কথায় বলে, বিচক্ষণ-বিবেচক লোকের সমস্যা কম। অর্থাৎ, যে-ব্যক্তি ভবিষ্যতের কথা ভেবে পরিকল্পনামাফিক আর্থিক সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করে রাখেন, তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা অনেকটাই আর্থিক ভাবে সুরক্ষিত এবং সমস্যামুক্ত থাকেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই যে, সুবিবেচক মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়। অথচ, সবারই স্বপ্ন অনেক। নিজের একটা ভালো বাড়ি থাকবে, একটা গাড়ি থাকবে, ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য ব্যাংক-এ মোটা টাকা জমা থাকবে, ছেলেমেয়েদের ভালো স্কুল-এ পড়ানো যাবে— এমন স্বপ্ন বা ইচ্ছে থাকে প্রায় প্রতিটি মানুষেরই। কিন্তু, এই স্বপ্ন পূরণ হয় না সকলের। কারণ, টাকার মূল্য যে-ভাবে কমছে, তাতে সংসারের ব্যয়ভার বহন করার পর, খুব বেশি টাকা সঞ্চয় করা সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। অতএব আর্থিক সুরক্ষা পেতে হলে, বিচক্ষণতা জরুরি।
প্রস্তুতি নিন এখনই
প্রথম থেকেই বুঝে নিতে হবে, টাকা-পয়সার জোগান বন্ধ হয়ে গেলে বাস্তবে কী কী বিপদের সম্মুখীন হতে হবে। উপার্জন এবং খরচের একটা হিসেব রেখে তার থেকেই অর্থ জমাবার একটা উপায় করতে হবে। পেশা এবং জীবনশৈলীতে ছেদ টানতে পারে, এমন অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি থেকে নিজেকে এবং প্রিয়জনদের (বয়স্ক মা-বাবাও শামিল এর মধ্যে) সুরক্ষা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত জীবনবিমা এবং স্বাস্থ্যবিমা করানো উচিত। পরিবারের জন্য সবথেকে ভালো এবং বিপন্মুক্ত ইনভেস্টমেন্ট হল জীবনবিমা এবং স্বাস্থ্যবিমা।
একক মহিলাদের নিজের উপর ভরসা রেখে ভবিষ্যতের বোঝা থেকে বাঁচার একটা উপায় খোঁজা উচিত। হঠাৎই কোনও খরচার সম্মুখীন হওয়া, যেমন— বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মেরামতি, কোথাও বেড়াতে যাওয়া অথবা কিছুদিনের জন্য ঋণ নিয়ে সেটা শোধ করার প্রয়োজনীয়তা বা গাড়ি কেনা, ভবিষ্যতের জন্য আর্থিক ভাবে সাবলম্বী হওয়া অর্থাৎ রিটায়ারমেন্ট-এর পরের অবস্থা, ঋণ থাকলে সেটা শোধের ব্যবস্থা— এই সবকিছুর জন্যই ইনভেস্টমেন্ট করা অত্যন্ত জরুরি। যে- যোজনাগুলিতে বিনিয়োগ করলে রিটার্ন-এর সুবিধা পাওয়া যায়, সেগুলির মধ্যে রয়েছে লিকুইড ফান্ড, মানিব্যাক বিমা পলিসি, রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান ইত্যাদি।
পুরুষদের মতো মহিলাদেরও বড়ো বড়ো স্বপ্ন দেখা উচিত। যেমন নিজের নামে জমি, বাড়ি কেনা, নিজের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করা। এর জন্য বর্তমানের প্রয়োজন কী এবং রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান কী কী আছে, সেগুলিও মহিলাদের মনোযোগ সহকারে দেখা কর্তব্য।
যদি আর্থিক ভাবে আপনি নিজেকে স্বনির্ভর মনে করেন এবং আপনার বয়স ৪০-এর কোটা পার হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে জেনে রাখুন— আগামী ৪০ বছরকে সুরক্ষিত করতে আপনার হাতে ১৫ থেকে ২০ বছর সময় আছে। এই পরিস্থিতিতে সবদিক ভেবে নিয়ে নিজেকে আর্থিক ভাবে সুরক্ষিত করুন।
রোজগার এবং খরচ
দৈনন্দিন সবকিছুর হিসেব রাখা শুরু করুন। হয়তো দেখবেন প্রতি মাসে এমন কিছু ব্র্যান্ডেড জিনিসের পিছনে ছুটেছেন, যেটা অর্থহীন অথচ আপনার পকেটের জন্য একটা বড়ো ভারও বটে। তাই, আয় বুঝে ব্যয় করুন। সঞ্চয় এবং বিনিয়োগ
দুটো কিন্তু আলাদা আলাদা বিষয়। খরচ না করাটাই কিন্তু ‘সঞ্চয় করা। আপনার অর্থ ব্যাংকে সেভিংস অ্যাকাউন্ট-এ পড়ে রয়েছে, যার উপর মাত্র ৪ শতাংশ সুদ পাচ্ছেন আপনি। অথচ এর উপর সরকার ‘ট্যাক্স’-ও কাটছে আপনার থেকে। যেখানে মূল্যবৃদ্ধির হার শতকরা ৬ শতাংশ, সেখানে ব্যাংকে রাখা টাকার মূল্য দিনে দিনে কমছে সেটা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া ওই টাকাটা ভবিষ্যতের কতটা বোঝা হালকা করতে পারবে? অতএব এফডি (ফিক্সড ডিপোজিট) করে বেশি সুদ পাওয়া নিশ্চিত করুন।
প্রায়োরিটি
২০ থেকে ২৫ বছর পর কীসের প্রয়োজনীয়তা বেশি, অর্থাৎ গুরুত্ব অনুসারে কোন কাজটা আগে বাছা উচিত এবং নিজের জীবন কীভাবে কাটাব, সেই কল্পনাও আমরা বেশিরভাগই করে উঠতে পারি না। সুতরাং, ৪০ বছর বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পরও আমরা সাপোর্ট সিস্টেম হিসেবে বিনিয়োগের প্রয়োজন উপলব্ধি করতে পারি না। বিশেষকরে মেয়েরা সামাজিক সম্পর্ক এবং পরনির্ভরতার বশবর্তী হয়ে জীবন কাটিয়ে দেন, অর্থের প্রয়োজনীয়তা বোঝার চেষ্টা খুব একটা করেন না। কিন্তু আপনি যদি একক জীবনযাপন করেন, তাহলে আপনাকে আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে আর্থিক সুরক্ষার বিষয়ে। সুতরাং, সময় থাকতেই রিটায়ারমেন্ট প্ল্যানগুলো নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা খুব দরকার।
সঠিক সিদ্ধান্ত
মহিলাদের উচিত বিনিয়োগ যোজনাগুলি নিয়ে সচেতন এবং সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেওয়া। নিজের জীবনবিমা থেকে শুরু করে, মা-বাবার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সবরকম প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকাটা খুব দরকার। বর্তমানের কথা খেয়াল রাখার সঙ্গে সঙ্গে একক মহিলাদের, রিটায়ারমেন্টের জন্য সুরক্ষিত পেনশন যোজনায় ইনভেস্ট করা উচিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। আসল কথা হল— এখন সময় এসেছে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী মহিলাদের নিজের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার।
তাছাড়া, কোনওরকমে মোটা টাকা জমিয়ে কিংবা জমানো টাকা নিঃশেষ করে বড়ো বাড়ি কিংবা দামি গাড়ি কিনলেই তো আর সমস্যা মিটল না, বরং ঝামেলা বাড়ল। কারণ, বড়ো বাড়ি মানেই জমা দিতে হবে বেশি টাকা সম্পত্তি কর। দামি গাড়ি মানেই মেন্টেন্যান্স খরচও বেশি পড়বে। আর এই বিলাসবহুল জীবনযাপনের বিপুল খরচ মেটাতে গিয়ে অনেকসময় আর্থিক সমস্যায় পড়েন অনেকে এবং ঠিক তখনই সম্পত্তি বন্ধক কিংবা বিক্রির বিষয়টি সামনে এসে দাঁড়ায় দুর্ভাগ্যক্রমে।
এই প্রসঙ্গে প্রথমেই জানিয়ে রাখি, কোনও বিপদ কিংবা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও, চট করে জমি-বাড়ি বিক্রি না করে, বন্ধক রাখার সিদ্ধান্ত নেবেন। কারণ, আপনি যে দামে জমি-বাড়ি বিক্রি করবেন, সেই দামে আর জমি-বাড়ি কিনতে পারবেন না। তাছাড়া, জমি কিংবা বাড়ি বিক্রির পর আপনার আর্থিক সমস্যা মিটতে নিশ্চয়ই অনেকদিন গড়িয়ে যাবে এবং ওই সময়ের ব্যবধানে জমি-বাড়ির দাম আরও বেড়ে যাবে। অবশ্য যদি একাধিক জমি-বাড়ি থাকে, সেক্ষেত্রে বিক্রির সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু যদি তা না থাকে, তাহলে বাড়ি বিক্রির পর পুনরায় বাড়ি কেনা পর্যন্ত ভাড়াবাড়িতে আশ্রয় নিতে হবে এবং বাড়ি ভাড়া বাবদ যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, তা বাড়ি বন্ধক রেখে টাকা নিয়ে সুদ মেটানোর থেকে অনেক বেশি।
কিন্তু মুশকিল হল এই যে, বেশিরভাগ মানুষ দেনার দায়ে জমি-বাড়ি হারানোর ভয়ে বন্ধক রাখতে চান না। আসলে এই ভয়ের কারণ হল অজ্ঞতা। সঠিক নিয়মকানুন জেনে বুঝে, সঠিক ভাবে চুক্তিপত্রকে মাধ্যম করে জমি-বাড়ি বন্ধর রেখে ঋণ নেন না অনেকে। অতএব, জমি-বাড়ি বিক্রি না করে, বন্ধক রেখে ঋণ নিতে হলে কী কী বিষয় গুরুত্ব সহকারে দেখে নিতে হবে, তা জেনে নিন বিশদে।
আপনার সম্পত্তির ভ্যালু অনুযায়ী আপনি তা বন্ধক রেখে কত টাকা ঋণ হিসাবে পেতে পারেন, সেই বিষয়টি জেনে নিন ঋণদাতা অর্থাৎ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের থেকে। এবার আপনি ঠিক করুন আপনার প্রয়োজনমতো কত টাকা ঋণ নেবেন। ঋণের পরিমাণ নির্ধারণ করার পর জেনে নিন সুদের পরিমাণ কত। কতদিনে আপনি ঋণ শোধ করবেন (অর্থাৎ পাঁচ, দশ কিংবা কুড়ি বছর) তার উপর সুদের হার নির্ভর করবে। শুধু তাই নয়, ফ্লোটিং এবং ফিক্সড এই দু’ভাবে ঋণ নেওয়া যায়। ফ্লোটিং অর্থাৎ যখন যেমন সুদের হার হবে, তখন তেমন ভাবেই সুদ মেটাতে হবে।
এক্ষেত্রে ইএমআই (ইক্যুয়েটেড মান্থলি ইনস্টলমেন্ট) একই থাকবে। কিন্তু সুদ বাড়লে ঋণের মেয়াদ বাড়বে এবং কমলে ঋণের মেয়াদ কমবে। আর যদি ফিক্সড রেট-এ ঋণ নেন, তাহলে সুদের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকবে। তবে ফিক্সড রেট অন্তত ৪ থেকে ৫ শতাংশ বেশি থাকে ফ্লোটিং রেট-এর থেকে। অতএব, বুঝে-শুনে বন্ধকি ঋণ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিন এবং শর্তাবলি ভালো ভাবে পড়ে নিয়ে ঋণের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করুন।
তবে মনে রাখবেন, গৃহঋণ, ব্যক্তিগত ঋণ এবং বন্ধকি ঋণ— প্রতিটি ক্ষেত্রেই কিছু নিয়মকানুন একই থাকে। যেমন, যেরকম ঋণই নিন না কেন, ঋণগ্রহীতার মাসিক আয় পনেরো হাজার টাকার বেশি হতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে, ইএমআই-এর (মাসিক প্রদেয় অর্থ) থেকে ঋণগ্রহীতার মাসিক আয় যেন দু’গুনের বেশি হয়। আর বাড়ি কিংবা জমি যাই বন্ধক রাখুন না কেন, সম্পত্তির আসল দলিল (ওরিজিনাল ডিড) ঋণদাতা-র কাছে অর্থাৎ ব্যাংক-এ জমা (বন্ধক) রাখতে হবে এবং লোন শোধ করার পর ওই দলিল ফেরত নিতে হবে।
অনেক সময় দেখা যায় যে, লোন নিয়ে জমি-কিংবা বাড়ি কিনেছেন এবং লোন শোধ করার আগেই হয়তো দুর্ভাগ্যবশত টাকার প্রয়োজন হল। এমন পরিস্থিতিতেও দ্বিতীয়বার ঋণ নেওয়া যায়। তবে এক্ষেত্রে যে-ব্যাংক আগে ঋণ দিয়েছে, তাদের থেকে লিখিত অনুমতি নিতে হবে। যদি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দেখেন যে, দীর্ঘদিন আপনি ঋণের টাকা ঠিকঠাক শোধ করে চলেছেন, তাহলে আপনাকে ভালো গ্রাহক ধরে নিয়ে পুনরায় বন্ধকি ঋণ নেওয়ার অনুমতি দিতে পারে।
বন্ধকি ঋণ শোধ করার ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা নিতে পারেন আর্থিক ক্ষমতা থাকলে। যেমন, যে-পরিমাণ ইএমআই আপনি দেবেন, তা বাদ দিয়ে পাঁচ হাজার, দশ হাজার যখন যেমন সুযোগ পাবেন সেই পরিমাণ টাকা জমা দিয়ে প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্ট (সুদ ছাড়া লোনের আসল টাকা) কমিয়ে দিতে পারেন। এতে আপনার ঋণের মেয়াদ কমে যাবে এবং কম সুদ দিতে হবে। আর যদি কোনও কারণে ঋণ শোধ না করতে পারেন, তাহলে বন্ধকি জমি কিংবা বাড়ি নিজে বিক্রি করাই লাভদায়ক।
কারণ ঋণদাতা-ব্যাংক যদি ঋণের টাকা না পেয়ে বন্ধকি জমি কিংবা বাড়ি বিক্রি করতে বাধ্য হয়, তাহলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের প্রাপ্য বকেয়া টাকা পেয়ে যাওয়ার পর আর বেশি মাথা ঘামায় না। এতে ঋণগ্রহীতার ক্ষতি হতে পারে। তাই ঋণগ্রহীতার উচিত, ঋণের টাকা শোধ করতে না পারলে, বন্ধকি সম্পত্তি বিক্রির বন্দোবস্ত করে, ক্রেতার কাছ থেকে অগ্রিম (অ্যাডভান্স) বাবদ কিছু টাকা নিয়ে ঋণ শোধ করে কিংবা ক্রেতার নামে লোন ট্রান্সফার করে সমস্যার সমাধান করতে পারেন।