ফ্ল্যাটের কোনও নাম রাখা যায় না? যেমন বাড়ির নাম হয়, কী সুন্দর সুন্দর সব নাম– ছায়াপথ, সুরলোক, সুখনীড়, মানসী– শান্তিনিকেতনে দেখেছি…। ফ্ল্যাটে ঢুকবার সময় দরজার গায়ে একটা নম্বর দেখে সবাই ৭সি-৩৬, কেন? একটা নাম রাখলে কী হয়? মহাভারত অশুদ্ধ হয়?– দুলাল বলল।

রাই বলল– কী নাম রাখতে চাও?

দুলাল সেটা ভাবেনি যদিও। মনে এল, তাই বলে ফেলল। রাইয়ের সঙ্গে গল্প করছিল কিনা, ব্যালকনিতে। পাশাপাশি বসে। সাততলা থেকে অনেকটা আকাশ দেখা যায়। কাশিপুর গান-শেল কারখানার চিমনিও দেখা যায়। আবার রাস্তার গাড়িগুলোকে খেলনা গাড়ির মতো লাগে। ওসব দেখছিল আর গল্প করছিল। সকালে আলুর পরোটাটা বেশ ভালো হয়েছিল দিয়ে শুরু। রাই বলল, পরোটা নয়, পরাঠা। নর্থ ইন্ডিয়ানরা এটাকে পরাঠাই বলে। দুলাল বলে, ধুর, পরাঠা কেন? ছোটোবেলা থেকে পরোটাই তো শুনে এসেছি। অফিস ক্যানটিনেও তো পরোটাই বলে।

বলুকগে। ভুল বলে। তর্ক কোরো না। বড়ো হোটেলে পরাঠাই বলে।

 

দুলাল চুপ করে।

ওর নাম কিন্তু দুলাল নয়। ওর নাম কংসারি। কংসারি মন্ডল। রাই ওকে দুলাল ডাকে। কংসারি ডাকা যায় নাকি?

বলো, একটা নাম বলো, সাজেস্ট করো তুমি, ফ্ল্যাটের কেউ নাম দেয় না তো কি হয়েছে, আমরা দিতেই পারি, খুব সুন্দর করে, কাঠে এনগ্রেভ করে একটা নাম দরজার গায়ে লাগিয়ে রাখব।

দুলাল নাম খুঁজে পায় না। মাথা চুলকে বলে কষ্ট নীড় রাখলে কেমন হয়, কত কষ্ট করে ফ্ল্যাটটা করলাম, ইএমআই দিতে দিতে টাট্টি জ্যাম হয়ে যাচ্ছে।

টাট্টি জ্যাম ধরনের শব্দ আগে খুব একটা বলত না, ইদানীং স্মার্ট হবার জন্য এসব শব্দ বলছে। বলে লাভ হয়। এই তো রাই খুশি হয়ে ওর থুতনিটা নাড়িয়ে দিল।

আজ রোববার। আলুর পরোটা বা পরাঠা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারা হল। তারপর হাতে খবরের কাগজ নিয়ে ব্যালকনিতে। রান্নাঘর থেকে টুংটাং ঠকঠক শব্দ। এগুলো গৃহস্থালির শব্দ। এই শব্দ সংসারের শব্দ। এই শব্দ খুব ভালো লাগে দুলালের।

বাসন মেজে, ঘর মুছে তরকারি কাটবে দীপা। একটা তরকারিও করে দেবে। রোববারের রান্নাটা রাই নিজে হাতে করে। আজ ছোটো চিংড়ি দিয়ে ওলের ডালনা, আর পাঁঠার মাংস।

কংসারি, তথা দুলারের এই শহরজীবন বেশি দিনের নয়। ও থাকত বাতকুল্লা নামে একটা জায়গায়। ছোটোবেলায় বাবা মারা গেছে। মা আর ছেলে। খুব টাকাপয়সার টানাটানি ছিল ছোটোবেলায়। ওর বাবার ছিল একটা মুদি দোকান। বাবা গত হলে ওর মা বসতেন। মা কি আর দোকান চালাতে পারে? মাল আনাই তো বড়ো সমস্যা। কখনও কৃষ্ণনগর, কখনও চাকদহ থেকে মাল আনতে হতো। কংসারির মায়ের ছিল এক ফুল পাতানো সই। সেই সই বাজার থেকে ব্যাগে করে মশলাপাতি, বিস্কুট, চায়ের প্যাকেট এনে দিত। মাঝেমধ্যে কংসারিকেও দোকানে বসতে হতো। মুসুর ডালের কিলো বাইশ টাকা হলে দেড়শো গ্রাম কত, দু’টাকায় কতটা কালোজিরে দেয়া যাবে, তেরো টাকার প্যাকেটে তিরিশটা বিস্কুট থাকলে খুচরো একটা বিস্কুট কত করে বেচলে প্যাকেটে টাকা লাভঞ্জথাকে– এসব জটিল অঙ্ক মুখে মুখে করতে হতো বলেই পাটিগণিতে ভালো হয়ে গিয়েছিল। মাধ্যমিক ফাস্ট ডিভিশন। সায়েন্স পড়লে নাকি খরচ বেশি, তাছাড়া মাস্টার রাখতে হয়, তাই কমার্স। বিকম পাশ করেই চাকরির জন্য নানা রকম পরীক্ষায় বসা। দু’বছরের মাথায় প্রথম চাকরিটা হয়ে গেল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ড-এ। রানাঘাট এ পোস্টিং। পরের বছরই ব্যাংকের প্রবেশনারি অফিসার। কলকাতার একটি ব্র্যাঞ্চে পোস্টিং।

সেই প্রথম কলকাতায় থাকা। আগে কলকাতা এসেছে পরীক্ষা দিতে কিংবা বইপত্র কিনতে, দু’একবার বড়োবাজারে দোকানের মাল কিনতে। কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক বলতে এটুকুই ছিল। ও সাউথ সিটি চিনত না, নিক্বো পার্ক জানত না, পিৎজা চোখে দেখেনি আগে, পার্ক স্ট্রিটের কোনও বার-এ ঢোকা দূরে থাক, ওই রাস্তাটা দিয়েও আগে হাঁটেনি কখনও। সেই পার্ক স্ট্রিট ব্র্যাঞ্চ-এ পোস্টিং হল।

একটা মেস-এ থাকত দমদমের কাছে। দু’বেলা পেট ভরে খাওয়া আর একটা ছোট্ট ঘরে নিজের একটা তক্তাপোশে– সেই তো অনেক। অফিস কলিগরা বলল, তুমি একটা বুদ্ধু। এভাবে থাকে কোনও ব্যাংক অফিসার? ব্যাংক তোমায় বাড়িভাড়া দেবে। একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে নাও।

একটা পুরো ফ্ল্যাট? ওরেব্বাবা। পুরোটা নিজের? ভাবাই যায় না।

চাকরি পাওয়ার পর টাকা যা পেত, সে তো অনেক। দোকানটা ঠিকঠাক করল। শো কেস, সুন্দর তাক, মা খুব খুশি। কংসারি ভাবল ফ্ল্যাট নিলে মাকে নিয়ে আসবে, আর দোকানটার দায়িত্ব দিয়ে দেবে ওর ছেলেবেলার বন্ধু হারুকে। সে আবার ওর মায়ের ফুল পাতানো সখীর ছেলেও। হারু বেকার। পড়াশোনাতে ও ভালো ছিল না তেমন। হায়ার সেকেন্ডারি দুবারে পাশ। কলেজে ভর্তি হয়নি। একটা লন্ড্রিতে জামাকাপড় ইস্তিরি করত।

ওর দাদা ছিল দুটো, বউদিরা গঞ্জনা দিত, দামড়া ছেলে ভাত গিলছে বসে বসে– এইসব বলত। হারুর মা, মায়ের সই, ফুলমাসি

কংসারিকে বলেছিল, ছেলেটাকে কিছু জুটিয়ে দাও বাবা।

ফুলমাসির জন্যই দোকানটা চালাতে পেরেছিল মা। আর, দোকানের সামান্য আয়েই তো কংসারির পড়াশোনা, এই চাকরি।

ফুলমাসির তিন ছেলে। হারু ছোটো। বড়ো দু’জন যে খুব ভালো রোজগারপাতি করত এমন নয়। হারু তো কিছু করত না। ফুলমাসি সন্ধের দিকে দোকানে বসত, হারুও বসত মাঝে মাঝে। কংসারির মা ওদের কিছু ধরে দিত। সুতরাং মাকে কলকাতায় নিয়ে এলে দোকানটা চালানোর দায়িত্ব হারুকেই দেয়া যায়। বিক্রি করতে চাইলে হারু কিনতে পারবে না, তা ছাড়া হারুর সঙ্গে কংসারির যা সম্পর্ক, তাতে দোকানের দরদাম নিয়ে দরাদরি চলে না। হারুর টাকাপয়সা হলে না হয় কিছু দিয়ে দেবে।

হারু ওর গুরু। অনেক কিছুর গুরু। ডাংগুলি গুরু, মাছধরা গুরু, অসভ্য খেলারও গুরু। কৈশোরের গুপ্ত পাঠক্রম হারুই দিয়েছিল। প্রথম বিড়ির টান, কাশি, ও কিছু নয়– পরে সব ঠিক হয়ে যাবে, হারুই তো বলেছিল।

মাকে ফ্ল্যাটে নিয়ে এল কংসারি। মা তো গ্যাসের উনুন দেখে হেসেই বাঁচে না। ওমা! আঁচ দিতে হয় না? হিহিহি। ওমা, ধুয়াঁ নাই? কীরে! হিহিহি। কিন্তু ছাই হয় না বলে দুঃখ, বাসন মাজা হবে কী করে? ফ্রিজ আগে দেখেছে, কিন্তু ব্যবহার করেনি কখনও। কী আজব আলমারি। সব ঠান্ডা করে রাখে। ঠান্ডা করার দরকার কী? সব তো গরম করতেই হয় আবার। ঠান্ডা তরকারি কি খাওয়া যায় না কি?

কংসারি বলে– একদিন রান্না করে তিনদিন খাওয়া যাবে মা, খাটুনি কমবে। উনি বলেন– সে কী রে? বাসি খাবি কেন? এই আলমারিটা ভালো না। রোজ রোজ টাটকা রান্না করে দেব। নীচেই তো বাজার বসে, তোর সময় না হলে আমিই বাজার করে আনব। আমার আর কাজ কী! ঠান্ডা করার আলমারিটা ফিরত দিয়ে আয়। কংসারি বলে– না মা, ভালো চাকরি করলে ঠান্ডাই খেতে হয়, ফ্রিজ রাখতে হয় ঘরে, বন্ধুরা আসবে, ফ্রিজ না হলে খারাপ ভাববে, গাঁইয়া ভাববে মা, ঠান্ডা জলে শরবত করে দিও।

কংসারির মা বলত– কত রকম খাবার খাওয়াস তুই, রোজ দুধ খাই, সন্দেশ, ইচ্ছামতো শাকসবজি। কিন্তু এখানে দমবন্ধ লাগে। খুপরি বাড়ি। উঠান নাই। একটা নিমগাছ নাই। নিমবেগুন করব বলে নিমপাতাও কিনতে হয়। সরুসরু চারগাছি দুটাকা। তুলসিগাছও নেই। তুই বিয়ে কর, শহরের মেয়ে যে সব জানে, ওকে তোর কাছে রেখে আবার দেশের ঘরে ফিরে যাই।

সেটা আর হল না। ওর মা আগুনে পুড়ে মারা গেল। সভ্যতার আগুনে। মানে গ্যাসের আগুনে।

গ্যাস কি করে খুলতে হয়, বন্ধ করতে হয় ভালো করেই তো শিখিয়ে দিয়েছিল কংসারি। তবু কিছু ভুল করেছিল ওর মা। অফিসে ফোন পেল– শিগগির চলে আসুন, আপনার ঘরে আগুন লেগেছে।

ততক্ষণে ঘরের দরজা ভাঙ্গা হয়ে গেছে। রান্নাঘরের দেয়ালের তেলরঙে কালচে ছোপ, কাঠের ক্যাবিনেট থেকে হালকা ধোঁয়া বেরুচ্ছে। মাকে ওরাই হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে।

করেছেন কি মশাই, গ্রাম থেকে যাকে এনেছেন, সে যদি গ্যাসের ইউজ না জানে তো গ্যাস ওভেন হ্যান্ডেল করাচ্ছেন কেন? সারা বাড়িতে আগুন ধরে যেত, সবাই পুড়ে মরতাম, ভাগ্যিস সিলিন্ডারে বেশি গ্যাস ছিল না, যা ছিল বেরিয়ে গেছে, নইলে সিলিন্ডার বার্স্ট করত।

মা তখনও জীবিত ছিল, জ্ঞানও ছিল, চোখের তারা নড়েছিল, ঠোঁট কেঁপে উঠেছিল, মুখের চামড়া ঝলসানো। পরদিন মারা গেল। বাড়িওলা ক্ষতিপূরণ চাইল। দিতে হ’ল। আবার নতুন করে রং করানো হল। বাড়িওলা বলল ছেড়ে দিন। আবার মেসজীবন। সেটাই ভালো। মেস থেকে হেঁটে দমদম মেট্রোরেল, পার্ক স্ট্রিট। অফিস, অফিসে যত বেশি সময় থাকা যায় থাকত, তারপর ফের মেসের গহ্বর। একটা কষ্ট কেবল ঘুনপোকার মতো ওকে কুরে খাচ্ছিল– ওর মায়ের মৃত্যুর জন্য ও দায়ী। সভ্যতা দিতে গিয়েছিল, আধুনিকতা দিতে চেয়েছিল মাকে। বাতকুল্লার নিম-তুলসী-উঠোন থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এসে গ্যাস চেম্বারে মেরে ফেলল নিজের মাকে।

একদিন পার্ক স্ট্রিট স্টেশন ছেড়ে পরের স্টেশনের দিকে ছুটল ট্রেনটা। কংসারি দাঁড়িয়ে, ওসব ভাবছে। সিটে বসা একটি মেয়ে ওকে বলল– এক্সকিউজ মি, পার্ক স্ট্রিট নামলেন না? ওর হুঁশ হল। বলল– থ্যাংকিউ। ভুল হয়ে গিয়েছিল। মেয়েটা বলল– রোজই তো নামেন, আপনি আনমাইন্ডফুল, বুঝতে পারছিলাম।

এই মেয়েটাই রাই। ট্রেনে দমদম থেকে পিছনের দিকেই ওঠে।

কংসারিও তাই। কংসারি খেয়াল করেনি আগে। এরপর থেকে মাঝে মাঝে দেখা হওয়া, গুডমর্নিং বলা, সিইউ বলা…। সিট পেলে মেয়েটা ব্যাগটা চেয়ে নিত, কংসারি সিট পেলে নিজে না বসে ওকেই বসতে দিত। মেয়েটা ওয়েব ডিজাইন করে। ওর অফিস এলগিন রোডে। নেতাজি ভবন স্টেশনে নামে। একদিন ফেরার সময় দেখা, ট্রেনেই। মেট্রোরেল গিরীশ পার্কে থেমে গেল, সামনের কোথাও আত্মহত্যার ঘটনা। মেয়েটা বলল– চলুন, ট্যাক্সি পাই কিনা দেখি। শীতকাল। ওরা হাঁটছিল, হাঁটতে হাঁটতে কথা। এভাবেই ক্রমশ।

মেয়েটা বলেছিল– আপনাকে কংসারি ডাকতে পারব না আমি। খুব বাজে নাম। আপনার কোনও ডাকনাম নেই?

কংসারি বলেছিল– ডাকনামটা তো আরও ইয়ে। ভুতো।

– ইশ্, ভুতো, ভুতো কেন?

– তা জানি না। পাড়ায় তো এটাই আমার নাম।

– ভুতো ডাকা যায় নাকি? কংসারি নামটাকে যে ছোটো করে ডাকব, তারও উপায় নেই। কংসারি ছোটো করলে কংস হয়। হুঃ, কী বাজে। এরকম নাম কে রেখেছিল?

– আসলে এটা শ্রীকৃষ্ণের একটা নাম। কংস বধ করেছিলেন কিনা, কংসের অরি।

তা কেষ্টঠাকুরের তো আরও নাম ছিল, সে সব রাখলেই তো হতো। বলুন তো কেষ্টঠাকুরের আর কী কী নাম আছে?

শ্রীকৃষ্ণের শতনাম তো মুখস্থই ছিল, মা রোজ সকালবেলা একবার বলতেন কিনা… যশোদা রাখিল নাম যদু বাছাধনযশ্রীনন্দ রাখিল নাম নন্দের নন্দন। ননীচোরা নাম রাখে যতেক গোপিনি কালসোনা নাম রাখে রাধা বিনোদিনী। দেবকী রাখিল নাম আদরে গোপালযচন্দ্রাবলী রাখে নাম নন্দের দুলাল…

– হ্যাঁ, নন্দের দুলাল নামটা মন্দ নয়, তবে নন্দটা বাদ। দুলাল বেশ মিষ্টি নাম। আমি দুলাল বলেই ডাকব।

কংসারি ঘাড় নেড়েছিল।

সেই থেকে রাই, দুলাল বলেই ডাকে।

– দুলাল বলেছিল– রাই মানে জানো তো?

রাই মানে সখী, গার্লফ্রেন্ড…।

– গার্লফ্রেন্ড ঠিক কথা, তবে কৃষ্ণের গার্লফ্রেন্ড। রাই হল রাধিকা। কীর্তনে আছে না– ললিতা বলছে, শুন বলি রাই, ডাকিছে কানাই…।

রাই বলে– তাই বুঝি? রাই মানে রাধিকা? আই মিন রাধা? আর তুমি কংসারি মিন্স কৃষ্ণ? তা হলে তো উই আর মেড ফর ইচ আদার।

রাইরা শহুরে। ওর বাবা মাঝারি মাপের সরকারি আমলা। বোঝাই যাচ্ছে বেশ স্মার্ট, আধুনিক। রাই প্রচুর স্মার্ট ছেলে দেখেছে জীবনে, হামবড়াই, চতুর, মিথ্যুক এবং শরীর লোভী দেখে ফেলেছে ওর ছাব্বিশ বছরের জীবনে। দুলালের সরলতা, আনস্মার্টনেস এবং যা অনেকের কাছে বোকামি মনে হবে– সেটাই ভালো লেগেছিল রাইয়ের। যে দিন ফ্লুরিস্ এ গিয়ে কোল্ড কফি অর্ডার দিয়েছিল রাই, দুলাল বলেছিল– কফি কেউ ঠান্ডা খায় নাকি? রাই বলেছিল– তোমার ভুতো নামটাই ভালো ছিল।

বিয়ে হল। রাইয়ের বাবার অমত ছিল না। অভিভাবকহীন সাধাসিধে অথচ সুচাকুরে জামাইকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে এটাই সবচেয়ে বড়ো প্লাস পয়েন্ট। এবং তাই হল। দুলাল রাইয়ের বাধ্য হল, যা নাকি রাইয়ের ভাষায় লক্ষ্মী ছেলে, আদরে সেটা ‘নো-ও-ক্ষ্মি’ হয়ে যায়।

যে ফ্ল্যাটটা ভাড়া করেছিল দুলাল, সেটা পছন্দ নয়। ব্যাংক অফিসার যখন, লোন নিয়ে নিজে কিনবে না কেন? লোন নিল। কাছাকাছির মধ্যেই একটা রেডি ফ্ল্যাট। থ্রিবিএইচকে। মানে তিনটে বেডরুম। ওয়ান ব্যালকনি, টু টয়লেট, প্লাস লিভিং-ডাইনিং। বারোশো আশি স্কোয়ার ফিট, উইথ লিফ্ট।

গত এক বছরের বিবাহিত জীবনে ভুতো দুলালকে অনেকটাই সভ্য করে নিতে পেরেছে বলে রাইয়ের ধারণা। অফিস যাবার সময় ডিও স্প্রে করে দুলাল, চুলে কন্ডিশনার দিতে শিখেছে, লিফ্টে কারুর সঙ্গে দেখা হলে হ্যালো গুডমর্নিং ইত্যাদি বলতে শিখেছে, এমনকী রাইয়ের কোনও বান্ধবী বাড়িতে এলে বলতে শিখেছে– আপনাকে দেখে তো ফিদা হয়ে যাচ্ছি। এমনকী যে চিজ-এর গন্ধটা সহ্য করতে পারত না, এখন চিজ স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। কিন্তু ছাড়তে পারছে না হারুকে। একটা ইরিটেটিং, ডিসগাসটিং লোক।

হারুর কথা ভাবতে ভাবতেই হারু এসে হাজির। কলিংবেল বাজার কায়দাই বুঝিয়ে দেয় ও হারু। পরপর তিনবার। একটু গ্যাপ দিয়ে আবার একবার। ভদ্রলোকরা একবারই বাজায়। বড়োজোর দুবার।

রাই ব্যালকনিতেই। চেয়ার ছেড়ে উঠল না। দুলাল ছিটকিনি খুলে দিল। হারুর হাতে একটা ব্যাগ। যখনই আসে ব্যাগ থাকে। কিছু না কিছু নিয়ে আসে। কুমড়ো, কিংবা লাউ, কিংবা এঁচোড়– কিছু না হলে পুঁইশাক। হারু বলল– দুটো নারকোল আছে, আমাদের গাছের, আর ক’টা পেঁপে আছে, তোদের উঠোনের গাছের।

রাই ভ্রু কুঁচকে তাকায়। এক্ষুনি ওকে জলখাবার দিতে হবে। আলুপরাঠার দুটো পুর ভরা গোলা রাখা ছিল কাল টিফিন নিয়ে যাওয়ার জন্য, ওগুলো এখন দীপাকে দিয়ে লেচি করিয়ে নিতে হবে।

সাধারণত সকালের দিকে আসে না এই হারুবাবু। রবিবার সন্ধের দিকে আসে। রাত্তিরে থেকে যায়, সোমবার সকালে বৈঠকখানায় মালপত্র কিনে বাড়ি ফেরে। বাতকুল্লা এমন কিছু দূরে নয়, সকালে বেরিয়ে বাজার সেরে বিকেলের মধ্যেই ফিরে যাওয়া যায়। কিন্তু ও মাঝেমাঝেই রোববার সন্ধের সময় হাজির হয়ে যায়। প্রশ্রয় আছে।

দুলালই ওকে আসতে বলে। যদি ওরা বাড়ি না থাকে, ব্যাগটা কেয়ারটেকারের জিম্মায় রেখে ঘুরে বেড়ায়, রাত্রে চলে আসে। দুলাল জানে রাই ওকে পছন্দ করে না, দুলাল বলে– সংসারের সবই তো তোমার কথা মতোই চলে, শুধু এই একটা ব্যাপার তুমি মেনে নাও। ওর উপর আমার দুর্বলতা আছে, বাবা মারা যাবার পর হারুর মা যদি  আমাদের হেল্প না করত, আমার লেখাপড়াই হতো না। তা ছাড়া হারু যত অনেস্ট। দোকানটা থেকে যা লাভ হয়, তার কিছুটা আমাকে দিয়ে যায়, জোর করে। ও আমার একমাত্র বন্ধু। অফিসে যারা আছে, ওরা তো কলিগ।

– আমি বুঝি বন্ধু না? রাই বলে,

দুলাল বলে– সরি সরি, তুমি সব চেয়ে বড়ো বন্ধু। বন্ধু, গার্জিয়ান, এভরিথিং। তোমার পরেই হারু।

চটিটা নোংরা। কখনও পালিশ দূরে থাক, ব্রাশও করে না। ওর জামা থেকে বাজে গন্ধ ছাড়ে। ভাগ্যিস থ্রি রুম ফ্ল্যাট, একটা ঘরে একটা সিংগল খাট পাতা থাকে, ছোটো আলনাও। ও চলে গেলে দীপাকে দিয়ে চাদরটা কাচিয়ে নেয়। বাইরের বাথরুমটা ইউজ করে ও। প্রথম যেবার এল, লোকটা নির্লজ্জের মতো গামছা পরে খালিগায়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ব্যালকনিতে মেলে দেয়া গৌহাটি থেকে আনা রাইয়ের সাদা গামছাটায় বগল মুছে নিল। রাই ওই দৃশ্য দেখেই বলল– দাঁড়ান, দাঁড়ান, তোয়ালে দিচ্ছি– বলে আলমারি খুলে একটা সাদা তোয়ালে ছুড়ে দিল ওর দিকে। ও বলল– আর তোয়ালে কী হবে, এতেই তো হয়ে গেছে। ভুতো, তোর একটা লুঙ্গি দে পরি।

বিয়ের পর দুলাল হয়ে গিয়ে লুঙ্গি পরা বন্ধ হয়ে গেছে ভুতোর। একটা পা-জামা দিয়েছিল দুলাল।

সেই পা-জামাটায় কালো সুতো দিয়ে একটা মার্ক করে রেখেছে রাই। ও এলে ওই পা-জামাটাই বের করে দেয়, পরে দীপাকে দিয়ে কাচায়। ওর জন্য একটা আলাদা সাবানও রাখতে হয়েছে। ও চলে গেলে পলিথিনে জড়িয়ে এক জায়গায় রেখে দেয়, আবার এলে বাথরুমের সাবানটা বের করে ওটা ঢুকিয়ে দেয়। ওর এদিক নেই, ওদিক আছে। একদিন বলল– কী ব্যাপার বলতো ভুতো, তোদের সাবান দেখি ফুরোয় না… সেই একই সাদা লাক্স, কতদিন চলে?

দুলাল তো ভুতোই, কী বলতো কে জানে? রাই ম্যানেজ করেছিল। বলেছিল– সবার আলাদা সাবান ব্যবহার করতে হয়। ডাক্তাররা তাই বলে। আপনারটাও তোলা থাকে। এবাড়িতে ওরা মাস ছয়েক হ’ল এসেছে। এবাড়িতে আসার পর মাসে দুবার করে ওর আসাটা প্রায় বাঁধা হয়ে গিয়েছিল। ওরা দুজনে একই গল্প করে। সেই ডাংগুলি খেলা, ভূগোল স্যার, বেঁটে স্যার, কুঁজো পিসি, কেঁচো দিয়ে মাছ ধরা, খ্যাপলা জাল না কি একটা জালে কচ্ছপ উঠেছিল, সেই কচ্ছপের মাথায় সিঁদুরের দাগ… সব মুখস্থ হয়ে গেছে। ওরা গল্প করতে থাকলে টিভির সিরিয়াল চালিয়ে দেয় রাই, বলে– তোমরা একটু চুপ করো। শুনতে পাচ্ছি না। ওরা ওই ছোটো ঘরটায় চলে যায়। একবার বিকেলে ওদের সিনেমায় যাবার কথা, বেরোবে, সেই সময় হাজির। ওকে নিয়েই সিনেমায় যেতে হল। পিভিআর-এ। তারপর পপকর্ন। আশি টাকা করে প্যাকেট। এমন করে খাচ্ছিল যেন দু’টাকার ঠোঙার মুড়ি খাচ্ছে।

লাস্ট যেবার এল, ওরা দুজন একটু ঘুরে আসছি বলে বেরিয়ে গেল, ফিরল দশটার পর। বোঝাই যাচ্ছিল ওরা মদ খেয়েছে। মদ-টদ আগে তো খেত না, বিয়ের পরই একটু-আধটু, দু’জনে মিলে। কখনওই দুপেগের বেশি নয়। বেশিই খেয়েছিল সেদিন, বিশেষত ওই লোকটা। হারু। জুলজুল করে তাকাচ্ছিল, চোখটা লাল। বলছিল– বউদি, বউদি, তুমি আমার বন্ধুকে হরণ করেছ। রাত্রে খেল না। বলল বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে। রাত্রে ওরা দুজনে একসঙ্গে শুল। সিঙ্গল খাটে। সেদিন থেকেই লোকটাকে অসহ্য লাগে। রাই জিজ্ঞাসা করেছিল দুলালকে– ওর সঙ্গে শুলে কেন? ও বলেছিল– যাতে তোমার কোনও অসুবিধে না হয়। মুখে একটু গন্ধ ছিল কিনা। খেয়ে ফেলেছিলাম।

– ও? ক’টা খেয়েছিলে?

– দুটোর পর একটুখানি, হাফ।

– ও ক’টা খেয়েছিল?

– তিনটের পর একটুখানি, হাফ। দুজনে মোট ছ’টা। ওর কি এসব অভ্যেস আছে নাকি? ভালো হুইস্কি খাবার পয়সা আছে নাকি ওর, যদি এক-আধবার খায় তো দেশিই খায়।

– দেশি? মানে বাংলা? বিচ্ছিরি লোক তো ও। ক্রিমিনালরা

বাংলা খায়। আঁৎকে উঠেছিল রাই। দুলাল বলেছিল– পয়সার অভাবে তো। ক্রিমিনাল হবে কেন? কত কবি সাহিত্যিক দেশি খেতেন জানো? পড়োনি অমৃতধারা ম্যাগাজিনটার লাস্ট ইস্যুতে?

হারুবাবু এসে সোফাতে বসেছে। বসেই চ্যাঁচাল– বউদি, চা খাব।

বউদি বলে কেন কে জানে? ও তো দুলালের চেয়ে বড়ো। দুতিন বছরের বড়ো। অবশ্য কীই বা ডাকবে? নাম ধরে ডাকলে তো আরও খারাপ হতো।

রাই ম্যাক্সিটার উপরে হাউসকোট চাপিয়ে নেয়। এসে না বসেই বলে– কী ব্যাপার, আজ যে সকালে?

হারু হাহা করে হাসে– আপনার হাতের কচিপাঁঠার ঝোল খাব। রবিবার দুপুরে পাঁঠার মাংস হয়, রাতের বেলায় আর থাকে না।

–ও। রাই তির্যক তাকিয়ে বলেছিল। হারু এবার বলল– আর একটা কারণও আছে। আজ একটা মিটিং আছে না, ধর্মতলায়, দুপুরের পর থেকে ট্রেনে ওঠা যাবে না। ওরা সব ফ্ল্যাগ, লাঠিসোঁটা নিয়ে ওঠে। ওরা খুব দজ্জালি করে। তাই ভাবলাম সকালেই আসি।

– ও।

খুব নির্লিপ্তভঙ্গিতে বলল রাই।

দুলাল বলল– বেশ করেছিস, বেশ করেছিস।

– চা খা। দুজনে বাজার যাব।

রাই বলল– দীপা, পরোটা বেলে দে।

বিকেলে দুজনে মিলে রাইয়ের এক কলিগের বাড়িতে যাওয়ার কথা। রাইয়ের কোম্পানিটা ভালো চলছে না। কাজটাজ বেশিরভাগই মুম্বই-ব্যাঙ্গালোর-গুরগাঁও থেকে হচ্ছে। গত দু’ বছর কোনও ইনক্রিমেন্ট হয়নি। শোনা যাচ্ছে লোক কমাবে। মানে ছাঁটাই। নিজেরা একটা বিজনেস করার কথা ভেবেছে। এখন বুটিকের ব্যবসায় লাভ ভালো। বিভিন্ন জায়গা থেকে কিনে আনলেই হল। সাজানোটাই আসল, আর লোকেশন। ঠিক জায়গায় বুটিক খোলা। খরচ প্রচুর।

ব্যাংক লোন নিয়ে কথা বলার ছিল। ওকে তো ওখানে নিয়ে যাওয়া যায় না। থাকুক, বাড়িতেই। রাই, হারুর সঙ্গে বিশেষ কথাবার্তা বলল না। ওয়াশিং মেশিনটা বের করে রাজ্যের জামাকাপড় চাদর কাচতে লাগল। একবার স্বগতোক্তি করল– রোদ উঠেছে বেশ। মাড় দিল। ব্যালকনিতে মেলে দিল। হারু আর ভুতো গল্পগাছা করছিল, সেই এক গল্প। মাঝেসাজে একবার বলল– সাইড বিজনেস শুরু করেছি। জমির দালালি। এবং এটা যে মিথ্যে নয়– বোঝা গেল, মাঝে মাঝে ওর মোবাইলে ফোন আসছিল, হ্যাঁ-হ্যাঁ-ডাঙ্গা জমি, জল জমে না, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ভ্যান রিকশা ঢুকে যাবে– এইসব কথাবার্তা শোনা যাচ্ছিল। কাচাকুচির পর মাংস রান্না। বেলা হয়ে গেল।

বিচ্ছিরি করে খায় লোকটা। কড়মড় করে হাড় চিবিয়ে টেবিলে রাখে। হাতের আঙুলগুলো বিচ্ছিরি ভাবে চাটে। রাই ওর সঙ্গে কথা বলছে না, পাত্তা দিচ্ছে না, সেটা বুঝতে পারলে এর পর আসতে গেলে চিন্তা করবে। ওকে মাংসের বাটিটা দেবার সময় টেবিলে ঠক করে শব্দ হয়েছে, আরও ভাত দেব? হাঁড়ির অর্ধেকটা দিয়ে দিই? এভাবেই বলেছে রাই। লোকটা তাও বোঝে না?ঞ্জবলেছে অর্ধেক কেন, তার চেয়ে কম।

বিকেলে বেরোল ওরা। আলমারির চাবি সঙ্গে করে নিয়ে গেল রাই। হারুকে বলল সাবধানে থাকতে। কেউ এলে দরজা না খুলতে। হারু বলল– কোনও চিন্তা নেই। চুপচাপ বসে বসে টিভি দেখব। কেয়ারটেকারকেও বলে গেল রাই, বাড়িতে বাইরের লোক আছে, লক্ষ্য রাখতে।

রাতে ফিরল, বাইরে থেকে খাবার কিনে। বেশি করেই আনতে হল, ছাতার-মাথা গেস্ট আছেন। বাড়ি ফিরে দুঃসংবাদ– হারু আরও একদিন থাকবে। আজকের মিটিং-এ আসা নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঝামেলা হয়েছে। বাতকুল্লার ভিতরের দিকে কোনও জায়গা থেকে ম্যাটাডোর বোঝাই কিছু মিটিংগামী লোক বাতকুল্লা স্টেশনে আসছিল, সেই ম্যাটাডোরে বোমা ফেলা হয়েছে। দু’জন মারা গিয়েছে। এর প্রতিবাদে আগামীকাল বাতকুল্লা বন্ধ। রেল অবরোধ। কৃষ্ণনগরেও বন্ধ পালিত হবে।ঞ্জওরা দেখল টিভিতেও এই খবর দেখাচ্ছে, হাসপাতালে ব্যান্ডেজবাঁধা আহত সকাশে নেতাগণ। অন্য চ্যানেলে বলছে সবরকম ভাবে প্রতিবাদের কর্মসূচি নেওয়া হবে।

হারু বলল– মালপত্র কিনে কাল বিপদে পড়ব। পরশু বরং যাব। একটা দিন বেশ রেস্ট হোক। ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেব। রাই ভ্রূ কুঁচকে তাকাল হারুর দিকে, আর কটমট করে দুলালের দিকে। দুলাল অপরাধবোধে মাথা নীচু করে।

– আপনার আর কোথাও যাবার জায়গা নেই? রাই বলেই ফেলল।

কোথায় আবার যাব? ভুতো ছাড়া আমার কে আছে? হারু মাথা চুলকোয়। বুঝতে পেরেছে এতক্ষণে। নইলে বলবে কেন– তোমাদের খুব ডিসটার্ব করছি, না?

দুলাল বলে– না-না, ডিসটার্ব কেন? ভালোই তো লাগে।

রাই দুলালকে ডেকে বলল– একদম ওর সঙ্গে গুজুর গুজুর করবে না। ও একা থাকুক। কোম্পানি দিতে হবে না। এইখানে বসে থাকো। বেডরুমের রকিং চেয়ারটাকে দেখায় রাই, হাতে নেতানো খবরের কাগজটা ধরিয়ে দেয়।

রকিং চেয়ারে ও দোদুল্যমান।

রাইকে চটানো উচিত হবে? হারুর কাছে একবার যাওয়াটা কি উচিত নয়? রান্নাঘর থেকে খুটখাট শব্দ আসছে। রাই কিচেন গুছোচ্ছে। জলের শব্দ। এবার হারুর কথা শুনল দুলাল। – বউদি, ও বউদি, কাল তো সারা দিন আমি ঘরে। একটু আটা জাল দিয়ে রাখলে সারাদিন ধরে ঠোঙা বানাতে পারি, খবরের কাগজ আর একটা কাঁচি যদি…

ওর কথা শেষ হবার আগেই রাই বলে– খবরের কাগজ নেই, সব বেচে দেয়া হয়েছে।

ও, ঠিক আছে। তা হলে এক কাজ করেন। একটা ইস্তিরি রেখে যান। সারাদিন তো অনেক কাচাকুচি করেছেন, রোদটাও বেশ খরখরে ছিল, অঘ্রানের রোদ, সব শুকিয়ে গেছে, ইস্তিরি করে দিতাম…।

রাই বলল– ইস্তিরি আপনার করতে হবে না, ইস্তিরি করার লোক এসে নিয়ে যায়।

হারু বলল– আমি খারাপ ইস্তিরি করব না। এই কাজই তো করতাম আগে। খুব ভালো পারি।

ভালো পারতে হবে না।– রাইয়ের গলা বেশ কর্কশ। রাই ঘরে আসে। দরজায় ছিটকিনি দেয়। হাউস কোট খোলে, নাইট ড্রেস পরে। মুখে নাইট ক্রিম মাখে। তারপর নাইট ল্যাম্প জ্বালায়। বলে– শুয়ে পড়ো। দুলালকে জড়িয়ে ধরে রাই। বলে– ওই লোকটার জন্য তোমার আমার চেয়েও বেশি দরদ, তাই না? নিজেকে দ্রুত অনাবৃত করে রাই। দুলালকেও। তারপর ক্রিয়াশীলা হয়। উথালপাথাল করে। বলে– তুমি এত প্যাসিভ কেন, অ্যাঁ? রাই সেই রাতে ভীষণ উদ্যমী, সেইরাতে ভীষণ রমন পটিয়সী হয়। তারপর রতিক্লান্ত রাই বেডসুইচে নীল আলো নেভায়।

ভোরের দিকে এখনও পাখি ডাকে। পাখির ডাকে আধো জাগরণে রাই পাশ ফিরে হাতটান করে দিলে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। চোখ মেলে দেখল সত্যিই ফাঁকা। দুলাল নেই। আলো জ্বালে। দরজা ভেজানো, কিন্তু ছিটকিনি খোলা। ছোটো ঘরটায় গিয়ে দেখে লাল কম্বলের উপরে দুটো মুন্ডু। ছিঃ।

ঘড়িতে দেখল পাঁচটা কুড়ি। সাধারণত সাতটা অবধি বিছানায় থাকে রাই। দীপা আসে সোয়া সাতটা নাগাদ। আজ আর ঘুম আসছে না রাইয়ের। যা-তা ভাবছে। একটু পরই ধীরে দুলাল এল। বিছানায় সন্তর্পণে উঠতে যাচ্ছিল, সে সময় রাই বলল– তুমি কি হোমো? দুলাল পর্দা চোঁয়ানো ভোরবেলার আলোয় রাইয়ের মুখের রক্তিমতা লক্ষ্য করল।

রাই আবার বলল– ওর সঙ্গে শুতে গিয়েছিলে কেন?

দুলাল গলা উঁচু করে না। ভোর বেলাটায় প্রকৃতি শান্ত থাকে। দুলাল শুধু বলে– ওকে বলতে গিয়েছিলাম ডোন্ট মাইন্ড।

রাই বলল– আই হেট ইউ।

তারপর কোনও কথা নেই। নিঃশব্দে চা। স্নান। দীপা যা বেড়ে দিল, খেয়ে নিল রাই।

দুলালের জামা-প্যান্ট, পার্স, মোবাইল বাইরের ডিভানে রেখে বেডরুমে তালা দিল। ডিভানে স্তূপ করে রাখা শুকনো জামাকাপড়, চাদর। পাশের ঘরটাও তালা– যেটা আসলে সত্যিকারের গেস্ট রুম। রাইয়ের বাপের বাড়ির লোক এলে যে-ঘরটায় থাকে। রাই বেরিয়ে গেল অন্যদিনের তুলনায় অন্তত পনেরো মিনিট আগে।

দীপাও কাজ সেরে বেরিয়ে গেছে। দুলাল আবার ভাত বসাল রাইস কুকারে। ভাতে আলু আর ডিম দিল। মাছের তরকারির কিছুটা হারুর জন্য রেখে দিল। টিভি খুলল, একটা সিনেমার চ্যানেল। হারুকে বলল– দুপুরে খেয়ে নিস। বসে বসে টিভি দ্যাখ, এটা টিপে চ্যানেল পালটাস, খেয়েদেয়ে ঘুম দিস, আমি যতটা পারি আগে চলে আসব। হারু বলে– বউদির খুব রাগ না? আমি বরং চলে যাই। দুলাল বলে– না-না, যাবি কেন? তোর বউদির তো আমার উপর রাগ। অন্য কারণে, তোর জন্য নয়।

সাতটা নাগাদ ফিরল দুলাল। কলিংবেল বাজাচ্ছে, বেজে যাচ্ছে, বারবার। দরজা ধাক্বা দিতে থাকল, পাশের ঘর থেকে লোকজন, ক্রমাগত শব্দ, চাবির ফাঁক দিয়ে কেউ কেউ দেখে কিছু বোঝার চেষ্টা করছে। মায়ের কথা মনে পড়ল দুলালের, চাবির ফুটোয় নাক রেখে বাতাস টেনে দুর্বিপাকের গন্ধ নিতে চেষ্টা করল।

কে ছিল? কে ছিল ভিতরে– এই প্রশ্নের উত্তরে দুলাল শুধু বলতে পেরেছিল, বন্ধু।

দুলাল ফোন করল রাইকে।– রাই, কিছু অঘটন ঘটেছে। তাড়াতাড়ি এসো। কেউ বলল পুলিশ। এক্ষুনি পুুলিশ।

দরজা ভাঙতেই হল। কোনও পোড়া গন্ধ নেই। সুইচ টিপলে আলো জ্বলল না। কাচের সার্সি চুইয়ে বাইরের রাস্তার আলোর কিছুটা ভিতরে। দুটো ঘরে তালা। ছোটো ঘরটায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা দেহ। পাশে এক মগ জল, একটা শতরঞ্জি পাতা, জামাকাপড় কুণ্ডলী করা, একটা ইস্তিরি, প্লাগে লাগানো।

কারুর মোবাইলের টর্চে দেখা গেল প্লাগ পয়েন্টে কালো রং। ফিউজ উড়ে গেছে– কেউ বলল। ফিউজ লাগানো হল। উদ্ভাসিত আলোয় উপুড় হয়ে আছে হারু, ওর হাতের থেকে দু’ইঞ্চি দূরে একটা ইলেকট্রিক ইস্তিরি, যেটা খারাপ, অব্যবহার্য, যার তারের থেকে তামা বেরিয়ে গিয়েছিল, যেটা চৌকির তলায় ফেলে রাখা হয়েছিল।

দেহটাকে উলটে দিল পুলিশের লোক। হারুর ঠোঁটের কোনায় রক্ত জমাট বেধেছে।

– কে এই লোকটা।

দুলাল বলল– বন্ধু। তারপর হুহু করে কেঁদে ফেলল।

ঝক্বিঝামেলা কম হ’ল না। পোস্টমর্টেম, পুলিশ কেস, দেশের বাড়ি যাওয়া… হারুর মায়ের আকুল ক্রন্দন…। কী করা যাবে? অ্যাক্সিডেন্ট ইজ অ্যাক্সিডেন্ট। আমরা তো ইস্তিরি করতে বলিনি, ওতো নিজে থেকেই…।

কিছুদিন পর হারুর দুই দাদা বাড়িতে এল। সেদিনও রবিবার। বলল হারু একটা লাইফ ইনস্যুরেন্স করিয়ে ছিল, বছর দেড়েক আগে। পাঁচ লাখ টাকার। নমিনি করে গেছে কংসারিকে।

কাগজ দেখাল– নমিনিঃ কংসারি মন্ডল। রিলেশনশিপঃ ফ্রেন্ড।

টাকার খুব দরকার ওদের। ওই হারুর ঝমেলায় লাখ খানেক টাকা বেরিয়ে গেছে। থানাপুলিশ, মর্গ, তাছাড়া ওর শ্রাদ্ধের পুরো খরচ, রাইয়ের কোনও ইনক্রিমেন্ট নেই, একটা গাড়িও কিনতে পারেনি ওরা এখনও…

হারুর দুই দাদাই হাত জোড় করে বসে আছে। বড়ো দাদা বলল –  ভুতো, তুমি ছাড়া তো এই টাকাটা উদ্ধার হবে না। তোমার সই লাগবে। তোমার নামেই তো চেক হবে। কিন্তু আমাদের অবস্থা তো…

কথা শেষ হবার আগেই রাই বলল– ও টাকাটা পেয়ে গেলে পুরো টাকাটাই আপনাদের মায়ের হাতে তুলে দেবে। আমি জানি, ও দেবে।

রাই আগে কাঁদেনি। এবার কাঁদছে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...