মাতৃত্বের মতো সুন্দর অনুভব আর হয় না। যে-কোনও আসন্ন প্রসবার সৌন্দর্যও তার এই মাতৃত্বের সুখেরই প্রতিচ্ছবি। চিকিৎসকরাও বলেন গর্ভবতীর সৌন্দর্য এ সময় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ হল, এই অবস্থায় একজন নারী সবচেয়ে প্রসন্ন থাকেন এবং স্বাস্থ্যবর্ধক ডায়েট গ্রহণ করেন। ভেতর থেকে আনন্দের অনুভূতি কাজ করে বলে, সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।

জেনে রাখা জরুরি, এই সময়টা হল গর্ভস্থ ভ্রূণের পরিণত হওয়ার কাল। সুতরাং গর্ভবতী মা-কে শিশুটির কথা ভেবেই নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। পুষ্টির প্রয়োজন এই সময় সবচেয়ে বেশি। সুস্বাস্থ্য ও প্রসন্নতায় ভরা মন— এই দুইয়ের মেলবন্ধনেই একটি সুস্থ শিশুর জন্ম হওয়া বাঞ্ছনীয়।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান

নিয়মিতভাবে চিকিৎসকের কাছে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো এসময়ে একান্ত জরুরি। শুরুর ৭ মাসে একবার করে, তারপর থেকে ১৫ দিন অন্তর এবং শেষের মাসটায় প্রতি সপ্তাহে একবার করে চিকিৎসকের কাছে যান। তাঁকে যে-কোনও শারীরিক সমস্যার কথা বলুন এবং সেই সংক্রান্ত কোনও টেস্ট করাতে হলে করিয়ে নিন।

গর্ভস্থ শিশুর বিকাশ হবে ভেবে অতিরিক্ত পরিমাণে খাদ্যগ্রহণ করবেন না। এতে আপনার ওজন বেড়ে যাবে এবং প্রসবে সমস্যা হতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ব্যালেন্সড্ ডায়েট গ্রহণ করা জরুরি। এই সময় দুধ পান করাও খুব প্রয়োজন। দুধ ও দুধের প্রোডাক্ট শিশুকে প্রয়োজনীয় ক্যালসিয়ামের জোগান দেবে, যা তার অস্থিগঠনে সাহায্য করবে। ক্ষীর, পুডিং, দই এগুলো আহারে রাখুন।

ফল খাওয়াও জরুরি

এই সময়ে স্বাভাবিক কারণেই পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রোটিনের চাহিদা থাকে। ডিম, মাছ, মাংস যেমন খাবেন, তেমন পনির আর ফলও রাখুন ডায়েট-এ। শাকসবজি থেকে প্রয়োজনীয় আয়রন ও ভিটামিন-এর জোগান পাবেন। কাঁচা স্যালাড খাওয়া আবশ্যক। দিনে দু’বার ভিটামিন সমৃদ্ধ ফল খাবেন, যেমন পাকা পেঁপে, কমলালেবু, মুসম্বি প্রভৃতি।

ফ্যাট-যুক্ত খাবারের প্রয়োজনীয়তা

চিকিৎসকের পরামর্শ মতো পরিমাণ বুঝে ফ্যাট রাখুন প্রাত্যহিক ডায়েট-এ। মাখন খেতে পারেন ব্রেকফাস্ট-এ। ১৫ থেকে ৩০ গ্রাম ফ্যাট রোজ গ্রহণ করলে তা স্বাস্থ্যের পক্ষে সুফলদায়ক হবে।

ব্যালেন্সড্ আহার

সবজি, ডাল, রুটি, ভাত— যাই খাবেন সেটা যেন পরিমাণমতো হয়। চিকিৎসকের পরামর্শমতো ডায়েট চার্ট ফলো করুন। এরফলে আপনার ও গর্ভস্থ শিশুর, উভয়ের ওজনই ঠিক থাকবে।

ধূমপান করবেন না

এই অবস্থায় সব ধরনের নেশা থেকে দূরে থাকুন। ধূমপানের অভ্যাস থাকলে, এ সময় এড়িয়ে চলুন। এর ফলে গর্ভস্থ শিশুর উপর নেশার সামগ্রীর কুপ্রভাব পড়বে না।

আরামদায়ক পোশাক পরুন

এই অবস্থায় ঢিলেঢালা পোশাক পরাই শ্রেয়। প্রাত্যহিক কাজ করা বন্ধ করে দেবেন না। এ সময় হালকা পরিশ্রম করা জরুরি। পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন। পরিষ্কার জামাকাপড় পরুন। হালকা সাজগোজ করুন। জুতোটাও আরামদায়ক হওয়া প্রয়োজন। পায়ের গ্রিপ ঠিক থাকে এমন জুতোই পরুন বিপদের সম্ভাবনা এড়াতে। ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডরোব পাওয়া যায় এখন বেশকিছু বিপণিতে। সেখান থেকে এই সময়ের উপযুক্ত পোশাক কিনুন।এই সময়ের জন্যই চাই রুচিশীল আরামদায়ক পোশাক যাতে উদরের স্ফীতিও চট করে লোকসমক্ষে না আসে। কিন্তু মুশকিল হল, উদরের স্ফীতি ঢাকতে অনেকেই ওভার সাইজড পোশাক পরে বিসদৃশ সাজে পথে বেরিয়ে পড়েন। এটা বোঝা জরুরি যে, হঠাৎ করে নিজের ড্রেসিং না বদলেও, আকর্ষণীয় সাজে নিজেকে প্রেজেন্ট করা যায়।

এথনিক ওয়্যার যারা পরেন তারা ঘেরওয়ালা কামিজ, আমব্রেলা কাট কুর্তি পরতে পারেন। ওয়েস্টার্ন পরলে বেলুন টপ বা ফ্রিলড ড্রেস ভালোলাগবে। আসলে পোশাক যা-ই পরুন না কেন, কমফর্ট-এর শুরুটা হয় অন্তর্বাস দিয়ে। মাতৃত্বের সময়টাতে স্তনের আকারেও পরিবর্তন আসে। সেক্ষেত্রে অন্তর্বাসের মাপেও বদল প্রয়োজন। শুরুতে কেবল নরম স্পোর্টস ব্রা পরুন। শেষের দিনগুলিতে নরম ইলাস্টিক কাপ বেছে নিন, স্টিফ আন্ডার-ওয়্যার যুক্ত ব্রা-এর বদলে। দেখবেন যাতে কাপ আর ব্রা-এর ব্যান্ড অতিরিক্ত টাইট হয়ে শরীরে না চেপে বসে। ভালো হয়, যদি স্তনের আকারের ক্রমপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে, সাধারণ ব্রা থেকে ম্যাটারনিটি ব্রা-এ নিজেকে মানিয়ে নেন। একই সঙ্গে ম্যাটারনিটি ব্রা ও পরবর্তী সময়ের জন্য নার্সিং ব্রা হিসাবে ব্যবহার করা যাবে, এমন ব্রা-ও আজকাল পাওয়া যায়। সে ধরনের ব্রা পরলে দীর্ঘ সময় অফিসে বসে কাজ করতেও অসুবিধা হবে না। সাধারণ অবস্থায় যে-পোশাক পরেন, সেই স্টাইলেই স্টিক করে থাকুন, শুধু উদর স্ফীতির সঙ্গে সঙ্গে পোশাকে ১-২ সাইজ বাড়িয়ে নিন। কেবল সুতি অথবা কোনও স্ট্রেচেবল ফ্যাব্রিকের পোশাকই কিনুন। আরামদায়ক, ঢিলেঢালা কিন্তু ফিটিং-এও বেঢপ নয়, এমন পোশাকই আপনার প্রায়োরিটি হওয়া উচিত।

এ যুগের নারীদের অন্যতম পছন্দের পোশাক জিন্স। কিন্তু  এ সময়ে জিন্স পরলেও তা ওয়েস্ট ব্যান্ড-যুক্ত জিন্স হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এছাড়া লংড্রেস, স্কার্ট-টপ, স্ল্যাক্স, কেপ্রি– এখন সবই পরছেন সাহসিনীরা। অফিসের জন্য অবশ্য ফ্রিল্ড বা বেশি ঘেরদার স্কার্ট, প্লিটেড কামিজ, লুজ ফিটিং কুর্তি, লেগিংস-ই ভালো। মলমল, ভয়েল, সুতি– এইসব ফ্যাব্রিকই আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান দেশের পক্ষে আদর্শ।

মাসাজ জরুরি

স্তন ও পেটে হালকা মাসাজ করুন। এর ফলে স্ট্রেচমার্কস পড়বে না। স্নানের আগে ভিটামিন ডি-যুক্ত তেল দিয়ে ফুল বডি মাসাজ করুন। শোওয়া ও বসার সময় সঠিক পশ্চার মেনটেন করুন। এরফলে শিশুর পজিশন ঠিক থাকবে।

অযথা পায়ের পরিশ্রম বাড়াবেন না

গর্ভকালীন সময়ে এমনিতেই শরীরের অতিরিক্ত ওজন বহন করতে হয় আপনার পা দু’টিকে। তাই পায়ের পরিচর্যা এসময় বিশেষভাবে জরুরি। অযথা পায়ের পরিশ্রম হয়, এমন কাজ করবেন না। যতটা জরুরি ততক্ষণই দাঁড়িয়ে কাজ করুন। বাকি সময় বসে বসে হাতের কাজ করুন। হাত-পায়ের নখ নিয়মিত ভাবে কাটুন, হাত-পা পরিচ্ছন্ন রাখুন।

চুল ও ত্বকের পরিচ্ছন্নতা

চুল শ্যাম্পু করার পাশাপাশি কন্ডিশনিং করাও জরুরি। ত্বকের স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দিন। ত্বকের নমনীয়ভাব বজায় রাখতে বেশি করে জল পান করুন। স্নানের পর ময়েশ্চারাইজার লাগান। এসময় অনেকেরই মুখে বলিরেখা দেখা দেয়, কিন্তু  প্রসবের পর তা মিলিয়েও যায়। মুখে ক্রিম মাসাজ করুন, এতে ত্বকের নমনীয়তা বজায় থাকবে।

হালকা মেক-আপ মন ভালো করে

নিজে সাজগোজ করে সুন্দর হয়ে থাকুন, এতে মন ভালো থাকবে। কোথাও গেলে হালকা মেক-আপ করতে পারেন। হালকা ফাউন্ডেশন, অল্প একটু ব্লাশার, ন্যাচারাল কালারের লিপস্টিক। চোখে লাউড মেক-আপ না করাই ভালো। একটা কাজলের রেখা টেনে স্নান করে নিন। বিশেষ কোনও সান্ধ্য পার্টিতে গেলে হালকা আইশ্যাডোও লাগাতে পারেন।

ঘুম জরুরি

পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুমের এসময় ভীষণ প্রয়োজন। শোয়ার সময় কোমরে কষ্ট হলে হাঁটুর নীচে বালিশ দিয়ে শোবেন। পায়ের দিকের উচ্চতা যেন মাথার দিকের চেয়ে বেশি হয়। রোজ খোলা হাওয়ায় ঘণ্টা চারেক বসুন, আর রাতে ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমোন।

মন চনমনে রাখুন

মনে কোনও উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তাকে ঠাঁই দেবেন না। সবসময় মনে স্ফূর্তি রাখুন। ভালো বই পড়ুন, ভালো মিউজিক শুনুন।

স্বামীর সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করুন। শারীরিক কষ্টটা কখনও কষ্ট মনে করবেন না। আপনার আসন্ন মাতৃত্বকে সেলিব্রেট করুন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...