আধুনিক প্রযুক্তির অন্যতম বড়ো অবদান হল কম্পিউটার এবং এই যন্ত্রটির মাধ্যমে ইন্টারনেটের ব্যবহার। সারা বিশ্বের মানুষ আজ এর ব্যবহারে অভ্যস্ত। পড়াশোনায়, কর্মক্ষেত্রে, ঘরে-বাইরে সব জায়গায় কম্পিউটারের প্রয়োজন। অজানা কোনও কিছু জানতে হলে, প্রয়োজনীয় তথ্য বিশ্বের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অল্প সময়ের মধ্যে পাঠাতে হলে, জায়গার দূরত্ব ঘুচিয়ে দুটো মানুষ আবার অনেক সময় একাধিক মানুষ একসঙ্গে কথা বলতে চাইলে ইন্টারনেটের প্রয়োজন মাথা তুলে দাঁড়ায়। এককথায় আধুনিক জীবনযাত্রা নেট ছাড়া অসম্ভব।
প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ সাধারণ মানুষের সুবিধা বাড়িয়েছে ঠিকই কিন্তু এর অপব্যবহার নতুন প্রজন্মকে পৌঁছে দিতে পারে অপরাধ জগতের দোরগোড়ায়। সুতরাং তাদের মধ্যে সচেতনতা নিয়ে আসার দরকার যেমন, তেমনই প্রয়োজন রয়েছে বাড়িতে অভিভাবকদের সতর্ক থাকার।
সুগত কলেজের থার্ড ইয়ারে পড়ে। সুগতর মা-বাবা দু’জনেই চাকুরিরত সুতরাং দীর্ঘ সময় তারা বাড়িতে থাকেন না। ছেলের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ কম হলেও তারা ছেলের সার্বিক প্রোগ্রেসের খবরাখবর নিয়মিত রাখেন। হঠাৎ করেই তারা লক্ষ্য করেন অনেক রাত পর্যন্ত কম্পিউটারে সুগত বসে থাকে। তারা জিজ্ঞাসা করলে বলে পড়াশোনা করার জন্যে প্রয়োজনে তাকে রাত পর্যন্ত কম্পিউটারে বসতে হয়। এটা খুবই স্বাভাবিক কিন্তু কোনও কারণে সুগতর বাবার মনে সন্দেহ দানা বাঁধে, ফলে ছেলের অনুপস্থিতিতে কম্পিউটার খুললে বুঝে ফেলেন ছেলে অত রাত পর্যন্ত বসে কী করে? পর্নোগ্রাফি সাইটগুলির প্রতি তার আসক্তি পরিষ্কার হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে অবশেষে সুগতর মা-বাবা কাউন্সেলিং-এর রাস্তা বেছে নেন।
এখন ইন্টারনেট খুললেই অজস্র সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটের ভিড়, মেসেঞ্জার, চ্যাট্ রুমের ছড়াছড়ি। নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা এগুলির ব্যবহারে এতটাই অভ্যস্ত যে তারা সেফটি ব্যাপারটায় তেমন আমলই দেয় না। সুতরাং অভিভাবক হিসেবে মা-বাবার দায়িত্ব পুরো প্রক্রিয়াটার সঙ্গে নিজে পরিচিত হয়ে, নেট ব্যবহারের ভালোমন্দ দিকগুলি নিজে বিশ্লেষণ করে তবেই সন্তানকে নেট সার্ফিং করতে দেওয়া। ইন্টারনেট ব্যবহারের কিছু সেফটি বিষয়ক নিয়মাবলী রয়েছে যেগুলি অভিভাবকেরা চাইলে সন্তানের নিষিদ্ধ সাইট ভিজিট করার সম্ভাবনাকে রোধ করতে পারেন।
এই যুগে যেখানে সাইবার অপরাধের এতটা রমরমা এবং অনলাইনে সেক্সুয়ালি এক্সপ্লিসিট তথ্যের এবং ভিডিও-র ছড়াছড়ি সেখানে অভিভাবকদের নিজেদের সন্তানদের কম্পিউটারে পেরেন্টাল কন্ট্রোল স্থাপন করা উচিত।
‘Windows 7’-এ চারটি সহজ স্টেপে পেরেন্টাল কন্ট্রোল সেট করা যায়। এর জন্যে অভিভাবকদের নিজস্ব অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ইউজার অ্যাকাউন্ট থাকা প্রয়োজন।
১) পেরেন্টাল কন্ট্রোল সেট করতে প্রথমে স্টার্ট বাটন ক্লিক্ করুন। কন্ট্রোল প্যানেল ক্লিক্ করে আন্ডার ইউসার অ্যাকাউন্ট এবং ফ্যামিলি সেফ্টি-তে আসুন। এবার যে-কোনও ইউজার-এর জন্য ‘সেট-আপ-পেরেন্টাল কন্ট্রোল’ ক্লিক্ করুন। অ্যাডমিনিস্ট্রেটর পাসওয়ার্ড টাইপ করতে হবে অথবা কনফারমেশন প্রোভাইড করতে হবে।
২) যে স্টান্ডার্ড ইউজার অ্যাকাউন্টের জন্য আপনি পেরেন্টাল কন্ট্রোল সেট করতে চান সেই অ্যাকাউন্টে ক্লিক্ করুন। স্টান্ডার্ড ইউজার অ্যাকাউন্ট যদি না থেকে থাকে তাহলে ‘ক্রিয়েট আ নিউ ইউজার অ্যাকাউন্ট’ ক্লিক করুন নতুন অ্যাকাউন্ট তৈরি করার জন্য।
৩) পেরেন্টাল কন্ট্রোলের মধ্যে ক্লিক করুন ‘এনফোর্স কারেন্ট সেটিংস’।
৪) আপনার বাচ্চার স্ট্যান্ডার্ড ইউজার অ্যাকাউন্টের জন্যে পেরেন্টাল কন্ট্রোল খোলার পরে আপনি নিজস্ব সেটিং অ্যাড্জাস্ট করতে পারেন যেটা কিনা আপনি নিজের কন্ট্রোলে রাখতে চান।
নিয়ন্ত্রণ এখন আপনার হাতে
আপনি নিজের সন্তানকে কীভাবে কম্পিউটারের ব্যবহারে অভ্যস্ত করাবেন সেটা পেরেন্টাল কন্ট্রোলের মাধ্যমে আপনি পুরোপুরি পরিচালনা করতে পারবেন। যেমন কতক্ষণ আপনার সন্তান কম্পিউটার ব্যবহার করবে, কী কী গেমস্ খেলতে পারবে, কী কী প্রোগ্রাম রান করাতে পারবে ইত্যাদির ওপর আপনি, আপনার ইচ্ছা প্রয়োগ করতে পারবেন। যখন কোনও গেম অথবা প্রোগ্রাম, পেরেন্টাল কন্ট্রোল দিয়ে ব্লক করা থাকবে, তখন এগুলো চালাতে গেলে একটা নোটিফিকেশন ডিসপ্লে বোর্ডে দেখাবে যে এগুলি ব্লক্ করা রয়েছে। আপনার সন্তান চাইলে নোটিফিকেশনে দেওয়া একটি লিংকে ক্লিক্ করে আপনার অনুমতি চাইতে পারে গেমটি খেলার জন্যে অথবা কোনও প্রোগ্রাম চালাবার ইচ্ছা হলে। আপনি চাইলে আপনার অ্যাকাউন্ট ইনফর্মেশনে ঢুকে সন্তানকে অনুমতি দিতে পারেন গেম অথবা প্রোগ্রামটি চালাবার।
তবে এটাই যথেষ্ট নয়। আপনার সন্তানের প্রতি দৃষ্টি রাখাটাও একান্ত জরুরি। আপনার ছেলে অথবা মেয়ে কতটা কম্পিউটারের ব্যবহার জানে, কীসের জন্যে কম্পিউটার ব্যবহার করে, নানা ধরনের অনলাইন কার্যকলাপের সঙ্গে তারা কতটা পরিচিত এবং স্বপ্নের এই জগৎ কতটা তাদের উপর প্রভাব ফেলতে সক্ষম– এরকমই খুঁটিনাটি বিষয়গুলি সম্পর্কে আপনাকে ওয়াকিবহাল থাকতে হবে। এরজন্যে সন্তানের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করা একান্ত বাঞ্ছনীয়। এছাড়াও কম্পিউটার বাচ্চাদের ঘরে না রেখে নিজেদের লিভিং রুমে রাখাই শ্রেয়। এর ফলে বাচ্চারা কতটা সময় বসে কম্পিউটার চালাচ্ছে সেটা নজরে থাকবে এবং অনলাইনে কী করছে সেটাও চোখের সামনে থাকবে। যদি ওয়েব ক্যাম থাকে তাহলে খেয়াল রাখতে হবে যাতে ক্যামেরার মাধ্যমে অপরিচিত কারও সাথে ভিডিও চ্যাটে ছেলেমেয়ে মত্ত না হয়ে পড়ে। বাচ্চাদের পরামর্শ দিন যাতে ইন্টারনেটে বাড়ির ঠিকানা, ফোন নম্বর কারও সাথে শেয়ার না করে এবং বন্ধুদের সঙ্গেও যেন পাসওয়ার্ড শেয়ার না করে।
অনলাইনে বিভিন্ন মেসেঞ্জারস এবং চ্যাট্ সাইটে যে চ্যাট্ রুম-স রয়েছে সেখানেই বেশিরভাগ পর্নোগ্রাফিক কনটেন্ট চালাচালি হয়। সাইবার সেক্স (সেক্স-টেক্সট-চ্যাট্ অথবা ভিডিও) নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের প্রলুব্ধ করে বেশি কারণ তাদের মধ্যেই অজানা বিশ্ব নিয়ে একটা প্রচণ্ড জিজ্ঞাসু মন রয়েছে। আর স্বাভাবিক ভাবে যা-কিছুর উপরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে সেটাই জানার ইচ্ছে প্রবল– এটাই মানুষের ধর্ম। অনলাইনের এই জগৎ সদ্য প্রস্ফুটিত মনকে প্রলোভনের কোন পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে সেটা ভাবতেও মন উদ্বেল হয়। তাই যতটা সম্ভব চ্যাট্ সাইটগুলির গাঢ়, পঙ্কিল, অন্ধকারময় রাস্তা থেকে সন্তানকে দূরে রাখুন।
যদি তারা চ্যাট্ রুম একান্তই এক্সপ্লোর করতে চায় তাহলে, ছেলে কি মেয়ে বোঝা যাবে না এমন নাম ‘ইউজারনেম’ হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। এর ফলে কিছুটা হলেও আনওয়ানটেড পর্নোগ্রাফিক কনটেন্টের সম্মুখীন কম হতে হবে আপনার সন্তানকে। যদিও এই চ্যাট্ রুমগুলি টিনএজারস-এর কথা মাথায় রেখেই করা হয়েছে কিন্তু এটি যে ব্যবহার করছে, সে যে প্রাপ্তবয়স্ক নয় এমন কোনও গ্যারান্টি অনলাইনে দেওয়া যায় না। মিথ্যা পরিচয়পত্র দিয়ে সে অনায়াসেই এই সাইটগুলি ব্যবহার করতেই পারে।
মনে রাখুন
ভাইরাস এবং হ্যাকারদের হাত থেকে বাঁচতে, অপরিচিত কারও পাঠানো ই-মেল অ্যাটাচমেন্ট অথবা লিংক খোলা একেবারেই উচিত নয়। লিংক খোলার আগে দেখে নেওয়া উচিত ডোমেন নেম (প্রেরকের নাম), সিওএম (কমার্শিয়াল), জিওভি (গভর্নমেন্ট), ওআরজি (অর্গানাইজেশন), এনইটি (নেটওয়ার্ক), ইডিইউ (এডুকেশনাল অর্গানাইজেশন) অথবা দু’অক্ষরের কানট্রি কোড (কানট্রি অফ ওরিজিন)। এগুলি দেখে নিলেই বোঝা যাবে সাইটটির বিশেষ উদ্দেশ্যটা কী? শিক্ষা (এডুকেশন) না বিক্রি (সেলস্)।
সন্তানকে বোঝান, ইন্টারনেট একটি শক্তিশালী টুল। সুতরাং বুদ্ধি, বিবেচনা দিয়ে এটির ব্যবহার করা উচিত এবং এর সঙ্গে নিজের চিন্তা শক্তিকেও সংযত করা একান্ত কাম্য।