সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই লক্ষ্য করছি, বাড়ির পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট হয়ে রয়েছে। চোখের সামনে দিয়ে আমার চটুল, বাক্পটু স্ত্রী ঘোরাফেরা করছে, অথচ টুঁ-শব্দটি নেই। মনে হল ঝড়ের আগের পূর্বাভাস। ক্ষণিকের শান্তির আবেশ। নাহলে তো অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই কাটা রেকর্ড-এর মতো সর্বক্ষণ বাজতেই থাকে। যাই হোক এই শান্ত পরিবেশ তো আর সহজে পাওয়া যায় না। ব্যাপারটা বেশ এনজয়-ই করছিলাম। তাই আর ওকে ঘাঁটাতে মন চাইছিল না। মানে মৌচাকে ঢিলটা কেই-ই বা ছুড়তে চায় বলুন! কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল জিজ্ঞাসা না করলেই যে রেহাই মিলবে তারও তো উপায় নেই। পরে সেই নিয়ে আবার বচসা বাধবে। তার থেকে ভালো, জিজ্ঞাসা করেই ফেলি। হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিউজ চ্যানেল চালিয়ে বসলাম। তার মিনিট দুয়েক পরে চা দিতে এল নীরা। তখনই প্রশ্ন করলাম, ‘কী হয়েছে?’

‘রথীনদা ওনার ফ্ল্যাটটা জনাকয়েক ছাত্রকে ভাড়া দিয়েছে।’ একমুহূর্ত অপেক্ষা না করেই মুখটা বেশ ব্যাজার করেই উত্তর দিল নীরা।

‘এটা তো খুব ভালো খবর। এতদিন ধরে ফ্ল্যাটটা ফাঁকা পড়ে ছিল। চলো, মানুষজন আসাতে অন্তত ওদের কলরব তো শোনা যাবে। তারপরে একটা পড়াশোনার পরিবেশও…। বাই দ্য ওয়ে তোমাকে এত চিন্তিত লাগছে কেন?’

আমার কথা শোনা মাত্রই ঝাঁঝিয়ে উঠল নীরা। ‘সাংসারিক চিন্তাভাবনা, বোধভাষ্যি কোনওদিনই তোমার ছিল না। তুমি এসবের কী বুঝবে! আজকালকার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার নামে বাবা-মায়ের অলক্ষ্যে বাড়ির বাইরে কী সব ঘটনা ঘটিয়ে বেড়াচ্ছে, জানো তুমি? রোজ তো টিভিতে, খবরের কাগজে দেখছ। বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কত কষ্ট করে তাদের পড়তে পাঠাচ্ছে, আর তাদের দ্যাখো, বেলেল্লাপনা করে বেড়াচ্ছে।’

‘আশ্চর্য! একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, অন্যের ছেলেদের নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কীসের? তুমি এত টেনশড কেন, খোলসা করে বলবে আমাকে?’

‘পরিষ্কার করে না বললে কি কিছু বোঝো না তুমি? বলি, আমার ঘরে দু-দুটো মেয়ে রয়েছে নাকি। সারাদিন আমরা বাড়ি থাকি না। মেয়ে দু-টো একা থাকে। চিন্তা হবে না? আর রথীনদাকেই বলি, ভাড়া দিবি, দে না বাবা, কে মানা করেছে? কিন্তু নিদেনপক্ষে একটা ফ্যামিলি দেখে তো দিতে পারত। তা নয় যত্তসব উটকো ঝামেলা,’ আপনমনে বিড়বিড় করতে থাকে নীরা।

‘কারওর সম্পর্কে কিছু না জেনে, ভুল ধারণা পোষণ করাটা ঠিক নয় নীরা। তাছাড়া ওরা পরের ছেলে, ওদের নিয়ে আমরা এত ভাবতে যাবই বা কেন? আমরা তো জানি আমাদের দুই মেয়েকে আমরা কী শিক্ষায় মানুষ করেছি। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।’ খানিক শান্ত করার চেষ্টা করলাম ওকে।

‘দ্যাখো এই বয়সটা খুব খারাপ। সামনাসামনি থাকতে থাকতে কখনও যদি কিছু ভুলচুক করে বসে! তুমি এখনই রথীনদার সঙ্গে কথা বলো। বলো ওদের বদলে ফ্যামিলি দিতে, নয়তো তুমি অন্য বাড়ির ব্যবস্থা করো। আমি এখানে থাকব না।’ আমার বোঝানোতে লাভ যে কিছু হল, নীরার কথায় তেমনটা মনে হল না।

ডিনার সেরে শুতে যাওয়ার সময়ও বাড়ি বদলানোর ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে বলল সঙ্গে চোখ-কান খোলা রাখার পরামর্শও। এমনকী রথীনদার ভাড়াটে ছেলেগুলোর সঙ্গে বেশি মাখোমাখো সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারটাও এড়িয়ে গেল না নীরা। কারণ ও জানে আমি খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে তাদের মতো করে মিশে যেতে পারি, ওটাই আমার স্বভাবসিদ্ধ বৈশিষ্ট্য। যাই হোক, ওর কথাগুলো আমায় বেশ ভাবিয়ে তুলল। নীরা যতটা ভাবছে, সত্যিই কি এতটা চিন্তার বিষয় এটা? এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই, এখন আকছার যা-সব ঘটনা শোনা যাচ্ছে, তাতে ভয়টা অমূলক নয়।

হঠাৎ-ই মিত্তির বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। এই তো দু-চারটে বাড়ির পর চোখের সামনে যা ঘটে গেল! বিজনদার সংসার বলতে তো ওই তিনজন। বিজনবাবু নিজে, ওনার স্ত্রী, আর মেয়ে সোহিনী। বিজনবাবুকে ব্যাবসার কাজে মাঝেমধ্যেই বাইরে যেতে হয়। মেয়ে আর স্ত্রী একা থাকবে, সেই কারণে চেনাজানার মধ্যেই দুজন পিজি রেখেছিলেন তিনি। দেখলে মনে হতো একেবারে ঘরের ছেলে। সেই তারাই কী পাশবিক ঘটনাটাই না ঘটাল! বিজনবাবু যখন সপ্তাহ খানেকের জন্য মধ্যপ্রদেশ গেলেন, সেই সুযোগে দুজন ছেলে মিলে সোহিনীকে একেবারে ছিঁড়ে খেল। বিজনবাবুর স্ত্রী বাধা দিতে গেলে, তাকে এমন মাথায় আঘাত করল যে, হাসপাতাল থেকে তিনি আর বেঁচে ফিরলেন না। আর মেয়েটা এখন অ্যাসাইলামে। মানসিক ভারসাম্যহীন। মনে পড়ে গেলেই গোটা শরীর শিউরে ওঠে। মানুষ কী এতটাও পাষণ্ড হতে পারে, যে নিজের বিকৃত পাশবিক কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে একটা মানুষকে খুন করতেও হাত কাঁপে না তাদের।

ধাতস্ত হতে খানিক সময় লাগল। তখন মনে হয় এসব নেতিবাচক চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়া একেবারেই উচিত নয়। সবাই তো আর সমান নয়। উলটোটাও তো হতে পারে। আমি কালই বাচ্চাগুলোর সঙ্গে কথা বলব। রবিবারও আছে, ওদের পরখ করার জন্য সারাটা দিন সময় পাব। তারপর না হয় যা ডিসিশন নেওয়ার নেব।’

পরদিন সকালে বাজার সারার পর ইচ্ছা করেই ঘরের দরজাটা খুলে রাখলাম। ওখানেই খবরের কাগজটা হাতে একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়লাম। লক্ষ্য করলাম জনাচারেক ছেলে, বয়স আনুমানিক বাইশ কী তেইশ হবে। তাদের প্রয়োজনে আসা-যাওয়া করছে কিন্তু আমার ঘরের দিকে উঁকিঝুঁকি মারার মতো প্রবৃত্তি কারওর মধ্যে দেখলাম না, বরং ওদের একজনের সঙ্গে চোখাচোখি হতে ভদ্রতার খাতিরে একটু মুচকি হাসল ছেলেটি। আমি-ই আগ বাড়িয়ে বললাম, ‘নাম কী?’

‘সরি আঙ্কল কিছু বললেন?’ বোধকরি ঠিক শুনতে পায়নি।

‘বলছি নাম কী?’

‘ওঃ নাম! অভীক।’

‘অভীক কী?’

‘আজ্ঞে অভীক রায়।’

‘বাড়ি কোথায়?’

‘মুর্শিদাবাদ’।

‘দেখেছ আমিও কেমন, তোমাকে বাইরে দাঁড় করিয়েই…। এক কাজ করো বন্ধুদের নিয়ে চলে এসো। চা-জলখাবার খেয়ে যাও। তখনই না হয় কথা হবে। পাশাপাশি যখন থাকতেই হবে তখন একে-অপরকে জেনে রাখাই ভালো, কী বলো ইয়ং-ম্যান? যাও যাও বন্ধুদের ডেকে নিয়ে এসো।’

নীরার পারমিশন ছাড়াই বাচ্চাগুলোকে চা-জলখাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি শুনলে, ও যে খুব একটা খুশি হবে না সেটা আমি ভালো মতোই জানি। তার চেয়ে চুপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। ওরা এলে অনাদর করবে না নীরা, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

হলও তাই। এক এক করে চারজন ছেলেই ‘নমস্কার আঙ্কল’ বলে ঘরে প্রবেশ করল। তার মিনিট পাঁচেক পরে চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল নীরা। সঙ্গে চারটে প্লেটে সকালের বানানো লুচি তরকারি। সকলকে ভাগ করে দিল নীরা। দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। বোধকরি এতটাও আশা করিনি।

কথায় কথায় ওদের পরিবার, ঠিকানা, যোগাযোগের নম্বর সমস্ত কিছু জেনে নিলাম। একবারও মনে হল না ছেলেগুলোর কোনও বদ মতলব আছে, বরং প্রত্যেককেই সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুশিক্ষায় শিক্ষিত বলেই মনে হয়েছে। মনে হয়েছে সত্যিই এই নম্র-ভদ্র ছেলেগুলি চাকরির জন্য পড়শোনা করতেই এসেছে, বেলেল্লাপনা করতে নয়।

নীরা খানিক আশ্বস্ত হল বটে তবে মা তো, কিন্ত কিন্তু একটা থেকেই যায়। সাধারণত বাচ্চারা একটু মায়েদের কোল-ঘেঁষা হয়, যার কারণে মায়েরা, বাবাদের তুলনায় বাচ্চাদের সঙ্গে বেশি অ্যাটাচ্ড। তাই একটু বাড়তি সচেতনতা– প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরোনো যাবে না, ব্যালকনিতে দাঁড়ানো যাবে না, বেশি হাসাহাসি, কোলাহল চলবে না, আরও অনেক কিছু।

ওদিকে যে-ছেলেগুলোর জন্য এত বাধা-নিষেধ, তারাই দিনের বেশির ভাগ সময়টা কাটায় কোচিং সেন্টারে। রাতটুকু বাড়িতে থেকে সকালে সেই একই রুটিন। ওদের কারণে আমাদের দিনচর্যার যে খুব একটা তফাত কিছু হয়েছে এমনটা নয়। উলটে কিছু কিছু বিষয়ে আমরা ওদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। ইন্টারনেটে কোনও কিছু জানার থাকলে, মোবাইলের কোনও সমস্যা হলে ওদের কাছে ছুটে যাওয়া। ওরাও পাড়াপড়শিদের মতো কখনও সখনও ‘আন্টি চা চাই চিনি চাই’। সম্পর্ক বলতে এই।

কিছুদিন পরে আমাদের ছেলেটা বড়ো হবে। তাকেও পড়াশোনার জন্য বাইরে থাকতে হতে পারে। তখন আমরাও তো চাইব সে যেখানে থাকবে, আশপাশের লোকেরা যেন তাকে ভালোবাসে। সেই কারণে ওদের সঙ্গে ছেলের মতো ব্যবহার করি আমি।

মাস চার-পাঁচেক এইভাবেই কেটে গেল। নীরাও এখন অনেকটা আশঙ্কামুক্ত। ছেলেগুলোকে দেখলে আজকাল আর মুখ ব্যাজার করে না। কিছু চাইতে এলেও বিরক্তি দেখি না ওর মুখেচোখে। সামনের রবিবার বাবুর জন্মদিন। বাবুর কয়েকজন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। মনে মনে ভাবছিলাম ছেলেগুলোকেও যদি বলা যেত। বলব বলব করে সাহস করে আর নীরাকে বলা হয়ে ওঠেনি। রাত্রে খেতে বসে নীরা নিজেই বলে বসল, ‘বলছি, রবিবার ছেলেগুলো বাড়ি থাকবে। না বললে কেমন একটা দেখায় না?’

বললাম, ‘আমিও তোমায় কথাটা বলব বলব ভাবছিলাম। ঠিক আছে। গৃহমন্ত্রীর পারমিশন যখন পেয়ে গেছি, কাল সকালেই ওদের বলে দেব।’ বলে রাত ররটা নাগাদ শুতে চলে গেলাম। নীরার কথা শুনে মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল।

সেই রাতেই যত বিপত্তি। রাত দুটো নাগাদ হঠাৎই মনে হল ঘরের মধ্যে কারা যেন কথা বলছে। দরজা খোলারও আওয়াজ হল। উঠে এসে দেখি, বড়ো মেয়ে ঈশিতা আর ছেলে বাবু, হন্তদন্ত হয়ে ঘরের মধ্যে এদিক-ওদিক কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাইরের দরজাটা হাট করে খোলা। সামনের ফ্ল্যাটের অরুণাভ আর মোহিতও ওদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করছে। বেশ চিন্তিত লাগল দুজনকে। কিন্তু এত রাতে এরা বাইরে কেন? কী করছে? ছুটে গেলাম ঈশির কাছে, ‘কী হয়েছে? তোরা এত রাতে এখানে কী করছিস? সুমি কোথায়? আর এত রাতে দরজাটাই বা কেন খোলা?’ হাজারো প্রশ্নে ঘাবড়ে গেল দুই ভাইবোন। কোনওমতে জবাব দিল, ‘বাবা, সুমি কোথাও নেই।’

‘কী বলছিস পাগল-টাগল হলি নাকি? বাথরুমে গেছে হয়তো। না দেখেই…’ ঝাঁঝিয়ে উঠল নীরা।

‘না মা বাথরুম যাব বলেই, উঠে দেখি, সুমি ঘরে নেই। ভাবলাম, বাথরুমে গেছে হয়তো। সেখানেও নেই। সব জায়গায় দেখেছি।’

এক মুহূর্তে মনে হল পায়ের তলায় আর মাটি নেই। সেই সময়ই নীরা বলে বসল, ‘মানসম্মান আর রইল না আমাদের। বিশ্বাসের এই মর্যাদা দিল ছেলেগুলো!’ কথাটা শোনা মাত্রই মাথায় রক্ত চড়ে গেল। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গেলাম পাশের ফ্ল্যাটে। দরজাটা খোলাই ছিল। চারজনের মধ্যে দুজন সামনেই দাঁড়িয়েছিল। বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল ওরা।

‘অভীক আর সুমন কোথায়?’ চিৎকার করেই জিজ্ঞাসা করলাম।

প্রত্যুত্তরে দু’জন একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আঙ্কল ওরা একটু বেরিয়েছে। এক্ষুনি চলে আসবে।’

‘এত রাতে বেরিয়েছে। আমায় শেখাচ্ছ। ভালো চাও তো বলো আমার মেয়েকে ওরা কোথায় নিয়ে গেছে। নয়তো সবকটাকে জেলে ভরে দেব।’

‘আঙ্কল আপনি ভুল করছেন। ওরা সুমিকে নিয়ে কোথাও যায়নি।’ অরুণাভ থতমত খেয়ে জবাব দিল।

‘ভুল হচ্ছে ভুল! তোমরা কেমন করে জানলে যে সুমিই বাড়িতে নেই? আমি তো তোমাদের বলিনি।’ নিজের স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আপন করে নিয়েছিলাম ছেলেগুলোকে। আর ছেলেগুলো আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে মুখে একেবারে চুনকালি লেপে দিল, ভেবেই যেন আরও ক্ষিপ্র হয়ে উঠলাম আমি। সামনে রাখা ব্যাটটা নিয়ে সপাটে চালাতে শুরু করলাম।

নিজেদের বাঁচাতে ওরাও বলপ্রয়োগ করল আমার উপর। সজোরে হাত থেকে ব্যাটটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল মোহিত। ওরাও উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল।

‘আপনার বয়সের কথা ভেবে এতক্ষণ চুপ ছিলাম, কিন্তু আর নয়। শুধুমাত্র আপনার সম্মান বাঁচাতে অভীক আর সুমন এত রাতে ঝুঁকি নিয়ে দৌঁড়োল, আর আপনি পিঠ চাপড়ানোর বদলে দোষারোপ করছেন? আন্টি তো সবসময় আমাদের সন্দেহ করে। আমরা না হয় বাজে ছেলে, কিন্তু আপনার মেয়ে তো খুব ভালো, সচ্চরিত্র তাহলে এমন দিন দেখতে হল কেন আপনাদের? আপনার ছোটো মেয়ে আমার বন্ধুদের সঙ্গে নয়, পাড়ার এক বখাটে ছেলের সাথে ভেগেছে। ওকে নিয়ে ফিরলেই সব জানতে পারবেন।’

শুনে অবাক হয়ে গেলাম। ছেলেগুলো কী বলছে! সত্যি কী মিথ্যে– দোটানায় পড়ে গেলাম। এমন সময় পেছন থেকে নীরা ভাঙা গলায় বলে উঠল, ‘এদের কথায় ভুলো না। এসব এদের চাল। এখনও সময় আছে, তুমি পুলিশে ফোন করো।’

‘প্লিজ আঙ্কল বিশ্বাস করুন, আপনি যেমনটা ভাবছেন ব্যাপারটা তা নয়। এত রাতে পুলিশ এলে সবাই সব জেনে যাবে, তাতে বদনাম আপনাদেরই হবে। তার চেয়ে আমাদের উপর একটু বিশ্বাস রেখে মিনিট দশেক অপেক্ষা করেই দেখুন না, ততক্ষণে যদি ওরা না ফেরে তখন না হয় যা ডিসিশন নেওয়ার নেবেন।’ বোঝানোর চেষ্টা করল মোহিত।

সত্যি বলতে কী, ওদের উপর বিশ্বাস করে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা ছিল না। হতভম্বের মতো সামনে রাখা চেয়ারটায় বসে পড়লাম। আমার অবস্থা দেখে বোধহয় ওদেরও করুণা হল। মোহিত গলার স্বর নামিয়ে বলতে থাকল, ‘আঙ্কল আপনি তো জানেনই আমাদের রাত জেগে পড়ার অভ্যাস রয়েছে। বেশ কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম, মাঝরাতে সুমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে ফিসফিস করে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। সত্যি বলতে কী আমরা অত গুরুত্ব দিইনি। লাস্ট দু-তিনদিন রাত্রিবেলা দু’টো ছেলে বিল্ডিংয়ের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল। আপনাকে বললে আপনি কীভাবে নেবেন, আদৌ বিশ্বাস করবেন কিনা, এই নিয়ে আমরা আজকেও পড়তে পড়তে আলোচনা করছিলাম। এমন সময় একটা গাড়ির আওয়াজ কানে এল। অভীক তখন ঘুম কাটানোর জন্য ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। হঠাৎই ছুটে এসে দরজাটা খুলতে খুলতে বলল, ‘মনে হয় সুমি ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে পালাচ্ছে। আমি ওকে এতবড়ো ভুল করতে দেব না। আমি এখুনি ওকে নিয়ে আসছি।’ ওকে একা যেতে দেখে সুমনও ওর পিছু পিছু ধাওয়া করল। আপনাকে কীভাবে জানাব, এসব ভাবতে ভাবতেই আপনি নিজেই জেগে গেলেন।’ খানিক থেমে আবার বলতে শুরু করল মোহিত, ‘এই অজানা শহরে আপনার থেকে যে স্নেহভালোবাসা পেয়েছি, তা তো ভোলার নয় আঙ্কল। তাছাড়া ঈশিতা, সুমিকে কোনওদিন নিজের বোন ছাড়া অন্য চোখে…।’

মোহিতের কথা শেষ হওয়ার আগেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল অভীক আর সুমন। সঙ্গে ভীতসন্ত্রস্ত সুমি। সুমির হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিল অভীক। আমার দিকে এগিয়ে এসে সুমির হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নিন আপনার মেয়ে। জানেন আঙ্কল পাড়ার ওই বখাটে সঞ্জুর সঙ্গে পালাচ্ছিল আজ। আর ছেলে পেল না ও! রাগে কয়েক ঘা দিয়েও দিয়েছি। জীবনটা কী ছেলেখেলা নাকি? এমন একটা পদক্ষেপ নেওয়ার আগে একবারও আপনার কথা ভাবল না। আমি ভেবে অবাক হয়ে যাই, যে মানুষটা অন্যের ছেলেকে এমন উদার ভাবে ভালোবাসতে পারে, নিজের করে নিতে পারে, সে তার নিজের সন্তানকে কত ভালোবাসে। আর এই মেয়ে কিনা…’ বলেই সুমির দিকে থাপ্পড় মারার ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল অভীক।

হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিলাম আমি। নীরাও। ‘হ্যাঁ বাবা মারো। বড়ো দাদা হয়ে তোমরা শাসন করবে না তো কে করবে। আমাদের আর আছেটাই বা কে?’

সেদিন একটাও কথা বলতে পারেনি নীরা। বলার ছিলটাই বা কী?

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...