না না না! এইটা হতে পারে না। কিচ্ছু করার নেই কর্ণের, ও তো নিরুপায়…
সকালের চায়ের প্লেট-টা হাতে নিয়ে রানু ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে, সুজিতবাবু ঘুমের ঘোরে এরকম ভুল বকছেন। এটা আজ নতুন নয়, গত সপ্তাহ থেকেই এ রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। তাই, সুজিতবাবুর বউমা রানু তার স্বামী রজতকে বলে, ওগো,বাবার কিছু একটা প্রবলেম হচ্ছে বোধহয়। সকালবেলা হলেই ঘুমের ঘোরে এরকম ভুল বকেন। একটা ডাক্তার ডাকতে হয় তো এবার!
সুজিতবাবুর একমাত্র ছেলে রজত, ক্রিকেট কোচ, ময়দানের একটি নামজাদা ক্লাবের। বল আসলে স্ট্রেট ব্যাটে কী ভাবে ছয় মারতে হয়, বাচ্চাদের শেখানো যার নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। এহেন স্ত্রীর কথাটাকেও তিনি ফুলটস বানিয়ে উড়িয়ে দিলেন শান্তিপল্লীর এই দোতলা বাড়ির বাইরে। আরে বাবার প্রেশার জানো না! আর তাছাড়া ষাট পেরিয়ে গেছে। এখন এরকম হয়, আমি কয়েকটা ভিটামিন এনে দেব’খন।
রজতবাবুর এমন কাটা কাটা দাঁত চিবানো কথা যে, রানুও আর খুব বেশি কথা বাড়াতে পারে না, তবে ষাট পেরোলেই যে-এমন কাণ্ড ঘটে, সেটাও সে মনে মনে কিছুতেই সমর্থন করতে পারেল না।
তিনমাস হল রিটায়ার করেছেন সুজিতবাবু, বনমালীপুর আদর্শ শিক্ষামন্দিরের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। স্কুলের নামের সাথে তাঁর চরিত্রও একেবারে খাপে খাপ মিলে যায়। গায়ে চেক শার্ট, সুতির প্যান্ট, চোখে বাইফোকাল একটা চশমা, খুব গম্ভীর, শান্ত প্রকৃতির একজন মানুষ। অবশ্য গম্ভীর মানেই যে ছাত্র পেটানোর দুর্নাম আছে, তা কিন্তু নয়। ছাত্ররাও খুব ভালোবাসে তাঁকে। স্কুলের এক ছাত্রেরই দিদিকে ছেলের বউ করে এনেছেন ঘরে। ওনার স্ত্রী অকালে চলে যাওয়ার পরে এখন, এই রানুই ঘরের একমাত্র লক্ষ্মী। তিনবছর হল বিয়ে দিয়েছেন ছেলের, এখনও ছেলেপুলে হয়নি।
সুজিতবাবু মানুষটাকে সব্বাই এতো ভালোবাসত যে, একদম এক কথাতেই রানুর বাবা এই বিয়েতে মত দেন। রানু বাংলা অনার্স-এর ২য় বর্ষ, একটু তাড়াতাড়িই বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের আগে রানুকে পইপই করে ওর মা-বাবা বুঝিয়ে পাঠিয়েছেন, ওরে, মাস্টারমশাই-কে একটু দেখবি বাবা, যত্নআত্তি করবি কিন্তু। মানুষটা বড়ো ভালো। রানু অবশ্য সেই কথা মন্ত্রের মতো জপ করে। বরং ওনার ছেলে যতটা না মাথা ঘামায় বাবার শরীর নিয়ে, তার চেয়ে বেশি খেয়াল রাখে রানু।
আজকেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে দৌড়ে ঘরে স্বামী-কে ডাকতে গিয়ে দেখে, সে মানুষ দিব্যি চাদর টেনে ঘুমাচ্ছে আর নাক ডাকছে। ডাকতে গিয়েও আর ডাকল না, ভাবল ডাকলেও তো সেই একই কথা শোনাবে। ধীরে ধীরে তার শ্বশুরমশাইয়ের খাটের কাছে গিয়ে দেখল, এই ঠান্ডাতেও মানুষটা দরদর করে ঘামছেন। মাথায় হাত দিল, নাহ্ জ্বর তো নেই। তবে কি প্রেশার বাড়ল? সুজিতবাবুর পরনের গেঞ্জিটা চপচপে ভিজে গেছে ঘামে। চায়ের প্লেটটা টেবিলে নামিয়ে আসতে আসতে কপালে হাত রেখে ডাকল, বাবা, ও বাবা!
সুজিতবাবু তখনও বিড়বিড় করে ঘুমের ঘোরে কী বকে যাচ্ছেন। আরও দুবার ডাকার পর হুঁশ ফিরল তাঁর। ধড়মড় করে উঠে বসে বললেন, আরে রথ… চাকাটা… কর্ণের তো দোষ নেই বলো!
কথাটা শুনেই রীতিমতো তাঁকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল রানু, বাবা! বাবা! কে কর্ণ? আমি রানু, এই তো। শরীর খারাপ? কী হয়েছে? আমি চা নিয়ে এসেছি। কোনওমতে এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল রানু।
এবার সম্বিত্ ফিরে পেয়ে সুজিতবাবু বলেন, ওহ, বউমা তুমি! তারপর হাতড়ে হাতড়ে টেবিল থেকে চশমাটা নিয়ে পরেন। খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর বলেন, কাগজ দেয়নি?
রানু চায়ের প্লেটটা টেবিল থেকে নিয়ে সুজিতবাবুর হাতে তুলে দিয়ে বলে, বাবা কাগজ দিচ্ছি। আগে আপনি বলুন তো আপনার কী হয়েছে?
একটু হেসে বলেন সুজিতবাবু, আরে! না না, ও একটু গরম লাগছিল!
গরম লাগলে মানুষ ভুল বকে বাবা? আপনি বলুন না আমায় ডাক্তার ডাকব? ওকে ডাকব?
আরে না গো কিচ্ছু হয়নি আমার, এ বুড়ো বয়সে এসব হয়। ভুল বকছিলাম বুঝি, বলে হা হা করে হেসে ব্যাপারটা-কে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।
সুজিতবাবু এত গম্ভীর মানুষ যে, তাঁর মুখে এরকম হাসি এতই বেমানান, লোকে এমনিই সন্দেহ করবে।
বাবা আজ বলে তো নয়, এই কয়েক দিন ধরেই দেখছি। আপনার ছেলে বলল, প্রেশার বাড়লে নাকি হয়! বলল ভিটামিন ট্যাবলেট নিয়ে আসবে। আমার নিজের বাবারও তো প্রেশার আছে, কই আজ অবধি তো তাকে ভুল বকতে শুনিনি। আর তাছাড়া আমি বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই যদি এমন ধারা দেখতাম, তবে না হয় ভাবতাম,আপনার সত্যিই বুঝি এরকম অসুখ-বিসুখ আছে। আজ অবধি তো এইরকম দেখিনি। এটা শুরু হয়েছে এই ক’সপ্তাহ ধরে। কে কর্ণ, কী সব বলছিলেন বাবা! আপনি শুয়ে শুয়ে মহাভারত আওড়াচ্ছিলেন।
না গো বউমা কিস্যু হয়নি আমার। একদম ঠিক আছি, বলে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু রানুর মুখে তখনও প্রশ্নের অমাবস্যা দেখে তিনি আবার বললেন, আচ্ছা যদি সেরকম বুঝি রথীন ডাক্তারকে গিয়ে দেখিয়ে নেব। আচ্ছা এখন কাগজটা দাও, দেখি কী লিখেছে।
রানু আর কথা বাড়াল না, যদিও বা তার মনে অসংখ্য প্রশ্ন আর চিন্তা উঁকি মেরে যাচ্ছে। এ অকাল অমাবস্যা। মনে মনে ভাবল, থাক কারও-র দরকার নেই,সে নিজেই এ সমস্যার সমাধান করবে।
টিচার্স রুমে এসে কোনওমতে ব্যাগটা ছুড়ে দিলেন রামতনুবাবু। চেয়ারটা টেনে নিয়ে ধুপ করে বসে পড়লেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছতে মুছতেই জিজ্ঞেস করলেন নতুন কেরানিকে, এই ফ্যানটা আর একটু জোর হবে না? উফ এটা শীতকাল না গরমকাল বোঝা দায়!
এই এলেন, হাঁফাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। দশ মিনিট বসুন, দেখবেন ঠান্ডা লাগবে। কথাটা ভেসে এল সাইডের টেবিল থেকে। এই ছেলেটা নতুন জয়েন করেছে, খুব একটা পছন্দ না রামতনুবাবুর। আড়ালে ডেঁপো ছোঁড়া বলে ডাকেন। তবে ছেলেটা মোক্ষম সময়ে তাঁকে সাপোর্ট করেছিল বলে খুব জব্দ করতে পেরেছিলেন আগের নন টিচিং স্টাফ নিবারণবাবুকে। তাই কাজের ছেলে ভেবে তার সাথে হাসিপূর্বক সহাবস্থান করাই শ্রেয় বলে মনে করেন তিনি।
বনমালীপুর আদর্শ বিদ্যামন্দির অনেক প্রাচীন স্কুল। সেই স্বাধীনতার বছরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এখানকার জমিদার অনন্তনারায়ণবাবু। স্কুল হিসাবেও সুনাম আছে। এই সুনামের মধ্যে আর একটি পালক যোগ হয়েছে। জেলার মধ্যে মাধ্যমিকে প্রথম কুড়িতে স্থান পেয়েছে স্কুলেরই এক পড়ুয়া। অনন্তনারায়ণবাবুর বংশধর সুমন্তবাবু বর্তমানে স্কুলের পরিচালন কমিটির হেড। প্রথমে খুব অল্প পরিসরে শুরু হলেও দিনকে দিন কলেবরে বেড়েছে এই স্কুল। নতুন একটা বিল্ডিং হয়েছে, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য। টিচার্স রুমের পরিধিটাও বেড়েছে। আগে সবাই একসাথেই বসতেন। এখন হেডমাস্টারের জন্য আলাদা একটি ঘর, আগে যেখানে শুধু একটি আলাদা টেবিল ছিল।
রামতনুবাবু তার গরম লাগাটাকে আর উত্তপ্ত বাক্যালাপে বাড়ালেন না। হ্যাঁ, সেই বলে ওখানেই ইতি টানলেন। এমনই সময় ঢুকলেন সমর ঘোষ, ইতিহাস শিক্ষক। সুজিতবাবু রিটায়ার করায় তাঁর চাপ বেড়েছে। আরও বেশি ক্লাস নিতে হচ্ছে। তাই বেশিরভাগ সময়ই উত্তপ্ত থাকেন। এসে ব্যাগটা রেখেই নতুন কেরানির ওপর উগরে দিলেন রাগ, এই তোমায় বলেছি না, সাইন করার খাতাটা টেবিলের ওপরেই রাখবে। চোদ্দো ঘন্টা ধরে খুঁজতে পারব না। ওদিকে সাড়ে দশটার একটু পার হয়ে গেলেই তো লাল কালি মেরে দেবে, সিএল হয়ে যাবে। লাস্ট কথাগুলো হেডমাস্টারকে শুনিয়ে তিনিও এই সবে নিজের ঘরে এসে ঢুকলেন। কম কথার মানুষ, হাসি হাসি ভাব নিয়ে থাকেন কিন্তু খুব চালাক। কুল মাইন্ডে সব কিছু খেলেন তিনি।
ওদিকে রামতনুবাবু তখন ঠান্ডা হয়ে এসেছেন। ব্যাগ থেকে সোয়েটার বের করে পরে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আরে বলতেই ভুলে গেছি, সেই যে চোর কী যেন নাম, হ্যাঁ নিবারণ, ওর সঙ্গে দেখা হল। আমাদের বাড়ির ওদিকেই থাকে তো। বাজারে গেছি, দেখি চাল কিনতে এসেছে, দর করছিল মিনিকিটের। তাকিয়ে ছিল হাঁ করে যেন গিলে খাবে। বলেই হো হো করে হাসতে লাগলেন তিনি। তারপর বললেন, চাল চোর এসেছে চাল কিনতে।
জানলাটায় জং লাগা, হাত দিতেই কিছুটা মরচে উঠে এল হাতে। তাই হাতটা সরিয়ে নিলেন। সুজিতবাবু জানলায় হাত দিয়ে ভাবছিলেন। এখন তো শুধু ভাবারই কাল, অবসর এক কল্পনা সমারোহ। না রানুকে কিছুতেই জানতে দেওয়া যাবে না, সেদিন রাতে তাঁর ছেলেকে কার সাথে কথা বলতে শুনেছিলেন, উফ্ আর বলিস না। ওনার হয়েছে এখন আসরের মাঠের জন্য টাকা দেওয়ার হুজুগ। কোথায় টাকা জমাবে, তা না শুধু উড়িয়ে যাচ্ছে। বাথরুমটায় টাইলস বসাব বলে চাইলাম, দিল না। নিজের ছেলেকে না দিয়ে অন্যের অন্ন জোগাচ্ছে। বাপই যদি এমন বেইমানি করে তাহলে আর কী করার।
আড়াল থেকে বেইমান শব্দটা শুনেই যেন বুকে লেগে গেল তাঁর, বুকের যে-খচখচানিটা অবসরের একমাস আগে থেকে বাসা বেঁধে আছে। আসলে স্কুলের মিড ডে মিলের চাল-ডালে অনেক দিন থেকেই গরমিল হচ্ছিল। নিবারণবাবুর ওপরেই দায়িত্ব ছিল কোন খাতে কত টাকা খরচ হচ্ছে রেজিস্টার খাতায় লিখে হেডমাস্টারকে পেশ করার। এমনকী মজুত খাবারের ঘরের চাবিও থাকত তাঁর কাছেই। তাই সন্দেহের তিরটা গিয়ে পড়ে তাঁর দিকেই। কিন্তু তাতে তো কাউকে আর দোষী ঠাউরানো যায় না। মিটিং হল পরিচালন সমিতির। সুমন্তবাবুও বললেন, স্কুলের এত নাম খারাপ হচ্ছে, ওঁকে বের করে দেওয়া হোক। কিন্তু সায় দিলেন না সুজিতবাবু। উনি বরাবরই একটু নীতিবাগীশ মানুষ। হ্যাঁ হতেই পারে কাজটা নিবারণ করেছে, আবার নাও তো হতে পারে। যতক্ষণ প্রমাণ না হয় ততক্ষণ তো কেউই চোর নয়। বিনা প্রমাণে দুম করে কাউকে টানা হবে, তা পছন্দ করতেন না তিনি। কথাটা বাকি কলিগদের বোঝাতে গিয়ে হল হিতে বিপরীত। সবাই বাঁকা চোখে দেখতে লাগল তাঁকে। মিটিং আটকাল না, ইচ্ছা করেই অনুপস্থিত থাকলেন তিনি।
নিবারণকে চুরির অপবাদ দিয়ে বার করে দেওয়া হল স্কুল থেকে প্রমাণ ছাড়াই। তারপর থেকে কানাঘুষো শুরু হল তাঁর নামে। একদিন তো সুমন্তবাবু নিজেই বাঁকা হাসি দিয়ে বললেন, কী মাস্টারমশাই, দল বদলালেন নাকি! খুব খারাপ লেগেছিল তাঁর। কোনও দিন পার্টি পলিটিক্স করে চাকরি পাননি, পেয়েছেন নিজের যোগ্যতায়। মনমরা হয়ে শুধু অবসরের দিন গুনতে লাগলেন। ওই ঘটনার পর থেকে স্কুলের শেষদিন অবধি কোনও কলিগ তাঁর সঙ্গে হাসিমুখে কথা পর্যন্ত বলেননি। কথাটা তাঁর বাড়ির লোক আজ অবধি জানে না।
ইতিহাসের পাতা থেকে বারবার মনে উঠে আসছে কর্ণের কথা। পাণ্ডবের পক্ষ না নেওয়ায় আজও প্রবলভাবে সমালোচিত হয় সে চরিত্র। কৌরবদের লালনপালনে বড়ো হওয়া কর্ণ, আজ যদি পাণ্ডবদের পক্ষ নিতেন সেটা কি বিশ্বাসঘাতকতা নয়! ছেলের চাকরি থেকে কতরকম সাহায্য করেছেন তিনি, সুমন্তবাবুও সেটা মানেন। আজ অবধি যেখানে কোনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি তিনি, সেখানে বিনা প্রমাণে কীভাবে একটা মানুষের বিরুদ্ধে কথা বলবেন তিনি? এটাও কি অন্যায়ের মধ্যে পড়ে না। কে তবে বিশ্বাসঘাতক?
উনি তো আর সুজিতবাবু নেই, উনি এখন কর্ণ! স্বপ্নে বারবার দেখছেন, তাঁর দিকে আঙুল তুলে সবাই তাঁকে বলছে বিশ্বাসঘাতক। কর্ণের দুঃখ কেউ বুঝবে না? নাহ, রানুকে কিছুতেই বলা যাবে না কথাগুলো।