সুবোধের যখন ঘুম ভাঙল পৃথিবীর গা থেকে কুয়াশার সর এতটুকু কাটেনি। যেন কয়েক লাখ টনের এসি ফুলদমে চলছে। পুরো কনকনে ঠান্ডা চারদিকে। পুরোনো সরষের তেলের গন্ধে ম-ম করা লেপটা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে আর এক চোট ঘুমের ব্যবস্থা করতে যাবে হঠাৎই মনে হল কাল রাতে ছেলেটার গায়ে চাদর ঢাকা দেওয়া হয়েছিল? আধো ঘুম আধো জাগা অবস্থায় গতকাল রাতের কথা মনে করতে চেষ্টা করল। রাত্রে ছেলেকে খাওয়ানো তারপর এঁটো বাসন তুলে…। কম্বলটা কি শেষপর্যন্ত জড়িয়ে দিয়েছিল? …যতদিন যাচ্ছে মাথাটার বারোটা যেন বেজে যাচ্ছে। আগে কত মনে থাকত! বড়ো বড়ো হিসেব সব গড়গড় করে বলে ফেলতে পারত, এখন সব গেছে, এই এক বছরে মাথাটা যেন অন্য লোকের হয়ে গেছে!

দু’-একবার এপাশ-ওপাশ করে নরম গরম বিছানার মায়া ছেড়েছুড়ে উঠে পড়ল সুবোধ। লেপ ছাড়তেই ঘ্যাঁক করে কামড়ে ধরল শীত। ঘরের টিউব জ্বালল। পাশের চৌকিতে নীলিমা ঘুমোচ্ছে। আপাদমস্তক লেপে ঢাকা। ও কী করে যে মুখ ঢেকে ঘুমোয় সে এক বিস্ময়। তিপ্পান্ন বছরের সুবোধ কোনওকালেই চাদর বা লেপে মুখ ঢেকে ঘুমোতে পারে না। দম আটকে আসে। নীলিমা ঠিক উলটো স্বভাবের। ছেলেটার স্বভাবও ঠিক তাই। পুরো মুড়ি দিয়ে তারপরে ঘুমোয়।

ঘরের এককোণে লালুয়া চটের পাপোশের ওপর গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছিল, সুবোধকে উঠতে দেখে এখন পিটপিট করে দেখছে। তিন বছর বয়স হয়ে গেল মদ্দা কুকুরটার। শালুক, মানে সুবোধের ছেলেই নর্দমা থেকে তুলে নিয়ে এসেছিল কুকুরটাকে। লালচে হলুদ কুকুরটার তখন এই লিকলিকে চেহারা। নর্দমায় পড়ে ঠান্ডায় ঠকঠক করে কাঁপছে। বড়ো কুকুরের কামড়ে পিঠের অনেকটা ছালও উঠে গেছিল। সেই কুকুরবাচ্চাকে রীতিমতো সেবা শুশ্রূষা করে পুরো ফিট করে তুলেছিল শালুক। তারপর যা হয়, কুকুরটা আর গেল না এই বাড়ি ছেড়ে। নীলিমা মাঝে মাঝে ছেলের ওপর রাগ করে বলত বাড়িটা পুরো চিড়িয়াখানা করে ফেললি! কুকুর, খরগোশ, পায়রা, এরপর বন থেকে বাঘ ভাল্লুক নিয়েও পোষ, আমাদের মেরে খাক তবে তোর শান্তি হবে।

মায়ের কথা শুনে হাসত শালুক। খুব হাসত, আর হাসলে এত সুন্দর লাগে… সুবোধ তো নিজের ছেলের রূপ নিয়ে খুব ডাঁটে থাকে, এখনও। ওর বন্ধুদের গ্রুপে এমন সুন্দর রাজপুত্রের মতো চেহারা আর একজনেরও নেই। হোক না সুবোধ গরিব মানুষ, হোক না দুইবেলা ইস্তিরি ঘষে সুবোধের সংসার চলে কিন্তু এমন সুন্দর দেখতে ছেলে পাড়ায় কটা আছে? ছিলও না থাকবেও না।

ঘুমচোখে পা ঘষে ঘষে শালুকের কাছে এল সুবোধ। ছেলের দিকে তাকাল। ইসসস যা ভয় পেয়েছিল ঠিক তাই… আহা রে! পুরো রাতটা ঠান্ডার মধ্যে ছেলেটা… নিজের কপালটায় চটাস চটাস করে দুটো থাপ্পড় মারল সুবোধ। তারপর নিজের তোবড়ানো গালের ওপর বিজিবিজি পাকা দাড়িগুলোয় নিজের কেঠো আঙুলগুলো কয়েকবার বুলিয়ে নিল। নিজের পিছনেই লাথি মারতে ইচ্ছে করছে সুবোধের। শালা বাপ হয়েছে ও! নিজের ছেলের এইটুকু খোয়ালও রাখতে পারে না!

আলনা থেকে একটানে নীল রঙের শালটা নামাল। এটা শালুকের বড্ড প্রিয়। শালুক তাকিয়ে রয়েছে বাবার দিকে। সুবোধ নিজের ছেলের চোখের দিকে তাকাতে পারল না, বড়ো অপরাধী লাগছে নিজেকে। ক্ষমা কর বাবা, একেবারে ভুল হয়ে গেছে, জানিসই তো তোর বাপটা চিরকালের অপদার্থ! এই ঠান্ডায় আবার সর্দি হলে মাথা যন্ত্রণাটা বাড়বে তোর। সব জানি তাও যে কী করে ভুলে গেলাম। বিড়বিড় করে কথাগুলো বলতে বলতে শালটা দিয়ে ভালো করে নিজের উনিশ বছরের ছেলে শালুকের মাথা কান ভালো করে মাফলারের মতো পেঁচিয়ে দিল। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামছিল সুবোধের। তারপর শালুকের নাকের ডগায় গালে হাত ঠেকাল। ইসস একেবারে ঠান্ডায় হিম হয়ে আছে ছেলেটা।

খুব ঠান্ডা লেগেছে না রে বাবা?

না বাবা আমার ঠান্ডা লাগেনি। বলল শালুক।

একবার তো ডাকবি আমাকে! আমার না হয় বয়স হচ্ছে আজকাল সবই কেমন যেন ভুলে যাই, আর তোর মা… তো ঘরে থেকেও নেই, কোনও কিছুতেই খেয়াল নেই শালীর। ছেলেটা সারা রাত এই যম ঠান্ডায়… একটা চাদর যে অন্তত গায়ে চাপিয়ে দেবে সেটাও মনে রাখে না। কতবার করে তোর মাকে বলেছিলাম, তোকে… কেউ শুনল না, তোর মাও না, তুইও না। এবার নে, ঠান্ডায় জমে বসে থাক। আমার কী! বলতে বলতেই বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠে নিজের বিছানার দিকে যাচ্ছিল সুবোধ। আবার ফিরে এল। শালুকের গালে হাত রেখে বলল রাগ করিস না মনা। বকলাম তোকে।

না বাবা রাগ করিনি আমি, তুমি শুতে যাও। আমার শীত করছে না।

মাথায় ব্যথা করছে না তো?

না করছে না।

আচ্ছা। কাল বেলায় আমাকে একবার মনে করাস। একটু সরষের তেল গরম করে ভালো করে মালিশ করে তারপর চান করাব তোকে। ঠান্ডা যদি লেগেও থাকে সব পালাবে। আর কাল মনে আছে তো? কী দিন?

হ্যাঁ বাবা মনে আছে। বলে সামান্য হাসল শালুক।

এত সুন্দর করে কী করে যে হাসে ছেলেটা! দেখলে সব মন খারাপ হুশ হয়ে যায়। একটা দারুণ জিনিস এনেছি তোর জন্য। দেখবি খুব পছন্দ হবে তোর।

কী জিনিস বাবা?

উহুঁ আজ না কাল দেখিস। তোর মায়েরও বেশ পছন্দ হয়েছে। বলে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল সুবোধ। আর শালুক তাকিয়ে থাকল কুয়াশার পাতলা পাতলা পর্দা ঢাকা ভোরের দিকে।

**

রবিবারটা সকলেরই ছুটি থাকে। প্রবুদ্ধ, সোনাল, অরিন্দম, নির্মাল্য একটু বেলা হলে চলে আসে সুবোধকাকুর দোকানে। ওরা সকলেই শালুকের বন্ধু। আগে যখন শালুক নিয়মিত দোকানে বসত তখনও আসত ওরা, এখন শালুক আর বসে না, তবু আসে। সুবোধের ইস্তিরি ঘরের ঠিক পাশেই শালুকের দোকান। পান, বিড়ি, সিগারেট, লজেন্স আরও টুকিটাকি জিনিস বিক্রির দোকান। সুবোধই দোকানটা করে দিয়েছিল ছেলেকে। টুয়েলভ পাশ করার পর আর পড়াশোনা করতে চাইছিল না শালুক। কোনওকালেই পড়াশোনায় তেমন মন ছিল না ওর। ছোটোবেলা থেকেই যার পায়রা ওড়ানোর শখ তার মনও আকাশেই ওড়ে। পড়ার বইয়ে আর বসতে চায় না। ক্লাস এইট পাশ সুবোধ ছেলেকে পণ্ডিত বানানোর কোনওদিনই স্বপ্ন দেখেনি। আর নীলিমাও তাই। আর শালুকের সেই মাথা যন্ত্রণার রোগটাও ছিল সাংঘাতিক। যখন তখন আসত। আর নিজেই ওষুধ খেত।

এইচএস পাশ করার পর বন্ধুরা যখন কলেজে ভর্তি হল তখন ছেলেকে নিজের ঘরেরই সামনে দোকান করে দিল সুবোধ। পাড়ার দোকান। মোটামুটি যেমন চলার তেমনই চলে। ছেলে ছোকরাদের ভিড়। ছেলের রূপের গর্বে গর্বিত সুবোধ শুধু শালুকের মুখের দিকে তাকাত আর ভাবত এমন রাজপুত্রের মতো চেহারা ছেলেটা পেল কী করে! এমন রং, ব্যাকব্রাশ করা এমন ঘন কালো চুল, সুন্দর নাক, ছুঁচলো চিবুক, পাতলা ঠোঁট, চোখের পাতাগুলো এত বড়োবড়ো। এমন চেহারা নিয়ে যেন কোনও বাজে মেয়ের খপ্পরে না পড়ে তাই নিয়েও অহরহ দুশ্চিন্তা সুবোধের। নীলিমা হাসত আর বলত, তোমার ওই পানবিড়িওলা ছেলেকে কোনও মেয়েই বিয়ে করবে না দেখো।

এহ্ বললেই হল! দেখো রাজকন্যাকে নিয়ে আসব বউমা করে।

কতযুগ আগের যেন সেইসব কথা। সুবোধ নিজের ইস্তিরি ঘরে দাঁড়িয়ে উনুনে লোহার ইস্তিরি গরম করে। তারওপর চাদর ঢাকা চওড়া টেবিলে খদ্দেরদের দিয়ে যাওয়া জামা, প্যান্ট, শাড়ি, সালোয়ার, ধুতি, পাঞ্জাবি একের পর এক ডলে যেতে থাকে। যত মনে পড়তে থাকে তত চাপ বাড়তে থাকে ইস্তিরির হাতলে।

সব ছুটির মতো আজও একটু বেলা হতেই প্রবুদ্ধ নির্মাল্যরা এসে পড়ল। আগে শালুক যখন দোকানে বসত তখন আড্ডাটা জমত দারুণ। কিন্তু ও যেদিন থেকে আর বসতে পারে না বন্ধুরা ভেবেছিল আর এই দোকানে কেউ অন্তত ছুটির দিনের সকালে আসবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি সুবোধকাকুর জন্য। ওদের সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিরকালের হাফ খ্যাপাটে লোকটা বলে এসেছিল হ্যাঁ রে তোরা কেমন বন্ধু। এতকাল একসঙ্গে রইলি আর যেই শালুক দোকানে বসতে পারবে না অমনি আসা ছেড়ে দিলি! তোরা না আসলে, ওর মনটা কেমন খারাপ লাগবে বল তো! আরে ওর হয়ে দোকান আমি খুলব। তোদের হাতজোড় করছি অন্তত ছুটির দিনগুলোয় ছেলেটার পাশে গিয়ে একটু বসে আগের মতো গল্পটল্প করিস।

প্রবুদ্ধরা বলতে চেয়েছিল কাকু বিশ্বাস করুন শালুককে ওইভাবে দেখতে আমাদের খুব কষ্ট লাগে… খুব! সেইজন্য ইচ্ছে হলেও ওর পাশে গিয়ে বসতে আর ইচ্ছে করে না। কিন্তু বলতে পারেনি কেউ। লোকটা আরও কষ্ট পাবে তাহলে। তাই ‘আচ্ছা কাকু আমরা আবার যাব ছুটির দিনে।’ কিন্তু কেউ যায়নি। যেতে পারেনি।

তার কিছুদিন পর নীলিমা গেছিল ওদের বাড়িতে। তোরা একটু ছুটির দিনগুলোয় পারলে যাস বাবা নইলে মানুষটাকে বাঁচাতে পারব না। জানিসই তো…

আচ্ছা কাকিমা যাব। আর না গিয়ে থাকতে পারেনি বন্ধুরা।

তারপর থেকে প্রতি ছুটির দিনে সেই আগের মতোই শালুককে ঘিরে সকাল সন্ধে গল্প করে ওরা। আর পাশের ঘরে ইস্তিরি চালাতে চালাতে সুবোধ কান খাড়া করে শুধু শোনে তার একমাত্র ছেলে শালুক, পাড়ার সবথেকে সুন্দর ছেলে শালুক কী গল্প করছে, কতটা হাসছে।

বেলা এগারোটা নাগাদ পৌঁছোল চার বন্ধু। গিয়ে দেখে তখন সুবোধকাকু হই হই করে শালুককে তেল মাখাচ্ছে। মাথায় মুখে কানে গলায় বুকে…

কী করছেন কাকু?

এই দেখ না তোদের বন্ধুর অবস্থা। ঠান্ডায় গালের চামড়া কেমন ফেটে গেছে। আজ এমন জম্পেশ করে তেল মাখাব সব ফাটাফুটি ভ্যানিশ হয়ে যাবে। আয় আয় দেখবি কেমন ফেটেছে দেখ বলে ওদেরকে কাছে ডাকল সুবোধ। চারজনেই এগিয়ে এসে মুখ ঝোঁকাল শালুকের মুখের সামনে। শালুক খুব হাসছে। কিছু বলছে না। বন্ধুরা দেখল শালুকের দুই গালে খুব সরু সরু ফাটা দাগ।

হ্যাঁ কাকু।

বল তো জন্মদিনের দিন এমন থাকলে মানায়? বোস তোরা, গল্প কর। আমি চানটা করিয়ে দিই ওকে।

গল্প আর কী করবে? প্রবুদ্ধ শালুকের দিকে তাকিয়ে বলল হ্যাপি বার্থ ডে শালুক। আজ সন্ধেবেলা সবাই আসছি। খুব আনন্দ হবে সবাই মিলে।

হ্যাঁ সন্ধের মধ্যে চলে আসিস সবাই। কাজ করতে করতে উত্তর দিল সুবোধ। তারপর বলল, তোরা এক কাজ কর তো। ঘরের ভেতর দেখ একটা হ্যালোজেন আছে আর সাউন্ড বক্স। কালকেই নিয়ে এসেছি। হ্যালোজেনটা বারান্দায় বেঁধে ফেল আর বক্সটা ফিট করে তোদের যা ইচ্ছে গান শোন, হই হই কর অমন চুপ করে বসে আছিস কেন বন্ধুর জন্মদিনে?

আচ্ছা কাকু করছি। উঠল চারজনে একরকম জোর করেই। শালুক সব দেখছে আর হাসছে। বন্ধুরা হ্যালোজেন লাইট বাঁধল, সাউন্ড বক্স ফিট করল আবার তার মাঝে শালুকের দোকানে যেসব খদ্দের টুকিটাকি জিনিস কিনতে এল তাদেরও জিনিস দিল। আর ওদিকে সুবোধ পুরো দুই বালতি জলে শালুককে স্নান করিয়ে নতুন গামছা দিয়ে ভালো করে মোছাল। তারপর শালুকের কপালে একটা চন্দনের ফোঁটা দিয়ে প্রবুদ্ধদের জিজ্ঞাসা করল বল এবার কেমন লাগছে তোদের বন্ধুকে।

খুব সুন্দর কাকু।

দেখবি রাত্রে তোদের বন্ধুর জন্য যা একখানা জিনিস এনেছি না। কাল রাতেও বলেছি তোদের বন্ধুকে। খুব দেখতে চাইছিল আমি দেখাইনি। একবারে রাতে দেখাব।

হ্যাঁ কাকু সেই ভালো।

তোরা বোস আমি পায়রাগুলোকে উড়িয়ে দিই একবার।

চার বন্ধু চুপ করে দেখল সুবোধকাকু ঘরের পিছনের মাচায় উঠে পায়রার খোপগুলো খুলছে। কত রকমের যে পায়রা রয়েছে শালুকের। গোলা, লককা, গিরিবাজ, চিলা। এইসব নাম শালুকের কাছ থেকেই জানা ওদের। একেক পায়রা একেক রকম স্পেশাল। কারও পেখম ময়ূরের মতো কেউ আকাশে উড়তে উড়তে দারুণ ভল্ট খায়। হাততালি আর বিশেষ রকমের সিটি দিয়ে পায়রা ওড়াত শালুক। খুব নেশা ছিল পায়রা ওড়ানোর। কম্পিটিশনে নামও দিত। ওর একজোড়া গিরিবাজ পায়রা রয়েছে সে দুটোর দারুণ ওড়ার দম। সকালে উড়িয়ে দিলে সন্ধে হয়ে গেলেও নামতে চায় না। শালুক যেখানেই খবর পেত কেউ ভালো জাতের পায়রা বেচতে চাইছে অমনি সাইকেল চালিয়ে ছুটত সেখানে, কিনে আনত সেটা। শালুকের কাছেই সোনালরা শুনেছিল অনেক সময় অন্য কোথাকার পায়রাকেও নিজের পায়রাদের দিয়ে ভুলিয়ে পোষ মানিয়ে ফেলা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আকাশের দিকে তাকিয়ে পায়রা ওড়াতে এতটুকু ক্লান্তি ছিল না শালুকের। খুব আনন্দ পেলে বলেই ফেলত একেক সময়, এর পরের জন্মে মাইরি পায়রা হয়ে জন্মাব, আর শুধু উড়ব।

সেই ছেলেটাই এখন সারাদিন চুপচাপ হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে।

আজ পায়রাগুলোকেও খুব ভালো দানা খাওয়াব বুঝলি। আর শোন তোরা শুধু চারজনেই আসিস না। তোদের গ্রুপের যত বন্ধু আছে সকলকে তো আমি চিনি না, প্রত্যেককে নিয়ে আসিস কিন্তু। খাবারের কোনও অভাব হবে না। বুঝলি?

আচ্ছা কাকু।

গোটা বেলাটা শালুকের সামনে কাটিয়ে দুপুরে বাড়ি ফেরার সময় সোনাল বলল, আমার একটুও আসতে ইচ্ছে করছে না।

আমারও না। কিন্তু আসিস নইলে কাকু…

হ্যাঁ আসব।

আর কাকে বলবি?

অয়ন, মারুফ আর অর্পণকে বলা যেতে পারে।

দ্যাখ।

আচ্ছা ফোনে বলে নেব।

***

সন্ধেবেলা থেকে হ্যালোজেনের চড়া আলো সুবোধকাকুর বারান্দায় কিছুটা রাস্তায়। সঙ্গে বক্সে গান, শালুকের বন্ধুদের গল্প। যতটা না আনন্দ আসছিল তার থেকে একটু বেশিই দেখাতে হচ্ছিল ওদের। চুপ করে গেলেই সুবোধকাকু এসে বলছিল কী রে চুপ করে বসে আছিস কেন? গানবাজনা কর। ওই দেখ তোদের বন্ধু কেমন হাসছে আজ এতদিন পর তোদের সকলকে পেয়ে। আর ড্রেসটা কেমন পরিয়েছি বল?

হ্যাঁ কাকু খুব সুন্দর হয়েছে, প্রশংসাটা করতে গিয়ে গলা শুকিয়ে গেছিল শালুকের বন্ধুদের। আজ বন্ধুরা মিলে শালুককে উপহার দিয়েছে একটা ধপধপে সাদা খরগোশ ছানা।

সুবোধ বলেছে ঘরে তো একটা রয়েছে, আবার আর একটা আনলি কেন?

আর একটাও থাকুক কাকু।

আচ্ছা থাক।

নীলিমা শালুকের বন্ধুদের জন্য লুচি ছোলার ডাল, খাসির মাংস রান্না করছে। রান্না করতে করতে বার বার ভুল হয়ে যাচ্ছে তার। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সবকিছু।

কেমন ফিটিং হয়েছে বল জ্যাকেটটা? খুব অহংকারের হাসি নিয়ে ছেলের বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করল সুবোধ। একটা নীল রঙের জ্যাকেট শালুককে আজ পরিয়েছে ওর বাবা। সুন্দর দেখতে।

খুব সুন্দর হয়েছে কাকু।

দ্যাখ দ্যাখ তোদের বন্ধুর কী হাসি দ্যাখ? বলে এমনভাবে শালুকের গাল টিপে দিল সুবোধ যেন এখনও ও ক্লাস টু-তে পড়ে। অবশ্য চিরকালই সুবোধের এমন স্বভাব। ছেলে যে বড়ো হয়েছে তা যেন খেয়ালই পড়ে না। এই বছর দেড়েক আগেও শালুক যখন এইচএস পরীক্ষা দিচ্ছে সুবোধ ওকে নিজের সাইকেলের হ্যান্ডেলে বসিয়ে স্কুল নিয়ে যাওয়া আসা করেছে, ওকে একা সাইকেল চালাতে দেয়নি। এত বেশি ছেলে ছেলে… আসলে নীলিমা বোঝে, বিয়ের ন’বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন ওর পেটে কেউ আসছে না, ডাক্তার ওষুধ পির মন্দির সব করতে করতে হয়রান তখন আচমকাই একদিন ভগবান মুখ তুলে চাইলেন। শালুক এল। সে যে কী আনন্দ সুবোধের। বড্ড শখ ছিল একটা বাচ্চার। শালুককে পেয়ে যেন মানুষটা এক পৃথিবী আনন্দে ভরে উঠেছিল। সারাক্ষণ শুধু ছেলে আর ছেলে। নীলিমা মা হয়েও যা করে উঠতে পারত না সুবোধ যেন সেটুকুও করে ফেলত। গোটা জীবনটাই শুধু শালুকে ভরা হয়ে উঠেছিল সুবোধের।

পথচলতি মানুষরা যেতে যেতে একবার থমকে দাঁড়িয়ে দেখল ব্যাপারটা কী ঘটছে। যারা পাড়ার পরিচিত তারা বুঝল যারা অপরিচিত তারা কিছু না বুঝেই কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে তাকিয়ে কিছুই না বুঝে আবার হাঁটা লাগাল।

আজ শালুক তোদের সঙ্গেই খাবে।

হ্যাঁ কাকু। আমরা আজ একসঙ্গে খাব।

শালুকের জন্য আজ নতুন থালা বাটি গ্লাস। তাতে লুচি মাংস ছোলার ডাল পায়েস। শালুক আজ যেন বেশি হাসছে। বন্ধুদের সঙ্গে কত খুশিতে খাচ্ছে শালুক। কতদিন পর আবার গুছিয়ে খাচ্ছে…। বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে অবশ হয়ে দেখছিল সুবোধ। নীল রঙের জ্যাকেটটা পরে কী সুন্দর লাগছে! ওর বন্ধুদের মধ্যে সেরা।

অনেক রাত। পৃথিবীর সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে। চোখ বুজে অনেকক্ষণ ভাবতে ভাবতে হঠাৎই চোখ মেলল নীলিমা। আজ তারও ঘুম আসছে না। একেক সময় মনে হয় বুক ফাটিয়ে কাঁদতে, কিন্তু তাহলে ওই মানুষটাকে আর বাঁচানো যাবে না। পাশ ফিরে নাইটল্যাম্পের আবছা আলোয় দেখল ঘরে সুবোধ নেই। নীলিমা জানে লোকটা কোথায় গেছে। লেপের ওম ছেড়ে উঠল। বারান্দার ভেজানো দরজাটা অল্প ফাঁক করে দেখল এক ভেঙেচুরে যাওয়া বাবা অন্ধকারে তার ছেলের সামনে বসে আছে। তার গায়ে মাথায় হাত বুলোচ্ছে আর বলছে তুই খুশি হয়েছিস তো বাবা? আমি কত করে মিস্তিরিকে বলেছিলাম শুধু বুক পর্যন্ত কেন বানাচ্ছ? পুরোটা চাই আমার ছেলে নইলে নড়াচড়া করতে পারবে না। কেউ শুনল না। জ্যাকেটটা তোকে বড়ো সুন্দর লাগছে… তোর হাতদুটো থাকলে আরও কত ভালো লাগত বল তো? কেউ শুনল না!…

উনিশ বছরের ছেলের শ্বেত পাথরের মূর্তির মাথায় গালে বুকে বার বার হাত বোলাচ্ছিল সুবোধ আর বলে চলেছিল তোর মাথায় ব্যথাটা আর নেই তো সোনা? ব্যথা হলে আমাকে এবার আগেই বলিস আর চুপ করে থাকিস না সোনা… আর নেই তো?

শালুক হাসছে। ওর বুকের পর থেকে যে চৌকো থামের মতো পাথরের পিলার তার অনেকটা পর্যন্ত ঝুলে রয়েছে জন্মদিনে বাবার পরানো জ্যাকেট। ওই কাপড়ের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে পাথরের ফলকে কালো রঙে লেখা একটা ছোটো লাইন। শালুক মজুমদার। জন্ম ১৮ অক্টোবর ১৯৯৭।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...