠে পড়েছেন প্রণববাবু। অচেনা সাইকেল দেখে বাড়ির লোকের মনে প্রশ্ন জাগবে। কিছু জিজ্ঞেস করলে প্রণববাবু বলবেন, আমারটা একজন ভুল করে নিয়ে গেছে, আমি তারটা চেপে চলে এসেছি।

পরের দিন অফিস বেরোনোর আগে খেতে বসেছেন প্রণববাবু। মেয়ে পিউ খাবার দিচ্ছে টেবিলে। মিত্রার জ্বর নেমে গেলেও, শরীর খুবই দুর্বল। চেয়ারে বসে স্বামীর খাওয়া দেখছে। বলে উঠল, কাল তো বাজারের গলিতে একটা খুন হয়েছে, শুনেছ?

বুকটা ধড়াস করে উঠল প্রণববাবুর। সেই ছেলেটাই কি? মার খাচ্ছিল যে? ভিতরের উত্তেজনা সামলে স্বাভাবিক গলায় জানতে চাইলেন, কখন হল খুন?

– রাত আটটা নাগাদ। তুমি যখন ওষুধ আনতে বেরোলে। বাজারের দিকেই তো গিয়েছিলে, কোনও গোলমাল টের পাওনি? জানতে চাইল মিত্রা।

খাবার গলা দিয়ে নামতে চাইছে না, প্রণববাবু বুঝতেই পারছেন সেই ছেলেটাই। স্ত্রীকে বললেন, না, আমি তো কোনও গণ্ডগোলের আঁচ পাইনি। খবরটা কে দিল তোমাকে?

– সকালে সমু বলল। কাল রাতেই ঘটনাটা ওর কানে এসেছে। আজ কাগজে বেরিয়েছে খবরটা।

এবাড়িতে খবরের কাগজ নেওয়া হয় না। সমু পড়ে পাড়ার কোনও দোকানে বা ক্লাবে। প্রণববাবু চোখ বোলান অফিসে, কোনও সহকর্মীর থেকে নিয়ে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফের মিত্রা বলতে থাকল, কী যে হচ্ছে আজকাল! কোন মায়ের কোল খালি হল, কে জানে! সমুরই বয়সি ছেলেটা। খুব নাকি পরোপকারী।

–সমুর চেনা, মানে আলাপ ছিল? খাওয়া থামিয়ে জানতে চাইলেন প্রণববাবু। আসলে জানার ইচ্ছে সমুর বন্ধু ছিল কিনা, তাহলে প্রণববাবুকে চিনতে পেরেই বাঁচাতে বলেছিল।

এবার পিউ উত্তর দিল, দাদা সেরকম তো কিছু বলল না। বন্ধু হলে নিশ্চয়ই কাল রাত থেকে হাসপাতাল-বাড়ি করত।

একটু হলেও আশ্বস্ত হলেন প্রণববাবু, অপরাধবোধের ভারটা বাড়ল না।

বাড়ি থেকে স্টেশনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছেন প্রণববাবু। অন্যের সাইকেলটাই চালাচ্ছেন। যা হোক তা হোক করে খাওয়া শেষ করেছেন আজ। কেন জানি তাঁর মনে হচ্ছে এই সাইকেলটা খুন হয়ে যাওয়া ছেলেটারই। ওর হাতে ওষুধের ক্যারিব্যাগ ছিল। সেবা মেডিকেলে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। গলির কাছে বলতে ওই দোকানটাই। ওখান থেকে বেরিয়ে সাইকেলে ওঠার আগেই দুষ্কৃতীরা ওকে ধরে, কোনও না কোনও অছিলায় গলিতে এনে শুরু করে মার। গলি নির্জন, লোক জড়ো হয়ে বাধা দেওয়ার সুযোগ নেই। এই সব কেসে পুলিশ বসে থাকবে না, এতক্ষণে খুনের তদন্ত শুরু করে দিয়েছে। ছেলেটার সাইকেলের খোঁজ পড়বেই। প্রণববাবুর সাইকেল ছেলেটা নেয়নি, পাওয়া যাবে দোকানের সামনে। সেই সূত্র ধরে পুলিশ আসবে প্রণববাবুর কাছে। …ভাবনাটা মাথায় খেলতেই পা-দুটোর জোর যেন ঝপ করে কমে গেল। প্যাডেলে সে ভাবে আর চাপ দিতে পারছেন না প্রণববাবু। পুলিশের জেরা ভয়ানক জিনিস। এসে বলতেই পারে, খুনের চক্রান্তে আপনিও জড়িত। মার্ডারটা যাতে নির্বিঘ্নে হয়, সেই পরিকল্পনার অংশীদার হয়ে আপনি ছেলেটার সাইকেল নিয়ে সরে পড়েছিলেন। বেচারির পালানোর ন্যুনতম সুযোগটুকু ছিল না।… প্রণববাবু তখন যদি বলেন, ওরা মারধর শুরু করার পর আমি দোকানে গেছি।… পুলিশ বলবে, আপনি তার মানে দেখেছেন ছেলেটাকে মারা হচ্ছে। বাধা তো দেনইনি, পুলিশকেও জানাননি ফোনে। অপরাধ ঘটতে দেখে পুলিশকে না জানানোটাও অপরাধ।… কথাগুলো ভাবতে ভাবতে প্রণববাবুর মনে হচ্ছে সাইকেলটা কোথাও ফেলে হেঁটে স্টেশনে যাওয়া উচিত। কিন্তু কোথায় ফেলবেন? তাঁদের মফস্সলে কোনও ঝোপঝাড় আর অবশিষ্ট নেই। ঘেঁষাঘেষি বাড়ি, ফ্ল্যাট, দোকান। অফিস টাইমে রাস্তায় এখন প্রচুর লোকজন। কোনও গলিতে গিয়ে যদি রেখে আসেন, কেউ না কেউ ঠিক দেখে নেবে, সাইকেলটা কে রাখল। তদন্তের সাক্ষী হয়ে যাবে সে। কী যে করা উচিত, বুঝে উঠতে পারছেন না প্রণববাবু। তবে এত দুশ্চিন্তার মধ্যেও কিছু আশাব্যাঞ্জক পয়েন্ট মাথায় আসছে। প্রথমত, তাঁর সাইকেল যদি পড়ে থাকত সেবা মেডিকেলের সামনে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই পুলিশ চলে আসত বাড়িতে। মাঝে একটা গোটা রাত গেছে। তদন্তপর্বের এই সময়টা ভীষণ মূল্যবান। সাইকেলটা নিয়ে গেছে অন্য কেউ, ফেলে গেছে এটা। প্রণববাবুর সাইকেল পড়ে থাকলে বিদ্যুৎ দোকান বন্ধ করার আগে লক্ষ্য করত এবং জানাত তাঁকে। অতএব সাইকেলটা খুন হয়ে যাওয়া ছেলেটার নয়। আর একটা আশার কথা, বাড়ির লোকও খেয়াল করেনি প্রণববাবু অন্য কারওর সাইকেল নিয়ে এসেছেন। তাঁর সাইকেল থাকে সিঁড়ির তলায়, সমুরটা ঢাকা বারান্দায়। বাড়ির কারওরই তেমন নজর যায় না সাইকেল দুটোর দিকে। ‘এই সাইকেলটা কার? তোমার সাইকেল কোথায়?’ এসব প্রশ্ন বাড়ির লোক আপাতত করছে না। যদি করে, সত্যি ঘটনা বললে ওদেরও মনে হবে সাইকেলটা বুঝি খুন হয়ে যাওয়া ছেলেটার। তার চেয়ে ক’টা দিন চুপচাপ থাকা যাক। যে ভুলোমনের লোকটা প্রণববাবুর সাইকেলটা নিয়ে গেছে, যদি ফেরত দিতে আসে, প্রণববাবু এটা দিয়ে দেবেন। ব্যস, ঝামেলা মিটে গেল।

পাঁচদিন কেটে গেল। অন্যের সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন প্রণববাবু। তাঁরটা এখনও ফেরত পাননি। বাড়ির লোকেরও চোখে পড়েনি এই সাইকেল আগেরটা নয়। এমনকী রেলস্টেশনে, যেখানে সাইকেল জমা দিয়ে অফিসের ট্রেন ধরেন, স্ট্যান্ডের ছেলেরাও অন্য সাইকেল দেখে কোনও মন্তব্য করেনি। আসলে সকলেই যে যার কাজে ব্যস্ত। প্রণববাবুও খুব একটা লক্ষ্য করার মতো ব্যক্তি নন, একেবারেই

ছা-পোষা। কেউ তেমন ধর্তব্যের মধ্যে আনে না। অতি সাধারণ হওয়ার এটা একটা সুবিধে। সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল কেনাটাও এখন মুলতুবি রেখেছেন প্রণববাবু। গতকাল মিত্রার ওষুধ ফুরিয়েছে, এখনও জ্বরটা ঘুরে ঘুরে আসছে, কোর্সের বাকি ওষুধগুলো প্রণববাবু আনতে গিয়েছিলেন সেবা মেডিকেলে, এই সাইকেলটা চেপেই গিয়েছিলেন। বিদ্যুৎ সাইকেল সংক্রান্ত কোনও কথাই তুলল না। ক’দিন আগে দোকান থেকে চার হাত দূরে ওই দোকানেরই এক কাস্টমার খুন হয়ে গেছে, সে সব নিয়েও কোনও আলোচনা নেই। যতদিন যাচ্ছে মানুষ কেমন যেন নিরাসক্ত হয়ে পড়ছে। প্রণববাবু কিন্তু খবরটায় চোখ রেখেছেন। অফিসে গিয়েই সহকর্মীর থেকে কাগজটা নিয়ে চোখ বোলান একটা খবরেই। এখন ভেতর পাতায় এবং ছোটো হয়ে এসেছে খবরটা। ছেলেটা পরোপকারী তো ছিলই। কিছু সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। একটি প্রতিষ্ঠানের বাড়ি দখলে নিতে চাইছিল কিছু সমাজবিরোধী, ছেলেটা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। খুন হতে হল অবশেষে। পুলিশ কয়েকজন আততায়ীকে চিহ্নিত করেছে। তারা সকলেই ফেরার। এই ধরনের ঘটনা নতুন কিছু নয়, আকছার ঘটছে। প্রথমবার প্রণববাবুর সামনে ঘটল। প্রণববাবু যে দেখেছেন ঘটনাটা, আততায়ীরা ছাড়া আর কোনও সাক্ষী নেই। যদি মুখ না খোলেন, প্রণববাবু নিরাপদ, খুনিরাও।

ভুলো লোকটা এখনও প্রণববাবুর সাইকেল নিয়ে ফেরত আসেনি। বোধহয় ব্যস্ত মানুষ, টাইম পায়নি আসার। সাইকেলের মতো তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো লোকও হয়তো সে নয়। ভাবছে, কাজ চলে যাচ্ছে, যাক। কোথায় বদলাবদলি হয়েছে, সেটাও মনে হয় খেয়াল করতে পারছে না। প্রণববাবুও ঠিক করছেন যে ভাবে চলছে, চলুক। সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল কিনতে গিয়ে অযথা টাকা খরচ করার কোনও মানেই হয় না। অসুবিধে শুধু একটাই, সাইকেলটাতে এখনও তিনি স্বাচ্ছন্দ্য হতে পারেননি। বেশ সমস্যা হয় চালাতে গেলে। এখনও মনে হয় সাইকেলটা প্রণববাবুর মালিকানা পছন্দ করছে না। সে নিজের মতো চলতে চায়। হ্যান্ডেল ঘোরাতে হয় জোর করে। প্যাডেলে চাপ মারতে হয় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। যান্ত্রিক কোনও জটিল গোলযোগ আছে সাইকেলটায়। সমস্যাটা ঠিক মতো বোঝানো যাবে না সারাইয়ের দোকানে। ত্রুটিটা নিজে অনুমান করতে চেয়ে গত পরশু অফিস ফেরত ট্রেন থেকে নেমে সাইকেল যেমন চলতে চেয়েছে, তেমনই চলতে দিয়েছিলেন প্রণববাবু। দেখা গেল সাইকেল বাড়ির উলটো পথে বেশ সাবলীলভাবে চলছে। প্রণববাবুদের দুর্গানগর পার হয়ে গেল, এরপর চণ্ডীতলা গ্রাম। অনিচ্ছুক ঘোড়ার লাগাম টানার মতো সাইকেল ঘুরিয়েছিলেন প্রণববাবু। বাড়ি ফিরতে যদি দেরি হয়ে যেত। চিন্তা করত মিত্রা, পিউ।

বাড়ির বিপরীত পথে সাইকেলের স্বাভাবিক চলনে প্রণববাবু বেশ বিস্মিত হয়েছেন। বড়ো খটকা লেগেছে মনে। আজ টিফিনের পর কেবল ফল্ট হয়ে কারেন্ট গেল অফিসে। ঘন্টা খানেক গরমে পচিয়ে ছুটি দিল কোম্পানি। অপ্রত্যাশিত ভাবে বেশ কিছুটা সময় পাওয়া গেল হাতে। সাইকেলটাকে ভালো করে পরখ করার এই সুযোগ। নিজেদের স্টেশনে নেমে, স্ট্যান্ড থেকে সাইকেল নিয়ে চেপে বসেছেন প্রণববাবু। বলা যেতে পারে নিজেকে সাইকেলটায় সঁপে দিয়েছেন। সাইকেল চলছে তার মর্জি মতো। আগের দিনের রাস্তাই ধরেছে। চণ্ডীতলায় এসে পড়েছেন প্রণববাবু। খালের দিকে যে মেঠো রাস্তাটা গেছে সাইকেল নিজের থেকেই সেই দিকে বাঁক নিল। সন্ধে নামছে। এখন কি এই নির্জন পথে যাওয়া ঠিক হচ্ছে?

রাস্তাটা মাঠ ধরে গেলেও মাটির নয়। পুরোটাই মোরাম পাতা এবং লরি যাওয়ার মতো চওড়া। কারণ, এই রাস্তার শেষে আছে একটা ইটখোলা, তারপরই গঙ্গার খাল। ইটখোলার জন্যই রাস্তার এত যত্ন। এখানে একবারই মাত্র এসেছিলেন প্রণববাবু, ইটের দর করতে। দোতলা তোলার ইচ্ছে ছিল। বাজেট করার পর পিছিয়ে গেছেন। সাধ্যে কুলোয়নি। কিন্তু সাইকেলটা তাঁকে আবার এখানে নিয়ে এল কেন?… ভাবনা এগোল না। কারণ, সাইকেলও এগোচ্ছে না। যেন গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে গেছে। কাজ-কারবার কিছুই বুঝতে পারছেন না প্রণববাবু, নেমে পড়লেন সাইকেল থেকে। গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তাও এগোচ্ছে না। স্ট্যান্ড নামিয়ে দিলেন প্রণববাবু। দু’পা পিছিয়ে গিয়ে সাইকেলটার দিকে তাকালেন, সন্ধের আবছায়াতে সাইকেলটাকে কেমন যেন জীবন্ত মনে হচ্ছে। নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে এসেছে আরোহীকে, এখন চাইছে তিনি আশপাশটা পায়ে হেঁটে দেখুন। কিছু একটা তাকে দেখাতে নিয়ে এসেছে সাইকেলটা। দেখার মতো কী আছে এখানে? অদূরে ইতস্তত সার সার ইটের পাঁজা। মাঝে ঢিবির মতো ভাটি, এখন নিভন্ত। ঢিবিটা সন্ধের অন্ধকার মাখা। আকাশ ছোঁয়া চিমনির মাথায় দিনশেষের চিলতে আলো। নিয়ে যখন এসেছে, কিছু তো একটা দেখার আছে নিশ্চয়ই।

দৌড়ে সব থেকে কাছের ইট সাজানো পাঁজার কাছে গেলেন প্রণববাবু। আড়াল ধরে সন্তর্পণে এগিয়ে যাচ্ছেন! স্ফূর্তির আড্ডা চলছে। পরের লাটের ওপার থেকে আসছে আওয়াজ। আলোও জ্বলছে ওখানে। বিড়াল পায়ে এগিয়ে গেলেন প্রণববাবু। পাঁজাটার ধারে গিয়ে বাড়ালেন মুখ, তাস-মদের আড্ডা চলছে। ইটখোলার অফিস থেকে তার টেনে জ্বালানো হয়েছে মাথা ঢাকা দেওয়া বাল্ব। দলটাকে খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে চমকে উঠলেন প্রণববাবু, সাতজনের চারজনই তাঁর চেনা! এই চারজন শোভানা বস্ত্রালয়ের গলিতে ছেলেটিকে মারছিল। পরে যে মারা যায়। আক্রমণকারী চারজনের বেশি ছিল। এক ঝলক দেখে এদেরকেই মনে রাখতে পেরেছেন প্রণববাবু। চারজনের দুজনকে ইট দর করতে এসে দেখেছিলেন এই খোলায়, সেটা এইমাত্র মনে পড়ল। ঘটনার সময় খেয়াল হয়নি। …পা কাঁপছে প্রণববাবুর, স্পষ্ট টের পাচ্ছেন সাইকেলটা মৃত ছেলেটারই। ওর আত্মা হত্যাকারীদের চেনানোর জন্য এখানে এনেছে। এদের হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। কিন্তু প্রণববাবু তো পুলিশের কাছে যাবেন না। বিস্তর ঝামেলা। যখন তখন ডেকে পাঠাবে থানা, আদালত। ধরিয়ে দেওয়ার জন্য এরাও লোক দিয়ে শোধ তুলবে প্রণববাবুর উপর। অনেক কষ্টে টিকিয়ে রাখা তাঁর সাংসারিক জীবন ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। …ইটের পাঁজা থেকে সরে প্রায় দৌড়ে এসে সাইকেলে উঠে পড়লেন প্রণববাবু। সজোরে প্যাডেল মারতে লাগলেন। তিনি আর সাইকেলটার মর্জি মতো চলবেন না, সোজা বাড়ি ফিরবেন।

তা কিন্তু হল না। কী ভাবে জানি থানার সামনেই এসে পড়লেন প্রণববাবু। সাইকেলটাই নিয়ে এল আর কি! প্রণববাবু বুঝলেন নিস্তার নেই। অদৃশ্য একজন তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করছে। থানার বাইরে স্ট্যান্ড করলেন সাইকেল। নিরুপায় মুখ নিয়ে ঢুকলেন ভিতরে।

একঘন্টার উপর কেটে গেল থানায়। টেবিলের এপারে বড়োবাবুর মুখোমুখি বসে আছেন প্রণববাবু। নিহত ছেলেটির বিষয়ে যতটুকু যা দেখেছেন। তারপর যা যা ঘটেছে সবিস্তারে বলেছেন ওসিকে। আততায়ীর হদিশ পেয়েই ওসি ফোর্স পাঠালেন ইটখোলায়। মনে হচ্ছে গোটা দলটা ধরা পড়েছে। এই মুহূর্তে কানে ফোন রেখে ফোর্সের কারুর সঙ্গে কথা বলছেন ওসি। চোখেমুখে উৎফুল্ল ভাব। কান থেকে ফোন নামিয়ে বড়োবাবু হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ইউ ডিড আ গ্রেট জব। সবকটা ধরা পড়েছে। সমাজের সবাই যদি আপনার মতো এগিয়ে আসত!

হ্যান্ডশেক সারা হল। প্রণববাবু বলতে যাচ্ছিলেন, আমি কিছু করিনি স্যার। যা করার ওই সাইকেলটাই… বললেন না। কথা বাড়িয়ে কী লাভ! বদলে বললেন, আমি তা হলে এখন বাড়ি যাই স্যার।

–সে কী, ওরা আসুক। আপনাকে তো আইডেন্টিফাই করতে হবে ওদের। ওসির কথায় মুখ আরও শুকিয়ে গেল প্রণববাবুর। বললেন, আমার খুব শরীর খারাপ লাগছে স্যার। সেই কোন সকালে অফিসে বেরিয়েছি। তারপর এতক্ষণ সাইকেলিং! তা ছাড়া আপনারা যে-দলটাকে খুঁজছিলেন, তাদেরই তো পেয়ে গেলেন। আমার সাক্ষীর আর কী দরকার?

–এখন অত দরকার না পড়লেও, কোর্টে আপনাকে সাক্ষী দিতে যেতে হবেই। আপনি একমাত্র আই উইটনেস। আপনি না চেনালে ওরা শাস্তিই পাবে না।

এসব ঝামেলা আসবে, জানেন প্রণববাবু। সেই কারণেই থানায় আসতে চাননি। বাঁচার ক্ষীণ চেষ্টায় প্রণববাবু বললেন, আমার স্যার প্রাইভেট কোম্পানি। কোর্টে যাওয়ার ছুটি কি পাব? সাক্ষী দিতে গিয়ে চাকরি না চলে যায়।

–ছুটি পাবেন না মানে! কোর্ট ডাকলে মালিক ছুটি দিতে বাধ্য। দাপটের সঙ্গে বললেন ওসি। প্রণববাবু কল্পনায় দেখে নিলেন এই দাপটের আঁচ লাগল তাঁর সদাগম্ভীর বসের মুখে। মুহূর্তে মিইয়ে গেল সেই অভিব্যক্তি। মনের চোখে প্রণববাবু দেখছেন, বস এসে তাঁকে বলছেন, আপনি ভাই তাড়াতাড়ি কোর্টে যান। পুলিশ অফিসার এই মাত্র ফোন করল। কোর্ট থেকেই বাড়ি চলে যাবেন, আজ আর অফিসে আসতে হবে না। কাল যেমন আসার আসবেন।

–চলুন, এবার আপনার সাইকেলটা দেখা যাক। যে-ছেলেটা খুন হয়েছে, সে ওষুধের দোকানে সাইকেল নিয়ে গিয়েছিল, এমন কোনও খবর নেই আমাদের কাছে।

ওসির কথায় বাস্তবে ফিরেছেন প্রণববাবু। বললেন, চলুন, দেখুন কার সাইকেল। আপনাদের কাছে সঠিক খবর নাও থাকতে পারে।

থানার বাইরে বেরিয়ে সাইকেলের সামনে যেতেই থমকে দাঁড়ালেন প্রণববাবু। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না। ভ্যাবাচাকা মুখ নিয়ে তাকালেন বড়োবাবুর দিকে। বড়োবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী হল?

বিস্ময়ের গলায় প্রণববাবু বললেন, এ তো আমারই সাইকেলটা স্যার। যখন ভিতরে ছিলাম, কেউ কি বদলে দিল?

ওসির ঠোঁটে প্রবোধ দেওয়ার হাসি। বললেন, আপনার ধারণা মতো সাইকেলটা মৃত ছেলেটার। সে তো আর এসে সাইকেল পালটে দিয়ে যাবে না। কোথাও ভুল হচ্ছে আপনার। টেনশনে আছেন, বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিন।

প্রণববাবুর দেরি দেখে মিত্রা, পিউ বেশ টেনশনে পড়ে গিয়েছিল। ওরা নাকি ফোনও করেছিল, প্রণববাবু ধরেননি। ‘অফিসে কাজের চাপ ছিল, বেরোতে দেরি হয়েছে’, বলে প্রণববাবু হাতমুখ ধুতে বাথরুমে গেলেন। ফিরে এসে চা নিয়ে বসেছেন টিভির ঘরের সোফাটায়। স্ত্রী এবং মেয়ে রয়েছেন এই ঘরেই। ওদের উদ্দেশ্যে শান্ত গলায় বললেন, তোমরা খেয়াল করেছ, এই কদিন আমি অন্যের সাইকেল নিয়ে বাড়ি ঢুকছিলাম?

–কই, না তো। সিঁড়ির তলাটা ধুতে গিয়ে গত দু’দিন তোমার সাইকেলটাই তো দেখেছি। বলার পর মিত্রা সামান্য উৎকণ্ঠার গলায় জানতে চায়, কেন, কী হয়েছে?

–পরে বলছি। বলে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন প্রণববাবু। চলন্ত টিভির দিকে তাকিয়ে ডুব দিলেন মনের গভীরে। থানার বড়োবাবু বলছেন কোথাও একটা ভুল হচ্ছে তাঁর। একটা ব্যাপার একটু গোলমাল লাগছে বটে, দু’জন দুষ্কৃতীকে তিনি আগে থেকে চিনতেন ইট দর করতে গিয়ে দেখেছিলেন খোলায়। তা হলে কি ওদের ডেরায় অন্য কেউ নিয়ে যায়নি? তিনি নিজেই… বাকিটা আর ভাবতে পারছেন না। ভয়ে কপালে ঘাম এসে গেছে প্রণববাবুর।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...