বছর তিনেক ধরে আমার স্বভাবে একটা উল্লেখযোগ্য বদল এসেছে, অন্যমনস্কতা বেড়েছে ভীষণ ভাবে। বিশেষ করে অফিস ছুটির পর। কখন যে বাস, ট্রেন ধরে আমাদের স্টেশনের কাছাকাছি চলে আসি, হুঁশ থাকে না। সম্বিৎ ফেরে লোকাল ট্রেনটা যখন ব্রিজের ওপর এসে পড়ে। গমগম আওয়াজ শুনে এগিয়ে যাই গেটের দিকে। ব্রিজ পার হলেই দেবনগর স্টেশন, জন্মাবধি এই অঞ্চলেই আমার বসবাস।
আজ আমাকে অন্যমনস্কতা সেভাবে গ্রাস করতে পারেনি। ডাউন লোকাল প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে পড়েছি, এটাই আপ-এ যাবে। কামরায় তাড়াতাড়ি ওঠার সুবাদে পেয়েছি জানলার পাশের সিট। অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য আদর্শ বসার জায়গা। কিন্তু হতে পারছি কই! মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছে, চাপা টেনশন। উদ্বেগটা গল্পের প্লট খুঁজে পাওয়া নিয়ে। গত তিনবছর ধরে আমার একটা বিশেষ পরিচয় তৈরি হয়েছে, আমি একজন লেখক। নামি বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় আমার লেখা নিয়মিত ছাপা হয়। এখন অবধি গল্পকার। উপন্যাসে হাত দিইনি। কবিতা আমার ঠিক আসে না। প্রবন্ধ লেখার মতো পাণ্ডিত্য আমার নেই। গল্প লেখা শুরু করেছিলাম কলেজবেলায়, কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। দু’তিনটের বেশি লিখিনি। বন্ধুরা ভালো বলেছিল। তবে চর্চাটা আর এগিয়ে নিয়ে যাইনি। কারণ আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা বড়োবাজারের এক ওষুধের হোলসেলারের খাতা লেখে। দাদার লেখাপড়ায় আগ্রহ ছিল না। হায়ার সেকেন্ডারি-র পর বিভিন্ন বিজনেস ট্রাই করে যাচ্ছিল। পুঁজির জোর নেই, ফেল করছিল বিজনেসগুলো। বাড়িতে মা, শ্বশুরবাড়ি ফেরত পিসি আর বোন, তখন স্কুলে পড়ে সে। একার রোজগারে ছ’জনের খাওয়াপরা চালাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল বাবা। এরপর বোনের কলেজে পড়া, বিয়ে দেওয়া এসব আছে।
গল্প লেখার শৌখিনতা সরিয়ে রেখে পড়াশোনায় মন দিয়েছিলাম। কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে বেরিয়েই ঢুকে গিয়েছিলাম এখনকার চাকরিতে। একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট আমি। আমার চাকরির টাকায় একটু স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করেছিল সংসারে। এদিকে দাদাও ফুড প্রোডাক্ট সাপ্লাইয়ের বিজনেসে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তার সুফল অবশ্য সংসারের গায়ে তেমন লাগেনি, দাদা দ্রুত বিয়ে করে নিয়েছিল বহুদিন অপেক্ষায় থাকা প্রেমিকাকে। তবু বলব দুই ভাই দাঁড়িয়ে যাওয়াতে আমাদের পরিবার নিত্যদিনের আর্থিক অনটন থেকে অনেকটাই মুক্ত হতে পেরেছিল।
ছুটির দিনগুলো সত্যিকারের অবসরের দিন মনে হতো। তখনই আমার মাথায় আবার গল্প লেখার পোকাটা নড়ে উঠেছিল। ভাবলাম, ছুটির সময়টা পাড়ায় আড্ডা না মেরে ভালো কাজে লাগাই। লিখে ফেললাম একটা গল্প। কাকে পড়াই? কেমন হয়েছে জানতে হবে তো। কলেজের সেই সব সাহিত্য অনুরাগী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কাউকে খুঁজে নিয়ে পড়ানোর চেয়ে একটা সহজ কাজ করে ফেলা যাক, গল্পটা পাঠিয়ে দিলাম সবচেয়ে নামি পত্রিকা ‘প্রিয়ভাষা’-র ঠিকানায়। আমি যে পাঠিয়েছি, কেউ তো জানতে যাচ্ছে না। মনোনীত না হলে লজ্জার কিছু নেই।
আমাকে অবাক করে গল্পটা ছাপা হয়ে গেল। লেখাটা পাঠানোর পর থেকেই প্রিয়ভাষার প্রতিটি সংখ্যার ওপর নজর রাখতাম।
যে-সংখ্যায় বেরোল আমার গল্প, দু’কপি কিনে ফিরলাম বাড়ি। এক কপি বাবার হাতে দিয়ে বলেছিলাম, এতে আমার লেখা একটা গল্প বেরিয়েছে।
সূচিপত্র ঘেঁটে গল্পের প্রথম পাতাটা বার করে ফেলল বাবা। তারপর আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল, যেন অচেনা কেউ! মুখে কিছু বলল না, পত্রিকাটা হাতে নিয়ে উঠে গিয়েছিল রান্নাঘরের দিকে। মায়ের উদ্দেশ্যে বলেছিল, মাধবী, তোমার ছেলে কী কান্ড ঘটিয়েছে দ্যাখো!
আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে গলাটা সামান্য কেঁপে গিয়েছিল বাবার। আসলে আমাদের বংশে এতবড়ো কান্ড কেউই ঘটায়নি। একেবারেই সাদামাটা গৌরবহীন বংশ।
বাবাকে যে-কপিটা দিয়েছিলাম, কদিনের মধ্যেই দুমড়ে-মুচড়ে একসা করে ফেলল। চেনাপরিচিতদের ধরে ধরে দেখাচ্ছে, পড়াচ্ছে ছেলের গল্প। এমনটা হবে আন্দাজ করেই আমি দু’কপি পত্রিকা কিনেছিলাম। প্রিয়ভাষার মতো বড়ো পত্রিকায় গল্পটা বেরোনোর ফলে চেনা, অচেনা মানুষের থেকে প্রচুর ফিডব্যাক পেলাম। কলেজের সেইসব সাহিত্য অনুরাগী বন্ধুরাও আমার ফোন নাম্বার জোগাড় করে নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল। উৎসাহিত হয়ে শুরু করে দিলাম একের পর এক গল্প লেখা। ছোটো, বড়ো, মাঝারি সব ধরনের কমার্শিয়াল পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে লাগল। আমাদের এলাকার শিক্ষিত, বিদগ্ধ মহলে যথেষ্ট গুরুত্ব পেতে লাগলাম।
গত তিনবছর ধরে জাগ্রত অবস্থায় আমি গল্প নিয়ে ভেবে যাই। কখনও গভীর ভাবে, অফিসে কাজের সময় আলতো ভাবে। অফিস ছুটির পর ভাবনাটা সবচেয়ে বেশি জমাট বাঁধে। টানা আটঘণ্টার ডিউটি শেষ হওয়ার ফলে মনটা থাকে উৎফুল্ল, আইডিয়াগুলো দৌড়ে দৌড়ে এসে ঢুকে পড়ে মাথায়।
আমি যেহেতু কোম্পানির ল্যাবে আছি, তাই শিফটিং ডিউটি। ছ’টা দু’টো, দু’টো দশটা। সপ্তাহন্তর ডিউটির শিফট বদলে যায়। জেনারেল ডিউটি নয় বলে বাস, ট্রেন মোটামুটি ফাঁকা পাই। ভাবনায় বিশেষ বিঘ্ন ঘটে না। কিন্তু আজ এখন অবধি গল্প নিয়ে ভাবা শুরু করতে পারিনি। ইতিমধ্যে দু’টো স্টেশন পার করেছে ট্রেন। ক’দিন ধরেই এমনটা হচ্ছে। আসলে হয়েছে কি, এ বছরই প্রথমবার আমি পুজোসংখ্যায় গল্প লেখার আমন্ত্রণ পেয়েছি। ‘প্রিয়ভাষা’ থেকে নয়, প্রায় ওরকমই নামি একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক চিঠি দিয়ে লেখা চেয়ে পাঠিয়েছেন। গল্পটা কত তারিখের মধ্যে দিতে হবে লেখা আছে তাতে। চিঠি দিয়ে লেখা চাওয়াটাও আমার জীবনে প্রথমবার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি যেচে পাঠিয়েছি, কয়েকবার মৌখিক আবেদনে দু’একজন সম্পাদক লেখা চেয়েছেন। ‘চিঠি’ মানে তো রীতিমতো অফিশিয়াল ব্যাপার! আর তাতেই বিরাট চাপে পড়ে গেছি আমি। কেমন যেন নার্ভাস লাগছে, সময় মতো যদি না দিতে পারি গল্পটা! আর তো কোনওদিন লিখতে বলবেন না সম্পাদক। পুজোসংখ্যায় লেখার সুযোগ হারানোর মানে, এক লাফে অনেকটা বিখ্যাত হওয়ার চান্স মিস করা। এমনটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।
কোনও গল্প লেখার প্রাথমিক পর্যায়টা আমার কাছে এই রকম, চার পাঁচটা প্লট মনের চারপাশে ঘুরঘুর করে। সবই অপূর্ণ, অস্পষ্ট। বলতে পারা যায় প্রায় বিষয়ের আকার। শুধুমাত্র গল্প হয়ে ওঠার ইঙ্গিতটুকু আছে সেখানে। যে-কোনও একটাকে বেছে নিয়ে মনে মনে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করি। গল্পটা কোথা থেকে শুরু করব, এগোবে কেমন ভাবে, শেষ করব কোথায়… ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবতে থাকি। যদি দেখি বেছে নেওয়া প্লটটাকে গল্প হিসেবে ঠিকঠাক দাঁড় করাতে পারছি না, সেটাকে তখনকার মতো সরিয়ে রেখে অন্য একটা প্লটকে নিয়ে আসি সামনে। ভাবনার এই প্রক্রিয়ায় হঠাৎই, বলতে গেলে আমার অজান্তে একটা প্লট পূর্ণতা পেয়ে যায়। লিখতে বসে যাই গল্পটা। কিন্তু এই প্রসেস কাজ করছে না পুজোসংখ্যার গল্পটা লিখতে গিয়ে। বাড়তি উত্তেজনা আর লিখিত আকারে দেওয়া সম্পাদকের ডেডলাইন আমার ভাবনার ধরনটাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। মনে মনে প্রণাম জানাচ্ছি সেই সব লেখকদের, যাঁরা বহুবছর ধরে ডেডলাইন মেনটেইন করে লিখে চলেছেন। আমার বোধহয় বড়ো লেখক হওয়া হল না।
ব্রিজের ওপর উঠে পড়ল ট্রেন। ছোটো খালব্রিজ। রোজকার সেই গমগম শব্দ আজ যেন আরও বেশি গম্ভীর শোনাচ্ছে। যেন ব্রিজটা বলছে, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তরুণ লেখক। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য হাতে মাত্র পাঁচটা দিন।
প্ল্যাটফর্মে নেমে খেয়াল করি বেশ মেঘ করেছে আকাশে! ট্রেন হাওড়া ছাড়ার সময় এত মেঘ ছিল না। বিকেল চারটেতেই দেবনগরে সকাল সন্ধে। গা-ছাড়া ভাব নিয়ে প্ল্যাটফর্ম পার হচ্ছি, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে কী হবে! লিখতে বসা হবে না। সাদা পাতার সামনে বসে ভাবতে হবে। ইদানীং আবার না লিখে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলে বউদি তাড়া দেয়। বলে, কী এত ভাবছ বলো তো! তোমার বড্ড খুঁতখুঁতানি বাই। আরে বাবা, তোমার লেখাটাই এত সুন্দর, যা লিখবে লোকে গোগ্রাসে পড়বে। …বলার পর বউদি আমার জন্য চা বানানোর উদ্যোগ নেবে। মানা করলে বলবে, তুমি খেলে আমারও একটু খাওয়া হয় আর কি। আমার লেখা নিয়ে বউদির এই যে এত উৎসাহ, এর একটা কিঞ্চিৎ বাস্তব দিকও আছে। লিখে টুকটাক রোজগার হয় আমার। সেই টাকাটা বোন, বউদি কিছুতেই আমার মূল রোজগারের সঙ্গে মেশাতে দেবে না। লেখা ছাপা হয়েছে দেখলেই, দু’জনেই নানান বায়না করতে থাকে। শৌখিনতার বায়না। লিপস্টিক, পারফিউম, ঝুটোগয়না ইত্যাদি। মা, বাবা, দাদার জন্যেও কিছু কিনে আনে, আমার জন্যেও। এই খাতে খরচ করতে আমারও ভালো লাগে। পুজোসংখ্যায় গল্পটা লিখতে পারলে টাকা অনেক বেশি পাব। শুনেছি পুজোর লেখায় বেশি দেয়। সম্পাদকের চিঠিতে অবশ্য অ্যামাউন্টের উল্লেখ নেই।
প্ল্যাটফর্মের শেড পেরোতে চলেছি, চোখ গেল সিমেন্টের বেঞ্চের নীচে, একটা বাচ্চাকে শুইয়ে রাখা আছে। ছ’সাত মাসের বাচ্চাদের আলাদা করে চেনা যায় না, তা সত্ত্বেও এই বাচ্চাটা কার, বুঝতে আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। জবার পুত্রসন্তান। বাচ্চাটার পিঠের কাঁথা, গায়ের জামা আমি চিনি। কারণ, জবা এঁটুলির মতো করে কোলে নিয়ে ঘোরে। কখনওই কাছছাড়া করে না। বাচ্চাটা এখানে এইভাবে পড়ে আছে কেন? জবা গেল কোথায়? প্ল্যাটফর্ম প্রায় ফাঁকা। দূরে দূরে এক দু’জন প্ল্যাটফর্মবাসীকে দেখা যাচ্ছে। প্যাসেঞ্জার বলতে আমি এখন একাই। লোকাল ট্রেনটা থেকে আরও যারা নেমেছিল, পা চালিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। গল্প মাথায় না আসার হতাশায় আমি শ্লথ হয়ে পড়েছিলাম। এখন বাচ্চাটাকে এই অবস্থায় দেখে চলে যেতে মন চাইছে না। একটা আশঙ্কা ঘিরে ধরেছে আমাকে, বাচ্চাটাকে কেউ যদি চুরি করে পালিয়ে যায়! প্ল্যাটফর্ম থেকে কিছু তুলে নিয়ে চম্পট দেওয়া খুবই সহজ। লোকাল ট্রেন এসে দাঁড়াবে, ছাড়ার মুখে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে কেউ যদি উঠে পড়ে কামরায়, চট করে চলে যাবে নাগালের বাইরে। জবাপাগলি ফিরে এসে বাচ্চাটাকে না দেখতে পেয়ে যে কী মূর্তি ধারণ করবে, কল্পনা করতেই ভয় পাচ্ছি আমি।
আপাতত বাড়ি যাওয়া স্থগিত রেখে বেঞ্চটায় গিয়ে বসলাম। জবার বাচ্চার পাহারায় বহাল হলাম আর কি! পায়ের খানিক দূরেই কাঁথার ওপর শান্ত হয়ে শুয়ে আছে বাচ্চাটা। হাত-পা একটু আধটু নাড়ছে। মুখটায় হাসিহাসি ভাব। পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীল। হঠাৎ যদি কান্নাকাটি শুরু করে দেয়, কী করব জানি না। বাচ্চাটাকে কোলে তুলে ভোলানোর প্রবৃত্তি আমার নেই। জবাপাগলি স্নানটান করে বলে তো মনে হয় না। শুধুমাত্র বৃষ্টিতে ভিজলে অথবা মাছ চুরি করতে পুকুরে নামলে স্নান করা হয় ওর। এই যার স্বভাব সে তার বাচ্চাকে তেলটেল মাখিয়ে স্নান করাবে, আশা করাই বৃথা। বাচ্চাটার গায়ের কাঁথা, জামা ছ’মাস ধরে এই একটাই দেখে আসছি। কাঁথা, জামা, বাচ্চাটা মিলিয়ে সাক্ষাৎ একটা উৎকট গন্ধের মণ্ড। যতই কাঁদুক ওকে আমি হাতে নিতে পারব না।
জবার এই অপরিষ্কার থাকার কারণেই লোকে ওকে পাগলি বলে। মাথায় অল্পবিস্তর ছিট থাকলেও, পুরো পাগলি সে নয়। যথেষ্ট সেয়ানা। বিশেষ করে পাওনাগণ্ডা বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে। জবাকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছি। তখন বাচ্চাটা হয়নি। বাচ্চা সমেত জবাকে নিয়ে আরও একটা দারুণ গল্প হতে পারে। তবে সে ঝুঁকি আমি নিচ্ছি না। আগের গল্পটা লিখে বিরাট ফেঁসে গেছি। সন্তানের প্রতি জবার নিরেট অবসেশন, এটাই আমার জবাকে নিয়ে পরের গল্পের মেন থিম হওয়ার কথা। ওকে খুঁটিয়ে খেয়াল করেই বিষয়টা আমার মাথায় এসেছে। সেই অবজার্ভেশন থেকেই আমি আন্দাজ করতে পারছি, খুব বেশি সময় বাচ্চাটাকে পাহারা দিতে হবে না, জবা এল বলে।
আমার এখন অদ্ভুত দশা! কয়েকহাত দূরে পড়ে রয়েছে গল্পের প্লট, পাহারা দিচ্ছি, কিন্তু এক লাইনও লেখা যাবে না। জবাকে নিয়ে লেখা আগের গল্পের আফটার শক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এরকম হেনস্থা আগেও আর একজনের বেলায় হয়েছে, তার নাম সাধন। আসলে আমাদের এই মফসসলে সাধন, জবার মতো বিচিত্র চরিত্ররাই আমার লেখার রসদ। পুরোটা বানিয়ে লিখতে পারি না। এই বিচিত্রদের মধ্যে যারা শিক্ষিত, তাদের নিয়ে সমস্যা কম। আমাকে খুব একটা বিব্রত করে না। মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলে অর্থপূর্ণ হেসে হয়তো বলল, অমুক পত্রিকায় তোমার গল্পটা পড়লাম (মানে যে গল্পটা তাকে নিয়ে লেখা)। আমার চোখে পড়েনি লেখাটা, দু’চারজন পড়ে আমাকে পড়তে বলল। কেউ হয়তো আর একটু এগিয়ে বলল, সবই তো বোঝা যাচ্ছে, আমার নাম পালটে দিয়েও তুমি কিছু আড়াল করতে পারোনি। তবে ভালোই হয়েছে গল্পটা।
যে সব শিক্ষিত চরিত্রদের অবলম্বনে গল্প লিখি আমি, তারা জানে গল্পে সত্যির মিশেল না থাকলে লেখা প্রাণ পায় না। তাছাড়া চরিত্রের নাম, ঘটনাস্থল সবই তো পালটে দিই, সরাসরি অভিযোগ করারও সুযোগ থাকে না তাদের। কিন্তু সে দলে তো সাধন, জবারা পড়ে না। বই বা সাহিত্য থেকে যোজন দূরত্ব দু’জনের। সাধন তবু খানিকটা স্কুলবেলা কাটিয়েছে। জবা স্কুলের চৌকাঠ ডিঙোয়নি। সাধনের মা হসপিটালের আয়া। ছেলের লেখাপড়া হল না বলে একটা চায়ের দোকান করে দিয়েছে। দোকানে নিয়ম করে বসে না সাধন। তার নেশা নাচ। পাতি হিন্দি সিনেমার নাচ। কলোনি এলাকার জলসায়, বিয়ের অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকারে মিউজিক সহযোগে নাচে। সাধনের বিয়ে দিয়েও ঘরমুখী করতে পারল না মা। বউটির স্বভাবগুণ ভালো, বরকেও ভীষণ ভালোবাসে।
সাধন একদিন স্টেজে নাচতে উঠেছে, খবর এল অন্তঃসত্ত্বা বউ ভীষণ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। নাচ বন্ধ করল না সাধন। পারফর্মেন্স শেষ করে ছুটল হাসপাতালে। বউ চোখ বুজে শুয়ে আছে, যেন মরেই গেছে! আকুল আশায় সাধন কান রাখে বউয়ের বুকে। হার্টবিট শুনতে পায়। খুশি ছড়িয়ে পড়ে সাধনের মুখে। নিজের অজান্তেই বউয়ের হার্টবিটের সঙ্গে আলতো করে তাল দিতে থাকে পায়ে। …মোটামুটি এই রকম ছিল গল্পটা। নামি পত্রিকায় বেরিয়েছিল। আমাদের এলাকার পাঠকদের সাধনকে আইডেন্টিফাই করতে অসুবিধে হয়নি। সাধনের মতো অখ্যাতর জীবনের গল্প বেরিয়েছে বিখ্যাত কাগজে! এই আবেগের উত্তেজনা কন্ট্রোল করতে না পেরে জনৈক পাঠক খবরটা তুলে দিল সাধনের কানে, লেখক পরিচয়সহ।
একদিন সাধনের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল সে। আমার হাত আঁকড়ে ধরে বলেছিল, গুরু, তুমি শুনলাম আমাকে নিয়ে একটা স্টোরি লিখেছ বইয়ে! চট করে ব্যাপারটা স্বীকার করিনি। গম্ভীর মুখে জানতে চেয়েছিলাম, তুমি কি গল্পটা পড়েছ? এমনটা জিজ্ঞেস করার কারণ, সাধন যদি অভিযোগ তোলে গল্পে ওকে ছোটো করা হয়েছে, তখন বলতে হবে, ও গল্প তোমাকে নিয়ে নয়। দেখছ না, ছেলেটার নাম আলাদা, থাকেও অন্য জায়গায়। ওই রাস্তায় গেল না সাধন। সে তখন আনন্দে আত্মহারা। বলেছিল, না, আমি পড়িনি। একজন দিদিমণি আমাকে বলল। স্কুলে পড়ায়, সে তো আর ঢপ দেবে না। তুমি মাইরি ‘সাজন’ সিনেমার সঞ্জয় দত্তর মতো। আমার সঙ্গে আড্ডা মারতে আসতে, কত গল্প করেছি, ধরতেই পারিনি তুমি রাইটার। চলো চলো, চা খাবে চলো।
সেই যে আমাকে খাতির করা শুরু করল সাধন, আজও উৎসাহে ভাটা পড়েনি। রাস্তাঘাটে আমাকে দেখতে পেলেই হাঁকডাক করে এগিয়ে আসে। চকরাবকরা ড্রেস, ভাবভঙ্গি, কথাবার্তায় ফিল্মি স্টাইল। আশপাশের মানুষজন বেশ অবাক হয়। বিশেষ করে যারা আমার লেখক পরিচয় জানে। ভাবে, লুচ্চা টাইপের ছেলেটার কী করে এই সাহস হয়, এরকম একজন মানী ব্যক্তির সঙ্গে এভাবে কথা বলতে? সাধনের অবশ্য সে সবের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। যেখানেই দেখা হোক, গল্প জুড়ে দেয়। নিজের জীবনের গল্প। জোরজার করে চা, সিগারেট খাওয়ায়। আমি টের পাই ওর মনোবাসনা, সাধন চায় ওকে নিয়ে আরও একটা গল্প লিখি আমি। ওর তুচ্ছ জীবন নিয়ে অসাধারণ কোনও গল্প। একজন দিদিমণি এসে সেই গল্পের খোঁজ দেবে ওকে। বেচারি জানে না ওর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশটা আগের গল্পে লেখা হয়ে গেছে আমার। বাকি যা পড়ে আছে, সমস্তটাই বোরিং। পরিচিত। পাঠক ওই গল্প জানে। সাধনকে ইদানীং এড়িয়ে চলি। দূর থেকে যদি দেখতে পাই, ধরে নিই অন্য রাস্তা।
জবাকে নিয়ে আমার সমস্যা আরও মারত্মক। মেয়েটা তিনবার সরকারি হোম থেকে পালিয়ে এসেছে। কোনও এক অদ্ভুত কারণে আমাদের দেবনগর জায়গাটাই জবার পছন্দ। শেষবার হোমের কর্মচারীরা ওকে নিতে আসেনি। ভীষণ বিরক্ত হয়েছিল জবার ওপর। প্রথমদিকে এই প্ল্যাটফর্মই ছিল জবার স্থায়ী ঠিকানা। ট্রেন থেকে নেমে প্যাসেঞ্জার হয়তো কুলি খুঁজে পাচ্ছে না, জবা লাগেজ তুলে নিয়ে রিকশা স্ট্যান্ডে দিয়ে আসে। বিনিময়ে টাকা নেয়। কখনও এর বাগানের ফল, ওর পুকুরের মাছ, খেত থেকে চুরি করে আনা সবজি ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে স্টেশন লাগোয়া বাজারে। কখনও আবার কেটারিং-এর কাজে যায়। দোকান পরিষ্কার কিংবা রং করাতেও ওকে হাত লাগাতে দেখা গেছে। এভাবেই নিজের পেট চালায়। তবে যেটাকে ‘চুরি’ বললাম, সেটা ‘ডাকাতি’ বলাই বোধহয় ভালো। চুরিতে বাধা দিতে এলে এমন খিস্তি খেউড় করে, ইট-পাটকেল ছোড়ে, মালিক ভয়ে চুপ করে যায়।
ওকে নিয়ে যে-গল্পটা লিখেছিলাম, তাতে একটা ভয়ংকর ঘটনার কথা ছিল। সত্যিই ঘটেছিল জবার জীবনে। লাস্ট লোকাল থেকে কিছু ছেলে নেমে প্ল্যাটফর্মে ঘুমন্ত জবাকে রেপ করতে গিয়েছিল। ছেলেগুলো জানত না জবা রেললাইনের পাথর থলেতে পুরে তার ওপর কাপড় জড়িয়ে মাথার বালিশ করে শোয়। পাথর ভরা থলে দিয়ে এইসান মার মেরেছিল ছেলেগুলোকে, একজন হসপিটালে, বাকিরা প্রাণ হাতে করে পালিয়েছিল। এই ঘটনা সম্বলিত গল্পটা পড়ে সাধনের দিদিমণির মতো কোনও এক পাঠক জবাকে জানায়, চিনিয়ে দেয় লেখককে। এক সকালে বাজার করছি, সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল জবা। কোমরে গিঁট বেঁধে উঁচু করা পরা রংজ্বলা ম্যাক্সি, গামছাও বাঁধা কোমরে, চুলে চিরুনির চলাচল নেই বহুদিন। এটাই রোজকারের ড্রেস। সেদিন একমুখ হেসে বলেছিল, তুই নাকি কাগজে আমার নামে খবর লিখেছিস!
আমি ‘হ্যাঁ, মানে, না, ইয়ে, আসলে’ বলে পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালিয়েছিলাম। জবা গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কাকে বলে জানে না। ছাপার অক্ষরে যা কিছু বেরোয়, ‘খবর’ বলেই মনে করে। আরও একটা বড়ো সমস্যা, জবার ভোকাবুলারিতে ‘তুমি’ সম্বোধন প্রয়োগ হয় না। যেসব রাশভারী কাস্টমারকে চুরি করে আনা মাছ, সবজি বিক্রি করে, তাদের আর মালিকশ্রেণির লোককে ‘আপনি’ ডাকে। বাকি সবাইকে তুই। যেহেতু ওকে নিয়ে লিখেছি, জবা ধরেই নিয়েছে আমি আপনজন। ‘তুই’ বলে তো ডাকবেই।
আপনজন হওয়ার যে কত ঝক্বি, বুঝতে পারলাম তারপর থেকে। দু’টো দশটার ডিউটি থাকলে সকালের বাজারটা আমি করি। একবার যদি জবার চোখে পড়ে যাই, সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসে। মুঠোতে বা গামছার কোঁচড়ে যা থাকে, মাছ, পেয়ারা, লেবু, ধনেপাতা, কলমি শাক… যেদিন যেমন চুরি করতে পারে, আমাকে অন্যদের তুলনায় সস্তায় দিতে চায়। বলে, নে না বাবু, পুরোটাই নে। কুড়িটাকা দিবি। তুই আমার চেনা লোক বলেই এত কমে দিচ্ছি।
‘বাবু’ সম্বোধনটা সম্মান জানানোর জন্য করছে, নাকি আমার নতুন নামকরণ করেছে জবা, বলার ধরন দেখে বুঝতে পারি না। জবার জিনিস না নেওয়ার থাকলেও, অনেক সময় নিতে হয়। একগাদা অদরকারি সবজিপাতি নিয়ে এলে মা রাগ করে। নিজের অসহায়তার কথা বলতে পারি না। বললেও বুঝবে না মা। কখনও দেখা যায় নিজের জিনিসপত্র সব বেচে ফেলে বাজারে এমনিই ঘুরঘুর করছে জবা, অথবা কোনও মাছওলা, সবজিওলাকে হেল্প করছে কাজে। আমাকে দেখতে পেলে মাঝে মাঝে উঠে আসে। পাশে হাঁটতে থাকে ডিঙি মেরে মেরে। এটাই ওর হাঁটার স্টাইল। নানা রাজ্যের গল্প বলে। সাধনের মতো ওকে নিয়ে আর একটা গল্প লিখিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশায় বলে না। জবার সেই বোধ নেই। নিজের জীবনটাকে তুচ্ছও মনে করে না। আমাকে নিজের লোক মনে করে গল্পগুলো বলে। বেশিরভাগ চুরির গল্প। মালিক বাধা দেওয়াতে কী কী খিস্তি করেছে সেগুলো শোনায়। আমি আতঙ্কে মরি, এই বুঝি পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকটা ওর কথাগুলো শুনে ফেলল! আমাদের একসঙ্গে হেঁটে যেতে দেখলে লোকজন ঘুরে ঘুরে তাকায়। সাধনের সঙ্গে হাঁটতে দেখলে যতটা অবাক হয়, জবার বেলায় তার চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, জবার পোশাক-আশাক পাগলির মতো তো বটেই, ডিঙি মেরে হাঁটাটাও পিকিউলিয়ার, রাস্তায় যারা হাঁটছে, সবার থেকে আলাদা। পায়ে আবার চটি পরে না।
ওর চুরির বিবরণের মধ্যেই আমাকে একদিন জানিয়েছিল, প্ল্যাটফর্মে আর থাকছে না। ঘর ভাড়া নিয়েছে স্টেশন ধারে। আমি বলেছিলাম, এবার একটা বিয়ে করে ফেল। লজ্জা পেয়ে হেসেছিল জবা, ভঙ্গিটা আর-পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতোই। পাগলামির ছিঁটেফোটা নেই তাতে। মাঝে কিছুদিন যাবৎ খেয়াল করি বাজারে, রেলের প্ল্যাটফর্মে, আশপাশের কোনও এলাকাতেই জবাকে দেখা যাচ্ছে না। গেল কোথায় মেয়েটা? প্রশ্নটা বাজারের কাউকে করিনি। এখান থেকে বিদেয় হলে বাঁচা যায়। বেশ কয়েক মাস বাদে দেখি জবা কোলে বাচ্চা নিয়ে ঘুরছে। চেহারায় বিয়ের কোনও সাক্ষর নেই, মানে সিঁদুর, শাঁখা, পলা… আমি সামনে দিয়ে হেঁটে গেলাম, খেয়ালই করল না। বাচ্চাটার দিকেই সমস্ত মনোযোগ!
মাছওলা রবিনের কাছে মাছ কেনার সময় জিজ্ঞেস করলাম, জবা কার বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরছে? কেন, ওর নিজের? বলেছিল রবিন।
জানতে চেয়েছিলাম, বিয়ে করল কবে? বাচ্চার জন্য ওদের আবার বিয়ে করতে লাগে নাকি! তাচ্ছিল্যের গলায় বলেছিল রবিন। ব্যাপারটা কিন্তু তুচ্ছ মনে হয়নি আমার। হাইফাই সোসাইটিতে আজকাল ‘সিঙ্গল মাদার’ প্রায়ই শোনা যায়। সেলিব্রিটিরা ‘সিঙ্গল মাদার’ হলে লেখালিখি হয় কত! সাহসিনীর সম্মান পায় নারীটি। এর উলটো দিকে, সমাজের প্রান্তসীমায় থাকা জবা একই রকম কাজ করে ফেলল, কোনও শাবাশি নেই! শুধুই তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা! রবিনের থেকে মাছ নিয়ে রাস্তায় এসে দেখি, জবা বসে আছে রেলের ইলেকট্রিক পোস্টের বেদিতে। ওর সামনে গিয়ে বলি, কী রে, তোর বাচ্চা? ছেলে না মেয়ে?
একগাল হেসে জবা বলেছিল, ছেলে।
ওর বাবা কোথায়? একটু ঝুঁকি নিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। খেঁচিয়ে উঠতেই পারত। কেন-না, এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই অনেকেই ওকে করেছে। ক্ষেপে যায়নি। শান্ত গলায় বলেছিল, ওর বাবা নেই। বাবার কী দরকার!
দরকার নেই কেন বলছিস? আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয়নি জবা। মুখে নানারকম আওয়াজ করে বাচ্চাটাকে আদর করতে লেগেছিল।
দিন যায়। জবাকে আর আগের মতো বাজারের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত করতে দেখা যায় না। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে, কোলে সবসময় বাচ্চা। একদিন একদম সামনে থেকে দেখলাম, জবার চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে। শরীরে ঝিমানো ভাব। হাঁটাচলায় আগের সেই চনমনে ব্যাপারটা নেই। কোলে বাচ্চাটা ঠিক আছে। একটু বড়োও লাগছে। মা কিন্তু অতীব শীর্ণ।
ফের রবিনকেই জিজ্ঞেস করলাম, জবার কোনও রোগভোগ হল নাকি? চেহারা তো বেশ ভেঙে গেছে দেখছি। আর বোলো না, অতিরিক্ত আদরে পাগলিটা বোধহয় বাচ্চাটাকে মেরেই ফেলবে। ছেলেটা হওয়ার পর থেকে সারাক্ষণ কোলে নিয়ে ঘুরছে। এক মুহূর্ত কাছছাড়া করে না। নিজের কাজ কারবারও বন্ধ করে দিয়েছে। আর ওকে দেখতে পাও বাজারে কিছু বিক্রি করতে?
মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝিয়ে ছিলাম আমি। রবিন ফের বলেছিল, নিজে কী খায়, কতটুকু খেতে পায়, কে জানে? ও না খেলে বুকের দুধও তো হবে না। বাচ্চাটা খাবে কী? এ নিয়ে তুমি যদি কিছু বলতে যাও, টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চাও, তক্ষুনি তেড়ে আসবে। টাকাপয়সার জন্য কোনওদিনই কারুর কাছে হাত পাতে না জবা, বিরাট প্রেস্টিজ জ্ঞান! বাচ্চাটার ভালোর জন্য কিছু বলতে গেলে গালাগাল শুনতে হবে। ইতিমধ্যেই শুনেছে অনেকে। ও বোঝে উলটো। মনে করে বাচ্চার ওপর নজর দেওয়া হচ্ছে। নজর কাটাতে নানান ঠাকুরের থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাদুলি, তাবিজ পরিয়ে যাচ্ছে বাচ্চাটাকে। …রবিন আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। মাছবাজার থেকে উঠে এসে ফের রেলের পোস্টের নীচে বাচ্চা কোলে বসে থাকতে দেখেছিলাম উশকোখুশকো চুলের জবাকে। একেবারে প্রেতিনীর চেহারা! মুখের ‘মা মা’ হাসিতে অবশ্য কোনও অন্ধকার লেগে নেই। বাচ্চাটার সঙ্গে আদরের খুনশুটি করে যাচ্ছে। সেদিন আর ওকে কিছু বলতে ইচ্ছে করেনি। সরে গিয়েছিলাম সামনে থেকে।
দিন দুয়েক বাদে ছ’টা দু’টোর ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরছি, স্টেশনরাস্তায় দেখি আমার সামনে হাঁটছে জবা। মন্থর হাঁটা। বাচ্চাটা তো কোলে আছেই। পা চালিয়ে ওর পাশে চলে গিয়েছিলাম। জবাকে বলেছিলাম, কী রে, কেমন আছিস? বাচ্চা মানুষ করতে গিয়ে চেহারাটা তো একেবারেই গেছে দেখছি! ওর বাবা খোঁজটোজ নেয়?
কেন নেবে? সে তো বাবা হতে চায়নি। আমি মা হতে চেয়েছিলাম। বলেছিল জবা।
আমি বললাম, তবু সে লোকটা তো বাবা। তার কোনও দায়দায়িত্ব নেই? গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে, তুই বাচ্চাটাকে মানুষ করতে গিয়ে হাড্ডিসার হয়ে যাবি! নিজেকে দেখেছিস আয়নায়?
ও সব ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চাটা একটু বড়ো হয়ে গেলেই কাজে নেমে পড়ব। এখন তো কোথাও রেখে যেতে পারি না। কারুর কাছে দিতেও পারি না, সবাই নজর দেয়।
বাচ্চার প্রতি জবার যা অন্ধ বাৎসল্য, ওকে বোঝালেও বুঝবে না, বাচ্চাটা বড়ো হওয়ার আগেই জবা মরে যেতে পারে। ও কথায় না গিয়ে জবাকে বলেছিলাম, মা হওয়ার যখন ইচ্ছেই হয়েছিল তোর, বিয়েটা করে নিতে পারতিস। তাহলে লোকটা এইভাবে পালিয়ে বেড়াতে পারত না। বাচ্চা মানুষ করতে মা-বাবা দু’জনকেই লাগে। উত্তরে জবা বলেছিল, বিয়ে ফিয়ে বহুত ঝামেলার ব্যাপার, আমার মা হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, হয়ে গেছি ব্যস। মা হওয়ার ইচ্ছেটা কখন, কীভাবে এল তোর মনে? জিজ্ঞেস করেছিলাম জবাকে। আসলে অশিক্ষিত মেয়েটা মাতৃত্বের আকাঙক্ষাটা কীভাবে প্রকাশ করে, সেটাই দেখতে চাইছিলাম। শিক্ষিতরা তো অনেক গুরুগম্ভীর ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু জবা যা বলল, বোধবুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল আমার।
একটা ঘটনার কথা বলেছিল জবা, মহাদেবের কেটারিং-এর হয়ে কাজে গিয়েছিল চাপাডাঙায়। বিয়ের কাজ। রাত হয়ে গিয়েছিল ফিরতে, পেটে ভালোমন্দ খাবার, ম্যাটাডোরে বাসনপত্রের মাঝে বসে ঢুলছিল জবা। মাকালতলায় এসে বিগড়ে গেল গাড়ি। ড্রাইভার চেষ্টা করছিল সারানোর। জবা ম্যাটাডোর থেকে নেমে মাঠের ধারে শিরীষগাছের নীচে গিয়ে বসেছিল। সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে স্বপ্ন দেখে, গাছটা তাকে যেন বলছে জবা রে, এবার মা হ। মা হয়ে যা জবা। মেয়েমানুষ যখন হয়েছিস, মা হবি না কেন? মা হওয়ায় দারুণ সুখ, খুব আনন্দ… ঘুম ভাঙতে জবা দেখেছিল ভোর হয়ে গেছে। তাকে ফেলে চলে গেছে কেটারিং কোম্পানির গাড়ি। তাতে রাগ হয়নি জবার, মা হওয়ার ইচ্ছেতে মন তখন টইটুম্বুর। গাছটাকে প্রণাম করে পায়ে হেঁটে মাকালতলা থেকে ফিরেছিল দেবনগরে।
জবার ভাষায়, কিছু হারামি সবসময় ওঁত পেতে বসে থাকে ওকে পাওয়ার জন্য, তাদেরই একটাকে ঘরে তুলেছিল জবা। কিছুদিন পর যখন বুঝল বাচ্চা এসে গেছে পেটে, হারামিটাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। …ঘটনাটা অবান্তর, কিন্তু চিত্তাকর্ষক। বিষয়টাকে নিয়ে গল্প লেখাই যায়। দ্রুত বাসনাটাকে আমি ত্যাগ করেছিলাম। সাধন, জবা এদের নিয়ে দ্বিতীয় গল্প লিখে ঝামেলা বাড়াতে চাই না। একটা করে লেখাতেই রাস্তাঘাটে বিরক্ত করে মারে। দু’টো লিখলে আমাকে এতটাই আপনজন ভাববে, চলে আসতে পারে বাড়িতে।
নাঃ, এবার কিন্তু বেশ চিন্তাই হচ্ছে। এখনও কেন ফিরছে না জবা? আকাশে যা মেঘ করেছে, বৃষ্টি নামল বলে। তবু ভালো, বাচ্চাটা এখনও কেঁদে ওঠেনি। যতবারই চোখ যাচ্ছে ওর দিকে, দেখছি, মুখে নানারকম আওয়াজ তুলে নিজের মনে হাত-পা নেড়ে যাচ্ছে। …বৃষ্টি এসেই গেল। জোর কদমে শুরু হয়েছে। শেডের শেষের দিকে আছি বলে প্ল্যাটফর্মে বৃষ্টি পড়ে ছিটকে আসছে জল। একটু বাদে প্ল্যাটফর্মও ভাসবে। শেডে অনেক ফুটোফাটা আছে, ওপর থেকে জল নামার পাইপও ভাঙা। বাচ্চাটাকে এবার তুলে আনতেই হবে, নয়তো ভিজে যাবে পুরোপুরি। বেঞ্চ থেকে নেমে বাচ্চাটাকে দু’হাতে তুলে ধরি, উৎকট গন্ধটা আছে ঠিকই, তবে শিশুর গায়ের সেই অদ্ভুত ঘোরলাগা গন্ধটা পুরোপুরি চাপা পড়ে যায়নি।
আমাকে চমকে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল জবা। ভিজে একেবারে সপসপে হয়ে গেছে। খুব হাসছে, নুয়ে পড়ে হাসছে। আমাকে দেখেই ওর হাসি। বলে ওঠে, তোকেই তো ওর বাপের মতো লাগছে! জবা যেন একদলা কাদা ছুড়ে মারল আমার গায়ে। রাগ হচ্ছে ভীষণ। ওকে কিছু বলেও তো লাভ নেই। কাকে কী বলতে হয় জানে না। বাচ্চাটাকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, কোথায় থাকিস? বাচ্চাটা তো এক্ষুনি ভিজে যেত।
বাচ্চাকে কোলে নিল জবা। বলতে থাকল, আর বলিস না মাইরি, বাচ্চাটাকে রেখে একটা প্যাসেঞ্জারের মাল তুলে দিতে গেছি রিকশায়, পুলিশ আটকে রেখে দিল। বাজারে হারানদার সোনার দোকানে চুরি হয়েছে, আমার কাছে এটা ওটা জানতে চাইছে পুলিশ। বলছি, বাচ্চাকে রেখে এসেছি স্টেশনে, কথা কানেই নিচ্ছে না!
অঝোরে বৃষ্টি সত্ত্বেও শেড থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা দিলাম। খেয়াল করলাম জবার ছোড়া কাদাটা আলকাতরার মতোন নাছোড়! এত বৃষ্টিতেও ধুয়ে যাচ্ছে না।
পরের দিন ঘুম ভাঙল একদম ভোরে। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। মাকালতলার যে শিরীষ গাছটার কথা বলেছিল জবা, গাছটা আমি চিনি। পিছনে মাঠ। অল্প বয়সে ম্যাচ খেলতে গেছি। স্বপ্নে দেখছি, সেই গাছতলায় শুয়ে আছি আমি। গাছটা বলছে, বাচ্চাটাকে নিয়ে গল্প লেখ। গল্পটা তো এসে গেছে মাথায়। কেন দেরি করছিস? গল্পটা যে মাথাতেই মরে যাবে…
ধড়মড় করে উঠে বসলাম বিছানায়। হাতে মাত্র চারটে দিন। পুজোসংখ্যায় গল্পটা দিতে হবে। বাথরুম ঘুরে এসে বসে পড়েছি লেখার টেবিলে। প্রথম লাইনটা লিখলাম, বছর তিনেক ধরে আমার স্বভাবে একটা উল্লেখযোগ্য বদল এসেছে…