হঠাৎ গোঁ ধরেছিল ছেলেটা। কাল থেকে অ্যানুয়াল পরীক্ষা শুরু, কিন্তু কিছুতেই পড়তে বসবে না। বিকেলে খেতে খেতে নিনজা হাতোড়ি, ছোটা ভীম, বেনটেন রোজকার মতো কালও অনুমোদন করা হয়েছে। খাওয়ার ছলে বেশ খানিকক্ষণ টিভি দেখতে থাকে এমনিতেই। কিন্তু কাল ওকে বোকাবাক্সের সামনে থেকে নড়ানোই যাচ্ছিল না। লিটারেচারের কী বিরাট সিলেবাস। অত প্রশ্নোত্তর, শব্দার্থ, ইডিয়ামস, কবিতা, বানান– তিথি নিজেও মনে রাখতে পারত কিনা সন্দেহ। আর রন্তির ভ্রূক্ষেপ নেই। দশ পূর্ণ হল। ক্লাস ফাইভে উঠবে। ছেলের নিজেরও তো গরজ থাকবে। তা নয়। মা চামচে মেখে গিলিয়ে না দিলে এক বর্ণ পড়বে না। আধাখ্যাঁচড়া প্রস্তুতি নিয়েও পরীক্ষার আগের দিন নিশ্চিন্তে কার্টুনে ডুবেছিল।

অনেকক্ষণ বোঝানোর পর পিঠে একটা চাপড় বসায় তিথি। এমন দুর্বিনীত ছেলে, মাকেই উলটে আক্রমণ করে। তবে রে? ছেলেকে এলোপাতাড়ি মেরে ধরে শোবার ঘরে টেনে নিয়ে যায় মা। যার জন্য নিজের প্রিয় ধারাবাহিক ছেড়ে দিচ্ছে, তার একটু হুঁশ থাকবে না? উলটে মাকে মার? ভাগ্যিস শাশুড়ি ওই সময় ফ্ল্যাটে ছিলেন না।

মার খেয়ে রন্তি আরও গোঁয়াড় হয়ে উঠল। এমন বিশ্রী জেদ, আদর করে ভুলিয়েও গলানো গেল না। বাবা অফিস থেকে ফিরেছে ছেলের জন্য বেনটেন কমিক্স আর এক প্যাকেট হিমায়িত চিকেন কাটলেট নিয়ে। কী আক্বেল। পড়ানোর বেলা গোল্লা, পরীক্ষার আগে এমন বিনোদনের বই কেউ কেনে? সাধারণত যেদিন এই ধরনের খাদ্য আসে, সেদিনই ভেজে উদ্বোধন করা হয়। ছেলে বই নিয়ে সদ্য বসেছে, আর দেরিও হয়ে গেছে। তাই বলল, ‘আজ থাক, কাল ভালো করে পরীক্ষা দাও। কাল ভেজে দেব। আর পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে যা চাইবে তাই দেব। সোনা বাবা আমার, পোয়েমদুটো লিখে দেখাও তো। ওগুলো থেকে ফিল ইন দি ব্ল্যাঙ্কস আসবে না? কমা ফুলস্টপ, সেমিকোলন সব ভালো করে দেখে নাও।’

‘কোলন আর ড্যাশও আছে। টু আ বাটারফ্লাই আমার মুখস্থ।’ অসন্তুষ্ট গলায় গজগজ করল রন্তি। তারপর দুটো মাঝারি কবিতা লিখতেই সাড়ে ন’টা বাজিয়ে দিল। প্রায় পঞ্চাশখানা প্রশ্নোত্তর ঝালানো বাকি। তাছাড়া সাহিত্যের টেক্স্ট থেকেও ব্যাকরণের প্রশ্ন আসে। সবই করিয়েছে তিথি একবার করে। কিন্তু পরীক্ষার আগে না দেখলে? ছেলের ঠাকুমা বলেন, ‘ও সব পারবে’। বাবা বলে, ‘বাদ দাও’।

অগত্যা জেনারেল লি’র অধিনায়কত্বে খ্যাঁদা-নেকো জাপানিদের তাকেশি’স কাসল অভিযান দেখতে দেখতে খাবার টেবিলের বদলে সেন্টার টেবিলে ডিমের ঝোল ভাত মেখে রন্তিকে গিলিয়ে দিল। খাওয়ার ব্যাপারে রন্তিকে সাধতে হয় না। কিন্তু আজ একে মার-বকুনি, তার ওপর আলু-পটল দিয়ে ডিমের ডালনা। মুখে মুখে প্রশ্নোত্তর ধরতে গিয়ে দেখল ছেলে হাঁ করে হাড়গোড় গুঁড়োনো খেলার একশো সাতান্নতম রিপিট টেলিকাস্ট আর ভাত গিলছে। মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না একটাও। চুলের মুঠি ধরে একবার নাড়া দিয়ে থালা হাতে উঠে গেল তিথি। ‘ব্রাশ করে সোজা বিছানায় যা। আইদার টেক্স্ট বুক, কিংবা ঘুম। কমিকস্ খুলতে দেখলে ছিঁড়ে ফেলব।’

রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত গোঁজ মারা ভাবটা কমেনি। ঠাকুমার রসিকতায় জবাব দিল না। মা মেরেছে তাই বাবার আদরে ভুলবে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে বালিস ভিজিয়েছে। তিথি রান্নাঘর, টেবিল ফ্রিজ, কোলাপ্সিব্ল গেটে তালা, বসার ঘরের আলো-পাখা, রাতের গা ধোয়া ইত্যাদি সেরে এসে দেখে বাপ নাক ডাকাচ্ছে। ছেলে বাবার ঘাড়ের কাছে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তিথি আর মনোময় দুজনেই লম্বা দোহারা। ছেলেটার এখন থেকেই কী সুন্দর সুঠাম দেহ। মায়ের চোখ ডাইনির চোখ। নিজেকে শাসন করল তিথি।

‘মায়ের সঙ্গে কি অমন করতে আছে সোনা? আমার কষ্ট হয় না তোকে মারতে? এত বড়ো হয়েছিস এটুকু বুঝবি না? অয়না দ্যাখ তোর চেয়ে ছোটো হয়েও কেমন ভালো রেজাল্ট করে। মাথায় কি তোরও বুদ্ধি কম? পরীক্ষার পর কত আনন্দ করব। বাবা বিরিয়ানি রাঁধবে। একদিন বাইরেও খেয়ে আসব। সোনা বাবা আমার…।’ ছেলের পাশে শুয়ে তার গুঁজে রাখা অভিমানী মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিতে চাইল। ডান পা-টা নিজের পেটের ওপর চাপাতে চাইল। রন্তি ঘুমের মধ্যেও মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল না। কাঠ হয়ে থাকল। এগারো বছরের ছেলের সঙ্গে গায়ের জোরে পেরে ওঠে না মা। ছেলের ঘাড়ে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শুয়ে পড়ল। তার স্কুলেও পরশু থেকে পরীক্ষা শুরু।

একজনের অফিস, একজনের স্কুল ও সংসার। পাশের ঘরে বৃদ্ধা শাশুড়ি। তাঁর জায়গাও বেশি লাগে, আর রন্তিও মাকে ছেড়ে ঠাকুমার কাছে শোবে না। রাতে ঘুমের ঘোরে ছেলে এখান সেখান হাত-পা ছুড়লে অস্বস্তি লাগে। কিন্তু উপায় কী? স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত আড়াল নেই। তাগিদও নেই। তেরো বছর তো হল। ছেলেই মা-বাবার অগ্রাধিকার। কাল থেকে পরীক্ষা শুরু। শেষ হতে দু সপ্তাহ।

দশ বছরে কয়েকটা টিকার বুস্টার ডোজ আছে। দীর্ঘদিন সর্দিকাশিতে ভোগায় সেগুলো দেওয়া যাচ্ছিল না। ডাক্তারের কাছে গিয়ে সর্দির প্রেসক্রিপশন হাতে ফিরতে হচ্ছিল। এমনিতেই তিনখানা টিকা একদিনে দেবেন না। দশ বছর বয়স থাকতে মেয়েকে সুস্থ অবস্থায় পাবে তো? সর্দিকাশি, পেট ইত্যাদি মোটামুটি ঠিক আছে দেখে পরীক্ষার আগের দিনই ডাক্তার সান্যালের কাছে ঘুরে এল শ্রেয়সী। আসার পথে রাই বায়না ধরল ফুচকা খাবে। মাথা খারাপ? পরশু থেকে পরীক্ষা শুরু। রাত্রে বাড়িতে ফ্রায়েড রাইস, মাংসের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়েকে ভোলাতে চাইল। রাই তবু ঘ্যানঘ্যান করে, ‘বেশি নয়, মোটে চারটে ফুচকা মা। কিছু হবে না। তুমি ওষুধ কিনে বাড়ি চলো।’

‘পাঁচ টাকার ফুচকার খেসারত একশো টাকার ওষুধের কোর্স, সেই সঙ্গে অরুচি? না বললাম না? কাল বাদে পরশু থেকে পরীক্ষা শুরু। একেই আজ এটা কাল ওটা করে ভুগিস। রাতে ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন করব বললাম তো। এখন বরং একটা আইসক্রিম খা। আসতে আসতে চেটে খাবি, গলায় ঠান্ডা না লাগিয়ে।’

আইসক্রিম যতই প্রিয় হোক, ফুচকার গন্ধে নাকে মুখে জল এলে আইসক্রিম কি তার বিকল্প হতে পারে? নিমরাজি হয়ে মাথা নাড়ল রাই। ওপারে দোকান। মা মেয়ে রাস্তা পার হতেই একটা ফাঁকা অটো হাঁকতে হাঁকতে পাশে দাঁড়াল। লাইনে না দাঁড়িয়েই বাহন পেয়ে যাওয়ায় শ্রেয়সী আর আইসক্রিমের দোকানে না ঢুকে সোজা অটোয় চড়ে পড়ল মেয়ের হাতে ধরে।

‘তুমি মিথ্যেবাদী।’

মাথায় চড়াক করে রক্ত উঠলেও শান্ত হয়ে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘তোমায় কি আইসক্রিম, চকোলেট দিই না? কিন্তু আইসক্রিম খেলে আধ ঘন্টা অটোর লাইনে দাঁড়াতে হতো। এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে হাত পা ধুয়ে পড়তে বসাটা জরুরি নয় এই সময়? আচ্ছা বাবাকে ফোন করে দিচ্ছি বাড়ি ফেরার সময় আইসক্রিম নিয়ে আসবে। এখন বাড়ি গিয়ে দুধ ফিনিশ করলে কিন্তু।’

তরুণকে ফোন করল শ্রেয়সী। তরুণের ফিরতে রাত হবে। সে দোকানের কর্মচারী শান্তনুর হাতে পাঠিয়ে দেবে। শান্তনু কোনও কাজে গিয়ে ফেঁসে গেছে। তরুণ ফিরল রাত দশটায়। এতক্ষণ বকুনি সহ ঘ্যানঘ্যান করতে করতে পড়ছিল রাই। রাতে বাবাকে খালি হাতে ফিরতে দেখে আর নতুন করে হতাশা প্রকাশ করল না। ফুচকার বদলে আইসক্রিম, তাও না দুধ-বোর্নভিটা। এখন রুটি তরকারি। মা ফ্রায়েড রাইস করতে পারেনি। রান্নার মাসিরও তাড়া ছিল। গতকালের একটু পনির উদ্বৃত্ত ছিল। তাই দিয়ে শান্ত হয়ে মায়ের হাতের রুটি খেয়ে নিল রাই ডিজনিতে হাসির ধারাবাহিক দেখতে দেখতে। রাতে ঘুম আসার আগে পর্যন্ত মায়ের মুখে মুখে প্রশ্নোত্তরও ঝালিয়ে নিল। হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘কাল করবে তো মা? সব পরীক্ষা শেষে দাদা-বউদির বিরিয়ানি আনবে বাবা?’

‘নিশ্চয়ই’। কে জানে, মেয়ে মনে মনে মা-বাবাকে মিথ্যেবাদী বলল কি না।

মেয়েটা দিন দিন বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে। সেভেন হল। এর মধ্যেই বাবার কানের পোকা খেয়ে ট্যাব আদায় করেছে। মাকে দিদি নম্বর ওয়ানে গিয়ে প্রাইজ জিতে আসার অনুপ্রেরণা দিয়ে কাজ হয়নি। নিজেই বাড়ি থেকে ইন্টারনেটে মায়ের আর নিজের অনলাইন আবেদন জমা করেছে। বছর ঘুরতে চলল। কতদিন আর দরকারি জিনিস অনিশ্চিত ইভেন্টের হাতে ফেলে রাখা যায়?

পড়াশুনো কী করছে দেখাতে চায় না। সারাক্ষণ কম্পিউটারে নেট খুলে খানাতল্লাশি চালায়। নাকি পড়াশুনো হচ্ছে। অত অত মোটা বইয়ের পাহাড় থাকতে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীর ইন্টারনেট থেকে বাড়তি কী এমন তথ্য জানার থাকতে পারে? তিনটে টিউশনি। নেট-এ খোঁজাখুঁজি। তাও ফলাফল ভালো থেকে ক্রমশ মাঝারি হয়ে যাচ্ছে। কিছু বললে যা মূর্তি ধারণ করে। মাকে তো পাত্তাই দেয় না। বাবাকে একটু মানে। আবার আবদারের বেলায়ও বাবা। কিন্তু এই বয়স থেকে একা একা নেটে থাকা মা-বাবা কেউই অনুমোদন করে না। পৃথিবীর কদর্যতম দৃশ্যটাও কয়েকটা মাউস ক্লিকের অপেক্ষায় সাইবার দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। নারী-পুরুষের ভালোবাসার মাধুর্য বোঝার আগেই যদি চরমতম বিকৃতি আর বীভৎসতার সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় তাহলে রুচি, মানসিকতা কেমন দাঁড়াবে? অবশ্য তেমন কিছু ব্রাউজিং-এর প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শুধু গাদা গাদা চ্যাট। পড়ার বই খুলে রেখে ট্যাব হাতে চেনা-অচেনা মানুষের সঙ্গে গপ্পো।

বাধ্য হয়ে পরীক্ষার দুদিন আগে সাত্যকী বারো বছরের মেয়ের গায়ে হাত তুলল। এগালে-ওগালে এলোপাতাড়ি। মল্লিকা ঝাঁপিয়ে পড়ে থামাতে এলে তার গায়েও দু-একটা পড়ল। পরীক্ষার আগে কেউ এভাবে মেরে মনমেজাজ খারাপ করে দেয়? নিজে যখন বুঝবে না, বোঝাতে হবে। মেয়ে বড়ো হচ্ছে। এভাবে বাপের মার খেলে আত্মসম্মানে লাগবে না? এখনকার ছেলেমেয়েরা মা-বাবার সব কিছুতে হস্তক্ষেপের অধিকারটা মেনে নেয় না। একদিকে আত্মকেন্দ্রিক। কিন্তু রাগলে নিজের চূড়ান্ত ক্ষতি করে ফেলে, ভালোবাসার মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিতে দুবার ভাববে না। মল্লিকা সাত্যকীকে ঠেলে সরাতে গেল, ‘ছাড়ো। ওকে বুঝিয়ে বললেই শুনবে’।

‘বাবাকে লেলিয়ে দিয়ে এখন সাধু সাজা হচ্ছে। আমার বইখাতা খুলে স্পাইং করো না তুমি?’

সদ্য কিশোরী কন্যার এই মন্তব্যে মা দিশাহারা হয়ে গেল। বাবা তো অফিস থেকে ফিরে প্রায়দিন দেখে মেয়ে টিউশনি থেকেই ফেরেনি। মা-ই মেয়ের খাতা বই দেখে যতটা সম্ভব পড়াশুনোর খবর নিয়ে নেয়। পারিজাতের সেটাও অপছন্দ? মায়ের গোয়েন্দাগিরি মনে হয়? মায়ের স্নেহ-চিন্তাকে চরবৃত্তি মনে হলে সে মেয়ের মুখে ঠাটিয়ে চড়ই মারা উচিত। কিন্তু তাহলে মোবাইলের সেল্ফিতে যে কেষ্টঠাকুরের ছবি আছে, তার সম্পর্কে জানা যাবে না, জানা যাবে না এমন আরও অনেক কিছুই। প্রশ্ন করলে হয়তো শুনতে হবে, মোবাইল ব্যক্তিগত বস্তু। তেরো বছরের নাবালিকা তার মাকে ব্যক্তিগত ব্যাপারে আড়াল করবে? এখনও বিছানার চাদরে, পোশাকে দাগ লাগলে কেচে দিতে হয়। মেয়ের সঙ্গে কি মারামারি করবে? মরিয়া হয়ে বলল, ‘পরীক্ষাগুলো তো উৎরোতে হবে পুপু। বন্ধুবান্ধব, আনন্দ-ফুর্তি তো আছেই।’

‘কিচ্ছু নেই। ঘাড় গুঁজে পড়ে পড়ে চোখে পাওয়ার আর ঘাড়ে পিঠে ব্যথা বাড়ানো ছাড়া আমাদের জীবনে কোনওটাই সিকিওরড নয়। পরীক্ষা তো দেব আমি। পড়ার ফাঁকে একটু রিল্যাক্স করলে এত গায়ে জ্বালা তোমাদের?’

সন্দীপন পড়াশোনায় মনোযোগী। মনোযোগ আর আগ্রহ আরও অনেক বিষয়ে। ভালো আঁকে, ফুটবল খেলে। ওদের সেকশনে নতুন আগত একটি মেয়ে গত বছর থেকেই সন্দীপনকে হটিয়ে প্রথম হচ্ছে। নিশ্চয়ই প্রিন্সিপাল বা টিচারদের সঙ্গে চেনাজানা আছে। এদিকে ছেলের নামে অন্য ছাত্রদের, বিশেষ করে মেয়েদের অভিভাবকরা নিয়মিত নালিশ জানায়। সন্দীপন ওদের মারে, ল্যাং মেরে ফেলে দেয়, বেণি ধরে, কানের রিং ধরে টানে। হিংসা! সব হিংসায় ফেটে যাচ্ছে। ভালো ফল করে কিনা। তাই যুক্তি করে ওকে পিছিয়ে দেওয়া। হলে একটা নতুন স্টুডেন্ট, তাও আবার মেয়ে, কালো শিকলি চেহারা কখনও ফার্স্ট হয়? ছেলেরা তো হাতেপায়ে দুরন্ত হবেই। দাদু আদর করে নাম রেখেছেন গুন্ডা। গুন্ডার অধীনে আবার স্কুলে একটা দলও আছে। ইচ্ছা করেই ছেলেকে বেশি বয়েসে পড়াচ্ছে সঙ্গীতা। বার্থ সার্টিফিকেটের বয়স বারো দেখালেও সন্দীপন আসলে চোদ্দ বছরের। ওর সঙ্গে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলো পারবে কেন? কী পড়াশুনোয়, কী খেলাধুলোয়। ছেলেকে শেখানো আছে, ‘মার খেয়ে ফিরবি না, মেরে আসবি’।

কেন করবে না। সকলেই এগিয়ে যেতে চায়। তোমার সামনে যারা আছে দরকারে তাদের মাড়িয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তোমায় কেউ একচুল জায়গা ছেড়ে দেবে? যারা পেরে ওঠে না, তারাই নালিশ করে। তা বলে ছেলে কি হাত-পা গুটিয়ে থাকবে? মারামারির ভয় যখন, তোদের মেয়েদের গার্লস স্কুলে পড়ালেই পারতিস। অত বড়ো খেলার মাঠ দেখে রাত থাকতে লাইন দিয়ে খুকিদের ভর্তি করিয়েছিস। এখানেও গুন্ডার নামে নালিশ। সে নাকি খেলার ক্লাসে মেয়েদের ইচ্ছা করে মেরে ফেলে দেয়। সঙ্গীতা মাঝে সাঝে স্কুলে গিয়ে দেখেছে, খেলার পিরিয়ডে ছেলেরা স্যারের সাথে ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেট বল খেলে। মেয়েরা গজালি করে, নয় রুমাল চোর খেলে, নয় তো স্রেফ বসে বা পায়চারি করে কাটায়। ব্যাডমিন্টনের র‍্যাকেট চাইলেও নাকি দিতে চায় না গেমস্ টিচার, দিলেও ছেলেরা কেড়ে নেয়। মেয়েরা খেলেই না তো মার কখন খাবে? আমার ছেলে কি খেলা ফেলে তোদের মেয়েদের পেছনে ধাওয়া করে?

ওই শুঁটকি অরিত্রিকে এবার বিট করতেই হবে। গুন্ডার চাইতে দু’বছর ছোটো হয়েও অমন রেজাল্ট এমনকী অংকেও? তা খাতায় কলমে কম দেখিয়েও মা পুত্রের বয়সের সুবিধাটা মনে মনে স্বীকার না করে পারে না। ছেলে আজকাল কম্পিউটারে ইন্টারনেট খুলে জোর পড়াশুনো শুরু করেছে। কী পড়ে দেখাতে চায় না। ছেলের বাবা চাকরিসূত্রে অন্যত্র থাকে। মা নিয়ম করে ছেলেকে কোচিং ক্লাসে নিয়ে যায়। শুধু ক্লাসে নয়, আইসিএসসিতেও স্কুল থেকে ফার্স্ট হতে হবে।

কাল থেকে যুদ্ধ, মানে পরীক্ষা শুরু। গুন্ডা সকাল বেলা বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছে বলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে। দুপুর দুটো বাজতে চলল, এখনও পাত্তা নেই। প্রথমে অর্ণবের বাড়ি, তারপর এর বাড়ি ওর বাড়ি ফোনাফুনি। সোয়া দুটোয় সিঁদুর মুখে বাড়ি ফিরে মায়ের কোনও প্রশ্নেরই জবাব দিতে চায় না। একবার ঝেঁজে বলল, ‘এই জন্যই মোবাইল চাই। বাড়িবাড়ি ফোন করতে হতো না তোমায়।’ ক্লাস সেভেনের ছেলে মোবাইল নিয়ে ঘুরবে? স্কুলেও তো অনুমতি দেবে না। আবার আসল বয়সটা মনে পড়ল। মায়ের কথায় উদ্ধত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক খোঁচাখুঁচিতে বলল, ‘তোমায় বলে কী হবে? তুমি তো না-ই বলবে।’ এখন থেকে এমন কী চাই যা মাকে বলা যাবে না? কাল থেকে পরীক্ষা শুরু সে খেয়াল আছে? পড়াশুনোয় ভালো বলেই ও অনেক বদমায়েশি করে পার পেয়ে যায়। এবার রেজাল্ট খারাপ হলে আর ছাড় দেওয়া যাবে না।

সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদে নির্বিকার থেকে রাতে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, ‘একটা স্পোর্টস্ সাইকেল দেখেছি। চল্লিশ হাজার পড়বে। আইসিএসসি দেখিও না। এই পরীক্ষার পরই চাই।’

সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উঠতেই এই। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করলে তো হেলিকপ্টার চাইবে। এর চেয়ে অরিত্রি, মেঘা, তিতিক্ষাদের পেটানোর অনুমতি চাইলে দেওয়াটা অনেক সহজ হতো। এই প্রথম ছেলেকে অচেনা লাগল মায়ের, ভয়ও হল। মাথা নাড়ল শুধু, যার মানে হ্যাঁ ও হতে পারে, নাও হতে পারে। পরীক্ষাটা তো উৎরোক। দর কষাকষি পরে।

স্নেহা শান্ত মেয়ে। অঙ্কে একটু দুঃখ আছে। কিন্তু বেয়াড়া নয়। পড়ালে খুব একটা আপত্তি করে না, অঙ্ক ছাড়া। একটু আদুরি আহ্লাদী প্রকৃতির। রোজ নিয়ম করে মা আর বাবার কাছে চটকাই মটকাই খাবে। সান্তাক্লজের রহস্য জানার পরও সান্তার কাছে উপহার চাই। গত বছর জন্মদিন পালন হয়নি ঘটা করে। এবার পরীক্ষার ঠিক পর জন্মদিন। মানে জন্মদিনের ঠিক আগেই পরীক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মীসোনা হয়ে ভালো করে পরীক্ষা দিয়ে বার্থ ডে সেলিব্রেশনটাও জমকালো করে করতে হবে। এইটুকু বায়না রাখাই যায়। বেচারার সব প্রিয় খেলনা খুড়তুতো ভাই এসে ভেঙে দিয়ে যায়। ভাইকে বড্ড ভালোবাসে। তাকে কিছু বলতে পারে না, পাছে কাকিমা আর নিয়ে না আসে। সে চলে গেলে মায়ের কোলে কিংবা বাবার বুকে মুখ গুঁজে হাপুসনয়নে কাঁদে।

বহুদিনের শখ আইপডের। বন্ধুদের আছে। ওকে বস্তুটা ঠাম্মা, দিদা, মাসি না মা-বাবা কে দেবে ঠিক না হওয়ায় এখনও পায়নি। এবার জন্মদিনে সেটাই দাবি। অঙ্কিতা নিজে বড়ো সিস্টেমেই গান শুনতে ভালোবাসে। অমন স্বার্থপরের মতো কানে গুজি গুঁজে অনেক কথা কানে না ঢুকিয়ে গান শোনা তার পোষায় না। তবে ধুমধাড়াক্বা গান পরিত্রাহি বাজলে মনে হয়, যার যেমন রুচি তেমন গান হেডফোনেই শোনা ভালো।

পরীক্ষা শুরুর কদিন আগেই মাসিমণি তার আদরের বোনঝিকে একটা আইপড দিয়ে গেল। অনেকগুলো নতুন গান লোড করা আছে। ব্যস! সারাদিন মারমার গান শোনা। এখন কি গান নিয়ে মেতে থাকার সময়? পড়াশুনোর বারোটা বাজবে জানালে মাসি বলবে, ‘আমার ইচ্ছে দিয়েছি। তোদের পছন্দ না হলে ডাস্টবিনে ফেলে দে।’

বুঝিয়েসুঝিয়ে যন্ত্রটা পরীক্ষা পর্যন্ত মায়ের জিম্মায় চালান করা গেলেও জন্মদিনের জন্য তাহলে নতুন কিছু চাই। নতুন মানে ট্যাব। টিভি রিয়ালিটি শোতে কাউকে ট্যাব জিততে দেখলেই এমন হাততালি দেয়, যেন পুরস্কারটা সেই জিতেছে। এমনিতে অঙ্কিতার অ্যানড্রয়েড মোবাইল অঙ্কিতার চেয়ে স্নেহাই ভালো চেনে। ক্লাস ফোর তো কী? এখনকার বাচ্চারা মায়ের পেটে থাকতে কম্পিউটার নাড়াঘাটা করতে শিখে আসে। অঙ্কে ভয় থাকলেও, কম্পিউটারের ঘাঁতঘোঁত ফাইলের অবস্থান খুঁজে বার করতে ওস্তাদ। মাকে কাজ করতে দেখে নিজে নিজে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানাতে শিখে ফেলেছে। মোবাইলে গান আর গেম ডাউনলোড তো হাতের ময়লা। সে তো ট্যাব চাইতেই পারে। কিন্তু বাড়িতে তিনজন মানুষের জন্য পাঁচটা সিম এটা ওটা অফার পরখ করতে গিয়ে জমে গেছে। প্রীতমের তাই বাচ্চার হাতে এখন থেকে নেট সমৃদ্ধ ট্যাবলেট তুলে দেওয়ার ইচ্ছা নেই। বলে, ‘যা করার পিসিতে করো। আর একদম নেট খুলবে না। আমি বা মা পাসওয়ার্ড দিয়ে মেশিন ওপেন না করা পর্যন্ত ওয়েট করবে। আমি এত বছর সিস্টেমস্-এ আছি, এখনও পর্যন্ত আমিই একটা ল্যাপটপ কিনলাম না, আর পাকু-মার ট্যাব চাই।’

মৌমিতা সদ্য চাকরির আনন্দে বলে ফেলল, ‘ডোন্ট ওরি। আই উইল টেক কেয়ার অব দ্যাট।’

সোজা প্রীতমের প্রেস্টিজে ছ্যাঁকা। সে কি নিজের মেয়েকে কিনে দিতে পারে না? এই বয়স থেকে এত বিলাসিতা ঠিক মনে করে না বলেই তো আপত্তি করছে। প্রিয় শ্যালিকাকে দেখলে হাসা বন্ধ। মৌমিতাও দমবার পাত্রী নয়। ‘কেন, হিয়া আমার কেউ নয়? মাসি হিসাবে আমার কোনও শখ থাকতে পারে না? অধিকার নেই? আমি আনন্দ করে কিনে দেওয়া মানেই প্রীতমদাকে ছোটো করা? তোরা আমাকে পুজোয় টাকা দিস না? আমার বিয়েতে দামি গয়না দিসনি? তোদের বিয়ের সময় আমি তো স্টুডেন্ট ছিলাম। কী দিয়েছি? আজ আমার আনন্দে যদি কারও মুখ গোমড়া হয়, তাহলে আমি আর এ বাড়ি আসব না। হিয়ার জন্মদিনেও নয়…’

আচ্ছা মুশকিল! অঙ্কিতা বরকে বোঝায়, না বোনকে। বড়োদের মান হানাহানিতে হিয়া অর্থাৎ স্নেহা বেচারা বোমকে গেছে। মায়ের কানে কানে বলল, ‘মাসিকে বলো, আমার ট্যাব চাই না। শুধু এগ্জামের পর আমরা, মাসি-মেসো সবাই মিলে আইনক্সে একটা থ্রিডি দেখব, নয়তো সিটি সেন্টার টুতে সেভেন ডি। আর সবাই মিলে বাইরে খাব। আর আমার বার্থডেতে মাসি সকাল থেকে এসে থাকবে।’

মৌমিতা শুনতে পেয়ে ঝুঁকে বোনঝিকে হামি খেয়ে বলল, ‘আমার তরফ থেকে ডান। তোর বাবা ছুটি না নিলেও আমি কিন্তু আমার নতুন চাকরিতেও একদিন ছুটি নিয়ে হিয়া সোনার সঙ্গে কাটাব, ক্যারাম খেলব। আর ওটা আমাদের সিক্রেট। রাইট?’

নিজের হাতে খেতে পারে না। মা খাওয়ালেও ন্যাকরচ্যাকর। কিন্তু কাল থেকে যে পরীক্ষা শুরু। লক্ষ্মী মেয়ের মতো টিভি না দেখেই খেয়ে দাঁত মেজে শুয়ে পড়ল। শোবার ঘর থেকে একটু পরে ডাকল, ‘মা তোমাদের হয়েছে? তুমি ছাড়া ঘুম আসে না মা।’

একটা টাটা সুমোয় গাদাগাদি করে চোদ্দজন বাচ্চা। সবাই বাচ্চা নয়। সপ্তম অষ্টম শ্রেণির ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ আকারে বড়ো মানুষই বলা যায়। মাঝেমাঝে এইসব গাড়ির পারমিট, ফিটনেস সার্টিফিকেট নিয়ে ধরপাকড় ওঠে। আবার সব মিটমাট হয়ে যায়। গরজ বড়ো বালাই। গাড়ি বন্ধ থাকলে গাড়িওয়ালাদেরও ক্ষতি, ছাত্রছাত্রী পক্ষেরও ক্ষতি। ধেড়েগুলো কুচোকাচাদের ওপর দাদাগিরি দিদিগিরি ফলায়, ঝগড়া থামায়, আবার বাধায়ও। কিন্তু পরীক্ষার কদিন বেশির ভাগই স্কুল যাবার পথে বই মুখে নিবিষ্ট। আজকের মতো ছুটি। বাড়ি ফেরার পালা। কালকের দিনটা পার করতে পারলেই ক্লাস ফাইভের কেল্লা ফতে। সিক্স, সেভেন আর এইট শেষ হতে আরও পাঁচ দিন। রোজ পরীক্ষা নয়, মধ্যে বিরাম আছে। কারো দুটো কারও তিনটে পরীক্ষা বাকি। ক্ষুদেগুলো কাল পরীক্ষার পর কী করবে তার জোর আলোচনা চালাচ্ছে। বড়োগুলো তাদের কাউকে কাউকে খ্যাপাচ্ছে। হই হই করতে করতে চলেছে টায়েটায়ে ভর্তি যান। গাড়ির চালকও যোগ দিয়েছে গুলতানিতে। এই গাড়িকাকু ওদের সবার খুব প্রিয়। না খেতে পারা টিফিন উদ্ধার করে সাহায্য করে। আবার যাদের যেদিন পরীক্ষার ইতি, সেদিন তাদের চকোলেট খাওয়ায়। বড়োগুলোর পরীক্ষা শেষ হতে দেরি থাকলেও চ্যাঁচাচ্ছে, ‘আমরাও আছি কিন্তু মোহিতকাকু। নো পার্শিয়ালিটি। কালকেই সবাইকে খাইয়ে দাও। শেষের দিন আমরা ফিস্ট করব। ওফ্ তোমাকে কখন থেকে গান লাগাতে বলছি না? আর ওই সামনের গদ্ধড় বাসটাকে ওভারটেক করতে পারছ না? পুরো রাস্তাটা আগলে চলছে।’

‘…ক্যাঁ…চ্’! বড়ো রাস্তার এক পাশটা খাওয়া। এক্সপ্রেসওয়ে কে বলবে? গদ্ধড় বাসটাকে কাটাতে গিয়ে পাশ থেকে একটা দৈত্যাকার লরির সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি। কাছাকাছি লোকালয় ছিল না। দেরিতে লোক পৌঁছোল। গাড়ির হেল্পারটি লাফিয়ে পালাতে পেরেছে, গুরুতর আহত। চালক ঘটনাস্থলেই শেষ। পকেটে তার আজও লজেন্স আছে। ফুচকা, আইসক্রিম, বিরিয়ানি, সাইকেল, ট্যাব, জন্মদিন সান্তাক্লসের ছোটো ছোটো স্বপ্নগুলো দুমড়ে দলা পাকিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে চেপে ভাঙা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলল।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...