গর্ভধারণ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। প্রায় প্রতিটি মহিলাই সহজাতভাবে এই আনন্দে গা ভাসিয়ে দেন। এই সময়ে গর্ভবতী মহিলারা সব কাজই করতে পারেন, তবে একটু সাবধানে। বর্তমানে অধিকাংশ ডাক্তারই সিজারিয়ান ডেলিভারির সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তবে কেরলের কোচি-র চাইল্ড বার্থ এডুকেটর প্রিয়ংকা ইডিকুলা এর ঘোর বিরোধী। ওনার মতে সিরিয়াস কনডিশন না হলে, সিজার এড়িয়ে চলাই ভালো। এতে পরবর্তীকালে মায়েদের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। তাই তিনি নর্ম্যাল ডেলিভারিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তাঁর হাত ধরেই কেরলের মানুষ, প্রথম ওয়াটার বার্থ সম্পর্কে জানতে পারেন। পিবিএস হাসপাতালে হানি নামের এক মহিলা সর্বপ্রথম এই পদ্ধতিতেই তার শিশুকন্যা জাহ্নবীর জন্ম দেন। এখন অনেক মহিলাই প্রসবযন্ত্রণা এবং কাটাছেঁড়ার হাত থেকে বাঁচতে ওয়াটার বার্থ পদ্ধতিকেই বেছে নিচ্ছেন।
শহরের ভিড়ভাট্টা থেকে কিছুটা দূরে কোচির পনংবিল্লিতে এই বার্থ ভিলেজের অবস্থিতি। গর্ভবতী মহিলাদের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে, গর্ভ সম্বন্ধিত বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করার পাশাপাশি, তাদের মনের কোণে জমে ওঠা শঙ্কাও দূর করা হয়ে থাকে এখানে।
চাইল্ড বার্থ এডুকেটর প্রিয়ংকা বলেন, ‘আমি নর্ম্যাল ডেলিভারিরই পক্ষপাতী। সর্বদা এটাই চেষ্টা করি কোনও টেনশন ছাড়াই গর্ভবতী মহিলারা প্রাকৃতিক ভাবে প্রসব করুক।’
‘আমিও নর্ম্যাল ডেলিভারির দ্বারাই বাচ্চার জন্ম দিয়েছি। সেই কারণেই আমি এব্যাপারে একটু বেশিই জোর দিই। যখন আমি হাসপাতালে ভর্তি ছিলাম, তখন অন্যান্য মহিলাদের ভয়, প্রসব সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণা পোষণ, আত্মবিশ্বাসের অভাব, প্রসবের সঠিক সময় নির্ধারণ করতে না পারা দেখে মনে মনে স্থির করেছিলাম, ভবিষ্যতে এই বিষয়ে, আমাকে নতুন কিছু একটা করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে পড়ার জন্য এই ধরনের কোনও কোর্স ছিল না, সেই কারণেই আমেরিকা গিয়ে ‘লামাজে সার্টিফায়েড কোর্স’ করা।
ভারতেও ১২-১৩টি জায়গায় এই ধরণের কোর্স করানো হয়। হায়দ্রাবাদ, দিল্লি, মুম্বইতেও কোচির মতো বার্থ ভিলেজ রয়েছে। এখানে হসপিটাল বেসড আর ইন্ডিপেন্ডডেন্ট কোর্সও চালু আছে। চাইল্ড বার্থ এডুকেশনে, নর্ম্যাল বার্থ কতটা সাপোর্টেবল, এই কোর্সগুলিতে এটাই বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখা হয়।
ওয়াটার বার্থ কী ?
প্রসবের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে ওয়াটার বার্থ হল একটি। এই প্রক্রিয়ায় প্রসববেদনা আনার জন্য ইনজেকশনও পুশ করা হয় না, আর যোনিদ্বার কাটাছেঁড়ারও প্রয়োজন পড়ে না। শুধু তাই নয়, প্রসবের সময় গর্ভবতী মহিলার দুর্বলতা দূর করার জন্য স্যালাইনও দিতে হয় না। ঈষদুষ্ণ জলে ভরা ওয়াটার পুলে প্রসব করানো হয়ে থাকে।
প্রসবপীড়া দূর করার জন্য সব থেকে ভালো উপায় হল ওয়াটার পুল। ‘ওয়াটার বার্থ’ এর বিশেষত্বই হল এই যে, প্রসূতি মহিলাদের প্রসবযন্ত্রণা যতটা সম্ভব (প্রায় ৭০ শতাংশ) লাঘব করে নর্ম্যাল ডেলিভারি করানো। বিদেশে আকছার বাড়িতেই এই বিধি অনুযায়ী শিশুর জন্ম দেন মহিলারা। শুধু সহকারী হিসাবে একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মিডওয়াইফ (নার্স) থাকলেই কাজ চলে যাবে। ঈষদুষ্ণ জলের অনুভূতি, গর্ভবতী মহিলাদের মানসিক ও শারীরিক কষ্ট থেকে রিল্যাক্সেশন প্রদান করে। গর্ভস্থ শিশুরও কোনও অসুবিধা হয় না। সায়েন্টিফিক্যালি আজ এটা প্রমাণিত। কারণ গর্ভাশয়ে অ্যামনিওটিক দ্রব্য (গর্ভাশয়ের মধ্যে থাকা তরল)-এর উষ্ণতায় অভ্যস্ত বাচ্চার পদার্পণও সেই হালকা গরম জলেই। যার জন্য জন্ম নেওয়ার পরমুহূর্তের নতুন পরিবেশে কোনও অসুবিধা হয় না সদ্যজাতের।
ওয়াটার বার্থ-এর প্রকারভেদ
সাধারণত ওয়াটার বার্থ দুটি উপায়ে করানো হয়ে থাকে।
১. ডেলিভারি ইন ওয়াটার
২. কমফর্ট ওয়াটার বার্থ ইন ল্যান্ড
‘ডেলিভারি ইন ওয়াটার’ পদ্ধতিতে শরীরের তাপমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জলেরও তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তারপর তাপমাত্রাকে মনিটার করা হয়ে থাকে। হালকা গরমজলের কারণে শরীর ঢিলে হতে শুরু করে, ফলে খুব সহজেই গর্ভাশয়দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যায়। সেই সময় গর্ভবতী মহিলা একটু পুশ করলেই অনায়াসে বাচ্চা গর্ভাশয়দ্বার দিয়ে বেরিয়ে আসে। প্রসবের সময় পাওয়া হালকা ক্ষতও খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায় এই ওয়াটার বার্থ পদ্ধতিতে বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ফলে। আজ তাই অধিকাংশ মহিলাই এই বার্থ ভিলেজে ডেলিভারির জন্য আসেন।
কোয়েম্বাটুর, মাদুরাই, ত্রিচী, ব্যাঙ্গালুরু-র মতো জায়গা থেকেও প্রচুর মহিলা এই বার্থ ভিলেজে আসেন ক্লাস অ্যাটেন্ড করার জন্য। কখনও কখনও প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফের অভাবে ওয়াটার বার্থ-এর সিদ্ধান্তও বদল করতে হয়। এর জন্য খরচ পড়ে আনুমানিক ৩৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা পর্যন্ত।
পাঁচ মাস থেকে শুরু করে ডেলিভারির সময় পর্যন্ত ট্রিটমেন্ট চলে। প্রেগন্যান্সির সময়ে, প্রেগন্যান্সি সম্বন্ধিত জটিলতাকে সহজভাবে নেওয়ার মানসিক শক্তি যোগানো হয় এখানে। এই সময়ে মিউজিক থেরাপির মাধ্যমেও দেহের কষ্ট খানিকটা লাঘব করা হয়।
অভিজ্ঞতা সঞ্চয়
বার্থ ভিলেজের ওয়ার্কিং টাইম সকাল ৯ঃ৩০ থেকে সন্ধ্যা ৬ঃ৩০ পর্যন্ত। তৎসত্ত্বেও ক্লাস অ্যাটেন্ড করার জন্য যে-কোনও সময়েই আসার ক্ষেত্রে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন শরীরের যথাযথ মুভমেন্টের জন্য, মেঝেতে বসে পদ্মাসন করার কথা বলা হয়ে থাকে। ঠাকুমা-দিদিমাদের আমলে বেডরেস্ট শব্দটাই শোনা যেত না। তখন অধিকাংশ মহিলাই ঘরের সমস্ত কাজ করতেন। কিন্তু আজ টেনশন আর ব্যস্ত জীবনশৈলীর কারণে বহুল পরিবর্তন এসেছে। তবে এটা মাথায় রাখতে হবে, গর্ভবতী মহিলা যত অ্যাকটিভ হবে, ডেলিভারিও ততই সহজসাধ্য হবে।
১৮ ঘন্টা আর ১৪ ঘন্টার শিডিউলে চলে ক্লাস। প্রত্যেক দিন ২ ঘন্টার ক্লাসে, প্রসবের সময় শরীরে হওয়া বিভিন্ন পরিবর্তন, প্রসব সংক্রান্ত আলোচনা করা হয়। গর্ভবতী মহিলাদের স্বামীদেরও এবিষয়ে জ্ঞাত করা হয়ে থাকে এখানে। এই সময় গর্ভে থাকা বাচ্চার সঙ্গে কথা বলা, তার দেখভাল করা, নতুন অতিথির অভ্যর্থনার জন্য মনকে তৈরি করা সমস্তই চলে ক্লাসে। জীবনে ইতিবাচক ভাবনা ভীষণ ভাবে জরুরি। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করলে তাদের জন্যও আলাদা ক্লাসের ব্যবস্থা রয়েছে।
গর্ভাবস্থায় থাকুন ফ্যাশনেবল
সাধারণত গর্ভাবস্থার সময় মহিলারা ঢিলেঢালা কাপড়ই বেছে নেন, যে তালিকায় থাকে বিভিন্ন ধরনের ফ্রক শেপের কুর্তা, ফিড টপ্স, ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট ওপেন টপ্স, সালোয়ার, স্ট্রেচড ড্রেসও থাকে। বার্থ ভিলেজে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের কমফর্টের কথা মাথায় রেখে ৫০০-২৫০০ টাকার মধ্যে ড্রেসও রাখা হয়েছে। যেগুলি কমফর্টের পাশাপাশি ফ্যাশনেবলও বটে।
খাবার আর ব্যায়াম
গর্ভাবস্থায় ওজন বেশী বাড়লেও চলবে না, আবার কম হলেও চলবে না। এই সময় পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা উচিত, যা মা এবং বাচ্চার জন্য উপযোগী। এই সময় অধিক ক্যালোরি-যুক্ত খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো। তৈলাক্ত খাবার আর মিষ্টি বাচ্চার বিকাশের পথে বাধার সৃষ্টি করে। তাই এগুলি যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলুন। এই সময় টেনশন আর উত্তেজনা থেকে দূরে থাকুন।