এই দফায় গাড়িতে সফর শুরু করেছি দিল্লি থেকে বিনসরের উদ্দেশে। মোরাদাবাদ কালাধুঙ্গি হয়ে করবেট ন্যাশনাল পার্ক ঢুকতেই মনটায় কেমন একটা শিহরণ খেলে গেল। বর্ষার জঙ্গল সতেজ সবুজ, এক সুন্দর বনজ গন্ধে পথ মোহময় হয়ে রয়েছে। নীল প্রজাপতির ঝাঁক উড়ে বেড়াচ্ছে ত্রস্ত ডানায়৷
আস্ত জঙ্গলটা যেন এক ধ্যানমগ্নতায় ডুবে রয়েছে৷ মাঝে মাঝে সেই নিস্তব্ধতা চিরে বেরিয়ে আসছে অচেনা পাখির ডাক৷
বেশ কিছুটা চলার পর নৈনিতাল পেরিয়ে যেতেই বৃষ্টি সঙ্গী হল। পাহাড়ি পথের বাঁক পেরিয়ে যত উপরে উঠছি মনে হচ্ছে এই সৌন্দর্য সুইটজারল্যান্ডকেও হার মানায়। খুরুপতাল-এর ছোট্ট ম্যাগি পয়েন্ট-এ ক্ষণিক বিরতি নিয়ে এগোতে থাকি আলমোড়ার পথে। গন্তব্য খুব দূরে নয়, কিন্তু ধ্বসপ্রবণ রাস্তায় গাড়ির রাশ টানতে হচ্ছে মাঝেমধ্যেই।
নৈনিতাল থেকেই পথের সঙ্গী হয়েছে কোসি নদী। এই নদীই পথ দেখিয়ে আলমোড়া নিয়ে চলল। জিম করবেট-এর বই পড়েই প্রথম আলমোড়ার সঙ্গে পরিচয়। তারপর সেই ভালোলাগায় শরিক করেছেন রাস্কিন বন্ড৷
মাত্র কয়েক ঘন্টার ড্রাইভে এখানে পৌঁছোতে পেরে এক অদ্ভূত রোমাঞ্চ হচ্ছে। আলমোড়া পৌঁছোতে পারলে প্রায় হাতের দূরত্বে এসে পড়ে বিনসর। মাত্রই ৩০ কিমি। করবেট ফরেস্ট-এর অন্তর্গত বিনসর, বস্তুত একটি অভয়ারণ্য। এখানে একটি বহু প্রাচীন শিব মন্দির রয়েছে বিনেশ্বর মহাদেবের। এর অদূরেই আমাদের রাতের আস্তানা ট্রাভেলার্স রেস্ট হাউস।
পাহাড়ি জঙ্গল যেমন হয়, তার সবটুকু রোমান্টিসিজম, বালাপোশের মতো জড়ানো বিনসরের গায়ে। পাখির কোলাহল রিমঝিম বৃষ্টি আর সবুজ বনস্থলি জুড়ে ঝিম ধরানো ঝিঁঝিঁর ডাক– এ এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। জঙ্গলের পথ পেরিয়ে ছোট্ট ট্রেক করে কাছের একটা গ্রামে ঘুরে আসা যায়। ১০-১২ ঘর মানুষের বাস, এই নিয়েই গউনাপ গ্রাম। আর-পাঁচটা অজানা অনামি গ্রামের মতোই এখানে বিদ্যুৎ নেই। আধুনিক দুনিয়ার সঙ্গে প্রায় সম্পর্কহীন এই গ্রাম, কিন্তু বড়ো আন্তরিক মানুষগুলোর ব্যবহার।
এবারে বৃষ্টি আমাদের পিছু ছাড়েনি। তাই শৃঙ্গ দেখার আশা প্রায় শিকেয় উঠেছে। বিনসর-এ দুটো দিন থাকাকালীন হিমালয় মুখ দেখাল না। মেঘ কুয়াশার চাদর চড়িয়ে রাখল দিগন্ত জুড়ে। তৃতীয় দিনে রওনা হলাম চৌকোরির উদ্দেশে। সাড়ে ন’টায় গাড়িতে উঠলাম। কুয়াশা মাখা অরণ্য পথে চোখে পড়ল শৃগাল, দু-একটি হরিণ। দীনাপানি হয়ে চৌকোরির পথে সঙ্গী হয়েছিল সরযূ নদী।
বেরীনাগ হয়ে চৌকোরি পৌঁছোলাম সাড়ে বারোটায়। থাকার ঠিকানা কেএমভিএন।চৌকোরি যেন রূপকথার বই থেকে উঠে আসা একটুকরো স্বর্গ। আমাদের চমকে দিয়ে মেঘ কেটে গিয়ে ঝকঝকে রোদ উঠতেই, দৃশ্যমান হল হিমালয় তার স্বর্গীয় রূপ নিয়ে। পঞ্চচুল্লির শোভা দেখে প্রায় বাকরুদ্ধ হবার অবস্থা। সানরাইজ, সানসেট সবই যাকে বলে ‘ব্রেথটেকিংলি বিউটিফুল’। একের পর এক পাহাড়ের সারির দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করি। এখানে এলে জীবনদর্শনটাই যেন বদলে যায়। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয় ওই স্বর্গীয় প্রকৃতির দিকে।