আপনি পায়রা ভালোবাসেন খুব, তাই না?

একটু দূরে বসে ছেলেটি মেয়েটিকে প্রশ্ন করে। উত্তরের আশায় হয়তো তারই দিকে তাকিয়ে স্টেশন চত্বর একা বিকেলের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছাউনির ওপর দিয়ে সূর্যের আভাটুকু ক্ষীণ হয়ে আসছে ক্রমশ…

সরি?

না, এই যে আপনি পায়রাগুলোকে খাবার দিচ্ছিলেন, তাই জিজ্ঞেস করলাম। আপনি হয়তো পায়রা ভালোবাসেন।

হ্যাঁ তা ভালোবাসি। কিন্তু আপনি কে?

এই কথা বলে মেয়েটি ছেলেটির দিকে ঘোরে, তারপর সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে।

আমি কেউ না। ধরুন আমি একজন অজানা মানুষ। যে আপনার মতোই এই প্ল্যাটফর্মে একা বসে আছে।

মেয়েটি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বলে তাই আপনি চলে এলেন কথা বলতে?

না তা নয়। আমিও তো একাই বসেছিলাম। ভাবলাম আপনিও একা, আমিও একা। যাই হয়তো আলাপ হয়ে ভালো লাগবে! যাইহোক আমার নাম ঋষি।

মেয়েটি মজার ছলে বলে ওহ ধন্যবাদ ঋষিবাবু। তবে আমি আমার নাম বলতে একেবারেই আগ্রহী নই।

রেললাইনের দিকে তাকিয়ে ঋষি বলে কাউকে রিসিভ করতে এসেছেন?

অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে ভাবতে মেয়েটি বলে আমি কি আপনাকে চিনি? না আমাকে বলুন, আমি কি এর আগে কখনও আপনার মুখোমুখি হয়েছি?

অবশ্যই। বেশ কয়েকবার। কিন্তু আপনি আমাকে দেখেছেন কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারব না। কারণ যতবারই দেখেছি আপনি খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেছেন।

মেয়েটি এবার একটু আগ্রহ নিয়ে ছেলেটির দিকে ঘুরে বসে। কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে যেন তার চোখগুলি পড়ে ফেলতে চেষ্টা করে। তারপর ঘাড় নেড়ে বলে না মনে পড়ছে না।

সেটাই স্বাভাবিক…

আচ্ছা বলুন আমাকে শেষ কবে, কখন দেখেছেন?

ওহ! সেটা তো বেশ এক ঘটনা ছিল। নিউ লাইফ কফি শপ্-এ আপনি আমার সামনের সিটেই পেছন ফিরে বসেছিলেন। ধরে নিলাম কফিই খাচ্ছিলেন।

ওহ, আপনিই সেইজন যিনি…

কথাটা শেষ হওয়ার আগেই ঋষি উত্তর দেয় হ্যাঁ আমি-ই সেই যে আপনার পড়ে থাকা পার্সটা নেওয়ার কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম।

মেয়েটি লজ্জায় জিভ কাটে। তারপর ঘাড় নাড়ায়। লজ্জা নিয়ে বলে দেখুন আমি ভীষণ ভাবে দুঃখিত। সেদিন আপনাকে একটা ধন্যবাদও বলে আসতে পারিনি। আসলে…।

আসলে কী? পাত্তা দিতে চাননি? আজকের মতো?

এ বাবা না না! আসলে ওইদিন একটু সমস্যার মধ্যে ছিলাম। এক বান্ধবীর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎই একটা দরকার পড়ে যাওয়ায়, বেরিয়ে আসতে হয়েছিল তাড়াহুড়ো করে। আমার অবশ্যই ধন্যবাদ জানিয়ে আসা উচিত ছিল। পরে আপশোশ করেছি।

আচ্ছা ঠিক আছে। এটা কোনও ব্যাপার না। এটা সবার সঙ্গেই হয়। খারাপ ভাবার কিছু নেই। তাহলে তো আমরা আলাপ করতেই পারি? আমি মানুষটা অতটাও খারাপ নই!

 

( ২ )

হাই! ব্যস্ত নাকি? আমি ঋষি।

মেসেজের শব্দ পেয়ে হাত থেকে চিরুনিটা নামিয়ে রাখে উর্বি। তারপর গুছিয়ে বসে বিছানার উপর। উত্তর পাঠায় প্রথমত খুব ব্যস্ত না। দ্বিতীয়ত আপনার নাম্বার আমার সেভ করা আছে। তাই আপনি ঋষি না হয়ে মণি হতে পারবেন না, হা হা।

মেসেজটা করার পরেই যেন উর্বির মুখে এক প্রকার অজানা হাসি নেমে আসতে শুরু করে। একমনে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

ঋষি লেখে আজকে আপনাকে দেখলাম বাজারে একটা বইখাতার দোকানে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি কি ঠিক বলছি?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কোথায় ছিলেন? আর ডাকলেন না-ই বা কেন?

কেউ একজন সঙ্গে ছিল বোধহয়। তাই আর কী। আর আমি যাচ্ছিলাম ওইদিক দিয়ে একটু কাজে।

তা ভালোই করেছেন না ডেকে। এক বান্ধবী ছিল। এই দিক দিয়ে না ডেকে বুদ্ধির পরিচয় দিলেন।

বুদ্ধি আছে বলছেন তাহলে?

সেটা তো আরও কিছুদিন গেলেই বুঝতে পারব।

বেশ অপেক্ষায় রইলাম।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে উর্বি বলে আজকে হরিণ দেখতে যাবেন?

হরিণ? কোথায় পেলেন তাকে? আপনি সঙ্গে গেলে অবশ্য যাওয়াই যায়।

উর্বি একটু শ্বাস ফেলে। তারপর বলে স্টেশনের পাশে চিড়িয়াখানাটা আছে না? ওখানে…

ওদিকে ঋষি একটু অবাক হয়ে উঠে বসে। মাথার চুল ঠিক করে। তারপর বলে এত সহজে দেখা করতে চাইছেন, বিশ্বাসই হচ্ছে না এখনও।

না না, তা নয়। আপনি আপনার মতো একা যাবেন, আমার সঙ্গে যেতে বলিনি। আমি আপনার সঙ্গে যাব কখন বললাম?

ঋষি একটু মৃদু হাসে। আশেপাশে তাকায়। উত্তর দেয় তাহলে আপনি? আপনি কার সঙ্গে যাবেন?

আমার এক বান্ধবী এল না ওইদিন! ষ্টেশনে যাকে আনতে গিয়েছিলাম। ও যাবে আমার সঙ্গে।

বেশ যান! ভালো করে ঘুরুন।

আপনি?

ঋষি মাথা নাড়ে তারপর উত্তর দেয় আমি ওসব ঝামেলার মধ্যে নেই। আপনারা দুজনেই ঘুরুন। আমি মাঝখানে গিয়ে কেন ঝামেলা পাকাতে যাব বলুন তো? এটা কি উচিত হবে?

উর্বি কোনও উত্তর দেয় না। ফোনটা হাত থেকে নামিয়ে রাখে। তারপর আবার কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়।

 

( ৩ )

কয়েকদিন কেটে যায়। মাঝে তেমন আর কথা হয়নি খুব বেশি।

একদিন বিকেলে ঋষি ঘরে বসে মাউথ অর্গানটিকে পরিষ্কার করছিল। ফোনটা শব্দ করল। মেসেজ এসেছে।

ঋষি ফোনটা খুলে দেখে অচেনা একটি নম্বর থেকে মেসেজ আপনি সম্ভবত ঋষি। আমি উর্বির বান্ধবী। ও একটু সমস্যার মধ্যে আছে। ওর তেমন আর কোনও বন্ধুকে আমি চিনি না। আপনার নাম শুনেছি, তাই আপনার সঙ্গেই যোগাযোগ করছি!

ঋষি হাত থেকে যন্ত্রটা নামিয়ে রেখে গম্ভীর হয়ে কিছু মুহূর্ত ফোনটা ধরে থাকে, তারপর উত্তর দেয় কী সমস্যা হয়েছে?

সমস্যা তো অনেক কিছু! আপনি একবার ফোন করতে পারলে খুব ভালো হতো। আপনি যদি ফ্রি থাকেন আমি ফোন করি?

ঋষি মেসেজের উত্তর না দিয়ে সোজা কল করে।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে ঋষিকে গম্ভীর দেখায়। চিন্তিত মনে হয়। কিছুক্ষণ কথা বলার পর ফোন রেখে চুপ হয়ে বসে থাকে। তারপর কী ভেবে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়।

কিছুটা সময় কেটে গেছে। ঋষি উর্বির বাড়ির সামনে এসে বান্ধবীটিকে মেসেজ করে আমি নীচে আছি।

মেসেজ পেয়ে সে নীচে আসে, ঋষিকে উর্বির ঘরে নিয়ে যায়। তারপর উর্বিকে বলে ঠিক আছে আমি একটু বাইরের দিকে যাচ্ছি কিছু লাগলে ফোন করে দিস কেমন?

উর্বি শুয়েছিল তখন। শুয়ে শুয়ে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে।

ঋষি ঘরের একটা কোণ থেকে একটি চেয়ার টেনে উর্বির কাছাকাছি যায়। তারপর চোখাচোখি হয়ে বসে। কিছু একটা ভেবে নিয়ে বলে এই শরীরে হঠাৎ করে সিগারেট খাওয়ার কী এমন দরকার ছিল? নিজের শরীরটাকে আপনিই তো ভালো চেনেন।

উর্বি মাথা তুলে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে। তারপর উত্তর দেয় ও এমন কিছু না। দুদিন গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। আপনাকে শুধু শুধু কষ্ট করে ডেকে আনল। আমার খুব খারাপ লাগছে।

চলে যাব তাহলে?

মাথা নীচু করে ছিল উর্বি। একটু ঘাড় ঘুরিয়ে নিয়ে বলে আমি কি তাই বলেছি? এসেই যখন গেছেন, একটু না হয় থেকে যান।

আপনি এখানে একা থাকেন, বলেননি তো কোনওদিন?

বলার মতো পরিস্থিতি আসেনি তাই হয়তো…

হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে ওষুধটা নিতে যায় উর্বি। ঋষি থামিয়ে দেয়, উঠে গিয়ে গেলাসে জল ভরে, ওষুধ আর জল নিয়ে সামনে ধরে।

প্রথমবার সিগারেট খেয়ে তাহলে ঘায়েল হলেন। কী মনে হচ্ছে? কেমন লাগল? আর নিশ্চয় ওদিকে পা বাড়াবেন না!

ভালোই লেগেছে। প্রথমবার বলেই কষ্ট হল। পরের বার থেকে আর হবে না।

 

পরের বার মানে? আপনি আবার খাবেন?

উর্বি অবাক হয়ে ঋষির মুখের দিকে তাকায়। তারপর বলে খাওয়ার জন্যই তো ধরলাম।

ঋষি কোনও উত্তর দেয় না। শুধু বলে ওষুধটা খেয়ে নিন।

উর্বি ওষুধ খায়। ঋষি আবার বলে আইসক্রিমও খেয়েছিলেন শুনলাম।

উর্বি উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। হয়তো না বলার উপায় নেই বলেই নীরব থাকতে চায়।

ঋষি উত্তর না পেয়ে জানতে চায় জ্বরটা শেষ কখন মেপেছিলেন? কাশিটা খুব হচ্ছে?

জ্বর এই মাত্র মেপেছি। কমের দিকে। কাশিটা কমছে না।

সিগারেটটা আর খাবেন না। এটা অনুরোধ হিসেবেই নিন, প্লিজ আর খাবেন না এইসব। আপনার শরীর এসব নিতে পারবে না। আর কী-ই বা দরকার এই সবের?

উর্বি কথাগুলো শুনল নাকি বোঝা গেলো না। ঋষির কথা শেষ হওয়া মাত্র সে বলে ঠান্ডাটা ভীষণই লেগেছে মনে হচ্ছে। হয়তো কদিন ভোগাবে।

তারপর কথা শেষ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে।

ঋষি ওর এমন অবস্থা দেখে বলে ঠিক আছে ওষুধটা খেলেন, একটু রেস্ট নিন। আমি বাইরে গিয়ে বসছি।

উঠতে যাবে এমন সময় উর্বি হাত বাড়িয়ে ঋষির হাতটা ধরে নেয়। তারপর বলে এখানেই বসুন কোথাও যেতে হবে না। পকেটের যন্ত্রটি বাজান না একটু শুনি।

ঋষি খেয়াল করে, আসার সময় মাউথ অর্গানটা রেখে আসা হয়নি। বুক পকেট থেকে সেটা হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।

 

পরের দিন সকাল।

উর্বি মেসেজ করে জানায়, বাড়ি থেকে আনতে এসেছে। একটু পরেই ওরা এখানে পৌঁছে যাবে। তারপর বাড়ি। বেশ কিছুদিনের জন্য শহর থেকে দূরে। অবশ্য সুস্থ হলেই ফেরা যাবে। মেসেজটি পড়তে ঋষির একটু দেরি হয়ে গেল বোধহয়। মেসেজটি খুলে দেখল ঘণ্টাখানেক আগে পাঠানো। সে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রেডি হয়ে নেয়।

সমস্ত কিছু সেরে যখন উর্বির বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছোল, গলিতে ঢোকার মুখে দেখল একটি গাড়ি বেরিয়ে বড়ো রাস্তার দিকে চলে গেল। ঋষি খেয়াল করল না। কোনও শব্দও কানে এল না।

উর্বির রুমের সামনেটায় ওর বান্ধবী দাঁড়িয়েছিল। ঋষিকে দেখে বলে ও তো এই বেরিয়ে গেল গো। আর একটু আগে এলে দেখা হয়ে যেত।

ঋষি পেছন ফিরে তাকায়। দেখে রাস্তাটা তখন ফাঁকা হয়ে আছে। সবকিছুই ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে কিনা, সে সেটা অনুভব করতে পারল না। শুধু বলল কিছু বলে গেছে?

মেয়েটি একটি ছোট্ট কাগজ হাতে দিয়ে বলে এই কাগজের টুকরোটুকু তোমাকে দিতে বলে গেছে। আর বলল তো কিছুদিনের মধ্যেই ফিরে আসবে।

কাগজটা হাতে নিয়ে সামনের বাড়িটাকে উপর-নীচ একবার দেখে নিয়ে ঋষি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর নিজের বাড়ির দিকে পা বাড়িয়ে রাস্তায় মিলিয়ে গেল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...