দালাল যেদিন আমায় ঘর দেখাতে নিয়ে যায়, সেই দিনই আমি চ্যাঁচানি পিসিকে দেখি। টাইমকল থেকে ছ্যারছ্যার করে জল পড়ছে। পাশে উবু হয়ে বসে তিনি বাসন মাজছেন। চটা উঠে যাওয়া সিমেন্টের চাতাল। একদিকে ডাঁই করা কাঠের ভাঙা তক্তা, প্লাস্টিকের বস্তা, মরচে ধরা আধখানা টিন, বইয়ের একগোছা ছেঁড়া পাতা, আরও কত কী। চাতালটার এখানে সেখানে ছিটিয়ে ছেতরে পড়ে রয়েছে পায়রার গু। দেখেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

বাড়িটার বয়েস একশো বছর তো হবেই। যেখানে সেখানে পুলটিস মারা। দরজা দিয়ে ঢুকেই চোখেমুখে অন্ধকার জড়িয়ে যায়। সরু গলি। খানিকটা গিয়ে ডানহাতে সিঁড়ি। তার মুখে একটা বইয়ের দোকান। সেখানে আলো জ্বলছে। বাঁদিকের দোকানেও আলো। কিন্তু অন্ধকার এত বেশি যে মনে হয় যেন দোকানের ভেতরে মশারি খাটানো আছে। সেখানে আলো একেবারে জবুথবু অবস্থায় পড়ে আর বেরোনোর পথ পায়নি।

বাঁহাতি মোড় নিয়ে ডানদিকে ঘুরলেই ওই চাতাল। তার তিন কোণে তিনটে দোকান। বাসন মাজতে মাজতে পিসি চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকিয়েছিলেন। ট্যারা চোখ। তার চেয়েও ধাক্বা লেগেছিল যেটা তা হল ওর পরনে একটা শুধু ফ্যাকাশে কামিজ। নীচে কিছু নেই। উবু হয়ে বসার ফলে কামিজের অনেকটা খসে গিয়ে রোগা পা দাবনা অব্দি দেখা যাচ্ছে। চোখ সরিয়ে নিতে নিতে খেয়াল হল একদম কিছু নেই তা নয়। একটা লাল রঙের ইজেরের খানিকটা উঁকি মারছে।

চাতালের পাশে সরু হাঁটাচলার জায়গাটা একটা খোলা কোলাপসিবল গেট টপকে আর একটা গলির রূপ ধারণ করেছে। আবার অন্ধকার। আরও একটা সিঁড়ি। কাঠের রেলিং ঘুরে ওপরে উঠেছে। এই ছোট গলিটা পেরিয়ে একফালি ফাঁকা জায়গা। সেখানে পাশাপাশি দুটো দোকানঘর। তার মধ্যে যেটা বন্ধ তার সামনে আমাকে ফেলে দালাল বলেছিল, দাঁড়ান, তালাটা খুলি।’

আমি বললাম, ‘এ কোথায় নিয়ে এলেন বলুন তো!’

সে ঘটাং ঘটাং করে ঠুকে তালা খুলে হড়হড় করে শাটার তুলতে তুলতে বলল, ‘বইপাড়ায় ঘর নিয়ে ব্যাবসা করতে গেলে ওসব ভাবলে চলবে? আপনার যা বাজেট তাতে এ যা দিচ্ছি, রাজা জিনিস বুঝলেন। যদি টিকে যেতে পারেন তাহলে এখান থেকেই মা লক্ষ্মী হাত ঝেড়ে দেবে। একটুকরো জায়গার জন্যে লোকে মাথা খুঁড়ছে। একবার নোঙর ফেলতে পারলেই হল। দোকানের ভেতরটা ভালো করে দেখুন। আশি স্কোয়ার ফুট। ফলস সিলিং করা আছে, ওপরে বই রাখতে পারবেন। সলিড একেবারে। ভাড়া কম, সেলামি কম, আর কী চাই?’

‘না আসলে এত ভেতরে তো, তাই।’

‘সামনে নিতে গেলে তো আপনার পড়তায় আসবে না দাদা। ফুটপাতের ধারের গুমটিগুলো দেখেছেন? পঞ্চাশ-ষাট স্কোয়ার ফুট– স্টাটিংই আছে সাত-আট লাখ থেকে। এখান থেকে লাগান না। কত এঁদো গলি থেকে বেরিয়ে রাজা-উজির হয়ে গেল সব। পঁচিশ বচ্ছর ধরে কলেজ স্ট্রিটে ব্রোকারি করছি। কম তো দেখলাম না।’

এদিকেও একটা সিঁড়ি আছে লাল সিমেন্টের। উঁচুতে তাকালাম। দোতলায় কতগুলো সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। তার মানে ওখানেও দোকান বা গোডাউন আছে। তিনতলার এদিকটায় জাল দিয়ে ঘেরা। বারান্দা হতে পারে। তার ওপরে আশি স্কোয়ার ফুটেরও কম মাপের আকাশ। দমচাপা লাগছিল সব মিলিয়ে। বললাম, ‘এখানে কি কোনও কাস্টমার আসবে? জায়গাটা যেন কেমন। ঢোকার মুখে আলো নেই, একজন কলতলায় বসে বাসন ধুচ্ছে–।’

দালাল এমন হাসল যেন আমি ছেলেমানুষি কথা বলছি। ‘ওঃ, চ্যাঁচানি পিসি? ওকে নিয়ে ভাববেন না। স্ক্রু ঢিলে আছে। ওই কলটা ওর। কলের পাশে যে-তিনটে দোকান– ওগুলো ওর ভাগে। যা ভাড়া পায় তাই দিয়ে চলে। বেশি পায় না যদিও। কবেকার ভাড়াটে সব। পিসি থাকে গলির ভেতরের দোতলায়। এ বাড়ির তিন শরিক। কারও সাথে কারও সম্পক্ব নেই। সামনের দিকেরগুলো যাদের তারা ওদিকেই তিনতলায় থাকে। এই বাড়িওলা থাকে এদিকের ওপরে। ঘর পছন্দ হলে বলুন, ডাইরেক্ট কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’

ঘরটা নিয়ে নিয়েছিলাম। বাবার একটা বইয়ের দোকান ছিল। বইয়ের সঙ্গে লেখাপড়ার কাজে আসে এমন সব জিনিসও বিক্রি হতো। যেমন হয় আর কী। বয়েস হয়ে গিয়েছে, আর বসতে ভালো লাগছে না, এসব বলে বাবা আমাকে সেখানে ভিড়িয়ে দিল। সাত বছর ধরে আমি সেটাই চালিয়েছি। তবে এত ছোট ব্যাপারে মনটা আটকে থাকতে চাইছিল না। বই ঘাঁটতে আমার ভালো লাগে। ভাবলাম বই বানালে কেমন হয়। বছর দেড়েক হল নিজে একটা পাবলিকেশন খুলেছি। গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি ছেপেছি, প্রবন্ধের বইও। কয়েকটা বইয়ের, কাগজে রিভিউ বেরোল। প্রকাশনার নাম জানল লোকে। কলেজ স্ট্রিট থেকে ফোনে অর্ডার হলে বই পৌঁছে দিতাম। ছোটদের বইয়ের কাটতি ভালো জেনে সেদিকেও যাব ভাবছিলাম। বাবাকে অনেক বলেকয়ে, বুঝিয়ে দোকানটা বিক্রি করে দিলাম। বাবার হাতে খানিকটা রেখে আমার হাতে কিছুটা পুঁজি এল। বিয়ে করেছি। ছেলে-বউ আছে। বউ একটা মন্টেসরি স্কুলে পড়ায়। আমার বেলায় পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে পাল্লাটা ঝুঁকির দিকেই চলে গেল বেশি, কিন্তু তখনই ঠিক করেছিলাম এই ব্যাবসাটা কলেজ স্ট্রিটে বসেই করতে হবে। দালালের পিছন পিছন ঘুরে শেষে এই বাড়ি।

এখানে চ্যাঁচানি পিসির সঙ্গে আমার কথা হওয়ার কোনও দরকার ছিল না। দালাল বলেছিল ওকে নিয়ে ভাববেন না। কিন্তু না ভেবে রেহাই নেই। সত্যি বলতে কী ওকে দেখলেই হাত-পা চিড়বিড় করে। বারোটায় যখন দোকানে আসি তখন তিনি খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাসন ধুচ্ছেন কলতলায়। বিকেল চারটেয় আবার জল আসে। পিসি থালা বাটি গেলাস হাঁড়ি কড়াই নিয়ে সেখানে হাজির। বাসন ধুচ্ছেন কলতলায়। শুধু বাসন নয়, নিজেকেও রগড়ে ধোবেন। একজন পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর হাড়সর্বস্ব মহিলা সর্ব অঙ্গ ভিজিয়ে বইয়ের দোকানের মাঝখানের চাতালে বসে চান করছেন এ দৃশ্য যে কী শুকনো হতে পারে, তা টের পাই। যাওয়া আসার পথে দেখে মনে হয় আড়াল করে দাঁড়াই। কোনও খদ্দের যদি আসে এখন? কিংবা লেখক কেউ? লজ্জার একশেষ হবে। তখন ওরই ভাড়াটে এক দোকানদারের স্টাফ পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে যায়– ‘আহা মন্দাকিনী। রাজ কাপুর দেখে যেতে পেল না রে। রাম তেরি গঙ্গা মইলি হো গয়ি…।’

চ্যাঁচানি তো কারও নাম হতে পারে না। পিসির আসল নাম যে কী সেটা ওরই ভাড়াটে ডিএম পাবলিশার্সের মালিকের সঙ্গে একবার কথা বলতে গিয়ে জানলাম। বললেন, ‘ওর নাম লাবণি, লাবণি দত্ত। ভাড়ার রসিদে ওই নামেই সই করে। এখানকার ছেলেছোকরারা বলে চ্যাঁচানি পিসি। বলবে নাই বা কেন। অষ্টপ্রহর কিছু না কিছু নিয়ে চ্যাঁচাচ্ছে।’

সাবধানে বললাম, ‘উনি তো আপনাদের বাড়িওয়ালি। কিছু বলেন না কেন?’

‘কী আর বলব। যবে থেকে এসেছি তবে থেকে তো এই দেখছি।’

আমি চুপ করে গেলাম। এখানে আরও যারা আছে তারাও পুরোনো। পিসিকে কেউ সামনাসামনি কিছু বলে না। বলতে গেলেই চিৎকার। কেউ গলির ভেতরে ধপাস করে বইয়ের বস্তা নামাল। পিসি সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠবে– ‘অ্যাই কে? কে রে? গায়ের জোরে বস্তা ফেলেছিস! আস্তে আস্তে নামানো যায় না? এটা তোর বাবার বাড়ি নয় বুঝলি! একেই ওখানকার মেঝেটা ফেটে রয়েছে, তার মধ্যে ইচ্ছে করে বদমাইশি। সারাতে গেলে তুই পয়সা দিবি?’

আমি সব শুনি। তবে খেয়াল করে দেখেছি গলির মেঝের একটা জায়গা সত্যিই অনেকটা বসে গিয়েছে। পুরোনো বাড়ি। ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর ঘুরঘুর করে। ওরাই ফাঁকফোকর থেকে মাটি তুলে আলগা করে দিয়েছে। গলিটায় কোনও আলো নেই। অন্ধকারে কেউ কোনওদিনও পড়ে পা মচকাবে।

ডিএমের মালিক বলেছিলেন, ‘আপনার বাড়িওয়ালা প্রভাত দত্ত হল ওর দাদা, জ্যাঠার বড়ো ছেলে। বাড়ি ভাগাভাগি হয়েছে অনেকদিন। শুনেছি আগে থেকেই ঝামেলা চলছিল। যে যার অংশ বুঝে নেওয়ার পর থেকে তিন শরিকের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ। কেউ কারও খোঁজও নেয় না। এই চ্যাঁচানি পিসির বাপ-মা তো কবেই স্বর্গে রওনা দিয়েছে। থাকার মধ্যে আছে এক দিদি-জামাইবাবু। বছরে বারদুয়েক আসে ব্যারাকপুর থেকে। আসবেই বা কী করতে। সেখানে তারা সুখেই রয়েছে। দয়া যেটুকু করে, এর ভাগের দোকানগুলোর ভাড়ায় হাত দেয় না। বয়েসকালে বিয়ে-থা হয়নি। বিয়ে হওয়ার কথাও নয়। ওই তো চেহারার ছিরি। আগেও ভালো কিছু ছিল বলে মনে হয় না। একাই রাঁধেবাড়ে, খায়। একা থেকে থেকে মাথাটা গেছে আর কী। কথা বলার লোক পায় না। চ্যাঁচায়!’

আমি ভাবছিলাম ভাগ্যিস এই মহিলা আমার বাড়িওয়ালি নয়।

আমার দোকানে কোনও কর্মচারী নেই এখনও। এই কোম্পানিতে আমিই মালিক, আমিই শ্রমিক। বিক্রিবাটা তেমন জমেনি। তবু রিটেল কোনও কাউন্টার থেকে বইয়ের নাম লেখা স্লিপ এলে বই দিই। ফোনে বললে দৌড়ে গিয়ে বই পৌঁছে দিয়ে আসি। চালান লিখি, বিল কাটি, টাকা তুলে আনি। বিজ্ঞাপন দেখে, খুঁজেপেতে কাস্টমার আসে খুব কম। ওই কালো ঝুল গলি পেরিয়ে যারা এসে পৌঁছোয়, দেবতাজ্ঞানে তাদের সামলাই। যাদের বই রয়েছে সেই লেখকদের মধ্যে কেউ কেউ এসে পড়েন কখনও। আর টাকা নিয়ে বই ছাপিয়ে দেব কিনা জানতে বা কথা বলতেও আসেন দু-একজন। হ্যাঁ বলে দিয়েছি কয়েকজনকে। নইলে তো প্রেসে ধার ধারালো হয়ে উঠবে। আমি ধরে নিই যারা টাকা দেবে তারা আমার টেম্পোরারি পার্টনার। বাইরে চায়ের দোকান আছে। লোকজন এলে সেখানে গিয়ে বললে চা দিয়ে যায়, কিন্তু কেউ জল চাইলেই আমি সিঁটিয়ে যাই।

পাশের দোকানটা বর্ণলিপি পাবলিকেশন। মাঝবয়েসি কর্মচারী বসে থাকেন একজন। তিনিই বলেছিলেন, ‘খাওয়ার জল ওই কল থেকেই আপনাকে ভরতে হবে তমালবাবু। তবে খবরদার। পিসি যতক্ষণ কলতলায় থাকবে ততক্ষণ ওদিকের ধারও মাড়াবেন না। খালি দেখলেই বোতল নিয়ে দৌড়ুবেন। আমরাও তাই করি। নাহলে ও চিল্লিয়ে মাত করে দেবে একেবারে।’

তাও টের পেয়েছি অনেক দিন আগেই। বিকেলে কেউ জলের বোতল কলের মুখে বসালেই হল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার– ‘অ্যাই, জল ভরছে কে? কার এত আস্পদ্দা! আমার এখনও বাসন ধোয়া বাকি।’

আসলে বাসন মাজা হয়ে গেছে। শুচিবাই থাকার ফলে উনি একই বাসন বারবার ধুতে থাকেন। এই সময় পিসিকে দেখা যায় না। শুধু তার কন্ঠস্বরটি দোতলার সিঁড়ি থেকে এমন করে নামতে থাকে যে ঝনঝনিয়ে বাসন গড়ালে তার চেয়ে মধুর শোনাত। কোনও কোনও দিন কলের সামনেই ওই চিৎকারে পায়রারা ভয় পেয়ে উড়ে যায় ঘুলঘুলি কী কার্নিশ থেকে। ঝগড়ার রেওয়াজি গলা ছাড়া এ সম্ভব নয়।

আমার দোকানঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একজন একদিন আঁতকে উঠলেন। চুঁচড়ো থেকে বই নিতে এসেছেন। কখনওসখনও মফসসলের দোকানিরা বা তাদের লোক আসে আমার এখানে। পিসিকে তাদের চেনার কথা নয়। তিনি বললেন, ‘কোথাও কি গোলমাল হচ্ছে কিছু? দেখে আসবেন একবার?’

আমি বললাম, ‘তেমন কিছু নয়। ওই জল ভরা নিয়ে–।’

‘সে কী! কাজের জায়গায় এরকম চ্যাঁচামেচি হলে তো মুশকিল। বিজনেস করবেন কী করে? একে তো বাড়ির বাইরে আপনাদের কোনও সাইনবোর্ড নেই, খুঁজে খুঁজে টাইম কাবার। তার ওপর–। আর জায়গা পেলেন না!’

চুপ করে থাকি। হাসি দিয়ে বিজনেস সামলাবার চেষ্টা করি। তবে এও দেখেছি, পিসি যখন কলতলায় গিয়ে বসে, সেই সময়টি বেছে নিয়ে এখানকার দোকানের কয়েকজন আধ ডজন বোতল হাতে হাজির হয়। তারা পিসির ওই গলাবাজির চোটপাট চেটে চেটে খেতে চায়। হ্যা হ্যা করে হাসে। বোতল বসানোর ছুতোয় বাসন ছুঁয়ে দিতে চায়, বোতলের তলানি জল ছুড়ে দিতে চায় পিসির গায়ে। তিনিও চ্যাঁচাতে থাকেন– ‘যাও, যাও বলছি, দূর হয়ে যাও এখান থেকে। জেনেশুনে পেছনে লাগা, না! আবার দাঁত ক্যালানো হচ্ছে? শয়তান বদমাইশের দল, মেরে হাত ভেঙে দোব একদম বলে দিচ্ছি।’

আমার বাড়িওলা পীযূষ দত্তকে দেখেছি কখনও এরকম ঘটনার মধ্যে পড়ে গেলেও তিনি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন। বোনের হয়ে দুটো কথা বললে হয়তো থামত। থামে না।

একদিন জল ভরতে গিয়ে দেখলাম কলে লাল বালতি, বাসনের পাঁজা। না বলে জল নেওয়া যাবে না। পিসি দোতলায় তার ঘরে আছে ভেবে ওপরে উঠলাম।

একটা পাঁচিল গেঁথে আমাদের ওদিকটা থেকে এদিকটা আলাদা করা আছে। লালচে ইটের দাঁতকপাটি বেরিয়ে পড়েছে সে পাঁচিলের। পাশে সিমেন্টের একটা খিলানের অর্ধেক। বৃষ্টির জল পড়ে শ্যাওলায় আঁকা নকশা ফুটেছে তার শরীরে। কত কাণ্ড করে যে বাড়িটা ভেঙে ভাগ করেছে এরা। সিঁড়ির যেখানে আমি দাঁড়িয়ে তাতে আমার নাকের প্রায় ডগায় শোয়ানো একটা মেঝে। লোহার শিক লাগানো কাঠের রেলিং। অর্থাৎ এটা দোতলার ভেতরের বারান্দা। একটা বেড়াল থাবায় মুখ নামিয়ে বসে আছে। এককোণে একটা স্টোভ, কেরোসিন তেলের জার, কাঠের ডাঁটির একটা বড়ো ছাতা দেয়ালে হেলান দিয়ে, সিলিঙের কড়িবরগা থেকে দড়ি বাঁধা একটা হ্যারিকেন ঝুলছে, রেলিঙের খুঁটি থেকে দেয়ালের পেরেকে টাঙানো আর একটা দড়িতে এলিয়ে রয়েছে কয়েকটা ময়লা কাপড়, সেই দেয়ালেই লোহার ব্র্যাকেটে বাল্ব, দরজার পাশের দেয়ালে বাঁধানো ছবিতে উলটে আঁচড়ানো চুলে এক পুরুষ। চৌকো চোয়াল। সাদা-কালো ছবি হলদেটে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল সব মিলিয়ে মৃণাল সেনের সিনেমার কোনও স্টিল ফ্রেম দেখছি। এমন সময় সেই ফ্রেমের ভেতর থেকে বেড়ালটা মুখ তুলে ডেকে উঠল– মিঁউ।

‘কী ব্যাপার? এখানে এসেছেন কেন?’

দরজায় আধময়লা কামিজ উঁকি দিয়েছে। বললাম, ‘আমার ওখানে একদম জল নেই। একটা বোতল যদি ভরে নেওয়া যেত।’

‘আপনি কি আমার পারমিশন নিতে এসছেন?’

‘হ্যাঁ।’

খোলা ঠোঁটদুটো টপ করে নেমে এসে কেমন গুম ধরে গেল মুখে। উনি কামিজের দু’পাশের চেরা জায়গা দু’হাতে চেপে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘যান, নিয়ে নিন জল।’

‘আপনার জিনিসপত্র সব ওখানে রয়েছে। সরাতে গেলে হাত ছোঁয়াতে হবে।’

‘বললাম তো ভরে নিন। সরিয়ে দিন ওগুলো।’

কী মনে হল, সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ওটা কি আপনার বাবার ছবি?’

‘হ্যাঁ, কেন?’

‘না এমনি। তাই মনে হচ্ছিল। ঘরের ভেতরে রাখলে পারতেন।’

‘ঘরে অন্ধকার।’

অদ্ভুত যুক্তি। আমি আর কিছু না বলে ফিরে আসছিলাম। তখন উনি বললেন, ‘জল নেওয়ার জন্য আমাকে বলতে আসতে হবে না। আপনার যখন দরকার নিয়ে নেবেন।’

আমি নেমে জল ভরে নিয়ে এসে কাউন্টারে বসি। বাইরে কত লোক, বই বোঝাই রিকশা ভ্যান, দোকান উপচে রাস্তায় বই, হাঁকাহাঁকি, হাত ধরে টানাটানি– কী বই লাগবে বলুন। আর এই জায়গাটা ঘুমন্ত পুরী। এরকম রোজই। বৃষ্টিতে, রোদ্দুরে, শীতে ভিজে ভিজে।

এক একদিন বসে বসে ঝিম ধরে যায়, চোখের পাতা নেমে আসে। তখন ওই রাজকন্যের চিৎকারে চটকা ভাঙে। সিগারেট ধরাই। ভাবি আরও কয়েকটা কাউন্টারে বই বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে, লাইব্রেরিতে ক্যাটালগ পাঠাতে হবে, বাংলাদেশের অর্ডার পেতে হবে। পারব কি আমি? দোকানের ভাড়া, সেই সাউথ থেকে মেট্রোয় যাওয়া-আসার খরচ, ইলেকট্রিকের বিল। মাত্র তেরোটা বই নিয়ে এখানে জায়গা হাঁকিয়ে বসাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। এই বাড়িটায় সব টেক্সট বইয়ের দোকান। সেখানে আমার পাবলিকেশনের বই মেলানো যাবে না। যাদের সঙ্গে মেলানো যায় তারা তো রথী-মহারথী। কম্পিটিশন তো দূরের কথা, টিকে থাকতে পারব কিনা সেই সন্দেহই চোঁয়া ঢেকুর হয়ে উঠে আসছে এই কয়েক মাসে। বড়ো লেখকদের বই পেতে গেলে অনেক টাকা দিতে হয়। বই ভালো করে ছাপতে গেলেও খরচ বেশি। বেশি ছাপলে খরচ কমে কিন্তু আমার দৌড় তিনশো কী পাঁচশো। লাইব্রেরি নামি প্রকাশকদের বই কেনে, বাংলাদেশের অর্ডারও তাই, কলকাতার বাইরে থেকে কদাচিৎ কেউ কিনতে আসে। এত কিছু আগে বুঝিনি। এখানে এসে মালুম হচ্ছে। আমার বউয়ের স্কুলে পড়ানোর ভরসায় তো এখানে আসিনি আমি। নিজেই নিজের দোকানের ছোট্ট সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে থাকি। কায়দা করে পাবলিকেশনের নাম দিয়েছি ‘সোনার তরী’। শেষে ডুববে না তো?

এসব ভাবতে ভাবতে কোনও দিন ঘটাং করে আওয়াজ শুনে পিছন ফিরে দেখি পাশের গোডাউন থেকে বই বের করতে এসেছে কেউ। দুটো ছেলে। এরা যে– দোকানে কাজ করে সেটা রাস্তার ওপরে। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। বলছে মানে প্রত্যেক কথার আগে পরে একটা করে খিস্তি। বাংলা ভাষাকে উদার প্রমাণ করতে এসব আমরা আপন করে নিয়েছি। কোনও শ্রেণিবৈষম্য নেই। বলার স্বাধীনতা আছে, না শোনার স্বাধীনতা নেই। তাই খিস্তি হজম করছিলাম। ঠিক তখন ওপর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন পিসি। ‘অ্যাই কে রে? তপন, না? এখানে দাঁড়িয়ে আবার নোংরা কথা বলছিস! ওসব এখানে চলবে না।’

তপন ছেলেটি মুখ তুলে বারান্দায় তাকাল। ‘তোমার ওখানে তো নেই পিসি আমি। এ তো আমাদের বাড়িওলার এরিয়া। আমি এপারে রয়েছি।’

এবার আরও জোরে চিৎকার ধেয়ে এল। ‘খারাপ কথার আবার এপার-ওপার কী অ্যাঁ! বেশি ওস্তাদ হয়েছ, না। বই বিক্রি করিস, সে তো বিদ্যের জিনিস রে, গালাগাল দিতে লজ্জা করে না!’

তপন পাশের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে হাসল। গলা নামিয়ে বলল, ‘বহুত ঢেমনি এই বুড়িটা, দেখবি একটা মজা?’

মোবাইলে খুটখাট করছে তপন। একবার আড়চোখে আমাকে দেখল। তারপর গান বেজে উঠল ফোনে। ও মধু… ও মধু… আই লাভ ইউ… আই লাভ ইউ…। সঙ্গে তপনের খিক খিক হাসি।

আমি ভাবছিলাম, পিসির তো এতদিনে জেনে যাওয়া উচিত ছিল যে বই বিক্রি হয় বলেই বইপাড়ায় সকলে সাধুভাষায় কথা বলবে না। হতে পারে একদিন বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলেজ স্ট্রিটেই বইয়ের দোকান খুলে বসেছিলেন। কিন্তু এখন বই এখানে একটা প্রোডাক্ট। বাংলা ভাষায় যাকে বলে মাল।

হঠাৎ চমকে উঠলাম আমি। তপন ও অন্য ছেলেটিও অবাক হয়ে গেছে। দোতলায় অন্ধকার বারান্দা থেকে আর চিৎকার নয়, গান ভেসে আসছে। ‘দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে… আমারে বাটের বটের ছায়ায়… সারাটা দিন গেল খেলে…।’ গলা খ্যানখ্যানে, সুর কিছু এলোমেলো কিন্তু ওটা গানই।

তপন কাঁধ ঝাঁকাল। ‘কী গো পিসি, এ আবার কী শুরু করলে?’

গান থামল। ‘কেন, তুই গান বাজাচ্ছিস, আমি গান গাইছি। কী অসুবিধে?’

‘আরে আমারটা শোনো, শরীর চাঙ্গা হয়ে যাবে।’

‘আরে তুই আমারটা শোন, তোর মন ভাল হয়ে যাবে। দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে…।’

অন্য ছেলেটি এবার তপনকে বলল, ‘চল চল মাল ওঠা। সব পাগলের কারবার এখানে।’

লাবণি দত্ত থামেননি। পুরোটাই গাইলেন।

অনেক দিন পর গানটা শুনতে পেলাম। মাঠে ফুটবল পিটিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সন্ধেবেলা কাদের বাড়িতে যেন হারমোনিয়ামে বাজত এই গান। আজ এই পুরনো ভাঙা ছায়াময় বাড়িটাতে যেন ঘুরে ঘুরে ভেসে ভেসে একটা কোনও ঝরা পাতা হয়ে গানটা নেমে আসে।

পরের মাসে বাড়িওলার কাছে ভাড়া দিতে গিয়ে বললাম, ‘আমাদের দোকানের আগে যে– প্যাসেজটা, সেটা বড্ড অন্ধকার। অনেকে ওটা দেখে ওখান থেকেই ফিরে যায়, একটা আলো লাগানো গেলে…।’

পীযূষ দত্ত টাকা গুনতে গুনতে বললেন, ‘ও বাবা, ও ব্যাপারে আমি কিছু করতে পারব না। আপনি লাবুকে, মানে আমার বোনকে বলে দেখতে পারেন। ওটা তো ওর অংশ। যদি রাজি হয়–। তবে আপনার পাশের বর্ণলিপি আগে বলেছিল শুনেছি, হয়নি।’

আমি নেমে এলাম। আলোটা লাগানো খুবই দরকার। ন’মাস হয়ে গেল এখানে এসেছি। কাউকে বলে দিলেও জায়গাটা চিনে আসতে পারে না। সন্ধে নেমে এলে তো কথাই নেই, দিনের বেলাতেও এরকম ঘটে। এ তল্লাটের অনেক বাড়ির ভেতরেই খুপরি দোকানঘর আর অফিস রয়েছে। তারা কী করে ম্যানেজ করে জানি না। আমাকে আমার ব্যাবসার কথা ভাবতে হবে।

খাওয়া শেষে, বাসন ধোওয়ার পর, দুপুর একটা নাগাদ পিসি বাড়ির একেবারে বাইরের দরজার মুখে রোয়াকটায় গিয়ে বসে থাকেন। রোজকার ব্যাপার। ভাবলাম তখনই গিয়ে আলোর কথাটা বলব। গিয়েছিলাম, কিন্তু বলা হল না। দেখি পিসি ডান হাতে চড় তোলার ভঙ্গিতে খালি পায়ে রাস্তায় নেমে ছুটছেন। সামনে দু-তিনটে দামড়া লোকও খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে এঁকেবেঁকে ছুটে পালাচ্ছে। তাদের কেউই এ বাড়ির কোনও দোকানের লোক নয়। বাইরের। হয়তো কাস্টমার নেই কোনও, কাজ নেই অন্য, তাই সময় কাটাতে পিসিকে বেছে নিয়েছে ওরা। পিসি চেঁচাচ্ছেন– ‘এক চড়ে মাথা ভেঙে দোব। অসভ্য কোথাকার। বাড়িতে মা-বোন নেই তোমাদের?’

টানা রিকশাওলা, অন্য দোকানদার, রাস্তার লোক, ভ্যানওলারা রগড় দেখছে। আমি পা চালিয়ে পিসির সামনে গিয়ে রাস্তা আটকালাম। খানিকটা ধমকেই বলে ফেললাম, ‘এটা কী করছেন আপনি? কেন দৌড়াচ্ছেন এভাবে?’

পিসি থতমত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। হাতটা নামিয়ে নিয়ে বললেন, ‘কী বাজে বাজে কথা বলছে ওরা, জানেন না আপনি। কাউকে কিছু বলি না, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, তাও ইচ্ছে করে আমায় খোঁচাবে। পিছনে লাগবে।’

বললাম, ‘ওরা তো চায় আপনিও রেগে গিয়ে ওদের বাজে কথা বলুন। তাতেই মজা। আপনিও সব ভুলে ওদের পিছনে ছুটবেন! চলুন, এক্ষুনি ফিরে চলুন। আসুন আমার সঙ্গে। আপনিই না সেদিন গান গাইছিলেন!’

ট্যারা চোখ রাস্তার দিকে রেখে, কামিজটা সেই দু’হাতে চেপে ধরে আমার সামনে সামনে হেঁটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। আরও কিছুটা ধমক দিয়ে বললাম, ‘এটা কী পরে থাকেন আপনি! আর কিছু নেই আপনার?’

বোধহয় চ্যাঁচাতে গিয়ে কষ জমেছিল। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মুখে পিসি হাত দিয়ে ঠোঁট মুছলেন। আমি দোকানে বসতে যাচ্ছিলাম। উনি বললেন, ‘আপনি ওখানে কেন গেছিলেন?’

মাথা নাড়ালাম। ‘আমি আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। আর সেকথা বলে কী হবে।’

‘কী কথা? বলুন।’

‘এই প্যাসেজটায় যদি একটা আলো লাগাতে দিতেন। লোকজন আসা-যাওয়ায় সুবিধে হতো একটু। আপনার ভাড়াটেদের তো এই সমস্যা ভোগ করতে হয় না।’

গলার স্বর হালকা হয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে। শুনতে পেলাম উনি বলছেন, ‘লাইট কিনে নিয়ে আসুন। লাগাবে কে? মিস্ত্রিকে ডাকুন। জানেন কোথায় পাবেন? বেরিয়ে দেখুন ভারবি পাবলিশার্স কোথায়। ওই বাড়ির একদম শেষমাথায় বাপ-ছেলে থাকে, ইলেকট্রিকের কাজ করে। বলবেন চ্যাঁচানি পিসির বাড়ি। ঠিক চলে আসবে।’

আলো লাগানো হল। গলির অন্ধকারটা ছিঁড়ে গেল। যদিও তাতে আমার কতদূর কী সুবিধে হবে বোঝা যাচ্ছিল না। বাড়িতে বউয়ের সঙ্গে কথা বললাম কয়েকদিন পর। শ্রাবন্তী বলল, ‘বাবার বইয়ের দোকানটা তবু ছিল, সেটাও বিক্রি করলে। কী যে তোমার মাথায় চাপল! বাবা-মাও এই নিয়ে বলতে ছাড়ছে না। বলারই কথা। এখন যদি ব্যাবসাটা না দাঁড়ায় তাহলে কী হবে?’

বললাম, ‘সেই তো ভাবছি। আমি তো খারাপ বই করিনি। কিন্তু বিক্রি তেমন হচ্ছে না। এ ব্যাবসায় ইনভেস্টমেন্ট বেশি, রিটার্ন এত স্লো! আরও যে বই করব, ফান্ডই তো জমছে না। কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে না পড়ে তো বুঝতে পারিনি। তাছাড়া বাজারও খুব খারাপ। দেখি। তেমন বুঝলে সব বিক্রি করে চলে আসতে হবে।’

শ্রাবন্তী আবার বলল, ‘মাস গেলে টাকা তো লাগে সংসারে। সেটা যদি না আসে, চলবে কী করে?’

দোকানে বসে শ্রাবন্তীর কথাগুলোই ভাবছিলাম। তিন-চারজন এসে দাঁড়াল কাউন্টারের সামনে। ‘এটা নতুন হয়েছে, না? মালিক কোথায়?’

চিনি না এদের, তবে কাস্টমার যে নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। বললাম, ‘বলুন কী ব্যাপার?’

‘ব্যাপার কিছু না, দুর্গা পুজোর ডোনেশান। এই পাশের গলি। পাশশো টাকা।’

‘পাঁচশো!’ চমকে উঠি। ‘এত তো আমি পারব না দাদা।’

‘না বলবেন না। নতুন বলেই দিতে হবে, পুরানো হলে দেখবেন অ্যামাউন্টটা কমে ফিক্স হয়ে গেছে।’

‘অ্যাই কে রে? চাঁদা চাইতে এসেছে কারা? কোন পুজো?’

একজন মুখ তুলে জায়গামতোই তাকাল। ‘আমরা পিসি। মুখটা বাড়াও। চিনতে পারবে।’

পিসি তরতর করে নেমে এলেন। ‘ওনার কাছে বেশি নিতে পারবে না তোমরা। একশো টাকা নিয়ে বিদেয় হও।’

‘কী বলছ পিসি! একশো টাকায় কী হয়?’

‘যা বলছি শোনো। ওতে যা হয় তাই হওয়াও।’ বলে তিনি চোখ দুটো আমার দিকে রাখার চেষ্টা করছিলেন। ‘আপনি এর বেশি দেবেন না কিন্তু।’

‘আঃ পিসি, এমন কেলোর কীত্তি করো না মাঝে মাঝে। কিছু বলতে গেলেই তো আবার চ্যাঁচাবে।’ বলতে বলতে ওরা বিলের পাতা ছিঁড়ল। ‘আর কী হবে, দিন ওই একশো। সিনিয়র সিটিজেনের কথা রাখলাম।’

ওরা চলে যাওয়া অবধি পিসি দাঁড়িয়েই রইলেন। তারপর আমায় বললেন, ‘কলেজ স্ট্রিটে ব্যাবসা করতে এসেছেন তো। অনেক কিছু দেখতে হবে।’

চেয়ারে বসে পড়েছি। ভালো লাগছিল না এসব। তবু বললাম, ‘ব্যাবসাটা যদি ঠিকঠাক হতো, তাও না হয় দেখতাম। এখন তো ভাবছি কেন এলাম।’

পিসি মুখটা গলির দিকে ফিরিয়ে নিলেন। ‘এই বই ছাপার ব্যাবসা তো আপনার বাপ-ঠাকুদ্দার নয়।’

‘না, কেন বলুন তো?’

‘আমি সেই জ্ঞান হওয়া থেকে এসব দেখছি বুঝলেন। কত পাবলিশার এ বাড়িতে এল আর গেল। আমার বাবাও প্রকাশক ছিল, জানেন? পড়ার বই নয়, গল্প-উপন্যাস-কবিতা এসব ছাপত। কত লেখক এসেছেন তখন। পয়লা বৈশাখে বই বেরোত। কিন্তু বাবা শেষ অবধি পেরে ওঠেনি। এখন যেটা যূথিকা প্রকাশনীর ঘর, ওটাই আমাদের কাউন্টার ছিল। পরে তিনটে ঘরই এক এক করে ভাড়া দিয়ে দিল। বাবা বলত ছোটো প্রকাশকের ব্যাবসা করা খুব কঠিন। পাট তুলে দিল। বইগুলো উইয়ে খেল। আপনি পারবেন তো?’

আমি বললাম, ‘এত ভেতরে বসে বসে কী করতে পারব তাই ভাবছি। বাইরে একটা বোর্ড অবধি নেই যে কেউ নাম দেখে ঢুকবে?’

পিসি বললেন, ‘আপনার খুব চিন্তা হচ্ছে, না? থাকতে থাকতে লোকে জেনে যাবে ঠিক। খুঁজে খুঁজে আসবে দেখবেন। এই তো গলিতে আলো লাগালেন, সামনের দিকে আমাদের যে শরিক থাকে ওরা আপনাকে বোর্ড দিতে দেবে না। আমি তো দুপুরবেলা আর সন্ধেবেলা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি, কেউ জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেব– এই দিকে সোনার তরী। আপনি ভালো ভালো বই করুন। বিক্রি বাড়ানোর বুদ্ধি বের করুন। আমার বাবার মতো হবেন না। পালিয়ে গেলে কিছু করতে পারবেন না। আর শুনুন, আমার আর এবেলা কলে কাজ নেই। যান জল ভরে নিন।’

আমি অবাক হওয়াটা ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। তার মধ্যেই পিসি চলে গেলেন। একটু পরেই শুনতে পেলাম দোতলার সেই বারান্দা থেকে ভাঙা গলার গান ভেসে আসছে। ‘এই আকাশে… আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…।’

আমি কাউন্টার ছেড়ে দোকানের সামনের ছোট্ট জায়গাটায় দাঁড়াই। ওপরে তাকিয়ে ফালি আকাশটা দেখি। একঝলক চোখে পড়ে, একটা পায়রা পাকসাট দিচ্ছে। ওখান থেকে কোনও পক্ষীরাজ ঘোড়া উড়ে এসে নামবে না আমার জন্য। কিন্তু আমি যতটুকু দেখতে পাচ্ছি আকাশ তো ততটুকু নয়। খামোখা পালাতে যাব কেন?

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...