‘আজি ঝরঝর মুখর বাদর দিনে

জানিনে জানিনে…’

– রিংটোনটা বেজে উঠতেই প্রদীপ্তর কাঁচা ঘুমে বাধা পড়ল। আচ্ছন্ন অবস্থায় কোনওমতে মাথার পাশে রাখা মোবাইলটা ধরতেই, ওপার থেকে মিষ্টি-মধুর স্বর কানে এল, ‘কনগ্র্যাচুলেশন্স। আমি জানতাম এবারের এগ্জামে তুই টপ করবি।’ দেবযানীর কথা শুনে আচ্ছন্ন প্রদীপ্ত একেবারে লাফিয়ে বিছানায় বসে পড়ল।

‘কী বলছিস? আমি! আর ইউ জোকিং?’

‘না একেবারেই জোক করছি না। আমি জানি তুই লেট রাইজার। কাজেই বিনা কারণে তোর ঘুম ভাঙানোর কোনও প্ল্যান আমার ছিল না। ভাবলাম, সবার প্রথমে খবরটা আমিই দেব। তাই…’ খানিক থমকে একটু নিশ্বাস নিয়ে আবারও বলতে শুরু করল, ‘ওয়েক আপ বেবি। আজকের নিউজ পেপারটা দ্যাখো, চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে বুঝেছ। একেবারে ফ্রন্ট পেজে বড়ো করে ছবি।’

ততক্ষণে আনন্দে আত্মহারা প্রদীপ্ত বিছানা ছেড়ে খবরের কাগজটা খোঁজার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছে।

‘ইন ফ্যাক্ট, আমি এতটা এক্সপেক্ট করিনি। ভেবেছিলাম, হবে কিছু একটা। যাক, এত ভালো একটা খবর দেওয়ার জন্য একটা ট্রিট তো হতেই পারে। আজ বিকেলে কী করছিস বল?’

‘সেরকম কিছু না। বাট তোর সঙ্গে যদি দেখা হয়, ভালোই লাগবে।’

‘ঠিক আছে, তাহলে আমাদের পছন্দের সেই টিট বিট কফিশপে বিকেল ৫টায়।’

‘ওকে চল। প্রচুর বকে ফেলেছি।’ বলেই ফোনটা রেখে দেয় দেবযানী।

দেবযানী আর প্রদীপ্ত সেই ছোট্টবেলার বন্ধু। স্কুলের সময় থেকে। প্রথম থেকেই প্রদীপ্ত ব্রিলিয়ান্ট। গ্র্যাজুয়েশনের পরে প্রদীপ্ত মাস্টারস্ ডিগ্রি আর দেবযানী কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশন-কেই বেছে নেয়, নিজেদের কেরিয়ার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। প্রদীপ্তর বাবা নির্মলেন্দুবাবু প্রাইমারি স্কুলের টিচার। কাজেই প্রদীপ্তও খুব ভালোই জানে এই কম্পিটিশনের যুগে অ্যাকাডেমিক কোয়ালিফিকেশন না থাকলে চাকরি পাওয়া খুব মুশকিল। সংসার বলতে মা-বাবা, দুই বোন আর সে নিজে। আজকালকার দিনে তিন ছেলেমেয়ের পড়াশোনা থেকে শুরু করে সংসার চালানো একজনের পক্ষে সত্যিই সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। তার উপর নির্মলেন্দুবাবুর রিটায়ারমেন্ট-এর আর মাস ছয়েক মাত্র বাকি। বাবার পরে সংসারের সব দায়দায়িত্ব তারই। তাই সে চেয়েছিল গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করার পর একটা চাকরি খুঁজতে। কিন্তু নির্মলেন্দুবাবুর তৎপরতায় সে আবারও পড়াশোনা শুরু করেছিল।

দেবযানীও যে পড়াশোনায় খারাপ তা নয়, র্যাংক না করতে পারলেও রেজাল্ট বেশ আশাপ্রদ, হাসিখুশি, প্রাণোচ্ছল মেয়েটির। বড়োলোক পুলিশ অফিসারের একমাত্র মেয়ে। কাজেই আদরের তো হবেই।

ছেলেমেয়ের কারণে দুই পরিবারের মধ্যে একটা সৌহার্দ্যের সম্পর্কও গড়ে উঠেছে। প্রদীপ্তর মতো প্রমিসিং, ডিসেন্ট ছেলেকে কার না ভালো লাগে! দেবযানীর বাবা অভিমন্যুবাবুও বেশ পছন্দ করে তাকে। বাড়িতে আসা-যাওয়া সবই চলে।

আজ সকাল থেকেই যেন উড়ে বেড়াচ্ছে দেবযানী। কোনও এক অজানা খুশি ধরা পড়ছে তার চোখেমুখে। কেবলই বারে বারে ঘড়ির দিকে চোখ চলে যাচ্ছে তার। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সেই মহাক্ষণের আবির্ভাব। কথামতো ঠিক বিকেল পাঁচটায় কফিশপে টেবিলে বসে কিছু স্ন্যাক্স অর্ডার দেওয়ার পর টুকটাক কথা চলতে থাকে তাদের মধ্যে। ‘তারপর? পরের প্ল্যান কী? কী ভাবছিস?’ প্রশ্ন করে দেবযানী।

‘যদি মন থেকে বলি, তাহলে তো পোস্ট ডক্টরেট-ই বলব, কিন্তু আমার ফিনান্সিয়াল কনডিশন তো তোর অজানা নয়। বাবার রিটায়ারমেন্ট-এর আর মাস কয়েক মাত্র বাকি। কাজেই ফ্যামিলিকে সাপোর্ট করার একটা ব্যাপার তো আছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা চাকরি…’ কথাগুলি বলতে বলতে বেশ উৎকন্ঠিত হয়ে ওঠে প্রদীপ্ত।

‘দ্যাখ যদি তুই বলিস, তাহলে বাবার সঙ্গে একবার কথা বলতে পারি। এব্যাপারে একমাত্র বাবাই তোকে হেল্প করতে পারে।’ হেজিটেট করতে করতে কথাটা বলেই ফেলে দেবযানী।

‘মনে হয় না বাবা এটা মেনে নেবেন! বাবাকে তো জানিস, সারাজীবন নিজের আদর্শে চলে এসেছেন। যাক এখন এসব ছাড়, প্রয়োজন পড়লে দেখা যাবে।’ বলেই প্রদীপ্ত বরাবরের মতো দেবযানীর নাকটা ধরে নাড়িয়ে দেয়। দেবযানীও আগের মতোই রিঅ্যাক্ট করে ওঠে, ‘তুই না যা তা, অভ্যাস যাবে না – না।’ বলেই হেসে ওঠে। এভাবেই আরও বেশ কিছুক্ষণ খুনশুটি চলার পর যে যার বাড়িতে।

দেখতে দেখতে আরও বেশ কয়েকটা মাস কেটে যায়। এরই মাঝে প্রত্যহ বিভিন্ন পেপার থেকে কর্মখালি দেখে নিয়ম করে ইন্টারভিউ দেওয়া একপ্রকার রুটিন হয়ে গিয়েছে প্রদীপ্তর। আশ্চর্যের বিষয় মেধাবী অ্যাকাডেমিক রেকর্ড হওয়া সত্ত্বেও চাকরির শিকে ছিঁড়ল না। এই বিফলতা প্রদীপ্তকে হতাশ করে তুলছিল।

কোনও আশা না দেখে পাড়ার এক সিনিয়র গভর্নমেন্ট অফিসারকে চাকরির জন্য ধরেছিল সে। লাখ চারেক টাকার বিনিময়ে তিনি একটা চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অসম্ভব জেনেও একটা শেষ চেষ্টা করতে বাবার কাছে কথাটাও পেড়েছিল প্রদীপ্ত। শোনামাত্রই তিনি নাকচ করে দেন। প্রথমত এটা তাঁর আদর্শ বহির্ভূত, দ্বিতীয়ত এতগুলো টাকা দেওয়ার মতো সামর্থ্যও ওনার নেই। সারাজীবনে একটু একটু করে যতটুকু জমিয়েছেন, তাতে কোনওমতে এক মেয়ের বিয়ে দেওয়া যায়। ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে প্রদীপ্তর মা অনুভাদেবী নিজের গয়নাও বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন। বাধ সাধেন নির্মলেন্দুবাবু। তিনি আজও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন, প্রদীপ্ত যথেষ্ট মেরিটোরিয়াস স্টুডেন্ট, সুতরাং সে ভালো চাকরি পাবেই। এরপরে প্রদীপ্ত এব্যাপারে আর কোনওদিন একটি বাক্যও ব্যয় করেনি। দিনের পর দিন হতাশা তাকে আরও ঘিরে ধরেছে।

ভালো চাকরির খোঁজে এতদিন সে কোনও ছোটোখাটো চাকরির কথা ভাবেইনি। অবশ্য প্রদীপ্তর বাবা-মাও এর জন্য কিছুটা দায়ী। এত ভালো স্টুডেন্ট কেন যা-তা কাজ করবে। বরং তারা সবসময় এনকারেজ করেছে, এখনই ভেঙে পড়ার মতো কিছু হয়নি। ভরসা রাখো, ধৈর্য্য ধরো, ফল হাতেনাতে পাবে।’

ছোটো থেকেই গাড়ি মেরামতের কাজটা সে ভালোই পারত। গরমে স্কুল ছুটি পড়লেই সোজা মুর্শিদাবাদ। মামার বাড়ি। বাড়ির নীচেই মামার মোটর পার্টস আর রিপেয়ারিংয়ের দোকান। কাজেই মামাবাড়ি গেলেই খাওয়াদাওয়া, ঘুম বাদ দিয়ে সর্বক্ষণ ওই দোকানে। পুরোনো সেই অভিজ্ঞতাটাই কাজে এল আজ। কেষ্টদার গ্যারেজে একটা মেকানিকের পোস্ট খালি ছিল। বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে হাইওয়ের পাশেই। একটু ফাঁকা বটে, কিন্তু মাসিক মাহিনা হিসাবে হাজার পাঁচেক তো পাওয়া যাবে। সেই ভেবেই কাজে লাগা। শুধু তাই নয় যথাযথ কাজ দেখাতে পারলে সময়ের সঙ্গে টাকাও বাড়বে। এতদিন পরে চাকরিটা পেয়ে প্রদীপ্ত সত্যিই খুব খুশি হয়েছে। অন্তত মানসিক শান্তি তো পেয়েইছে। খুশি হতে পারেনি দেবযানী। কোথাও গিয়ে যেন তার মনে হয়েছে প্রদীপ্ত এর থেকে অনেক ভালো চাকরি পেতে পারত। কিন্তু তৎসত্ত্বেও প্রদীপ্তকে কিছু বুঝতে দেয়নি সে। হয়তো বহুদিন পরে বন্ধুর ঠোঁটের কোণে একটু হাসি দেখে।

কয়েকদিনের মধ্যেই প্রদীপ্ত, মালিকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল। ওভারটাইম করে আরও কিছু টাকা বাড়তি উপায় করতে শুরু করল সে। নিজের খরচের পাশাপাশি সংসারে যৎসামান্য টাকা দিতে পেরে মনে মনে খুশিই হতো।

এক কনকনে শীতের সকালে প্রদীপ্ত সবেমাত্র ওয়ার্কশপে পৌঁছেছে। তখনও অন্য কর্মচারীরা এসে পৌঁছোয়নি। সেদিন অবশ্য এক সরকারি অফিসারের গাড়ি ডেলিভারি দেওয়ার কথা। তাই সাতসকালে হাজির হতে হয়েছিল তাকে। শাটার তু্লে সামনে সারিয়ে রাখা সরকারি গাড়িটা ট্রায়াল দেবার জন্য বার করতে যাবে কী দুই আগন্তুক হন্তদন্ত হয়ে গ্যারেজের ভিতর ঢুকে মালিকের খোঁজ করতে শুরু করল। প্রদীপ্ত তাদের জানাল, ‘মালিক এত তাড়াতাড়ি আসেন না। কী দরকার আমাকে বলতে পারেন।’

প্রত্যুত্তরে তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল, ‘আমাদের এক বন্ধু আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। ইমিডিয়েট একটা গাড়ি দরকার।’

‘ক্ষমা করবেন, এব্যাপারে মালিকের অনুমতি ছাড়া আমি সাহায্য করতে পারব না। না বলে গাড়ি বার করা তো অসম্ভব। একটু অপেক্ষা করুন ওনাকে ফোন করছি। উনি কাছেই থাকেন, সঙ্গে সঙ্গে চলে আসতে পারবেন।’ বলেই প্রদীপ্ত পকেট থেকে ফোনটা বার করতে যাবে কী দুজনেই তারস্বরে বলে উঠল, ‘আমাদের বন্ধুর যা সিরিয়াস কন্ডিশন, তাতে এক মিনিটও অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। যে কোনও মুহূর্তে অঘটন ঘটে যেতে পারে। আর আপনি…’

‘ওকে, সেক্ষেত্রে আপনাদের হসপিটালে ড্রপ করেই আমি চলে আসব।’

আইডিয়াটা যে তাদের মনোমতো হয়নি তা তাদের চোখমুখ দেখেই বুঝে গিয়েছিল প্রদীপ্ত। কিন্তু অসময়ে মানুষের পাশে না দাঁড়ানোটাও তো অমানবিক। শুধু তাই নয় দুজন লোকও তো সমানে প্রেশার ক্রিয়েট করে চলেছে। খানিক চাপে পড়েই গ্যারেজ থেকে একটা সাদা রঙের অ্যাম্বাসাডার বার করতে যাবে কী, দুজনের মধ্যে একজন একটু নরম সুরেই বলল, ‘দাদা সরকারি গাড়িটা নিয়ে চলুন, নয়তো রাস্তায় হ্যারাস হতে হবে। সরকারি গাড়ি দেখলে পুলিশ কোথাও আটকাবে না। বুঝতেই তো পারছেন, এখন যত তাড়াতাড়ি ছেলেটাকে হসপিটালাইজ্ড করা যায় ততই ভালো।’

‘কিন্তু দাদা ওটা সকাল এগারোটার মধ্যে যে ডেলিভারি দিতে হবে।’ প্রত্যুত্তরে জবাব দেয় প্রদীপ্ত।

কথা কেটে তাদের মধ্যে একজন বলে ওঠে, ‘আরে দাদা তার অনেক আগেই আপনি গ্যারেজে রিটার্ন চলে আসবেন। আপনি তো শুধু আমাদের হসপিটালে পৌঁছে দিয়েই…।’

অগত্যা সরকারি গাড়িটায় চেপে বসল তারা। খানিক এগোনোর পরেই প্রদীপ্তর চোখে পড়ল রাস্তার পাশে একজন রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। গাড়িটা সেখানে থামাতেই চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল প্রদীপ্তর। ‘আপনারা যে বললেন অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে! এর তো গুলি লেগেছে। গুলি লাগল কী করে?’

প্রদীপ্তর প্রশ্নে একজন বেশ ধমক দিয়েই বলল, ‘এসব জানার অনেক সময় রয়েছে। আপনাকে যা বলছি তাই করুন। গাড়িতে বসুন।’ বলেই দুজনে মিলে চ্যাংদোলা করে গাড়িতে তুলল ওই আহত ব্যক্তিটিকে। তারপরে প্রদীপ্তকে আদেশের ভঙ্গিতে বলল, ‘খানিক গিয়ে জঙ্গলের দিকে ইউ-টার্ন নেবেন।’

এমনিতেই গুলি লাগার ব্যাপারটায় একটা খটকা ছিল প্রদীপ্তর। তার উপর এখন জঙ্গলের পথ ধরে, বেঁকে বসল প্রদীপ্ত। ‘এক পাও নড়ব না আমি। তখন থেকে আপনারা মিসগাইড করে চলেছেন। প্রথমে বললেন অ্যাকসিডেন্ট, পরে দেখা গেল গুলি খেয়েছে। আর এখন বলছেন জঙ্গলের পথ ধরে যেতে, যেখানে হাসপাতালের নামগন্ধ নেই। নেমে যান আপনারা গাড়ি থেকে।’

কথাটা শোনা মাত্রই তাদের মধ্যে একজন পকেট থেকে রিভলবার বার করে প্রদীপ্তর মাথায় ঠেকিয়ে, ‘অনেক ড্রামা করেছিস। যা বলছি তাই কর, নইলে একেবারে জানে মেরে দেব।’

আমতা আমতা করতে করতে জঙ্গলের পথই ধরতে বাধ্য হল সে। প্রায় ঘন্টা-আড়াই পথ অতিক্রম করার পর ঘন গভীর অরণ্যে একটা আউট হাউসের সামনে গাড়িটা দাঁড় করাতে বলল তারা। গাড়িটা থামাতেই একজন আর একজনকে প্রশ্ন করল, ‘এবার কি আমরা নামতে পারি?’

অন্যজন কমান্ডোর মতো জবাব দিল, ‘একটু অপেক্ষা কর, আগে আমি দেখে আসি ডাক্তারবাবু আছেন কিনা। তারপরে নামাস।’

ওদিকে প্রায় বেলা এগারোটা বেজে গেছে। মালিক গ্যারেজে এসে তাকে আর গাড়ি দেখতে না পেলে বেজায় চটে যাবেন। ভাববেন সে হয়তো কী না কী করে বসে আছে, হয়তো চোরও… ভেবে আঁতকে ওঠে প্রদীপ্ত। তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে থাকে।

‘এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন, আমরা পলিটিকাল অ্যাক্টিভিস্ট, ওই আপনাদের ভাষায় টেররিস্ট। সমাজের সাধারণ মানুষের স্বাধীনতা যারা দিনের পর দিন খর্ব করে চলেছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই। লড়াই সিস্টেমের বিরুদ্ধে। অযথা ভয় পাবেন না, আমাদের কাজ হয়ে গেলেই আপনাকে ছেড়ে দেব। জানেনই তো আমাদের এক কমরেড এনকাউন্টারে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। যতক্ষণ না সেটা বার করা যায়, ততক্ষণ আপনাকে আমাদের সঙ্গে থাকতেই হবে। আমাদের মুভমেন্টের জন্য সরকারি গাড়ির ট্যাগটাই আমাদের হেল্প করবে। চতুর্দিকে টিকটিকির তো অভাব নেই।’ প্রদীপ্ত বুঝে গিয়েছিল যিনি কম্যান্ডারের মতো আদেশ দিচ্ছিলেন তিনিই এদের গ্রুপ লিডার। অগত্যা তাদের নির্দেশ মানা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না প্রদীপ্তর।

গ্রুপ লিডার ওই আউট হাউসের মধ্যে প্রবেশ করার মিনিট দুয়েক পরেই আবার বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে স্ট্রেচার নিয়ে এক সুদর্শন যুবক। গাড়ি থেকে আহত ব্যক্তিকে স্ট্রেচারে করে আউট হাউসের ভিতরে দিয়ে এসে বাইরে অপেক্ষা করতে শুরু করলেন। ওই ডাক্তারও যে উগ্রপন্থায় বিশ্বাসী, তা আর বুঝতে বাকি রইল না প্রদীপ্তর। অপারেশন করতে অন্তত ঘন্টা-দুয়েক তো লাগবেই, সেই ভেবে আউট হাউসের পাশেই একটা জায়গায় বসে পড়ল সে। সেই ফাঁকেই আলাপ সুদর্শন যুবকটির সঙ্গে। নাম জেমস্। প্রায় প্রদীপ্তেরই সমবয়সি। কিছুক্ষণের আলাপে হাসিখুশি জেমস্কে দেখে সাহসে ভর করে প্রশ্ন করেই ফেলল প্রদীপ্ত, ‘সমাজের মূল স্রোতের বিরুদ্ধে গিয়ে এই উগ্রপন্থা কেন?’

ঠোঁটের কোণায় খানিক হাসি নিয়ে জেমস্ জবাব দিল, ‘প্রায় দু’বছর আগের ঘটনা। চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছি। কেবল হতাশই হয়েছি। কাউকে পাশে পাইনি। অবশেষে এই পথ বেছে নেওয়া। অনেকে আমাদের দেশদ্রোহী বলেন, কিন্তু আমাদের এই লড়াই সমাজের পরিবর্তন আনার জন্য। জানি এতে জীবনও যেতে পারে।’ জেমসের বৈপ্লবিক যুক্তিগুলো নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করছিল প্রদীপ্ত। কথামতো ঘন্টাদুয়েক পরে ওয়ার্নিং দিয়ে প্রদীপ্তকে ছেড়ে দেওয়া হল। ততক্ষণে সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়েছে। গ্যারেজে পৌঁছেই একেবারে মালিকের তোপের মুখে। তিনি প্রদীপ্তর কোনও কথা শুনতেই রাজি নন। সাফ জানিয়ে দেন তার মতো দায়িত্বজ্ঞানহীন লোককে কাজে রাখবেন না।

অনেক কষ্টে একটা কাজ যোগাড় করেছিল সে। সেটাও যদি চলে যায়– সেই ভেবে প্রদীপ্তের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। বারবার অনুনয়-বিনয় করতে থাকল। কিন্তু মালিক তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। সে খুব ভালো করেই বুঝে গিয়েছিল, কোনও কিছুতেই চিঁড়ে ভিজবে না। অগত্যা গাড়ি রেখে বেরিয়ে পড়ল। মাথায় হাজারো চিন্তা। বাড়িতে গিয়ে কী বলবে? চাকরি নেই! আবার বেকারত্ব! সংসার চলবে কী করে?

মনে পড়ে জেমসের কথা। রওনা দেয় আউট হাউসের দিকে। ভাবে অন্তত বাবার ঘাড়ে তো বসে থাকতে হবে না, নিজেরটা নিজে চালিয়ে নিতে পারবে।

কাজের কারণে অনেক সময়তেই রাতে গ্যারেজে থেকে যেত প্রদীপ্ত। বাড়ির লোক ভাবল, আজও হয়তো কাজের চাপে থেকে গেছে। কিন্তু সকালেও না ফেরায় চিন্তায় পড়ে যায় তার বাবা-মা। গ্যারেজের মালিক জানিয়ে দেন তিনি জানেন না। ছেলের খোঁজ না পেয়ে থানায় ডায়ারি করেন নির্মলেন্দুবাবু।

এর মধ্যে আর এক দুর্ঘটনা। উগ্রপন্থী হানায় মারা যান দেবযানীর বাবা ইন্সপেক্টর অভিমন্যু। এই মর্মান্তিক ঘটনায় সবাই পাশে এসে দাঁড়ায় দেবযানীর, শুধু আসেনি সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি। দেবযানী ভেবেছিল প্রদীপ্ত হয়তো খবরই পায়নি। নাহলে সবার আগে সে-ই ছুটে আসত।

কিছুদিন পর বাবার চাকরিটা পায় দেবযানী। প্রথম পোস্টিং পুরুলিয়ার পুলিশ হেড কোয়ার্টারে। ইয়ং এসপি রাহুল মুখার্জির অধীনে। শুরু থেকেই কাজের প্রতি মনোযোগী দেবযানী। মাঝেমধ্যে অফিস আওয়ার্স-এর পরেও থেকে যেত কাজের জন্য। দেবযানীর বাবাও খুব হার্ডওয়ার্কিং মানুষ ছিলেন। পুলিশ মহলে বেশ সুনাম ছিল। দেবযানীর মধ্যেও যা ভীষণ রকম ছিল। ওর এই একাগ্রতা টানত রাহুলকে। ক্রমে সে ভালোবেসে ফেলে দেবযানীকে। কিন্তু কোনওদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি সে কথা। দেবযানীর মনজুড়ে তখনও প্রদীপ্ত। তার দৃঢ় বিশ্বাস, একদিন না একদিন সে ঠিক ফিরে পাবে তার মনের মানুষটাকে। পুরুলিয়ায় সেই সময় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা অতি সক্রিয়। রাহুলের মূল দায়িত্বই ছিল টেররিজ্ম উৎখাত করা। আর এদের কেউ যদি সমাজের মূল স্রোতে ফিরতে চায়, তাদের সরকারিভাবে সবরকম সাহায্য করা। তাদের পাশে দাঁড়ানো। প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে গ্রামবাসীদের কথা বলা। তাদের বোঝানো। হিংসা কখনওই কোনও সমস্যার সমাধান হতে পারে না। তার জন্য আলোচনায় বসা যেতে পারে। তবেই দেশের এবং দশের উন্নতি সম্ভব।

ওই গোষ্ঠীর-ই এক সদস্য স্বরাজ দলের কিছু কিছু নীতিগত কারণে উগ্রপন্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছিল। কথায় কথায় গুলিগোলা, হানাহানি, খুন-জখম সে আর নিতে পারছিল না। অনেক দিন থেকেই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। নতুন এসপি রাহুলের নাম তখন সর্বজনবিদিত। ঠিকই করে রেখেছিল সুযোগ বুঝেই একদিন সে চম্পট দেবে। কিন্তু তবুও একটু আশ্বস্ত হওয়া দরকার। সেইমতো একদিন পুলিশেরই এক কর্মী জয়ের সহায়তায় আত্মসমর্পন করার আগে এসপি রাহুলের সঙ্গে দেখা করে।

সহকর্মী দেবযানী এবং জয়কে নিয়ে রাহুল গোপনে একটি জায়গায় দেখা করে স্বরাজের সঙ্গে। নির্ভয়ে এসপি রাহুলের কাছে তাদের গোষ্ঠী সম্পর্কিত সমস্ত কার্যকলাপ তুলে ধরে স্বরাজ। আরও জানায়, কীভাবে শিক্ষিত ইয়ং ছেলেগুলোকে মিসগাইড করে ব্যবহার করছে তারা। মাস্টারর্স ডিগ্রিতে ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট হয়েছে, এমন ছেলেও রয়েছে তাদের সংগঠনে।

‘মাস্টারর্স ডিগ্রিতে ইউনিভার্সিটিতে ফার্স্ট,’ কথাটা শুনেই চমকে ওঠে দেবযানী। কোনও এক অশনিসংকেত যেন ভেসে বেড়ায় তার মনের কোণে। বারবার মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকতে থাকে সে, যেন ভুল হয়। তার মন যা বলছে, তা যেন সঠিক না হয়। ওদিকে তখনও কথা চলে রাহুল আর স্বরাজের মধ্যে। সেখানে সশরীরে উপস্থিত থেকেও কোথাও যেন হারিয়ে যায় সে। কোনও কথা কানে আসে না তার। অবশেষে রাহুল যখন উঠে দাঁড়িয়ে স্বরাজকে আশ্বস্ত করে, প্রতিশ্রুতি দেয় সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসার জন্য সবরকম সাহায্য করা হবে তাকে, তখন সম্বিত ফেরে দেবযানীর।

খানিক পরে রাহুলকে অন্যদিকে ডেকে গিয়ে জয়ের সঙ্গে কিছু কথা বলতে শুরু করে। সেই ফাঁকে দেবযানী স্বরাজকে বেশ উৎকণ্ঠিত হয়েই জিজ্ঞাসা করে, ‘দেখুন আপনাকে ফোর্স করব না, যদি খুব কনফিডেন্সিয়াল না হয়, তাহলে এসপি রাহুলকে যার সম্পর্কে বলছিলেন, তার নামটা কী বলা যায়? প্রমিস করছি ব্যাপারটা আমাদের মধ্যেই থাকবে।’

‘দেখুন গ্রুপের অন্যান্যদের নাম ডিসক্লোজ করাটা আমাদের এথিক্স-এর বিরুদ্ধে, অন্তত যতদিন এই দলের সঙ্গে যুক্ত আছি। হ্যাঁ একদিন স্যারেন্ডার করব এটা সত্যি।’ স্বরাজের কথায় বেশ বিমর্ষ দেখাল দেবযানীকে। হতাশ হয়ে সে বস রাহুলের দিকে পা বাড়াতে যাবে, স্বরাজ তাকে ডাকল, ‘শুনুন, জানি না কেন, আমাদের এথিক্স-এর বাইরে গিয়ে আপনাকে বলতে ইচ্ছে করছে। অনেকের নাম হলে হয়তো বলতাম না, যেহেতু নির্দিষ্ট মাত্র একজনেরই নাম জানতে চাইছেন, তাই বলছি। কিন্তু দয়া করে কাউকে বলবেন না। ওর নাম প্রদীপ্ত। বছর দুয়েক আগে ইউনিভার্সিটিতে টপ করেছে।’

ভীষণভাবে ধাক্বা খেল দেবযানী। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকল সে। তার অবস্থা দেখে স্বরাজ বলে উঠল, ‘কী হল? আপনাকে এমন ডিস্টার্বড্ দেখাচ্ছে কেন?’

‘আমি একটিবার প্রদীপ্তর সঙ্গে দেখা করতে চাই। আপনি আমাকে সাহায্য করবেন?’ অনুরোধ করে দেবযানী।

‘সত্যি কথা বলতে কী আমিও জানি না এখন সে কোথায়। দীর্ঘদিন তার সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ নেই। এনিওয়ে, আমি জানার চেষ্টা করছি, এই মুহূর্তে একজনই তার সঠিক ঠিকানা বলতে পারে।’

‘কে সে? কোথায় গেলে তাকে পাব?’ প্রশ্ন করে দেবযানী।

‘অমর। ওর আন্ডার-এই প্রদীপ্ত কাজ করত।’

‘কিন্তু ওনার সঙ্গে দেখা করব কীভাবে?’

‘সব ব্যবস্থা আমি করে দেব। কাল বিকাল পাঁচটার সময় সীমান্তবর্তী জঙ্গলের পাশে দাঁড়াবেন। উনিই দেখা করে নেবেন আপনার সঙ্গে।’ এমন সময়ে ফের রাহুলের উপস্থিতিতে কথা বন্ধ হয়ে যায়।

কথামতো পরদিন বিকেল পাঁচটায় দেখা হয় তাদের। প্রদীপ্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে অমর, দেবযানীকে জানায়, ‘হ্যাঁ প্রদীপ্ত আমাদের দলের সঙ্গেই যুক্ত। তবে এই মুহুর্তে তাকে স্পেশাল অপারেশনে দূরবর্তী স্থানে পাঠানো হয়েছে। সে ফিরলেই আপনার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেব, তবে তার পরিবর্তে আমাদেরও কিছু কাজ আপনাকে করে দিতে হবে।’

‘আপনাদের কাজ?’ অবাক দেবযানী পালটা প্রশ্ন করে।

‘হ্যাঁ, আপনি খোদ পুলিশের হেড কোয়ার্টারে কাজ করেন। সুতরাং গোপন তথ্য বের করে আনা আপনার পক্ষে কঠিন নয়।’

শুনে আঁতকে ওঠে দেবযানী। কঠোর ভাবে জবাব দেয়, ‘একাজ আমার পক্ষে সম্ভব নয়। স্যার আমাকে অত্যন্ত বিশ্বাস করেন, সে বিশ্বাসের অমর্যাদা আমি করতে পারব না। আর এটা আমার জবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতাও।’

‘ওকে, তাহলে প্রদীপ্তকে ভুলে যান। বাই দ্য ওয়ে কোন এথিক্সের কথা বলছেন? দেশ যা আমাদের উপহার দিয়েছে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শোষণ?’ ক্ষুব্ধ গলায় বলে অমর।

দেবযানীও চুপ করে থাকে না। বলে, ‘তার মানে এই নয়, যে আপনারা অস্ত্র তুলে নেবেন। সমস্যা সমাধানের আরও অনেক রাস্তা আছে।’

দেবযানীকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে অমর বলে, ‘তর্ক করে লাভ নেই, যা বলার বলে দিয়েছি। এবার আপনিই ঠিক করুন কী করবেন।’

প্রদীপ্তকে বাঁচাতে দ্বিতীয় কোনও পথ নেই বুঝে যায় দেবযানী। তার ভালোবাসা ফিরে পেতে অমরের শর্তে রাজি হয়ে যায় সে। সেইমতো নিয়মিত গোপন তথ্য তুলে দিতে থাকে মাওবাদীদের হাতে। ওদিকে রাহুলও বুঝে পায় না কীভাবে গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। আশপাশের বেশ কয়েকজনকে সন্দেহের নজরে দেখলেও দেবযানীর কথা মনের কোণেও আসে না তার।

এইভাবেই কেটে যায় আরও দুটো মাস। কিন্তু প্রদীপ্তর দেখা মেলেনি। বারবার অমরকে জিজ্ঞাসা করেছে দেবযানী। কিন্তু তার সেই একই কথা, খুব তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ফিরে আসবে প্রদীপ্ত। কিন্তু একসময় ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় দেবযানীর। স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সাতদিনের মধ্যে প্রদীপ্ত ফিরে না এলে সংগঠনের আর কোনও কাজ করবে না সে।

এরপর আসল সত্যটা সামনে আসে। দেবযানী তার অবস্থানে অটল দেখে এগিয়ে আসে অমরেরই গ্রুপের এক দলীয় কর্মী। জানায়, মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে তাকে। প্রদীপ্ত অনেক দিন আগেই মারা গেছে। নির্দেশ অমান্য করায় অমরই গুলি করে মারে প্রদীপ্তকে।

নিমেষে অন্ধকার নেমে আসে দেবযানীর দুচোখে। হতভম্ব হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি নিশ্চিত প্রদীপ্ত আর নেই।’ সদস্যটি জানায়, ঘটনাটা তার সামনেই ঘটেছিল। ‘ব্লু-হিলস্ অপারেশনে’ প্রদীপ্তকে দায়িত্ব দেওয়া হয় পুলিশি কনভয়ের উপরে হামলা চালানোর জন্য। আর এই কনভয়ের নেতৃত্বে ছিলেন দেবযানীর বাবা অভিমন্যুবাবু। রাজি হয়নি প্রদীপ্ত। জীবন দিয়ে যার মাশুল গুনেছিল সে।’

মুহুর্তের জন্য ভেঙে পড়লেও নিজেকে সামলে নেয় দেবযানী। ঠিক করে ফেলে পরবর্তী পদক্ষেপ। রিভেঞ্জ। বাবার এবং প্রদীপ্তর মৃত্যুর বদলা তাকে নিতেই হবে। অমরকে ছাড়া যাবে না।

পরের দিন সকালে অমরের ডেরা ঘিরে ফেলে বিশাল পুলিশবাহিনী। যার নেতৃত্বে রাহুল মুখার্জি। চার ঘন্টার অপারেশনে ধরা পড়ে অমর ও তার দলবল। মারা যায় দুজন অ্যাক্টিভিস্ট-ও। বিপুল পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। আর এই সফল অপারেশনের পুরো কৃতিত্বটাই দেওয়া হয় রাহুল মুখার্জিকে। সরকারের তরফে রাহুলের নাম বিশেষ সম্মানের জন্য প্রস্তাব করা হয়। যদিও রাহুল জানত কৃতিত্বটা কার। পরের দিন কৃতজ্ঞতা জানাতে দেবযানীর বাড়িতে যায় রাহুল। জিজ্ঞাসা করে কী করে জঙ্গিদের এত খবর জানল সে। সত্যিটা আর আড়াল করতে পারেনি দেবযানী। ভেঙে পড়ে সে। জানায় তার ভালোবাসাকে পাওয়ার জন্য সে কত বড়ো অপরাধ করেছিল। অমরের হাতে তুলে দিয়েছিল সরকারি গোপন নথি। যার জন্য তার শাস্তি প্রাপ্য, প্রশংসা নয়।

‘আমাকে অ্যারেস্ট করুন, শাস্তি দিন।’ ডুকরে ওঠে দেবযানী।

দেবযানীর কান্না দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি রাহুল। মেলে ধরেছে দেবযানীর কাছে, ‘বিশ্বাস করো স্বপ্নেও ভাবিনি এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হব। প্রথম থেকেই মনে মনে ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। কিন্তু সাহস করে বলে উঠতে পারিনি। যাকে ভালোবাসায় অ্যারেস্ট করতে চেয়েছি, তার হাতে হাতকড়া পরানো আমার দ্বারা সম্ভব নয়। এতদিন যা বলতে পারিনি তা আজ বলছি, তোমাকে ভালোবাসি। বিয়ে করতে চাই।’

উত্তরে দেবযানী বলে, ‘না স্যার আমি আপনার যোগ্য নই। দেশ এবং কাজের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি আমি। আমি অপরাধী। আমার শাস্তি হওয়া উচিত। আমার জীবনের সঙ্গে আপনাকে জড়াতে চাই না। বরাবর আপনার কথা শোনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজ পারব না। আমাকে অ্যারেস্ট করুন।’

পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট-দের কাছে সরকারি গোপন তথ্য পাচারের জন্য পাঁচ বছরের জেল হয় দেবযানীর। রাহুল কিন্তু হার মানেনি। পাঁচ বছর অপেক্ষা করেছে দেবযানীর জন্য। নিয়মিত জেলে দেখা করেছে দেবযানীর সঙ্গে। ভরসা জুগিয়েছে। স্বপ্ন দেখিয়েছে নতুন জীবনের। সঙ্গে এও জানিয়েছে, সে-ই তার জীবনের প্রথম ও শেষ নারী।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...