মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই বিপ্লবের মনে পড়ল আজকের রাতটাই শেষ, তারপর থেকে পুরো একা। আচ্ছা পুরোপুরি একার জীবনটা ঠিক কেমন কাটবে? আদৌ কি কাটাতে পারবে ও? কথাটা ভাবতেই হাসি পেল। স্রেফ বোকা বোকা ভাবনা। পারলেও কাটাতে হবে, না পারলেও। আচ্ছা ঈশানীও কি একই কথা ভাবছে এখন? নাকি ঘুমোচ্ছে? ইচ্ছে থাকলেও জানার উপায় নেই। যদিও ঈশানী আর বিপ্লবের মধ্যে দূরত্ব মাত্র একটা দেয়ালের। কিন্তু সেই দেয়াল যতটা না দৃশ্যত তার থেকে অনেক বেশি অদৃশ্য।
বিপ্লব আর ঈশানীর আজ একসঙ্গে থাকার শেষ রাত। অবশ্য একসঙ্গে থাকা শব্দটা না বলে বরং এক ছাদের নীচে থাকার শেষ রাত্তির বলাই ভালো। কারণ একসঙ্গে থাকার রাত্তিরগুলো শেষ হয়ে গিয়েছিল প্রায় মাস চারেক আগে। কিংবা আরও একটু আগে থেকেই। সেই যবে থেকে অশান্তি শুরু হয়েছিল। সেইসব দিনগুলো ঝগড়া, অশান্তি, কান্নার সন্ধে, রাতগুলো…। উফফফ…!
কথাটা মনে হতেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল বিপ্লব। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। এখন মার্চ মাসের শুরু। ভরা বসন্তকাল। শেষ রাতের দিকে শীত এসে জানলার পাশে দাঁড়ায়। এখনও সে কিছুটা রয়ে গেছে সেই খবর দিতে। কাচের শার্সির ওপারে ঘন অন্ধকার আর শিরশিরে ঠান্ডা দাঁড়িয়ে। বিপ্লবের ইচ্ছে হল কাচের জানলাটা খুলে সেই অন্ধকার আর শীতলতা গায়ে মাখতে। খুলতে গিয়েও খুলল না।
থাক। অনেকদিন আগে, অনেক অনেক দিন আগে- এমনই একটা ঘন মাঝরাতে আদর শেষ করে আদিম ভাবে ও আর ঈশানী এসে দাঁড়িয়েছিল এই জানলাটার সামনে। এমন অন্ধকার ছিল বাইরেটা। ঈশানী কাচের জানলা খুলে দিতেই ঠান্ডা নরম হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরেছিল ওদের দুজনকে। তারপর প্রায় ভোররাত পর্যন্ত দুজন দুজনকে ওইভাবে জড়িয়ে থেকে পরস্পরের শরীরের ওম নিয়েছিল। মনে হয় যেন গত জন্মের কথা…। একটা জীবনের মধ্যেই মানুষের কতগুলো জন্ম যে লুকিয়ে থাকে…
জানলার সামনে থেকে সরে এল বিপ্লব। মন খারাপ লাগছে। কেমন যেন এলোমেলো লাগছে সব। আবার পুরোটা ভাবতে চেষ্টা করতে শুরু করল। সত্যিই কি ওর কোনও দোষ ছিল? ছিল হয়তো কিংবা ছিল না। আর ভেবে লাভ নেই। সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।
তারপরেও আরেকবার ভাবার চেষ্টা করতে থাকল। আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগের কথা। ছয় বছর। কম্পিটিটিভ এক্সামের ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে দুজনের পরিচয়। পরিচয় গড়িয়ে বছর দুয়েকের প্রেম। প্রেম গড়িয়ে চার বছর আগে বিয়ে। ততদিনে বিপ্লবের সরকারি ব্যাংকে চাকরি। গড়িয়াতে টু বিএইচকে ফ্ল্যাট নেওয়া। ঈশানীর সরকারি চাকরি পাওয়ার যে খুব ইচ্ছে ছিল তা নয়। সরকারি চাকুরে বাবার জোরাজুরিতে ভর্তি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু মনপ্রাণ পড়ে থাকত গ্রুপ থিয়েটারে। ছোটোবেলা থেকে শখ। কলকাতার একটা নামকরা গ্রুপে ছিল। মাঝে মাঝে টুকটাক টিভি সিরিয়ালেও কাজ করেছে। বিয়ের আগে ঈশানী বারবার একটাই শর্ত রেখেছিল বিপ্লবের কাছে, আমার বাবার মতো তুমিও বলবে না তো অভিনয় করা, গ্রুপ করা ছেড়ে দিতে?
আমি তো ভাবছি আমিও তোমাদের গ্রুপে ভিড়ে যাব। আরেকটু বেশি সময় থাকতে পারব তোমার সঙ্গে। তখন হেসে বলত বিপ্লব।
কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই যখন আবার পুরোদমে নিজের অভিনয় জগতে ফিরে গেল ঈশানী, তখন থেকেই একটু একটু করে মনের অনেক ভেতরে একটা ক্ষোভ জমতে শুরু হয়েছিল বিপ্লবের। জমতে জমতে পাথর, পাথর জমে পাহাড়। দিন নেই রাত নেই রিহার্সাল। তারপর আজ বাঁকুড়াতে শো তো কাল আকাদেমি, বাড়ি ফেরার কোনও সময়ের ঠিক নেই। দিন রাত সব এক। ক্ষোভটা একসময় প্রকাশ পেতে শুরু করল।
ঈশানী প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো, সংসারটা এইভাবে চললে কিন্তু একদিন সব ভেসে যাবে।
কী চাইছ তুমি, আমি সব ছেড়ে দিই?
তা বলছি না। কিন্তু একটু কম করলে কি হয় না?
না হয় না। এটা আমার প্রফেশন। আর তা ছাড়া বিয়ের আগে থেকেই তুমি কিন্তু সব জানতে।
হ্যাঁ জানতাম, কিন্তু এতটাও জানতাম না, তাহলে…
কী তাহলে?
কিছু না।
দিনে দিনে অসহ্য হতে শুরু করল। তীব্রতা বাড়তে বাড়তে একটা সময়ে দুজনেই বুঝল এই সম্পর্কটার আর কোনও অর্থ নেই। শুধুমাত্রই এক ছাদের নীচে থাকা। দুজনের শোবার ঘর আলাদা হয়ে গিয়েছিল আগেই। মন আলাদা হয়েছিল তারও অনেক আগে। তবু সামাজিক ভাবে থাকতে থাকতে একসময় দুজনেই বুঝল দিনের পর দিন এই অভিনয়ের কোনও মানে হয় না। এতে কষ্ট আরও বাড়ে। সুতরাং পাকাপাকি ভাবে আলাদা হয়ে যাওয়াই সততা।
সেই সিদ্ধান্তের আজই শেষ দিন। শেষ রাত। নিজের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিয়েছে ঈশানী। আর বহুদিন পর আজ সারাটা দিন পরস্পর দুজনের সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেছে।
সকাল হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকল বিপ্লব।
কলিংবেলটা ননস্টপ বাজছে। এত সকালে আবার কে এল? রান্নার মাসিকে আজ আসতে বারণ করে দিয়েছিল বিপ্লব। যদিও সে সবই জানে তবু চোখের সামনে বাড়ির বউ চলে যাচ্ছে সেটা দেখাতে চায়নি ও। তাই রান্নার লোক, কাজের মাসি আজ দুজনেরই ছুটির দিন। তাহলে কে?
বিপ্লব দরজাটা খুলল। আর খুলতেই চূড়ান্ত বিস্ময়। সমীরণ! তাও আবার একা নয়, সঙ্গে ওর স্ত্রী, সায়ন্তনী।
কী রে ভূত দেখছিস নাকি? সর, ভেতরে ঢুকব। একগাল হেসে বলল সমীরণ। বিপ্লবের অনেকদিনের বন্ধু।
বিপ্লব খানিকটা হতভম্ব হয়ে দরজাটা খুলতেই হইহই করে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল সমীরণ, তারপর ওর সেই স্বভাবসিদ্ধ বাজখাঁই গলায় কোথায় তোর বউ? ডাক ওকে। বলে নিজেই ডাকতে শুরু করল, ঈশানী ও ঈশানী গেলে কই? আমরা এসে গেছি। এমন ভাবে বলল যেন ওর আসার কথা আগে থেকেই বলে রাখা ছিল। সমীরণটা চিরকালই এমন। হুল্লোড়বাজ। ধীরে সুস্থে কিছু করতে পারে না। সবকিছুতেই হইহই। অবশ্য ওর এই স্বভাবের জন্যই সেই কলেজ লাইফ থেকে ও খুব জনপ্রিয় ছিল। একডাকে চিনত সকলে। কলেজের সোশাল কিংবা প্রিন্সিপাল ঘেরাও, অ্যানুয়াল ফেস্ট কিংবা ইউনিয়নের চাঁদা তোলা– সব কিছুতেই এগিয়ে ছিল সমীরণ। দারুণ মজাদার, দেখতে সুন্দর বলে মেয়েদেরও নয়নের মণি ছিল ও। তবে প্রেমে অ্যালার্জি ছিল ওর। বক্তব্য ছিল ওসব লাইনে আমি নেই ভাই। প্রেমে বহুত টাইম দিতে হয়। আর আমার কাছে নো টাইম ফর দ্যাট।
সত্যি সত্যিই অনেক অফার আসা সত্ত্বেও কোনও প্রপোজাল অ্যাকসেপ্ট করেনি কখনও। বরং একেকটা মেয়ের অফার নিয়ে রীতিমতো মজা করত, অপদস্থ করত তাকে। তাতেই মজা পেত।
বন্ধুরা বলত এই যে তুই এত লোভনীয় অফার হেলায় হারাচ্ছিস একদিন এর জন্য তোকে পস্তাতে হবে দেখিস। মেয়েদের দীর্ঘশ্বাসের ফল কিন্তু মারাত্মক।
শুনে হো হো করে হাসত সমীরণ।
সেই সমীরণও একদিন বিয়ে করল এবং রীতিমতো সম্বন্ধ করেই ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে করল। সমীরণ চাকরি করত একটা বেসরকারি স্কুলে। ইংরেজি পড়াত। আর ওর স্ত্রী গভর্নমেন্ট স্কুলের ইতিহাসের টিচার। সত্যি বলতে সমীরণের বউকে মোটেও সুন্দর দেখতে নয়। অন্তত সমীরণের পাশে তো একেবারেই বেমানান। তাই নিয়ে বিপ্লব আর ওর বন্ধুরা মিলে বিস্তর আলোচনা করেছে। কানাঘুষোয় যেটা জানা গিয়েছিল যে সমীরণ নাকি কিছু একটা কেসে ফেঁসে গিয়েই বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু সেটা সকলের কাছে গোপন রেখেছিল বলেই কেউ সরাসরি ওর কাছ থেকে কিছু জানতে পারেনি। তাও এইসবই প্রায় বছর তিনেক আগের কথা।
তারপর প্রায় বছর খানেক হয়ে গেল সমীরণ আচমকা ডুব। কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই। যদিও বন্ধুদের মধ্যে বিয়ের পরেও সব থেকে বেশি যোগাযোগ রাখত ওই। ওর মাধ্যমেই বাকি বন্ধুদের হালহকিকত জানা যেত। সেই সমীরণই যখন আচমকা সকলের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করে দিল তাই নিয়েও অল্পবিস্তর আলোচনা হয়েছিল বন্ধুদের মধ্যে। তারপর যা হয় আর কি। কিছুদিনের মধ্যেই আবার যে যার জগতে। ভুলেই গেছিল সকলে। বিপ্লবও।
সেই সমীরণ আজ আবার সামনে। তবে প্রথমে দেখেই একবারে চিনতে পারেনি বিপ্লব। একটু সময় লেগে গেছিল। সেই সুন্দর চেহারাটা একেবারে ফুলে বেগুন। মুখটাও ফুলে ঢোল। চোখের তলায় কোলেস্টেরলের কোলবালিশ। শুধু যেন বাইরের হইহই-টাই রয়ে গেছে। আসল সমীরণ গেছে হারিয়ে। অবশ্য এমনটা না-ও হতে পারে, পুরোটাই বিপ্লবের ভ্রম। পৃথিবীর দুখী মানুষেরা বাকি সকলকেই দুখী দেখতে চায়।
কিন্তু তার থেকেও বড়ো সমস্যা হল এই আজকের দিনে সমীরণের সস্ত্রীক চলে আসা। হতচ্ছাড়াকে এতদিন পর আজই আসতে হল! একটু পরেই হয়তো ও সব জেনে যাবে। তারপর কী করবে কে জানে! আচ্ছা মুশকিল তো। পুরো অকওয়ার্ড সিচুয়েশন।
কোথায় রে তোর বউ কোথায় লুকোল, শিগগির ডাক। আর তুই চটপট বাজারে যা। ভালো করে বাজার করবি। আজ আমরা কিন্তু দুপুরটা এখানেই কাটাব। যাব সেই বিকেলে।
সে তো খুবই ভালো কথা, কিন্তু আগে একটা ফোন তো করতে পারতিস।
হুঁ পারতাম। বাট করিনি। এমনকী তোর এখান থেকে সন্ধেবেলায় যাব আরেকজনের বাড়িতে। রাত্রে ওর ফ্ল্যাটেই থাকব। ওদেরও কিছু বলিনি। গিয়ে ব্যাটাদের চমকে দেব। তবে কাদের কাদের বাড়ি যাব জিজ্ঞেস করিস না। বলব না। পরে সব জানবি।
তা এমন প্ল্যানের কারণ? জিজ্ঞেস করল বিপ্লব।
ধীরে বৎস ধীরে, সব বলে দিলে কী করে হবে? বললাম তো সব ক্রমশ জানবি। আরে ও ঈশানী তুমি গেলে কই? হ্যাঁ রে তোর বউ বাড়িতে নেই?
হুঁ আছে তো। ওর ঘরে… বলেই থমকে গেল বিপ্লব।
ওর ঘরে মানে? তোরা কি আলাদা আলাদা ঘরে থাকিস নাকি?
আরে না না মানে অন্য ঘরে।
দাঁড়াও আমি ডাকছি, কোনদিকে ঘরটা? জিজ্ঞেস করল সায়ন্তনী।
অ্যাঁ…
আরে ঘরটা বলো। অ্যাঁ, কি?
বাধ্য হয়ে আঙুল তুলে বিপ্লব ওর ঘরের পাশের বন্ধ দরজাটা দেখাল।
দরজার সামনে গিয়ে টোকা দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল ঈশানী। একেবারে ঠিক সময় বুঝেই বেরিয়েছে। বিপ্লব টেনশনে ছিল ঈশানীর রিয়্যাকশনটা ঠিক কেমন হবে। হয়তো খারাপ কিছু, সকলকে অপ্রস্তুত করে দেওয়ার মতো কিছু। কিন্তু না, একেবারে স্টেজের মতোই নিখুঁত অভিনয় করল। দরজা খুলেই একগাল হাসি দিয়ে বলল, ওরেব্বাবা এত সকাল সকাল অতিথির আগমন যে। ব্যাপার কি?
এই একটু হনিমুনে বেরিয়েছি দুজনে। বলে সায়ন্তনীর হাত ধরল সমীরণ। দেখে এক মুহূর্তের জন্য বুকের ভেতরটা অকারণে চিড়িক করে উঠল বিপ্লবের। আর এক পলকের মধ্যে চোখাচোখি হল ঈশানীর সঙ্গে। দেখে মনে হল না ঈশানীর মধ্যে ওই দৃশ্যের কারণে কোনও ভাবান্তর হয়েছে।
খুব ভালো করেছিস। কিন্তু চেহারাটার এমন অবস্থা করলি কী করে?
সঙ্গদোষে ভাই। বলেই সায়ন্তনীর দিকে তাকাল সমীরণ। দুপুরে কী খাওয়াবি বল?
বিপ্লব অকূলপাথারে পড়ল। কি বলবে ভেবে পেল না। ঈশানী কি এখনই বেরিয়ে যাবে? ভাবতে ভাবতেই দেখল সায়ন্তনী ঈশানীর ঘরের দিকে এগোচ্ছে। তোমাদের বাড়িতে সেই একবারই এসেছিলাম বিয়ের পর। ওর কাছে শুনেছি তোমরাও এখনও আমাদের মতো ঝাড়া হাত পা? তা ফ্যামিলি প্ল্যানিং আর কতদিন?
সায়ন্তনীর কথা শুনে সামান্য হাসল ঈশানী। উত্তর দিল, দেখি কতদিন।
এই, তোমরা কোথাও বেরোনোর প্ল্যান করছিলে নাকি? সায়ন্তনীর কথায় চমকে উঠল বিপ্লব।
কেন?
ঘরে বড়ো বড়ো বাক্স রাখা দেখছি খাটের উপর।
হ্যাঁ একটু বেরোনোর ছিল। ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিল ঈশানী।
এবাবা তাহলে তো সত্যিই ভুল দিনে চলে এসেছি। পরে একদিন… বলে থামল সায়ন্তনী।
অন্যদিনে কি আর আসার সুযোগ পেতাম আমরা, বলে জোর করে হাসল সমীরণ।
আরে বাবা কোনও ব্যাপার না। আমরা দুজনে কোথাও যাচ্ছিলাম না। আমারই একা এক জায়গায় যাওয়ার ছিল। সেটা বিকেলে গেলেও চলবে।
একা? মানে? এই এত বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে একা একা নিরুদ্দেশে যাচ্ছিলে কোথায়? ঈশানীকে জিজ্ঞেস করল সায়ন্তনী।
সায়ন্তনীর প্রশ্নে বিপ্লব কাঠের পুতুলের মতো স্থির হয়ে থাকল। এর কী উত্তর দেবে ঈশানী, তার অপেক্ষা করতে থাকল।
কিছু না, একটা শো আছে, সেই কারণেই। বিকেলে বেরোলেও হবে।
নাহ্, অভিনয়টা সত্যিই নিখুঁত পারে ঈশানী। কী অবলীলায় বলতে পারল এত বড়ো মিথ্যাটা, কিন্তু একটা ব্যাপারে ও মনে মনে অবাক হচ্ছিল যে, সমীরণ যেহেতু ওর বন্ধু তাই ওর কাছে নিজের পরিবারের দৈন্য লুকানোর একটা দায় আছে, কিন্তু ঈশানীর সেই দায় নেই, এমনকী ওদের দুজনের সঙ্গে কোনও ঘনিষ্ঠতাও নেই কোনওকালে। তাহলে এই লুকোচুরি কেন? নেহাতই সৌজন্য? আশ্চর্য!
যা যা ব্যাটা জমিয়ে বাজার করে নিয়ে আয়। বলল সমীরণ।
হ্যাঁ যাচ্ছি। তুই যাবি সঙ্গে?
খেপেছিস? আমি আজ বউ ছাড়া এক মুহূর্তও থাকছি না।
কেন রে আজ ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি নাকি তোর?
উঁহু। তার থেকেও বড়ো ব্যাপার। পরে জানবি। এখন যা বেরো। আমরা তিনজনে মিলে একটু গল্প করি।
কিচেনে ঢুকে বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বিপ্লব ভাবল আজ সকালটা কেমন হওয়ার ছিল আর কেমন হতে চলেছে। সমীরণরা না আসলে হয়তো এতক্ষণে ঈশানী চলেও যেত। কিন্তু বদলে যেটা হল তা আরও ঘাঁটা কেস। পুরো একটা জগাখিচুড়ি সিচুয়েশন। ব্যাগটা হাতে নিয়ে ফিরতেই চমকে উঠল বিপ্লব। সামনে ঈশানী দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুজনে মুখোমুখি হল। দুজনেই চুপ।
কিছু বলবে?
তোমার বন্ধু চিংড়ি খেতে চাইছে সেটাই বলতে এলাম।
আচ্ছা। বলে একটু থেমে বিপ্লব বলল, সরি, আমি আসলে জানতাম না ওরা এইভাবে চলে আসবে।
ইটস ওকে।
তোমার প্রবলেম হচ্ছে বুঝতে পারছি।
আমি বিকেলে যাব।
থ্যাংকস, মুখ থেকে বেরিয়ে গেল বিপ্লবের। যেভাবে মানুষ পরিচিত কিংবা স্বল্প পরিচিত মানুষের কাছ থেকে উপকার পেলে বলে ওঠে, সেইভাবেই বলল।
তার উত্তর দিল না ঈশানী। সমীরণ আর সায়ন্তনী এখন ড্রয়িংরুমে বসে। ওদের গলার শব্দ আসছে। এই সাতসকালে অন্যের বাড়ি এসে এত ফুর্তির কী আছে ভেবে পেল না বিপ্লব।
ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে এল। অন্যমনস্ক ভাবেই বাজার করছিল আর বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল অনেক পুরোনো দিনগুলোর কথা। ঈশানীর কথা, সমীরণের কথা, কলেজ জীবনের সেই দিনগুলো। অনেক অনেক কথা। সব কেমন যেন হয়ে গেল জীবনটার।
ঈশানীর সঙ্গে অশান্তি খুব বেশিদিন এগোয়নি। আসলে ওদের দুজনেরই লড়াই ঝগড়া এইসব করতে রুচিতে বাধে। তবে দুজনেই বুঝতে পারছিল, হচ্ছে না, এইভাবে আর খুব বেশিদিন নয়। আর বেশিদূর এগোনো যাবে না। কিন্তু সেই কথাটা কে কবে বলবে তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতেই একদিন ছুটির দিন সকালে ঈশানী নিজেই দায়িত্ব নিয়ে বলেছিল বিপ্লবকে। তোমার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।
কী কথা শোনার আগেই বুঝে গিয়েছিল বিপ্লব। যেভাবে বোঝা যায়। তবু বসেছিল, শুনেছিল সবটা। তারপর বলেছিল ওকে। আমার কোনও আপত্তি নেই।
আপাতত ডিভোর্স নয়, তবে সেপারেশন। ঈশানী ওর গ্রুপেরই একটি মেয়ের সঙ্গে তার মেসে রুম শেয়ার করে থাকবে।
সেই আলোচনা হয়েছে প্রায় দিন দশেক আগে। হ্যাঁ ঠিক দশ দিন আগেই।
বাজার থেকে বাড়িতে আসতেই হাউ হাউ করে উঠল সমীরণ। কী রে এত দেরি! আমরা তো ভাবলাম বাজার করতে গিয়ে পালালি বুঝি। যা চিপকুস তুই। বলে নিজেই হো হো করে হেসে উঠল। বিপ্লব সামান্য হেসে বলল নাহ্, কোথায় আর পালাব? আমার পালানোর কোনও জায়গা নেই। বলে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে কিচেনে ঢুকল। ওর পিছনে আসল ঈশানী। ওকে দেখে বিপ্লব নীচু গলায় বলল, সরি, তোমায় খুব প্রবলেমে ফেলে দিলাম। রান্নার লোকও আজ আসবে না।
ইটস ওকে। তুমি ওদের কাছে গিয়ে বসো, আমি সামলে নিচ্ছি। বিপ্লব অবাক হচ্ছিল, এই মেয়েটাই আজ চলে যাচ্ছিল, হয়তো… হয়তো না, সত্যিই চলে যাবে চিরকালের জন্য বিপ্লবকে ছেড়ে, অথচ এত ক্যাজুয়াল রয়েছে কী করে। কই বিপ্লব তো এমন সহজ হতে পারছে না, বারবার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। আচ্ছা এমনটা কি ঈশানীও ভাবছে? না নিশ্চয়ই ভাবছে না। বিপ্লব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঈশানীকে, পারল না।
কিচেনের সামনে এসে দাঁড়াল সায়ন্তনী। কী ব্যাপার কত্তা-গিন্নিতে কি ফুসুর ফুসুর হচ্ছে? যান আপনি বন্ধুর সঙ্গে গপ্পো করুন গে আমরা এদিকটা দেখছি।
নাহ্ গুজুর গুজুর আর কি?
থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। কতদিন বিয়ে হল যে এখনও ফিসফিসে প্রেমের কথা ফুরোল না? মুচকি হেসে বলল সায়ন্তনী।
উত্তর দিল না বিপ্লব। ঈশানীও কিছু বলল না। ম্লান হেসে সরে এল বিপ্লব। সমীরণের কাছে গেল। সামনে যেতেই কথার ফুলঝুরি শুরু।
সারাদিন কেটে গেল গল্পে, খাওয়াদাওয়া, পুরোনো সব কথায়। বিপ্লব যেন সত্যিই কখন ভুলে গেল আজ সকালে কী ঘটতে চলেছিল কিংবা ওরা চলে যাওয়ার পর কী ঘটবে। সমীরণ আর সায়ন্তনীর কারণেই হয়তো বিপ্লব বা ঈশানী কেউই খুব বেশিক্ষণ চুপ বা গম্ভীর থাকতে পারেনি। বিপ্লব অবাক হচ্ছিল বিয়ের এত বছর পরেও ওদের দুজনের মধ্যে কী গভীর বন্ধুত্ব, প্রেম। একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলে কিংবা খুনসুটি করে যেন সদ্য বিয়ে হয়েছে কয়েকদিন আগে। এমনও হয়?
কথায় কথায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। বাইরে রোদ্দুর ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবের বুকের ভেতরেও মেঘ জমা হচ্ছিল। অস্থির হয়ে উঠছিল মনটা। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। ওর আর ঈশানীর মধ্যে এমন আর কিছু নেই যার জন্য একসঙ্গে থেকে যাওয়া যায়। তাহলে? ঈশানীর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল বিপ্লব। ওরও কি এমন কিছু হচ্ছে। কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। আগাগোড়া নিখুঁত অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিল ঈশানী।
একসময় উঠে দাঁড়াল সমীরণ। না রে আর না, ঢের গপ্পো হল, এবার উঠি, নইলে বাকি ব্যাটাদের জ্বালানো হবে না।
এখনই চলে যাবি? ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে এল বিপ্লবের।
হ্যাঁ আর দেরি করলে পৌঁছোতে পারব না। আজই যেতে হবে। আর তো সুযোগ হবে না ভাই। বলেই হো হো করে হেসে উঠল সমীরণ। বলল আমরা দুজনেই, যে রেটে ব্যস্ত থাকি। দুজনের ভালো করে কথা বলারই ভাগ্য হয় না, বেরোনো তো দূরের কথা।
তোদের দেখে কিন্তু সেটা মনে হয় না। বলল বিপ্লব।
আর দেখে কি কিছু মনে হয় রে ভাই। এই যেমন তোদের দুজনকে বাইরে থেকে দেখে কেউ বলবে… বলে পজ দিল সমীরণ।
ধক করে উঠল বিপ্লবের বুক। জেনে গেছে সব! কে বলল? কী করে বুঝল।
আরে ভাই সব বোঝা যায়, হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে কী হবে? এমন অমর প্রেম তোদের পুরো চিরদিনই তুমি যে আমার… বলেই আবার হাসি।
তাড়া দিল সায়ন্তনী। অনেক ইয়ার্কি হয়েছে এবার চলো।
ওক্বে স্যার গুডনাইট। থ্যাংক ইউ ম্যাম। দারুণ লাঞ্চ হল। আজীবন মনে রাখব। ঈশানীর দিকে তাকিয়ে বলল সমীরণ।
আবার আসবেন দুজনে। সামান্য হেসে বলল ঈশানী।
দেখা যাক। চললাম তাহলে।
চলে গেল দুজন। বিপ্লব আর ঈশানী আবার একা। এক মুহূর্ত পরস্পর দুজনের মুখের দিকে তাকাল তারপর ঈশানী নিঃশব্দে চলে গেল ওর ঘরের দিকে। এবার বোধহয় ও-ও বেরোবে।
ফোন বাজছে বিপ্লবের। হাতে মোবাইলটা তুলে নিয়ে দেখল অরূপের ফোন। অরূপও ওদের গ্রুপের বন্ধু। নাম্বার আছে ঠিকই যোগাযোগ খুব কম। আজ হঠাৎ!
হ্যাঁ অরূপ বল।
হ্যাঁ রে তোদের বাড়িতে কি সমীরণ আর ওর বউ এসেছিল?
হ্যাঁ এই তো বেরোল। কেন?
আশ্চর্য চিজ তো ওরা!
কেন কী হয়েছে?
আজ ভোর পাঁচটার সময় ওরা দুজন আচমকা আমাদের বাড়ি এসেছিল। ঘুম থেকে টেনে তুলে প্রায় ঘন্টা খানেক ছিল দুজনে। চা খেয়ে তারপর বিদায় নিয়েছে। বলে আজ নাকি ওরা দুজন মিলে সব পুরোনো বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরবে। কিন্তু কাদের বাড়ি যাবে কিছুতেই বলেনি।
হ্যাঁ আমাকেও তাই বলেছে। কিন্তু ব্যাপার কী?
আরে ব্যাপারটা অদ্ভুত। ওরা চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর আমার ড্রয়িংরুমে সোফার কোণে একটা ছোটো ভাঁজ করা কাগজ পাই। খুলে দেখি, চিঠি। সমীরণের। সেখানে লিখেছে আজ নাকি ও আর সায়ন্তনীর একসঙ্গে থাকার শেষ দিন। মানে দুজনে সেপারেট হয়ে যাচ্ছে। তাই শেষবারের মতো দুজনে বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরবে। আমি একবার শুনেছিলাম যে ওদের মধ্যে ঠিক বনিবনা হচ্ছে না। সে ঝামেলা ওদের বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে এতদিন পরে এমন অদ্ভুত প্ল্যান… ওরা কি পাগল নাকি?… এসবের মানে কি? চিঠিটা পেয়েই আমি অনেকবার ফোনে ট্রাই নিয়েছিলাম কল করার, কিন্তু ফোন সুইচ্ড অফ…
কথা আর কানে আসছিল না বিপ্লবের। ধপ ধপ করে শব্দ হচ্ছিল ভেতরে। ফোনটা কেটে দিল বিপ্লব। ঈশানী খুব ধীরে ধীরে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। একহাতে ওর বড়ো বাক্স আর অন্য হাতে একটা খোলা কাগজ।
তোমার বন্ধুর চিঠি। আমার ঘরের খাটে রেখে গিয়েছে, বলে কাগজটা বাড়িয়ে দিল ঈশানী।
চিঠি নিতে এগিয়ে এল না বিপ্লব। একভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঘরের মাঝখানে।
কাগজটা খুব যত্নে ড্রয়িংরুমের সেন্টার টেবিলের ওপর রাখল ঈশানী। তারপর নিজের বাক্স সমেত পা ঘষে ঘষে এগোল মেইন গেটের দিকে। ভাঙা গলায়, সাবধানে থেকো বলে, ছিটকিনি নামিয়ে দরজা খুলে বেরোতে যাবে, পিছন থেকে বিপ্লব খুব নীচু গলায় বলে উঠল, ঈশানী।
উঁ।
বলছি …. যে তোমার কাছে … মানে … আর সামান্য একটু সময় হবে?
ঈশানী উত্তর দিল না। তাকাল বিপ্লবের দিকে, তাকিয়েই রইল। আর নেহাত যান্ত্রিক কারণেই আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা ….