গিয়ার একটু উপরে তুলে প্রবীর বলল, আসল মজা আসত মামার বাড়িতে। পাশেই ছিল সীতা কুণ্ড, সবাই মিলে হুল্লোড় করে ঝাঁপ দিতাম তার স্নিগ্ধ শীতল জলে। সারাদিন সাঁতার কেটেও জ্বর-সর্দি কিচ্ছু হতো না।

পাশেই অরিন্দম বসেছিল, সে হই হই করে উঠল। থাম তো তোর সীতা কুণ্ড। আমার গ্রামে চল। পাশেই দ্বারকেশ্বর নদী আর বিশাল ধানের খেত। গেলে বুঝবি পাড়াগ্রামে কত আনন্দ।

দুজনে বেশ তুমুল বিতর্ক শুরু করেছে দেখে অতনু চুপ থাকে কেন? সেও যোগ দিল, তোরা নদী আর কুণ্ড নিয়ে রইলি আর আমার মাসির বাড়িতে পাঁচ কিলোমিটার-এর মধ্যে পাহাড়, নদী, রাজবাড়ি, খেত, পুকুর সবকিছুই পাবি।

রাজবাড়ির নাম শুনে অনন্ত আর প্রবীরের মুখ হাঁ হয়ে গেল। অরিন্দম বলল, চল তাহলে পুজোর ছুটিতে তোদের মাসি বাড়ি ঘুরে আসা যাক। সবাই রাজি হয়ে গেল।

পুজোর ছুটিটা বেশ জমিয়ে উপভোগ করতে চায় সবাই। তাই শহরের পুজো নয়, এবার গ্রামে গিয়ে একটু অন্য ভাবে পুজো উপভোগ করার জন্যে সবাই অনন্তর কথামতো হাজির হল গিয়ে ওর মাসির বাড়ি। দারুণ জায়গা, মন প্রাণ খুলে ঘুরে বেড়ানো যায়। বাধা দেওয়ার কেউ নেই। আর মাসিমণির বরাতে বেশ জম্পেস খাওয়াদাওয়া চলছে।

সারাদিন পাহাড় নদী ঘুরে এসে ভীষণ ক্লান্ত চারমূর্তি। এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় আর নিজেদের মধ্যে নিয়মমাফিক তর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েছে সকলেই। ইতিমধ্যে মাসিমা মুড়ি আর তেলেভাজা দিয়ে গেছেন, ওটাকেই চটকানো হচ্ছে। কথা প্রসঙ্গে অতনু বলে উঠল, তোরা রাজবাড়ি কবে যাবি? আমি বাপু পাহাড় নদী দেখতে আসিনি। আমার মামারবাড়িতে এইসব ঢের দেখেছি।

প্রবীর বললে, চুপ কর তো। শুধু ঘ্যান ঘ্যান করতে হবে না। অতনু বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। সে প্রায় সাড়ে তিন হাত লাফিয়ে উঠে বললে, জানিস রাজবাড়ি মানে অনেক কিছু থাকতে পারে, এই ধর গুপ্তধন!

অরিন্দম বললে, হ্যাঁ তোর জন্য গেড়ে রেখে গেছে। তুই যাবি আর তুলে নিয়ে আসবি।

গল্প শেষ পর্যন্ত গড়িয়ে গেল রাজবংশের কেউ এখনও আছে কি না। ওদের সাথে দেখা করে সব জানতে হবে।

অতনুর যেন এখানে আসার একটাই কারণ। রাজবাড়ি গিয়ে লুকোনো গুপ্তধন আবিষ্কার করা। ওর কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল। পাশের ঘরে মাসিমা ছিলেন, তিনিও চারমূর্তির কথা শুনতে পেয়েছেন। তিনি এসে বললেন, একবার ঘুরেই এসো। তবে সন্ধে কোরো না। জায়গাটা ভালো নয়।

সকালে উঠেই সবাই তৈরি রাজবাড়ি দর্শন করতে যাবার জন্যে। মাইল খানেকের পথ। একটা টোটো করে সবাই উঠে বসল। মনের মধ্যে অনেক কথা লুকোচুরি খেলছে, অতনুর মুখ দেখলেই বোঝা যায়। সেই সবার আগে বসেছে। আর ক্রমাগত টোটো চালককে একটু তাড়াতাড়ি চালানোর জন্যে খোঁচাতে শুরু করেছে। টোটোওয়ালা ভীষণ বিরক্ত হয়ে শেষমেশ বলেই ফেলল, দাদাবাবু আপনি এরোপ্লেন ভাড়া করে নিন। আমার টোটো এই স্পিড-এর বেশি চলে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা রাজবাড়ির সামনে এসে উপস্থিত। টোটো থেকে নেমে অবাক চোখে সবাই তাকিয়ে দেখতে লাগল, প্রায় ভগ্নদশা তবু মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন রাজবাড়ি। হুট করে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে দেখল দুজন প্রহরী। রাজবাড়ি এখন সরকার অধিগ্রহণ করেছে, তাই ভেতরে প্রবেশ নিষেধ। বাইরে থেকে ঘুরে দেখতে পাওয়া যাবে। ভেতরে যেতে গেলে সরকারি অনুমতি লাগবে।

একটু নিরাশ হলেও সেই দিনের মতো ওরা আশেপাশেই ঘুরে দেখে নিতে লাগল। কোথায় হাতিশাল, কোথায় সিপাহিদের থাকার জন্য ঘর ছিল। সামনেই একটা বড়ো পুকুর আছে। টোটোচালক সব ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল। ওরা ঘুরতে ঘুরতে রাজবাড়ির পশ্চিম দিকে এসে দেখতে পেল কিছু ভগ্ন মন্দিরের স্তূপ। সেখানে অনেকক্ষণ নিরীক্ষণ করে যখন ফিরে এল তখন বেশ খিদে পেয়েছে।

অরিন্দম বলল, চল রে আগে পেটে কিছু দিয়ে আসি, তার পর দেখা যাবে। এই কথা শুনে সবাই এসে হাজির হল একটা হোটেলে। হোটেলের বেয়ারা বেশ মিশুকে ছেলে। ওদের দেখেই বলল, বাবুরা নতুন নাকি? গ্রাম দেখতে এসেছেন। একটুর মধ্যেই বেশ ভাব জমে উঠল তার সাথে।

প্রবীর বললে, তোমাদের গ্রামে কী আছে দেখার জন্য।

ছেলেটি সব কিছুই বলতে লাগল। শেষে এল রাজবাড়ির কথা। অতনুর এই সময়টার অপেক্ষায় ছিল। সে জিজ্ঞেস করে বসল, এখানে গুপ্তধন নেই?

ছেলেটি হো হো করে হেসে উঠল। তা তো জানিনে বাবু, তবে লোকে বলে রাজবাড়ির ভেতরে ভূতের উপদ্রব আছে। তাই রাতে পুলিশেও পাহারায় থাকে না।

নতুন খবর পেয়ে চারমূর্তি নড়ে চড়ে বসল। আরও কিছু কথা হল কিন্তু খাওয়া হয়ে গেছে আর বেলা বেড়ে চলেছে তাই ওরা বেরিয়ে এল হোটেল থেকে। সবাই বেশ উত্তেজিত! একটা ভালো তথ্য মিলল রাজবাড়ি নিয়ে, এই সময় সুযোগ রয়েছে ভূতের দর্শন পাওয়ার। যদিও ভূত বলে কিছু আছে সেটা কেউ বিশ্বাস না করলেও, নাম শুনলেই একটা শিহরণ জাগে বুকের ভিতর।

মনের ভিতর অনেক প্রশ্ন খেলা করতে লাগল। পুজোর বাজার। একটা সাজো সাজো রব চারিদিকে। কলকাতার মতো এখানে সারারাত জেগে ঠাকুর দেখা হয় না। এই সুযোগটাকেই কাজে লাগাতে হবে। বাড়িতে জানিয়ে গেলে মাসিমা বাধা দেবে। তাই বাড়িতে না জানিয়ে চারমূর্তি রাজবাড়িতে রাত কাটাবে প্ল্যান করল। এখন শুধু অপেক্ষা নির্দিষ্ট দিনের।

 

এক সময় সেই দিন এসেও গেল। সবাই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে হাজির হল রাজবাড়ির পেছনে। ওখানে একটা প্রাচীর ভেঙে আছে আগেই দেখে এসেছিল তারা। ভীষণ উত্তেজিত চারমূর্তি। এই কয়েকদিন শুধু এই নিয়ে আলোচনা চলেছে। অতনু গুপ্তধন-এর নেশা কবেই ভুলে গেছে। যদিও অরিন্দম বলেছে, ভাগ্যে থাকলে গুপ্তধন পেয়ে যেতে পারিস।

একটা রোমহর্ষক ঘটনার সাক্ষী হতে যাচ্ছে ভাবলেই শিউরে উঠছে অতনু। যাই হোক, পিছনের রাস্তা দিয়ে ওরা রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখল চারিদিকে অন্ধকার। একটাও আলোর ব্যবস্থা নেই। পকেট থেকে মোবাইল-এর আলো জ্বালিয়ে চারপাশ ভালো করে দেখে নিয়ে একটা ফাঁকা মতো জায়গা দেখে ওরা বসে পড়ল। চারদিকে শুধু অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ছে না।

হঠাৎ পাশে সড়সড় করে একটা শব্দ আসতেই প্রবীর মোবাইল-এর আলো জ্বেলে দেখতে গিয়ে চমকে উঠল। একটা সাপ নিশব্দে এগিয়ে চলেছে। সবাই বেশ ভয় পেয়ে গেল। অনেক রাত অবধি যখন কিছুই হল না, বেশ বিরক্ত হয়ে উঠল চারজনেই। এভাবে ভূতের দেখা না মিললেও সাপ আর বিছের দেখা প্রতি মুহূর্তে মিলতে পারে। আর ভুল করে যদি কেউ পা দিয়ে ফেলে একবার কামড় খায়, তাহলে আর কথাই নেই!

প্রবীর বলল, চল একবার রাজবাড়ির ভেতর থেকে ঘুরে আসি তারপর ফিরে যাব। এই ভাবে রাত জেগে কোনও লাভ নেই। ভূতের দেখা মিলবে না। শুধু শুধু মশার দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছি। সবাই রাজি হয়ে গেল। আসলে কৌতূহলী হয়ে সবাই এলেও এখন অনুভব করছে, কী ভুলই না করেছে! এ ভাবে বাড়িতে না জানিয়ে এখানে এসে। যে-কোনও মুহূর্তে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। ধরা পড়লে পুলিশও চোর বলে লক-আপ-এ ঢুকিয়ে দেবে। তাই মোবাইলের আলো জ্বেলে এবড়ো খেবড়ো ভাঙা রাজবাড়ির ভেতরে কিছুক্ষণ ঘুরে এবার ফিরে আসবে ভেবেই পিছনের দরজার কাছে উপস্থিত হয়েছে। এমন সময় অতনু সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে আঁতকে উঠল! ওই দ্যাখ…

সবাই চমকে উঠল। অরিন্দম সেখানেই হুঁশ হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। প্রবীর ওকে ধরে ফেলল। অতনুর মুখে রা নেই। সবাই এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে দোতলার একটা ভাঙা ঘরের ভেতর লাল রঙের আলো জ্বলছে। ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। অরিন্দম নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়েছিল। হঠাৎ প্রবীরের হাত ঝাঁকিয়ে একটা দৌড় লাগাল। অতনুও দেখাদেখি দৌড়োতে গেল।

প্রবীর বলল, দাঁড়া আগে ব্যাপারখানা দেখতে হচ্ছে। অতনু বেশ উত্তেজিত হয়ে বলল, বলিস কী এত রাতে লাল আলো জ্বেলে দোতলায় কী হচ্ছে! নির্ঘাত ভুতুড়ে কাণ্ড। চল পালাই। প্রবীর ওকে শান্ত করে বলল, এত দূর ভূত দেখতে এসে এখন এভাবে পালিয়ে গেলে চলবে না। আগে পুরো ব্যাপারটা দেখতে হবে। একপ্রকার জোর করেই অতনুকে টেনে নিয়ে রাজবাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল প্রবীর।

ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে কোনও ভাবে দোতলায় উঠে দেখল, সে রকম কিছুই নেই। বেশ কয়েকটা ধংসস্তূপ আর ছাদহীন ঘর। ঘরের শ্রী দেখলে ভয় লাগে, কখন হুড়মুড় করে নীচে ধসে পড়বে। খুব সন্তর্পণে ওরা ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

হঠাৎ করে মুখের উপর জোরালো আলো এসে পড়ল দুজনের উপর। কে তোমরা? এত রাতে এখানে কেন মরতে এসেছ? বেশ রাশভারী গলায় কেউ প্রশ্ন করেছে। এই রকম অবস্থায় যে কেউ হলে ভয় পেয়ে যেত। কিন্তু প্রবীর বেশ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, সব কিছুর উত্তর পেয়ে যাবে একটু সবুর করো, তারপর একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। হঠাৎ লাফিয়ে সামনে যে-আলো ধরেছিল তার বুকে একটা জম্পেস লাথি মেরে বসল প্রবীর। আলোটা কোথায় পড়ে নিভে গেল আর মুহূর্তের মধ্যে আবার অন্ধকার।

অতনু কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ কারও দুমদাম করে নীচে নেমে যাওয়ার শব্দ হতে লাগল। প্রবীর বলল, অতনু চল ওদের তাড়া কর। পালিয়ে যেন না যায়। অন্ধকারে থাকতে থাকতে চোখ সয়ে গেছে। আবার বাইরে হালকা চাঁদের আলোও আছে, তাই বেশ দেখা যাচ্ছে। দুতিন জন পালিয়ে পিছনের ভাঙা প্রাচীরের কাছে এসে গেছে।

প্রবীর আর অতনুও নীচে নেমে এসেছে। এমন সময় একটা কাণ্ড হল, ওপাশ দিয়ে পুলিশের একটা দল ভেতরে ঢুকছে। যারা পালাচ্ছিল তারা ধরা পড়ে গেল। বড়োবাবু প্রবীর আর অতনুর হাত ঝাঁকিয়ে বললেন, বেশ বাহাদুর ছোকরা তো তোমরা। এই দলটাকে আমরা বেশ কয়েক মাস ধরে খুঁজছিলাম। লোকাল চুরি ডাকাতির অনেক কেস আছে এদের নামে।

অতনু অবাক হয়ে সব কিছুই দেখছিল। সব কিছু যেন একটা স্বপ্ন। এতক্ষণে বলল, কিন্তু স্যার আপনি ঠিক সময় এখানে কী করে হাজির হলেন? একটু দেরি হলেই তো ওরা পালিয়ে যেত।

পুলিশকর্তা এবার হাসতে হাসতে বললেন, এর জন্যে তোমার এই বন্ধুটি দাযী। আমরা নিয়মমাফিক পেট্রলিং-এ বেরিয়েছিলাম। এমন সময় তোমার এই বন্ধুটি আমাদের দেখতে পেয়ে সব ঘটনা খুলে বলে। এখানে এসে দেখি এই কাণ্ড।

প্রবীর বলল, আমাদের বন্ধুটিকে দেখতে পাচ্ছি না?

সবার পিছন থেকে শুকনো গলায় অরিন্দমের আওয়াজ ভেসে এল, আমি আছি!

 

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...