বিজ্ঞানভিত্তিক যত নতুন নতুন আবিষ্কার হয়েছে এবং আজ যে আমরা প্রগতির পথে অনেকখানি এগোতে পেরেছি, সেটা সম্ভব হয়েছে কিছু মানুষের দৃঢ় সংকল্প করার মানসিকতার জন্য। কোনও জিনিসকে পাওয়ার তীব্র ইচ্ছা থেকে অথবা কোনও প্রচেষ্টাকে সফল করে তোলার মানসিক দৃঢ়তা, ব্যক্তিবিশেষের মনে আন্তরিক প্রেরণা যুগিয়ে তাকে লক্ষ্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
লক্ষ্যে পৌঁছোতে হলে দৃঢ় সংকল্প দরকার ঠিকই কিন্তু দেখতে হবে এর ফলে অপরের অথবা নিজের কোনওরকম ক্ষতি যেন না হয়। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যেতে পারে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ প্রখ্যাত ডা. নলিনী পটেলের কথা। দৃঢ় সংকল্প নিয়েই তিনি ভারত এবং বিদেশ থেকে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং দেশের মাটিতে মহিলাদের শরীর-স্বাস্থ্যের উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন।
অস্বচ্ছল কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম। মাত্র ৪ বছর বয়সে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। অন্যান্য আত্মীয়স্বজনেরা নলিনীর মায়ের স্বল্প শিক্ষার সুযোগ নিয়ে তাঁকে দিয়ে সই করিয়ে জমিজায়গা সমস্ত হস্তগত করে। একমাত্র সন্তান নলিনী এবং নিজের পেট চালাবার জন্যে লোকের বাড়িতে বাসন মাজা, কাপড় কাচার মতো কাজও তাঁকে করতে হয়। নলিনী সরকারি স্কুলে পড়াশোনা করতেন। মেধার কারণে পড়াশোনায় জলপানি পেতেন। ছোটো থেকে মনস্থির করেছিলেন বড়ো হয়ে ডাক্তার হবেন এবং অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা করবেন। মা-কেও সমস্ত অসম্মান থেকে মুক্তি দিয়ে সুখের মুখ দেখাবার সংকল্পও তিনি মনে মনে গ্রহণ করেছিলেন।
উদ্দেশ্য এবং সংকল্প অনুযায়ী নলিনী কঠোর পরিশ্রম করে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছোতে সক্ষম হন এবং আজ তিনি এক জনপ্রিয় চিকিৎসক হিসাবে যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত।
মানুষ সামাজিক প্রাণী। সমাজে থেকে নিজেদের গৃহস্থ জীবনকে সুখশান্তিতে ভরিয়ে তোলার ইচ্ছা সব স্ত্রী-পুরুষের মধ্যেই থাকে। এই ইচ্ছেকে পূরণ করতে সকলে নিজের মতো করে চেষ্টা করে। তাছাড়াও আত্মীয়স্বজন, বন্ধুর সাহায্য, পর্যাপ্ত অর্থ এবং মানসিক ধৈর্যেরও প্রয়োজন রয়েছে। কঠোর পরিশ্রমও করতে হয়।
লক্ষ্যে পৌঁছোবার তীব্র ইচ্ছা মনের মধ্যে পোষণ করে, মনকে শান্ত এবং মজবুত করে গড়ে তোলাকেই দৃঢ় সংকল্পের আক্ষরিক ব্যাখ্যা বলা যেতে পারে।
জেদকেই অনেকে দৃঢ় সংকল্প বলে ভুল করেন
দৃঢ় সংকল্প অনেকের ক্ষেত্রেই জেদের আকার ধারণ করে। জেদের ক্ষেত্রেও তীব্র ইচ্ছাশক্তিই কাজ করে। কোনও জিনিস পেতে হলে অথবা নিজের পছন্দ অনুযায়ী পরিবেশ তৈরি করতে গিয়ে অন্যের উপর চাপ সৃষ্টি করে ফেলাকেই ‘জেদ’ বলা যেতে পারে। জেদ দেখাতে হলে বেশিরভাগই অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়। কোনও বাচ্চা পছন্দের খেলনা কিনতে চাইলে বড়োদের উপর (মা-বাবা) নির্ভর করে। মা-বাবা স্বইচ্ছায় খেলনা কিনে দিতে না চাইলে, অনেক সময় রাগ দেখিয়ে, কান্নাকাটি করে অথবা অন্য কোনও উপায় অবলম্বন করে মা-বাবার উপর খেলনাটি কিনে দেওয়ার চাপ সৃষ্টি করে।
এক সন্তানের অভিভাবকেরা কিছুটা পর্যায় পর্যন্ত সন্তানের জেদ মেনে নেন, কারণ এর জন্যে বাবা-মা অথবা বাচ্চা, কারোরই খুব একটা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না। অনেক সময় রাস্তায় বেরিয়ে এমন খাবার কিনে দেবার জন্যে বাচ্চারা বায়না ধরে, যেটা খেলে তাদের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। রাস্তার ফুটপাথের আঢাকা খাবার, তেলেভাজা, ফুচকা, দইচাট্ ইত্যাদি খাবার কিনে দেবার জেদ করলে, বড়োদের উচিত তাদের বুঝিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়ানো। যদি বাচ্চা একেবারেই বড়োদের কথা না শুনে নিজের জেদ বজায় রাখে, তাহলে অভিভাবকেরা কম পরিমাণে খাবারটা কিনে বাচ্চাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু বড়োদের উপর জেদ ফলাবার পরিণামস্বরূপ, বেশিরভাগই জেদি বাচ্চারা নানারকম অসুখে ভোগে। ফলত বাচ্চা এবং বড়ো, দুজনকেই বিপদের মুখে পড়তে হয়।
ভাঙনের হাত থেকে সংসারকে বাঁচান
সংসারে থাকতে গেলে, একে অপরের সঙ্গে বাদ-বিবাদ লেগেই থাকে। তাই বলে জেদের বশবর্তী হয়ে সংসার ভেঙে ফেলে বেরিয়ে আসাটা সমস্যার সমাধান নয়। বরং দৃঢ় সংকল্প মনের মধ্যে রেখে সঠিক রাস্তায় নিজের প্রিয়জনদের নিয়ে সংসারে থাকার চেষ্টা করা উচিত।
শ্রীপর্ণা আজ নিজের জেদের মাশুল গুনছে। ছয় বছর আগে প্রবালের সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছিল। বাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ি। দুই ননদের বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। শ্বশুরের ব্যাবসায় স্বামী যুক্ত ছিল। অর্থ, প্রতিপত্তি কিছুরই অভাব ছিল না। একটাই সমস্যা ছিল, শাশুড়ির সঙ্গে শ্রীপর্ণার একেবারেই বনিবনা হতো না।
এক বছর পরে ওদের একটি মেয়ে জন্মায় কিন্তু বাড়ির অশান্তির কারণে, শ্রীপর্ণা মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়ে ওঠে। প্রবাল ওকে অবহেলা করে এই অজুহাত দেখিয়ে, শ্রীপর্ণা কোর্টে বিবাহবিচ্ছেদের জন্যে আবেদন করে। পরে অবশ্য আত্মীয়দের এবং উকিলের বোঝানোতে সেই মামলা তুলে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসতে মনস্থির করে শ্রীপর্ণা।
কিন্তু শাশুড়ি জেদ ধরে, বউমা ফিরে এলেও ওই বাড়িতে সে উঠতে পারবে না। বরং প্রবালকে সঙ্গে নিয়ে অন্য বাড়িতে চলে গেলে শ্বাশুড়ি খুশি হবেন, সেটা স্পষ্টই জানিয়ে দেন। শ্রীপর্ণাও জেদ ধরে বলে, ফিরলে শ্বশুরবাড়িতেই ফিরবে নয়তো না।
মা আর স্ত্রীয়ের জেদের মধ্যে পড়ে, প্রবালের জীবনটা দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে মদ আর ড্রাগের নেশায় প্রবাল ব্যাবসার কাজকর্ম এড়িয়ে যেতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত প্রবালকে নেশা ছাড়াবার জন্যে চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি করতে হয়। শ্বশুরমশাই ব্যাবসা গুটিয়ে ফেলেন। শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। জেদের যে এরকম পরিণাম ঘটতে পারে সেটা শ্রীপর্ণা আদৌ কি কল্পনা করতে পেরেছিল? সেদিন যদি ও জেদ না করত তাহলে হয়তো প্রবালের সঙ্গে সুখে শান্তিতে এতদিন সংসার করতে পারত।
মিতা-ও শ্বশুরশাশুড়ির সঙ্গে বিবাদ লেগে থাকায় দুই ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিল। ওর জেদ ছিল স্বামীকে আলাদা বাড়ি নিতে হবে ওর সঙ্গে থাকতে হলে। কিন্তু স্বামীর এতে মত ছিল না।
এদিকে বাপের বাড়িতেও মিতা, ভাই-ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছিল না। অশান্তি লেগে থাকত। বাচ্চারাও সুস্থ পরিবেশে মানুষ হতে পারছিল না। মিতার মা-বাবাও ছেলে, ছেলের বউকেই সাপোর্ট করতেন। ছয়, সাত মাস এভাবে কাটার পর মিতার মনে হতে থাকে ভুলটা সে নিজেই করেছে। এত সামান্য কারণে স্বামীর বাড়ি ছেড়ে এসে ও একেবারেই ভালো কাজ করেনি। আর একটু সহনশীলতা এবং ধৈর্য তার ধরা উচিত ছিল, তাহলে সংসার এভাবে ছেড়ে আসতে হতো না। মিতার এই আত্মউপলব্ধির খুবই প্রয়োজন ছিল। নিজের জেদ ত্যাগ করে মিতা দুই ছেলেকে নিয়ে আবার শ্বশুরবাড়িতে ফিরে এসেছিল, সংসারটাকে ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল একমাত্র জেদ ত্যাগ করার জন্যই। সুতরাং কিছু পাওয়ার জন্য দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করুন কিন্তু তাকে জেদে পরিবর্তিত হতে দেবেন না।