সানগ্লাসটা তাড়াতাড়ি চোখের উপর টেনে নিল কুমকুম। সে তার চোখের জল, এমনকী সমুদ্রকেও দেখাতে চায় না। ঢেউগুলো তার পায়ের পাতা ছুঁয়ে গুঁড়িয়ে যাচ্ছিল, পরমুহূর্তেই আবার একটা ঢেউ। তার মনে হল, অনুপম তাকে এইটাই দেখাতে এনেছে। একটা ঢেউয়ের ব্যর্থতা, পরবর্তী ঢেউয়ের নাছোড় উদ্যম। এভাবেই তাকে বাঁচতে শিখতে হবে।

এত ভেবেও সে ফোনটা না করে পারল না।

‘কি করছিস বেটা?’

ওপারে উত্তজিত গলায় মিষ্টি বলল, ‘মা, পায়েস করছি। জাস্ট ইমাজিন। লাইফে প্রথম। তোমার জামাইয়ের জন্মদিন তো। একটু পরে তোমায় সঙ্গে কথা বলছি। দুধটা নাকি ননস্টপ নেড়ে যেতে হবে, ও বলে গেল।’

কুমকুম দেখতে পেল তার মেয়ে হাতা দিয়ে সমানে দুধ নেড়ে যাচ্ছে। সে বলল, ‘রজত বেরিয়ে গেছে? কী বানিয়ে দিলি? তুই ব্রেকফাস্ট করেছিস বেটা?’

‘ওঃ মা, ছোলে চাউল, ছোলে চাউল। পরে তোমার সঙ্গে কথা বলছি।’ ব্যস্ত গলায় ফোন ছেড়ে দেয় মিষ্টি।

আবার সেই অবিশ্রান্ত ঢেউ। অবশ্য বেশিক্ষণ দেখতে হবে না। এখুনি পরের স্পটে যেতে হবে। তারপর আর একটা স্পট, তারপরও একটা। অনুপম আক্ষরিক অর্থেই নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে তাদের। দাদাভাই, দিদিভাই তো অনেক স্পটে নামছেই না ভয়ে।

‘না রে, তোরা যা। আমরা এখানেই বসি। ওই তো চায়ের দোকান একটা। দেখি লাল চা পাওয়া যায় কিনা।’ এইসব বলে কাটিয়ে দিচ্ছে।

কুমকুম পারছে না ওরকম। সে কোথাও হাঁটু ব্যথা, বুক ধড়ফড়ের অজুহাতে নামতে না চাইলে অনুপম হই হই করে উঠছে, ‘আরে তোমার জন্যেই তো আসা। নইলে আমি তো অফিস টুরে তিন বছর আগেই…।’

সবাই ভাবছে কুমকুমকে ভোলানোর জন্যেই এই ভ্রমণের ললিপপ ধরিয়ে দিয়েছে অনুপম। অথচ ব্যাপারটা ঠিক সেরকম নয়।

দাদাভাই আর দিদিভাই যাচ্ছিল চোখ দেখাতে চেন্নাই। ফেরার পথে ওদের ইচ্ছে আরাকু ঘুরে আসে। দক্ষিণের এইটুকু বাকি আছে ওদের। ফেরার পথে দমদমে ওদের ফ্ল্যাটে কয়েকদিন থেকে শিলিগুড়ি ফিরবে। অনেক আগে থেকেই ঠিকঠাক এসব। টিকিটও কাটা। হঠাৎ এক রাতে দাদাভাইয়ের ফোন। ‘তোরাও চল ভাইজাগ, আমরা চেন্নাই থেকে চলে আসব। পাশাপাশি দুটো ডাবল রুম বুক করে ফেল।’

অনুপম ক্ষীণ আপত্তি তুলেছিল। টিকিট পাওয়া অসম্ভব, কুমকুম আজকাল কোথাও বেরোতেই চায় না, মিষ্টিদের আসার কথা সামনে। দাদাভাইয়ের জোরের কাছে কোনও আপত্তিই টেকেনি।

যাদের জোরাজুরিতে এখানে আসা, তারা অনেক জায়গা স্রেফ গাড়িতে বসেই দেখে নিচ্ছে। কুমকুমের মন ভালো করার পাশাপাশি অনুপম আর কুমকুমকে খানিকক্ষণ একলা ছেড়ে দেওয়ার এক কৌতুকও কি কাজ করছে না ওদের মধ্যে?

অথচ অনুপম এখন তার ধারেকাছেও নেই। খটখটে রোদ্দুরে, শুনসান ইরাডা বিচে সে একরকম একাই দাঁড়িয়ে, অনুপম সেই কোথায় পাহাড় ঘেঁষে বড়ো বড়ো পাথর টপকে টপকে চলেছে। ওখানে নাকি ঝাঁকে ঝাঁকে লাল কাঁকড়া আছে। থাক, কুমকুম যাবে না। ওই পাথর সে টপকাতে পারবে না। তাছাড়া কাঁকড়ার জ্বালা সে কি কম বুঝছে? বুকের মধ্যেটা সবসময় জ্বলে যাচ্ছে। মিষ্টিকে ছেড়ে থাকতে এত কষ্ট হবে আগে বুঝতে পারেনি তো।

সানগ্লাসটা খোলে কুমকুম। একেবারে ঝাপসা হয়ে গেছে। চোখ মোছে। এই এত বড়ো একটা তটে সে প্রায় একা– যেমন একা ওই আকাশ, দুপুরের পড়ন্ত রোদ। অনুপম দূরে যেতে যেতে একটা ছোট্ট বিন্দু হয়ে গেছে। এত ছোট্ট, যেন আঙুল দিয়ে মুছে ফেলা যায়।

কুমকুমের মনে পড়ল তার কাঁধের ব্যাগে একটা বায়নোকুলার আছে, বার করলেই হয়। এটা মিষ্টির খুব আদরের জিনিস। বাবার কাছে বায়না করে আদায় করেছিল। অনুপম তাই বলে বায়নোকুলার নয়, বায়নাকুলার। এত প্রিয়, তবু নিয়ে যায়নি মিষ্টি যাবার সময়। এখন আরও কত নতুন মডেল বেরিয়েছে। কত পাওয়ারফুল। অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। মিষ্টি কিন্তু এতেই সন্তুষ্ট ছিল। মেয়েটা কখনও সাধ্যাতীত জিনিসের বায়না করেনি। জানত, বাবার মাপা রোজগার। মা কত হিসেব করে চলে।

সেবার পুজোয় কত দ্বিধা করে একটা আনারকলি চুড়িদার চাইল। তাও অর্ধেক টাকা নিজের জমানো ফান্ড থেকে দিল। সেই সাধের চুড়িদারও নিয়ে যায়নি মেয়ে।

‘আরে এখানে থাক। আমি আসব তো মাঝে মাঝে। এসে থাকব। তখন কি সব বয়ে বয়ে আনব? নাকি ভাবছ একেবারে বিদায় করে দিচ্ছ?’

কত দূরে বিয়ে হল, তাও বায়না ধরেনি কাছে দাও বলে। হয়তো দিল্লি বলেই করেনি। বছর আটেক তো ওখানেই কেটেছে। এখানেই বরং ওর ভালো লাগত না। দমদমের ঘিঞ্জি রাস্তা, নোংরা, জ্যাম কোনওদিনই মানিয়ে নিতে পারেনি।

যতই চেনা জায়গা হোক, তবু কুমকুমের বুক কাঁপে। কী যে সব হচ্ছে। সেদিন বাসের মধ্যে ২০-২১ বছরের মেয়েটা, মিষ্টিরই বয়সি…! বায়নোকুলার চোখে লাগায় কুমকুম। অনুপমকে খোঁজে। কোথায় অনুপম? তার কোনও চিহ্ন নেই। সে খানিকটা আনমনে সমুদ্র, আকাশ, নারকেলের সারি দেখে যায়। হঠাৎ তার বায়নোকুলার থমকে যায় একটা বিন্দুতে। এই ইরাডা বিচে সে তাহলে একা নয়। ওই তো গোলাপি ফ্রক পরা দস্যি মেয়েটা দৌড়োচ্ছে, পেছন পেছন ছুটছে তার মা। মোটাসোটা চেহারার, সে দৌড়ে বিশেষ সুবিধে করতে পারছে না। কুমকুমের চোখে হাসি খেলে যায়।

ওই তো দশ-পনেরো বছর আগের কুমকুম। সে অমনিই মোটা চিরকাল, আর মিষ্টি বরাবরই রোগা-পাতলা। তার খুব কৌতুহল, বিয়ের জল মিষ্টির গায়ে লাগে কিনা। রজতরা প্রবাসী বাঙালি, ভিলাইয়ের। ওদের খাবার ধরনটাও অবাঙালিদের মতো হয়ে গেছে। ছোলে, রাজমা, কালি ডাল, পনির মশলা। গাদাগুচ্ছের ঘি আর প্যাকেটের মশলা ঢাললেই রান্না হয়ে গেল। মাছ প্রায় খেতেই পায় না মেয়েটা। রজত রুই ছাড়া মাছ চেনেও না কিছু। তাতেও মেয়ের কোনও অভিযোগ নেই। যখনই ফোন করে কুমকুম, তখনই মেয়ে ওইসব আগড়ম-বাগড়ম রাঁধছে। কী রেঁধেছে যেন বলল সকালে, ‘ছোলে চাউল!’ ইস্! পারশের ঝাল খেতে কি যে ভালোবাসত!

দাদাভাই আর দিদিভাই তাদের সঙ্গেই ফিরবে। কুমকুম ভালো করেই জানে, ফেরার পথে ট্যাক্সি থেকে বাজারমোড়েই নেমে যাবে অনুপম, একরাশ বাজার করে ফিরবে। এমন নয় যে এখানে এসে তারা দক্ষিণী তেঁতুলগোলা খাবার খেয়েছে। বাঙালি হোটেল, ভাত-মাছ চলেছে দুবেলাই। কিন্তু ওই যে– বাই। আর আনবেও সেই মিষ্টির প্রিয় মাছগুলোই, পারশে, পমফ্রেট, ভেটকি– সেগুলো ধুতে ধুতে, হলুদ মাখাতে মাখাতে, তেলে ছাড়তে ছাড়তে খানিকটা কেঁদে নেবে কুমকুম। দুপুরে একা ঘরে খেতে বসে সে মাছ কিছুতেই মুখে তুলতে পারবে না, শুধু নাড়াচাড়া করবে। দুপুরে তো একবার ফোন করবেই মিষ্টি। খেয়ে উঠতে উঠতে আসবেই ওর ফোন।

‘খেয়েছ তো? নাকি শুধু কেঁদেছ?’

‘খেয়েছি রে বেটা খেয়েছি। আজ সব তোর ফেভারিট ডিশ। কলমি শাক, পোস্ত আর পারশের ঝাল।’

‘পারশে! সরষে দিয়ে করেছ তো?’ প্রায় লাফিয়ে ওঠে মিষ্টি। এত কষ্ট হয় তখন। কিন্তু পরক্ষণেই মেয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।

‘জানো মা, আমি কী খেলাম?’ শোনার কোনও উৎসাহ থাকে না কুমকুমের। সেই তো ঘি জবজবে ডাল, নয় পনির, বড়ো জোর আন্ডা কারি। রাতে ধরাবাঁধা চিকেন। তবে মঙ্গলবার বাধ্যতামূলক নিরামিষ। ওখানে গিয়ে হনুমানের পুজো ধরেছে মিষ্টি, পাশের ফ্ল্যাটের একটা মেয়ের দেখাদেখি। হনুমানচালিশা না পড়ে মেয়ে জল খায় না। ভাবো! মাছ তো পনেরো দিনে একবার আসে, তাও রুই। কুমকুম তবু ক্ষীণ গলায় জিগ্যেস করে, ‘কী খেলি বেটা?’

‘ভাপা ইলিশ।’

‘ভাপা ইলিশ!’ চমকে ওঠে কুমকুম। কে আনল আর কেই বা রাঁধল!

‘তুমি ভাবছ রজত ইলিশ কিনেছে? চিনলে তো। ওই যে পাশের ফ্ল্যাটে শম্পা আছে না, ওরা খুব মাছ খায় মা। আর কি মুশকিল জানো, প্রায় দুপুরেই আমাকে দিয়ে যাবে। আমি ওকে একদিন ভালো করে খাওয়াব ভাবছি।’

‘খাওয়াস।’

‘জানো মা, ও আসা থেকে একদিনও বাপের বাড়ি যায়নি। তিন বছর! জাস্ট ভাবো। খুব কাঁদে জানো মা। মাকে ছেড়ে থাকেনি তো কখনও। একটা ভাই আছে। ক্লাস এইটে পড়ে।’

কুমকুম অস্ফুটে বলে ‘আমার যে তাও নেই বেটা। আমি কি নিয়ে থাকি বলত?’

রোজ দুপুরেই এভাবে ভাতে অনেকখানি অশ্রু মিশে যায়। ওখানে মিষ্টি কেমন থাকে, সত্যি কেমন আছে কে জানে। যা চাপা মেয়ে। সারাক্ষণই অন্যদের কথা বলে যায়। রজতের কথা, শম্পার কথা। আর কি উত্তেজিত গলা, যেন কি দারুণ একটা খবর দিচ্ছে মাকে।

কুমকুমের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে। মিষ্টি আসলে এখনও ছেলেমানুষই থেকে গেছে। সাত তাড়াতাড়ি ওর বিয়েটা না দিলে যেন চলত না। অনুপমের যত বাড়াবাড়ি। কি, না ইন্টারনেটে ম্যাচিং, একেবারে রাজযোটক।

ইন্টারনেট কি ঠিকুজিকুষ্ঠি– এসব নিয়ে কোনও আগ্রহ নেই কুমকুমের। সে শুধু চেয়েছিল মেয়েটা কাছাকাছি থাক। একটাই তো সন্তান। একদম বাড়ির পাশে চায়নি। দু-তিন ঘন্টায় পৌঁছে গিয়ে মেয়ের মুখটা দেখে আবার ফিরে আসা যাবে– এমনটা হলে কি ক্ষতি হতো! তা নয়, একেবারে দিল্লি! কথায় বলে, ‘কোনওকালে নেই ষষ্টীপুজো, একেবারে দশভুজো!’

অবশ্য দিল্লি একেবারে অচেনা জায়গা নয় তাদের, বছর আষ্টেক ছিল তারা ওখানে, আর্মি কোয়ার্টারে। মিষ্টি তো ওখানেই বড়ো হল। স্কুলে পড়ল বছর চারেক। যদিও কুমকুম কলকাতায় ফেরার জন্যে ছটফট করত। অনুপমদের বাড়িটাকে কেন্দ্র করে পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের একটা বৃত্ত আঁকলে সেই বৃত্তের পরিসীমার মধ্যেই তার সব আত্মজন– বাপের বাড়ি, দিদি, বোন, দুই ননদ। অনুপমের অবশ্য সেরকম টান ছিল না ফেরার। ছোটোবেলায় বাবা-মাকে হারিয়েছে। হস্টেলে মানুষ। অল্প বয়সেই মিলিটারিতে ঢুকেছে। লোকটার যেন কোনও শেকড় নেই। নইলে একমাত্র মেয়েকে কেউ অতদূরে বিয়ে দেয়? রজতকে নাকি আবার কানাডায় পাঠাবে অফিস থেকে। মিষ্টিকে না নিয়ে কি ও যাবে? আর একবার ওখানে গেলে কেউ ফেরে না, জানে কুমকুম। এই তো তার মাসতুতো দাদা, বাবুলদা, তার ছেলে-বউ মন্ট্রিয়েল-এ চলে গেল। যাবার সময় বলল, দু’বছরের বন্ড, শেষ হলেই চলে আসবে। তারপর কত দু’বছর কেটে গেল। ফিরল না। এমনকী বাবুলদা যখন চলে গেল, তখনও আসতে পারল না। এল তিনমাস পরে শীতে। ওদের আর এ দেশের সামার সহ্য হয় না। তার মিষ্টিও যদি… বুকটা ধড়াস করে ওঠে কুমকুমের।

ধুৎ! কত বাড়িয়ে ভেবে ফেলছে সে। অনুপম বলে ফালতু চিন্তা মাথা থেকে বার করে দিতে। তার হার্ট একটু কমজোরি। ইদানীং একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। গ্যাসের ব্যথা ভেবে এতদিন পাত্তা দেয়নি সে। এবার ভাবছে ফিরে গিয়ে কার্ডিওলজিস্ট দেখাবে। দিদিদের পাড়ায় বসে ডা. মনোজিৎ জানা। দেবতুল্য ডাক্তার।

বায়নোকুলারটা আবার চোখে লাগিয়ে চমকে ওঠে কুমকুম। একি! বাচ্চা মেয়েটা যে ক্রমশ জলে নেমে যাচ্ছে। সে চেঁচিয়ে ওঠে, ‘এই বেটা, বেটা, যায় না, ঢেউ টেনে নিয়ে যাবে।’

মা ছাড়া অন্য কারও স্বরে থমকে দাঁড়ায় মেয়েটা। দুটো বিনুনি, চুলে বার্বি ক্লিপ, গোলাপি রিবনে ওকে অবিকল প্রজাপতির মতো দেখায়। অনুপম এই প্রজাপতিটাকে না দেখে লাল কাঁকড়ার খোঁজে গেছে। পারেও বাবা!

সে আবার বলে ‘এসো বেটা, চকোলেট দেব, এসো।’ মিষ্টির জন্যে ব্যাগে চকোলেট রাখার অভ্যেস এখনও রয়ে গেছে কুমকুমের। এই সব জার্নিতে চকোলেট খুব কাজে দেয়। আরাকু ভ্যালির ওই লম্বা রাস্তায় চকোলেট খেয়ে খেয়েই তো সে খিদে সামলেছে। বুকের ব্যথাটার জন্যে সে বোরা কেভ-এ নামেনি। দাদাভাই, দিদিভাই তো নয়ই। অতগুলো সিঁড়ি ভাঙা ওদের পক্ষে অসম্ভব। ওরা দুজনে কফি খেল আর সে বসে বসে চকোলেট। দাদাভাই কিনে দিয়েছিলেন কফি চকোলেটের অনেকগুলো স্ল্যাব আরাকু থেকে। তারই একটা বার করে মেয়েটাকে দেখাল কুমকুম। চকোলেটের টানেই হোক কিংবা অচেনা মানুষের আকর্ষণে– মেয়েটা ছুটে ছুটে তীরের দিকে আসছিল। ওর মা-ও এসে পড়ল থপথপ করে। ‘দেখছেন তো? এই মেয়ে নিয়ে কোথাও যাওয়া যায় বলুন?’

কুমকুম হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। মেয়েটা এসে ততক্ষণে ওর বুক ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে।

‘তুমি ব্যাগে চকোলেট রাখো কার জন্যে?’ কুমকুমের আবার চোখে জল আসছিল। সেটা সামলে সে চকোলেটটা মেয়েটার হাতে দিয়ে বলল, ‘তোমার জন্যে বেটা।’

‘মা দ্যাখো, আন্টি আমাকে বেটা বলছে!’

‘আপনারা ওয়েস্ট বেঙ্গলের বাইরে থাকেন বুঝি?’

কুমকুম জবাব দেবার আগেই অনুপম ডাকল ‘চলে এসো, ড্রাইভার তাড়া দিচ্ছে।’

অনুপম কখন লাল কাঁকড়া ছেড়ে এদিকে চলে এসেছে খেয়াল করেনি কুমকুম। দেখতে পেয়ে সে বলল ‘এদিকে শোনো না। দ্যাখো এই নান্হি পরিটাকে। ছোটোবেলায় মিষ্টি ঠিক এইরকম ছিল না?’

অনুপম রুক্ষস্বরে বলল ‘চলে এসো, এরপর লাইটহাউস বন্ধ হয়ে যাবে।’

কুমকুম অপ্রস্তুত হেসে বলল ‘চলি ভাই, এই ড্রাইভারগুলো সব ঘোড়ায় জিন দিয়ে আসে। চলি রে বেটা।’ মেয়েটার গালে আলতো হাত ছুঁইয়ে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না কুমকুম। বালির ওপর দিয়ে ওর দ্রুত হাঁটার চেষ্টা দেখে ফ্যাকাশে হাসল মা। মেয়ে তার হাত টেনে বলল ‘রান। আমাদেরও তো লাইটহাউস চড়তে হবে।’

কুমকুমের মুড অফ হয়ে গেছিল। অনুপমটা মাঝে মাঝে এত অভদ্র হয়ে যায়। তার ইচ্ছে করছিল দাদাভাই, দিদিভাইয়ের সঙ্গে বসে থাকতে। কিন্তু অনুপম তাকে বসতে দিলে তো? লাইটহাউস নাকি বন্ধ হয়ে যাবে।

কুমকুমের বুকে আবার ব্যথা করছিল। সে আর কিছু বলল না। লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে বহু কষ্টে ওপরে উঠে সে অবশ্য মুগ্ধ হয়ে গেল। সমুদ্রটা কি অপূর্ব লাগছে এখান থেকে! পড়ন্ত আলোর আভা জলের ওপর। কিন্তু কি হাওয়া, বাব্বা! তার মতো মোটা মানুষকেও উড়িয়ে নিয়ে যাবে মনে হয়। ভয়ে সে বসে পড়ল রেলিং ধরে। বসে বসে আরও ভালো লাগছিল সব কিছু। এই প্রথম বেড়ানোটা সে এনজয় করছিল। মিষ্টির কথা মনে পড়ে কোনও কষ্ট হচ্ছিল না তার। মনে হচ্ছিল, সব মানুষেরই মাঝে মাঝে এতটা উঁচু থেকে পৃথিবীটাকে দেখা দরকার। দু-তিনটে ছেলেমেয়ে ছিল ওপাশে। মেয়েটা তার সাদা ওড়না ধরে আছে। ওড়নাটা পতপত করে উড়ছে, ছেলেটা ছবি তুলছে। কুমকুম কৌতুকের সঙ্গে দেখছিল। এমন সময় একটা দুষ্টু-দুষ্টু মুখ লাইটহাউসের দরজা দিয়ে উঁকি দিল।

‘আন্টি!’

কুমকুমের বুক ধড়াস করে উঠল ‘বেটা! তুই একা এসেছিস?’

মেয়েটা দাঁড়িয়ে পড়ে লাফাতে লাফাতে বলল ‘মা উঠতেই পারছে না। যা মোটা! তোমার থেকেও মোটা!’

কুমকুম ভয় পেয়ে বলল ‘বসে পড় বেটা, তুই যা রোগা, হাওয়ায় উড়ে যাবি!’

মেয়েটা কোনও কথাই শোনার পাত্রী নয়। সে পুরোটা ঘুরে দেখবে। নীচ থেকে ওর মা’র কাতর গলা শোনা গেল।

‘একটু দেখবেন প্লিজ মেয়েটাকে। আমি হাফ উঠে আর উঠতে পারছি না।’

অনুপম এক মনে ছবি তুলছিল। হঠাৎ সে ঘুরে মেয়েটার হাত চেপে ধরল। কুমকুমের বুক ঢিপঢিপ করছিল। আবার না কড়া কড়া কথা বলে অনুপম। অনুপমের হাতে বন্দি মেয়েটা ছটফট করছিল যেন দৈত্যের হাতের মুঠোয় একটা পাখি। হঠাৎ অনুপম হাঁটু গেড়ে ওর সামনে বসে পড়ল। এখন ওর আর বাচ্চাটার মাথা সমান সমান। মেয়েটা অবাক হয়ে চেয়ে রইল ওর দিকে। কুমকুম শুনল অনুপম বলছে ‘লাইটহাউস কাকে বলে জানিস?’

‘ওই যে আলো দেখায়।’

‘কাদের?’

‘শিপগুলো যখন নাইটে কিছু দেখতে পায় না।’

‘দেখবি, লাইটহাউস কী করে কাজ করে?’

অমনি মেয়েটার চোখ চকচক করে উঠল। সে কুমকুমের দিকে চেয়ে হাসল। জয়ের হাসি। তারপর অনুপমের হাত ধরে দরজা গলে কলকব্জা বুঝতে গেল। কুমকুমের দু’পা টনটন করছিল। সে দু’পা ছড়িয়ে বসল। মেয়েটার ওড়না উড়ে গেছে। সেই নিয়ে কি ভীষণ হাসাহাসি ওদের। অচেনা ভাষা, তবু ওদের কথাগুলো ছুঁতে পারছিল কুমকুম। দূরে তখন সূর্য ডুবছে। তবু চারপাশে যথেষ্ট আলো।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...