পুরোনো দিনের কথা আজ বড়ো বেশি মনে পড়ছে নীলিমার। শহর প্রায় স্তব্ধ। মেয়ের কাছে বেড়াতে এসে আটকে পড়েছেন মুম্বই শহরে। বাড়িতে নাতি, নাতনি রয়েছে, ওদের কষ্টটাই বড়ো ভাবাচ্ছে নীলিমাকে। দুধের শিশু, সারা বিশ্ব সংসারে কী হচ্ছে কতটুকুই বা ওরা বুঝছে!
দুই সপ্তাহ হয়ে গেল হঠাৎ করে স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। প্রথম কটাদিন বেশ কেটেছে হঠাৎ পাওয়া ছুটির আনন্দে। কিন্তু এখন শুধুই পড়াশোনা সঙ্গে মোবাইল গেম, টিভি দেখা। কতক্ষণ আর বাচ্চার ভালো লাগতে পারে। এছাড়া মোবাইল বা টিভির পর্দায় বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে দেওয়া যায় না বাচ্চাদের। ডাক্তাররা বারবার সাবধান করছেন এতে শিশুর চোখের ক্ষতি হবে।
অথচ নীলিমার মনে হল তাঁদের সময় কোথায় ছিল এই মোবাইল, টিভি। তবুও তো তাঁরা কোনওদিন বোর ফিল করেননি। সবসময় মা বাবার কড়া শাসনে থাকতে হয়েছে। স্কুল আর বাড়ি। খুব বেশি হলে বাড়ির সামনের ছোট্ট একফালি জমিতে চার-পাঁচজন বন্ধু মিলে একটু দৌড়াদৌড়ি। চোর-পুলিশ খেলা। সবাই লুকোবে একজন খুঁজবে। প্রথম যে ধরা পড়বে সে আবার পরের সবাইকে খুঁজবে। কী মজাটাই না হতো। আর বাড়ির উঠোনে সেই চু… কিত্ কিত্ খেলা। কে কতক্ষণ দম ধরে রাখতে পারে। চক দিয়ে ঘর কেটে এক পায়ে খেলতে হতো। পাথর বা ইটের টুকরো দিয়েই কাজ চলত। নীলিমা মনে মনে হাসলেন, দমে ওনাকে কেউ হারাতে পারত না।
দস্যি মেয়ে বলে খ্যাতি ছিল ঠিকই কিন্তু পাড়ায় আর সব সমবয়সীদের সঙ্গে পুতুলের বিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে রান্নাবাটি খেলা এগুলোও বাদ দেননি। পুতুলের বিয়ে মানে সে কী ধুমধাম। সবার বাড়ি থেকে একটা একটা রান্না করা জিনিস একত্রিত হতো। রীতিমতো সবাইকে নেমন্তন্ন করে খাওয়ানো হতো। বাড়িতে মায়েরাও কনেকে বেনারসিতে সাজিয়ে দিতেন সে মেয়ের পুতুল হোক না কেন। গরমে স্কুলের ছুটি পড়লে কারো না কারো বাড়িতে তার পুতুলের বিয়ে লেগেই থাকত।
বাড়িতে দাদা ছিল নীলিমার। ইংরেজি স্কুলে পড়ার দৌলতে ওর স্ট্যান্ডার্ড একটু হাই ছিল- নিজের মনেই একটু হেসে নিলেন নীলিমা। ওর সঙ্গে বসেই বেশিরভাগ নীলিমা চাইনিজ চেকার, ক্যারাম, লুডো এগুলো খেলতেন তবে সেটা খানিকটা বড়ো হয়ে। মা বাবাও অনেক সময় তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিতেন। দাদার সঙ্গে সাপ লুডো খেলতে বসলে শেষ হতো ঝগড়ায় কারণ বেশিরভাগ তাঁরই পাকাগুটি সাপের মুখে যেত। সেটা নিজের অসাবধানতা ছিল নাকি দাদার চালাকি আজও নীলিমার অজানা।
বাড়িতে একটা বাগাডুলি ছিল। খেলার সাথি কেউ না থাকলে একা বসেই লাঠি দিয়ে বলগুলো ঘরে ফেলবার চেষ্টা করতেন। পয়েন্ট কত হল নিজের মনেই হিসেব করতেন আর খাতায় লিখে রেখে দিতেন।
সান্যাল কাকুর কথা মনে হল নীলিমার। ক্লাস এইট এ যখন নীলিমা, কাকু লন্ডন থেকে একটা বোর্ড গেম ওকে উপহার দিয়েছিলেন নাম ‘মনোপলি’। টাকার বিনিময়ে প্রপার্টি কেনা বেচার খেলা। বুঝতে একটু সময় লেগেছিল কিন্তু দারুণ ইন্টারেস্টিং একটা খেলা।
দাদা যেহেতু ইংরেজি স্কুলে পড়ত ওর হাত ধরেই নীলিমা বেশ রপ্ত করে ফেলেছিলেন টেবিল টেনিস খেলাটা। বাবা প্রাকটিস করার জন্য টেবিল টেনিস ব্যাট কিনে দিয়েছিলেন দাদাকে। সেটা দিয়েই খাবার টেবিলে চলত টেবিল টেনিসের প্রশিক্ষণ। নিজেদের স্কুলে অবশ্য ব্যাডমিন্টন খেলাটা শিখেছিলেন খেলার দিদিমণির কাছে। দিদিমণি জানতেন নীলিমার খেলাধুলোর উপর বিশেষ আকর্ষণ আছে।
নীলিমার মনে হল মায়ের কাছে বসে সামান্য সেলাই বোনা ছাড়া আর পড়াশোনাটুকু করা ছাড়া খেলার সময় ছিল প্রচুর। বিয়ের আগে রান্নাঘরে তাঁকে ঢুকতে হয়নি। তাই বলে কী পড়াশোনা হয়নি? অর্থনীতি নিয়ে স্নাতক হয়েছেন।
আজ বারবার এটাই মনে হচ্ছে নীলিমার, সামগ্রিক বন্দি হয়ে পড়া জীবনে এরকম হারিয়ে যাওয়া কিছু খেলাই হয়তো শিশুদের জীবনের একঘেয়েমি কাটিয়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে।