কিডনি বা বৃক্বে যে পাথর জমতে পারে, এ বিষয়টি এখন আর কারও অজানা নয়। আর যাদের বৃক্বে পাথর জমেছে, তারা অনুভব করেছেন এর যন্ত্রণা কেমন। কিন্তু কিডনি স্টোন (নেফরোলিথিয়াসিস) হলে শরীরের কী কী ক্ষতি হতে পারে কিংবা এর সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতিটাই-বা কী, এ সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান অনেকেরই নেই। ওষুধের মাধ্যমে কিডনি স্টোন গলানো যায়, এই ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে অনেকের। স্টোনের আকার বৃদ্ধি হলে নিরাময় কঠিন। তাই শুরুতেই সতর্ক হোন। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসাকে মাধ্যম করে কিডনি স্টোন থেকে পরিত্রাণ পান। সম্প্রতি এ বিষয়ে আলোকপাত করলেন ডা. অমিত ঘোষ।
উল্লেখযোগ্য ঘটনাঃ দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতায় কত রোগীর সঙ্গেই তো চিকিৎসকের পরিচিতি ঘটে, কিন্তু কোনও কোনও রোগীর কথা মনে থেকে যায়। বহুজাতিক সংস্থার উচ্চপদে কর্মরত ৫৬ বছর বয়সি এক ব্যক্তি যখন ডা. ঘোষের কাছে আসেন, তখন তাঁর পেটে অসম্ভব যন্ত্রণা। একে গ্যাসের ব্যথা মনে করে দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে তিনি নিজেই ওষুধ খেয়ে গেছেন। শেষে যন্ত্রণা-যুদ্ধে পরাজিত হয়ে এক বিশেষজ্ঞ গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজিস্টের কাছে গেলে তিনি সোনোগ্রাফি করানোর পরামর্শ দেন। আর তাতেই ধরা পড়ে যে, তাঁর কিডনিতে স্টোন হয়েছে। এরপরে তিনি অন্য কোনও ‘প্যাথি’তে না গিয়ে, সরাসরি ডা. ঘোষের কাছে গিয়েছিলেন। ডা. ঘোষ সব শুনে রুগিকে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে কোনও চিকিৎসাতেই কিডনি স্টোন গলানোর ব্যবস্থা নেই, যেমনটা দাবি করা হয়।’
কিডনি ও স্টোনঃ শরীরে কিডনির বিশেষ ভূমিকা আছে। এই বিশেষ অঙ্গ ফিল্টারের মতো কাজ করে শরীরের অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর পদার্থ বর্জ্য হিসেবে প্রস্রাবের আকারে শরীর থেকে বের করে দেয়। যখন ফিল্টারের কাজ চলে তখন মূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া কিছু কেলাস, কিডনির ভেতরে এক ধরনের ডেলার সৃষ্টি করে অর্থাৎ জমাট বেঁধে যায়, যা আসলে স্টোন। ছোটো আকারের স্টোন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বেরিয়ে গেলেও, বড়ো স্টোন অপসারণ করতে হয়। অপসৃত না হলে এরা নানা সমস্যার সৃষ্টি করে। এমনকি সংক্রমণ ও সেপ্টিসেমিয়া ঘটিয়ে কিডনির কার্যকারিতা পর্যন্ত নষ্ট করে দিতে পারে।
উপসর্গঃ পাঁজরের নীচের অংশ থেকে নিতম্বের হাড় পর্যন্ত প্রচণ্ড ব্যথা হতে পারে। মূত্র ত্যাগের সময়েও অসুবিধে হয়। যেমন, বারে বারে প্রস্রাব, প্রস্রাবের সময় জ্বালা এবং সঙ্গে রক্ত বেরোনো। অনেক সময় ব্যথার তীব্রতা এত বেশি থাকে যে, রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
চিকিৎসাঃ যে-স্টোন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বেরিয়ে যায়নি, তা অপসারণে অস্ত্রোপচারই আদর্শ চিকিৎসা। ১ সেমি বা তারও ছোটো স্টোন লিথোট্রিপসির সাহায্যে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সমস্যা হয় বড়ো স্টোনের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে পিসিএনএল (পারকিউটেনিয়াস নেফ্রো লিথোটমি) করা হয়। পিসিএনএল একটি কি-হোল সার্জারি। ছোটো ফুটোর সাহায্যে এই অস্ত্রোপচার করা হয়। অ্যানাস্থিশিয়া করে পাঁজরের পর থেকে নিতম্বের হাড় পর্যন্ত অংশের যে-কোনও স্থানে ফুটো করে তৈরি করা পথে এন্ডোস্কোপের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। নেফ্রোস্কোপ নামের যন্ত্রটি কিডনিতে থাকা স্টোনের সঠিক অবস্থান নির্ধারণ করে। এরপর আলট্রাসোনিক, ইলেকট্রোহাইড্রলিক, নিউমোব্যালিস্টিক জাতীয় প্রোব ব্যবহার করে স্টোনকে ভাঙা হয় এবং নেফ্রোস্টোমি টিউব ব্যবহার করে ভাঙা টুকরোগুলিকে সরানো হয়। এর জন্য রোগীকে ১-২ দিন হাসপাতালে থাকতে হতে পারে। এতে সম্পূর্ণভাবে স্টোন অপসারিত হয় এবং দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যায়।
জরুরি বিষয়ঃ ব্যথা কমা মানে স্টোন চলে যাওয়া নয়। কোনও ‘প্যাথিতে’ ব্যথা কমিয়ে স্টোন চলে যাওয়ার দাবি করা হলে, সোনোগ্রাফি করে দেখে তবে নিশ্চিন্ত হবেন। কিডনি স্টোন কিন্তু বারে বারে হতে পারে, তাই সতর্ক থাকবেন। প্রতিদিন অন্তত চার লিটার জল পান করবেন। চকোলেট এবং চিনাবাদাম খাবেন না। মাঝেমধ্যে ডাবের জল পান করবেন।