আমরা সমাজবদ্ধ জীব। সামাজিক মেলামেশা আমাদের জীবনের অঙ্গ। কিন্তু ছোটো থেকেই যদি কিছু বদভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে সন্তান, তবে ভবিষ্যতে বিপর্যস্ত হতে পারে তার সামাজিক জীবন। মিথ্যা বলার অভ্যাস তার অন্যতম।মিথ্যা বলার বদভ্যাসে নষ্ট হয় সামাজিক সম্পর্ক। তাই বাচ্চা ছোটো থাকতেই সতর্ক হোন।
আমাদের চারপাশে ঘটে এমন নানা ঘটনা। যেমন সুতপা বুঝতে পারছিল আজকাল ওর মেয়ে রুপাই মাঝেমধ্যেই মিথ্যা কথা বলে নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে। ওর বয়স মাত্র ১২ বছর। বন্ধুদের সঙ্গে খেলার চক্বরে স্কুলের হোমওয়ার্ক ঠিকমতো করে না। দু’দিন তো স্কুল থেকে সুতপাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল, মেয়ের নামে হাজার নালিশ করলেন ম্যাম-রা। সত্যিই তো। কতদিন আর শিক্ষিকারাও রুপাইয়ের মিথ্যা কথা বলা সহ্য করবেন। আজকাল নাকি বেশিরভাগ দিনই ক্লাসের পড়া করে যায় না, হোমওয়ার্ক করে না। ম্যামরা কারণ জিজ্ঞেস করলে বলে মা-বাবার সঙ্গে নেমন্তন্ন খেতে গিয়েছিল অথবা বাড়ির কারও নাম করে সে অসুস্থ ছিল ইত্যাদি মিথ্যার ডালি সাজায়।অথচ সুতপা বাড়িতে হোমওয়ার্কের কথা জিজ্ঞেস করলে নিশ্চিন্তে মাথা হেলায় হয়ে গেছে বলে অথবা কখনও বলে কোনও হোমওয়ার্ক নেই।
একই অবস্থা পারমিতারও। পরের বছর ছেলে টুয়েলভ পাশ করে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তির পরীক্ষায় বসবে তারই কোচিং-এর ক্লাস করাতে হচ্ছে সায়নকে। বিকেলে স্কুল থেকে এসে কোচিং ক্লাসে পড়তে বেরিয়ে যায়। সেদিন পারমিতার স্বামী অমিতাভ, সায়নকে দেখেছে কোচিং ক্লাসের কাছেই একটা ধাবায় বসে বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করছে। বাড়িতে ফিরতে, বাবার প্রশ্নের উত্তরে বলে সে কোচিং-এই ক্লাস করতে গিয়েছিল। অমিতাভরা দু’জনেই বুঝতে পারে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ছেলে মিথ্যা কথা বলছে।
মা-বাবার সন্তানকে নিয়ে এই চিন্তা অস্বাভাবিক নয়। কারণ প্রত্যেকেই প্রায় সন্তানকে নিয়ে এই সমস্যায় ভোগেন। বাড়ির সঙ্গে সঙ্গে স্কুল-কলেজেও বাচ্চারা মিথ্যা বলতে শুরু করে, অনেক সময়ে বড়োদের বকাঝকা থেকে নিজেদের আড়াল করতে। নানারকম অজুহাত তৈরি করতেও তারা বিন্দুমাত্র ইতস্তত করে না। পরে এই অভ্যাস থেকে যদি বেরোতে না পারে, তাহলে কর্মজীবন এবং সাংসারিক জীবনেও তাকে অনেক সমস্যার মুখোমুখী হতে হবে।
বাড়িতে এবং বাড়ির বাইরে থেকেও যখন বাচ্চাদের মিথ্যা কথা বলা নিয়ে নানা নালিশ আসতে থাকে তখন মা-বাবার চিন্তায় চোখের পাতা বন্ধ হয় না অথচ কেউ কি একবারও ভেবে দেখেন যে বাচ্চাদের মিথ্যা বলার পেছনে একটা বড়ো অবদান তাদেরও রয়েছে। সকলের এটাই মনে হয় মা-বাবা সবসময়ে সন্তানের ভালো চান, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে কারও পক্ষে কি বাচ্চাকে মিথ্যা কথা বলা শেখানো সম্ভব?কিন্তু একটু গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় নিজেদের অজান্তেই মা-বাবারা বাচ্চাদের মিথ্যা কথা বলতে প্ররোচিত করেন।
বড়োরা মুখে সবসময় বাচ্চাদের বলতে থাকেন, মিথ্যা বলবে না তাতে জীবনে অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। হাজার মুশকিলে পড়লেও সত্যি কথা বলবে। কোনও বড়ো ধরনের ভুল হয়ে গেলেও বাড়িতে মা-বাবাকে সত্যিটাই বলে দেবে, এরকম মিথ্যা না-বলার অনেক উপদেশ অভিভাবকেরা প্রতি মুহূর্তে বাচ্চাদের মগজস্ত করতে থাকেন। তারা ধরেই নেন ক্রমাগত সত্যি বলার উপদেশ শুনতে শুনতে বাচ্চারা সত্যি কথাই বলতে শিখবে এবং ভবিষ্যতে ‘ভালো’ মানুষ হতে পারবে। কিন্তু ধীরে ধীরে মা-বাবা যখন বুঝতে পারেন তাদের শেখানো পথে বাচ্চারা চলছে না তখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে।
আসল কথা হল পই পই করে শিক্ষার বুলি আওড়ালেই বাচ্চারা চট্ করে তাই শিখে ফেলবে এমন ভাবাটা ভুল। বাচ্চারা তাই শেখে যেটা তারা বাড়িতে মা-বাবা বা পরিবারের আর সকলকে করতে দেখে বড়ো হয়। সকলের আচরণ, বাড়িতে কথাবার্তা বলার ধরন ইত্যাদি বাচ্চাদের উপর প্রভাব ফেলে বেশি। সেই মতোই বাচ্চারা নিজেদের গড়ে তোলে। ভালোমন্দ বিচার না করে, ছোটো থেকে দেখা পথই অনুসরণ করারই চেষ্টা করে।
বড়োরা সাধারণ ভাবে নিজেদের অগোচরেই বাচ্চাদের মিথ্যা কথা বলার প্রবণতার দিকে ঠেলে দেন। বাড়িতে দাদু, ঠাকুমারা নাতি, নাতনীর প্রতি একটু বেশি আদর এবং পক্ষপাতিত্ব দেখিয়ে থাকেন। অনেক সময় প্রয়োজনের অতিরিক্ত আদর দেওয়ার ফলে বাচ্চার মা-বাবার কাছেও পুরো ব্যাপারটা গোপন রাখা হয় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে মা-বাবাক মিথ্যা বলতেও আরম্ভ করে বাচ্চারা, দাদু-ঠাকুমার অপ্রয়োজনীয় আদর ঢাকা দেবার জন্যে।
বাড়িতে কাজের ফাঁকে অনাবশ্যক ফোন এলে অথবা অনাহূত অতিথি সমাগম হলে অনেক মায়েরাই বাচ্চাদের বলেন, ‘বলে দে বাড়িতে মা নেই।’ পরে আসতে অথবা পরে ফোন করে নেওয়ার নির্দেশ দেন মায়েরা তাদের সন্তানদের। বাবারাও এই একই ভাবে বাচ্চাদের মিথ্যা বলতে প্ররোচিত করেন। পাওনাদার, বস অথবা অফিস থেকে কলিগদের ফোন এলে অনায়াসে মিথ্যা কথা বলে দিতে অনেক বাবারাই বাচ্চাদের শিখিয়ে দেন। এইভাবেই বাচ্চারা সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মিথ্যা কথা বলাটা অনেক বেশি সহজ হয়ে যায়, বড়োদের মুখের উপদেশ তখন আর কোনও কাজে লাগে না।
আবার অনেক সময় দেখা যায় শিশুর অতিরঞ্জিত কথায় বড়োরা আমোদ উপভোগ করছেন, তার কল্পনাশক্তির তারিফ করছেন। এই বাড়িয়ে বলার অভ্যাস যে ইন্ধন পেয়ে পরবর্তীকালে শিশুটির মিথ্যা বলার অভ্যাসে পরিণত হতে পারে, তা অভিভাবকেরা ভেবে দেখেন না। এই ধরনের অভ্যাস থাকলে, শিশুটিকে শুরুতেই সংশোধন করে দেওয়া উচিত।
মনোবৈজ্ঞানিকদের মতে বড়োরা নানা ধরনের নেশা করেন। কখনও সেটা অভ্যাসের জন্যে, কখনও বা স্ট্যাটাস সিমবল হিসেবে। বাচ্চাদের মনে, বড়োদের এই নেশার প্রতি আসক্ত হতে দেখাটা খুব বড়ো একটা ধাক্বা। তাদের নিষ্পাপ মনে প্রশ্ন জাগে বড়োরা যেটাতে অভ্যস্ত সেটা তাদের জন্যে কেন বারণ? সুতরাং ওই নিষিদ্ধ বস্তুর স্বাদ গ্রহণ করতে হলে লুকিয়েই করতে হবে সেটা বাচ্চারা প্রথমেই বুঝে যায়। বড়োদের জন্যে যেটা করা ঠিক ছোটোদের ক্ষেত্রে সেই একই জিনিস করাটা কেমন করে অন্যায় প্রমাণিত হয়?
বাচ্চাদের সামনে বড়োদের নিজের ব্যবহার, নিজেদের চালচলন ঠিক রাখা খুব জরুরি। বাচ্চাকে পুঁথিগত বিদ্যায় শিক্ষিত করে তোলার আগে নিজেদের মিথ্যাচারকে সংযত করতে শিখতে হবে। তাহলেই নিশ্চিত ভাবে বাচ্চাদের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং তারা নীতিবোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। পরবর্তী সময়ে সামাজিক মেলামেশাতেও আর কোনো সমস্যা হবে না।