হাঁটু দেহের বৃহত্তম অস্থিসন্ধি। আমরা যখন হাঁটি, নীচু হই, ঘুরি, লাফাই বা ওই ধরনের কোনও কাজ করি, তখন হাঁটুর উপর সবচেয়ে বেশি চাপ পড়ে। সুস্থ অবস্থায় এটা আমরা টেরও পাই না। কিন্তু যখনই হাঁটু ব্যথা করে, ফোলে বা শক্ত হয়ে যায়, তখনই আমরা আমাদের গতিবিধির স্বাধীনতার অর্থ বুঝতে পারি।

সৌভাগ্যবশত আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে কৃত্রিম হাঁটু প্রতিস্থাপন করে এই ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। সমগ্র বিশ্বে এই অপারেশন অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে হয়ে চলেছে।

কীভাবে হাঁটু কাজ করে

হাঁটুর অস্থিসন্ধি একটি উল্লেখযোগ্য কারিগরি। উরুর হাড়ের (Femur) শেষপ্রান্ত, পায়ের হাড়ের (Tibia) উপরপ্রান্ত এবং মালাইচাকি (Patella) দিয়ে তৈরি এই সন্ধির ভিতরে মোটা তরুণাস্থির আস্তরণ থাকে। এই আস্তরণটি হাঁটুর মসৃণতা এবং সাবলীলভাবে চলাচল সুনিশ্চিত করে। সুস্থ হাঁটুর মধ্যে একটি পর্দা থাকে, যাকে সিনোভিয়াল মেমব্রেন (synovial membrane) বলে। এই পর্দা থেকে এক ধরনের তরল বেরিয়ে হাঁটুর সাবলীল চলাকে মসৃণতর করে এবং তরুণাস্থির পুষ্টি যোগায়। আর্থ্রাইটিস বা বাত হলে এই পর্দা, তরল এবং তরুণাস্থির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।

আর্থ্রাইটিস এবং হাঁটুর সমস্যা

আর্থ্রাইটিস কিন্তু শুধুমাত্র বার্ধক্যের লক্ষণ নয়। এটি সন্ধিস্থলের স্ফীতি বা বিকৃতি যা স্বাভাবিক বার্ধক্যের মধ্যে পড়ে না। প্রকৃতপক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই এটি বাল্যকাল বা যৌবনে প্রকাশ পায়। অস্টিয়োআর্থ্রাইটিস এমনই একটি আর্থ্রাইটিস যাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ আক্রান্ত। আর্থ্রাইটিস হাঁটুর তরুণাস্থির ভয়ানক ক্ষতি করে। তরুণাস্থি নিজে থেকে ঠিক হয় না। চাপের ফলে ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায় কিংবা ভেঙে যায়। ফলে হাঁটুর চাপ সহ্য করার ক্ষমতা বিলুপ্ত হয়। রোগ আরও এগিয়ে গেলে হাড়ে হাড়ে ঘষা লেগে হাড় ক্ষয়ে যায় এবং হাঁটু বেঁকে যায় আর আটকে যেতে থাকে। ক্রমে হাঁটাচলার ক্ষমতা কমে যায়। ওজন বেশি হলে এই ক্ষতি আরও তাড়াতাড়ি হয়।

আর্থ্রাইটিস-এ দৈনন্দিন কাজের ব্যাঘাত ঘটে এবং ধীরে ধীরে সাধারণ কাজ করার ক্ষমতাগুলিও হ্রাস পায়। টোটাল নি-রিপ্লেসমেন্ট (Total Knee Replacement বা  TKR) এই সময় জীবনযাত্রাকে আবার স্বাভাবিক করে তুলতে সক্ষম।

কখন অপারেশনের প্রয়োজন

ব্যথা যখন অসহ্য হয়ে ওঠে এবং তা দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে ব্যহত করে, তখন TKR-এর জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। রাত্রে ব্যথা হলে কিংবা মাঝেমধ্যে পা আটকে যাওয়া মানেই এই অপারেশনের সংকেত।

শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি

হাঁটু প্রতিস্থাপনের আগে চারটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

১)  শল্যচিকিৎসার সাফল্য সম্বন্ধে নিশ্চিত হোনঃ আপনার চিকিৎসক, আপনার পরিবার এবং পরের সব প্রস্তুতি আগে থেকে সেরে রাখুন। কোন সপ্তাহে কী কী করণীয় সব আগে থেকে বুঝে নিন।

২)  বাড়তি ওজন ঝরিয়ে ফেলুন বা তার পরিকল্পনা নিন। মনে রাখবেন, ওজন কমানো শল্যচিকিৎসার সুফলকে ত্বরান্বিত করে।

৩)  চিকিৎসক অনুমোদিত হালকা ব্যায়াম শুরু করতে হবে। এই ব্যায়াম হাঁটুর আর কোনও ক্ষতি করবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অন্য কোনও ব্যায়াম করবেন না।

৪)  ধূমপান বন্ধ করতে হবে। এর ফলে অপারেশনের পরে সেরে উঠতে অনেক কম সময় লাগবে।

সম্পূর্ণ হাঁটু প্রতিস্থাপন সম্বন্ধে জ্ঞাতব্য তথ্য

বিগত কয়েক বছরে হাঁটুর সন্ধি-প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে শল্যচিকিৎসা এবং সরঞ্জামের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। উপকরণগুলি আরও দীর্ঘস্থায়ী ও শক্তপোক্ত হয়েছে। অপারেশনের পদ্ধতি আরও নিখুঁত ও ত্রুটিমুক্ত হয়েছে। ফলে অস্ত্রোপচারে সাফল্যের হার অনেক বেশি।

এক্ষেত্রে সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃৎ সন্ধিটি তিন অংশে বিভক্ত। Femoral অংশটি ধাতু নির্মিত, Tibia অংশ ধাতু এবং ঘন পলিথিলিন এবং Patella অংশটি ঘন পলিথিলিন দ্বারা গঠিত।

সন্ধিপ্রতিস্থাপনের উপকারিতা

অপারেশনের পর হাঁটু ঠিক হতে প্রায় ছয় মাস লাগে। তার মানে অবশ্যই এই নয় যে, আপনি ছয় মাস কিছু করতে পারবেন না। বাইরে বেরিয়ে হাঁটা বা স্বাভাবিক কাজকর্ম আপনি মাসখানেকের মধ্যেই করতে পারবেন। কিন্তু পুরো উপকারিতা পেতে ছয় মাস সময় লাগবে। সম্পূর্ণ সেরে যাওয়ার পর আপনি দেখবেনঃ

১)  ব্যথা কমে যাবে অথবা একদম থাকবে না।

২)  হাঁটাচলার ক্ষমতা বেড়ে যাবে।

৩)  বাঁকা পা সোজা হয়ে যাবে।

৪)  পায়ের শক্তি বাড়বে।

৫)  জীবনের স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে। কিন্তু দৌড়ানো, লাফানো এবং অন্যান্য লাফঝাঁপ করা যাবে না।

হাঁটুপ্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচারের ঝুঁকি

সব অপারেশনের মতো এখানেও কিছু ঝুঁকি আছে। সেগুলোও জেনে রাখা প্রয়োজন।

  •  সংক্রমণঃ  মুখের থেকে নতুন সন্ধিতে জীবাণু সংক্রমণ হতে পারে। অস্ত্রোপচারের আগে দাঁতের সংক্রমণ সারিয়ে নিতে হবে। অপারেশনের পরে দাঁতে সংক্রমণ হলে তৎক্ষণাৎ আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
  • রক্ত জমাট বাঁধাঃ Thromboembolism symptoms অর্থাৎ শিরার মধ্যে রক্ত জমে যাওয়া একটি গুরুত্বপুর্ণ সমস্যা। এর প্রতিরোধে কিছু ওষুধ এবং এক বিশেষ ধরনের মোজা পরতে হতে পারে।
  • ফুসফুসের সংক্রমণ আর-একটি ঝুঁকি, যা সাধারণত যারা অপারেশনের পর বেশি দিন শয্যাশায়ী থাকেন, তাদের হয়। এই কারণে অপারেশনের পর বিছানা ছেড়ে ওঠা খুব জরুরি।

অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি

  •  পুরো চিকিৎসাগত মূল্যায়নঃ  পুরো স্বাস্থ্যের বিবরণ চিকিৎসকের জানা প্রয়োজন। নানারকম রক্তপরীক্ষা, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাফি, বুকের এক্স-রে ইত্যাদির মাধ্যমে রোগীর শারীরিক অবস্থার কথা জানা হয় এবং সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া হয়।

বাড়ির প্রস্তুতি

  •  সাহায্যকারীর ব্যবস্থাঃ  অপারেশনের পরপরই একা একা চলাফেরা করা সম্ভব হবে না। কাজেই এমন একজন চাই যিনি রোগীকে সব কাজে সাহায্য করবেন। ডাক্তারের কাছে যাওয়া, দোকানপাট করা এবং অন্যান্য গৃহস্থালির কাজে এইরকম সাহায্যকারী প্রথম ছয় সপ্তাহে অপরিহার্য।
  • বাড়ি নতুন ভাবে সাজিয়ে নেওয়াঃ  অপারেশনের পর প্রথমদিকে নীচু হওয়া, হাঁটু গেড়ে বসা সম্ভব নয়। এটাও মনে রাখতে হবে যে প্রথম কিছুদিন আপনাকে ক্রাচ বা ওয়াকারের সাহায্যে চলাফেরা করতে হবে। সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস ওপরের দেরাজে অথবা সহজে পাওয়া যায় এমন জায়গায় রাখুন। বৈদ্যুতিক তার যেন মেঝেতে না পড়ে থাকে। মেঝে পিছল রাখবেন না।
  • কিছু প্রয়োজনীয় বস্তু, যেমন একটি কর্ডলেস ফোন, একটি বহুপকেটযুক্ত Apron এবং জিনিস তোলার জন্য একটি লম্বা লাঠি অনেক কাজ সহজ করে দেয়।

ওষুধ সম্পর্কে কিছু জ্ঞাতব্য তথ্য

অপারেশনের আগে আপনি যা যা ওষুধ খান,সবই আপনার ডাক্তারকে জানাতে ভুলবেন না। কিছু ওষুধ অজ্ঞান বা অবশ করার সঙ্গে প্রতিক্রিয়া করে। কিছু ওষুধ রক্ততঞ্চনে বাধা দেয় বা রক্তচাপ বাড়ায়। আপনার চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত এই সময়ে অন্য কোনও ওষুধ খাবেন না।

অপারেশনের পরে

  •  দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে সমস্ত নল খুলে যাবে
  • ফিজিওথেরাপি শুরু হবে পরের দিন থেকে
  • দাঁড়ানো শুরু হবে দুই থেকে পাঁচ দিনের মধ্যে
  • দুইদিন পরে আপনার ড্রেসিং বদল হবে
  • সাধারণভাবে পাঁচ থেকে সাত দিনের মাথায় আপনি বাড়ি চলে যাবেন
  • প্রথমদিকে ক্রাচ বা ওয়াকারের সাহায্যে হাঁটতে হবে
  • আপনার বাড়িতে প্রতিদিন ফিজিওথেরাপিস্ট যাবেন
  • তাছাড়াও আপনাকে কিছু ব্যায়াম দেখিয়ে দেওয়া হবে, যা আপনি দিনে তিন চারবার করবেন।

মনে রাখবেন, সঠিক ব্যায়ামই আপনার হাঁটুকে সুস্থ করে তুলবে।

পরামর্শ

  •  কয়েকটি নিয়ম মানলে আপনার হাঁটু আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং সমস্যাশূন্য হবে
  • অপারেশনের পর দাঁতের কোনওরকম সংক্রমণ হলে Antibiotics নিতে হবে
  •  শরীরের কোনওরকম সংক্রমণ সন্দেহ করলেই ডাক্তারের কাছে যাবেন
  • ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখুন
  • সাঁতারকাটা বা সাইকেল চালানো অভ্যাস করুন
  • নিয়মিত ভাবে আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন।

হাঁটুর বাত এখন হাঁটুর সন্ধি-প্রতিস্থাপন দ্বারা নিরাময় সম্ভব। ভালো ভাবে ভেবে সব জেনে এগিয়ে যান। জীবন আবার উপভোগ করুন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...