অস্বস্তিটা ক্রমশ বাড়ছে । এই ক’দিন রূপসা লোকটাকে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে, তার অফিসের উলটোদিকের ফুটপাতে। তার কেবিন থেকে মাথা তুললেই যে-জানলা দিয়ে অনেকখানি আকাশ আর গলির মোড় পর্যন্ত দেখা যায়, গত এক সপ্তাহ ধরে লোকটাকে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে রূপসা, দিনের নানা সময়ে।
লোকটার হাবেভাবে একটা কথা বেশ স্পষ্ট — সে কোনও ভাবেই ঠিক লুকিয়ে থাকতে রাজি নয়। যেন চায় রূপসা তাকে লক্ষ্য করুক। বয়স আন্দাজ সত্তর। রূপসা তার বাবাকে কোনওদিনও দেখেনি। তবে বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁরও, এর কাছাকাছি বয়সই হতো। বাবার বয়সি এই লোকটা, তার কন্যাতুল্য একটা মেয়েকে এভাবে কেন দেখছে! কী চায় লোকটা!অস্বস্তিটা কিছুতেই তাকে কাজে মন বসাতে দেয় না। বুঝে উঠতে পারে না, অফিসের পর লোকটা তাকে ফলো করে কেন?
অফিস থেকে বেরিয়ে আজ বাসে উঠতেই লোকটাও পেছনের গেট দিয়ে উঠে পড়ল। এবার একটু খুঁটিয়ে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করল রূপসা৷মুখ ভর্তি পাকা দাড়ি। গত সাতদিনে একবার মাত্র তাকে জামা বদলাতে দেখেছে । খুব একটা সচ্ছলতার ছাপ নেই চেহারায় ।
আজ জানালার ধারে সিট পেয়েছে রূপসা। যতটা সম্ভব লোকটার অস্তিত্ব ভুলে সে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল। অফিস ছুটির কলকাতা৷ ভিড় বাড়ছে বাসে৷ ঘরমুখো লোখের ভিড় পেরতিটি বাসস্টপেই৷এত লোকের ভিড়ে আদৌ কি বোঝার উপায় আছে কে কী চায়? কার কী মতলব! বরাবরই নিজের আত্মরক্ষার দায়িত্ব তাকে নিজেকেই নিতে হয়েছে। আর- পাঁচটা মেয়ের মতো, মাথার উপর বাবা থাকার সুবিধা তো সে পায়নি। মাকে যে সমস্যার কথা বলবে, সে উপায় নেই। গত তিন বছর ধরে নার্ভ-এর অসুখে, মায়ের শরীরের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে।
কাকে বলবে সমস্যাটা? প্রবীরকাকু ! বাবার একসময়ের এই বন্ধু, নানা দুর্দিনে, বিপদে আপদে পাশে থেকেছে। তার জন্মের বছর চারেক পরেই বাবার মৃত্যু হয়েছিল। মায়ের কাছে একটাই সাদা কালো ছবি আছে, মা বাবার সঙ্গে রূপসার। তার চার বছরের জন্মদিনের। একটা সাদা ফ্রিল দেওয়া ফ্রক পরে সে বসে আছে বাবার কোলে।গাল ফোলা ফোলা, নরম নরম, ফুটফুটে রূপসা। পুরোনো হতে হতে ছবিটা জায়গায় জায়গায় বেশ ঝাপসা। মা সেটা বের করে দেখাতেও যেন অস্বস্তি বোধ করে। রূপসা বোঝে আসলে মা, বাবাকে ভুলে থাকতে চায়।
আজ তার জন্মদিন। জন্মদিন শব্দটা মাথার মধ্যে এক মুহুর্ত ঘুরপাক খেয়ে অন্য ভাবনার পরতে চাপা পড়ে গেল। তার স্টপেজ এসে গেছে। তড়িঘড়ি নামল রূপসা। দূরত্ব রেখে লোকটাও। রূপসা আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে, গলির দিকে পা বাড়াল। লোকটা তাকে ফলো করছে। রূপসা গতি বাড়াল। লোকটাও। না ভয় পেলে চলবে না। মাঠ পেরিয়ে ক্লাবঘর। কী একটা কারণে আজ দোকানগুলোর কয়েকটা বন্ধ। ফলে রাস্তায় অন্য দিনের মতো লোকজন নেই। ক্লাব অবধি যাবে , নাকি তার আগেই একটা ব্যবস্থা করবে লোকটার? ভাবতে ভাবতে রূপসা হাঁটা থামায় ।
দূরত্ব একটু কমতেই পিছন ফিরে সরাসরি জিজ্ঞেস করে লোকটাকে, ‘কী চাই আপনার? কে আপনি? আমায় ফলো করছেন কেন?’
লোকটা একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে, একটা স্মিত হাসি নিয়ে রূপসার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আরও কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে, খুব ধীরে ধীরে বলে, ‘আমি তোর বাবা রূপসা।’
রূপসা প্রায় থতমত খেয়ে তাকায়।
‘ কী আজেবাজে বকছেন! আমার বাবা কবে মরে ভূত হয়ে গেছে! ‘
কথাটা বলতে গিয়ে মনে খটকা লাগে, সে কি ভূত দেখছে নাকি! কী বলতে চাইছে লোকটা। নাহ, সে ঘাবড়ে গেছে, এটা একদম বুঝতে দেওয়া যাবে না। তাই একটুও জড়তা না রেখে বলে,’কী ধান্দা সত্যি করে বলুন তো? ‘ রূপসার গলায় ঝাঁঝ স্পষ্ট। ভিতু সে কোনও দিনই নয়। কিন্তু একটাই ডাউট হচ্ছে, লোকটা তার নামটা জানল কী করে! তার মানে খোঁজখবর নিয়েই এসেছে।
লোকটা এবার আরও একটু কাছে এগিয়ে এল। যেন স্ট্রিট লাইটের লালচে আলোয় ভালো করে দেখতে চায় রূপসার মুখ। না, লোকটার তাকানোর মধ্যে কোনো বদ মতলব নেই, বরং কেমন একটা মায়া মায়া ভাব আছে।সেই শান্ত দৃষ্টি নজর এড়ায় না রূপসার। কিশোরী বয়স থেকে সে অনেক রকম পুরুষের মুখ দেখেছে। কারও কারও চোখে অন্য ভাষাও পড়েছে। কিন্তু এই লোকটার চাহনি তেমন নয়।
লোকটা আবার কাতর ভাবে বলে, ‘আমি সত্যিই তোর বাবা রূপসা। আমি মারা যাইনি। পালিয়ে গিয়েছিলাম।’
এবার রূপসা যেন আর ঠিক ততটা অবিশ্বাস করতে পারে না লোকটাকে। ভিতরে একটা অদ্ভুত তোলপাড় হতে শুরু করেছে তার। সে সোজাসুজি লোকটার চোখে চোখ রাখে। কিন্তু সেই দৃষ্টির কাছে হার মেনেই যেন লোকটা চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর দেরে যাওয়া গলায় আবার বলতে শুরু করে, ‘হ্যাঁ তোদের ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম আমি। অন্য একজনের সঙ্গে সংসার করব বলে। কিন্তু সেই পাপের শাস্তি আমি পেয়েছি। সংসার , ব্যবসা , সব খুইয়েছি নিজেরই দোষে। আমি তোদের কাছেও অপরাধী মা। মুখ নেই তোদের সামনে এসে দাঁড়ানোর । আমি কোনও দায় দায়িত্ব নিইনি তোদের। ‘
রূপসা মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে, ‘ কিন্তু মায়ের মুখে আমি শুনেছি আমার বাবা মারা গেছে।মা কী করে বলল এত বড়ো মিথ্যে!’
‘তোর মা আমার সম্মান বাঁচাতে তোকে মিথ্যে বলেছে মা।ভালোবাসত তো খুব৷ প্রবীর সবই জানে। ওর সঙ্গে যোগাযোগটা খুব ক্ষীণ ভাবে হলেও রয়ে গেছে এত বছর ধরে। তোদের সব খবরই আমি পাই। জানি তোর মায়ের চাকরিটা ছিল বলে তোকে বড়ো করতে পেরেছে। কিন্তু আজ আমি অনুতপ্ত রূপসা।’
কথাটা বলার পর লোকটা জামার হাতায় চোখ মোছে। রূপসার মনের ভিতর কী যেন একটা ঝড় শুরু হয়েছে। সে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। উলটো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা, যাকে এইমাত্র বাবা বলে সে জেনেছে, তাকে আরও একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চায় যেন। তারপর কঠিন গলায় প্রশ্নটা করেই ফেলে– ‘এতদিন পরে কী চান আপনি? কেন এলেন? ‘
আগন্তুক এবার আবেগরুদ্ধ গলায় বলতে শুরু করে,’আমি আর বেশি দিন নেই। প্রায়শ্চিত্ত করার সময়ও হাতে নেই আর। আজ তোর জন্মদিন। তোকে একটা জিনিস দিতে চাই শুধু। এত বছর ধরে এগুলো আগলে রেখেছিলাম। আজ তোকে দিয়ে আমার ছুটি। আর কোনও দিন সামনে আসব না তোর। পারলে আমায় ক্ষমা করিস।’
লোকটা একটা খবরের কাগজে মোড়া প্যাকেট এগিয়ে দেয় রূপসার দিকে। হাতে দিয়েই হনহন করে হাঁটা দেয়। কিন্তু তার হাঁটায় যেন আর তেমন জোর নেই, কেমন যেন ঝুঁকে পড়া চেহারা । হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রূপসা তার চলে যাওয়াটা দেখে।
কখন কীভাবে একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরেছে , মনে পড়ে না রূপসার। এখন রাত এগারোটা। মা পাশের খাটে অঘোরে ঘুমোচ্ছে।ঘুমের ওষুধ খায় রোজই৷মায়ের দিকে আলগোছে একবার তাকিয়ে নিয়ে, টেবিল ল্যাম্পের আলোয় প্যাকেটটা খোলে রূপসা। খুলতেই বেরিয়ে আসে একটা পুরোনো ফোটোগ্রাফ । হাতে ধরা ফোটোটা আলোর কাছে ধরতেই বুঝতে পারে, এটা সেই পুরোনো সাদাকালো ছবিটারই প্রতিলিপি, যা সঙ্গোপনে রয়েছে, মায়ের ডায়ারির ভাঁজে। তবে এটা অনেকটাই পরিষ্কার। খুব যত্নে রাখা ছিল বোধহয়। প্যাকেট থেকে এবার বেরিয়ে আসে ছোট্ট একটা ফ্রক। সেই সাদা ফ্রিল দেওয়া জন্মদিনের ফ্রকটা!
কত কিছুতেই কতবার কষ্ট পেয়েছে রূপসা। কেঁদে দুঃখ ভুলেছে। কিন্তু আজ কেন এমন হচ্ছে! বুকটা ফেটে যাচ্ছে তবু বাবা বলে একবার ডেকে উঠতে পারছে না৷ কিছুতেই পারছে না।চোখটা অসম্ভব জ্বালা করছে রূপসার। সে কাঁদতে পারছে না। মা বলে ,জন্মদিনে কাঁদতে নেই।