ভোলা, এক কাপ চা দিয়ে যা বাবা’। কথাগুলো বলেই প্রশান্ত আরামকেদারায় দেহ এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। মিনিট দশেক আগেই অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে।

সামনেই মেয়ের বিয়ে। একা একটা মানুষের পক্ষে সবদিক সামলানো প্রায় যুদ্ধেরই সমান। খুঁটিনাটি সব বিষয়েই বাড়তি খেয়াল রাখতে হয়। অন্যথায় একটু এদিক-ওদিক হলেই মেয়েকে সারাজীবন কথা শুনতে হবে। একদিকে বিয়ের পর মেয়ের অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা ভেবেই মরমে মরছে প্রশান্ত। তার উপর তার জীবনে এক মর্মস্পর্শী ঘটনা তো রয়েছেই। যার সমাধান করার জন্য অনুতপ্ত প্রশান্ত মেয়ের বিয়ের এই সময়টাকেই বেছে নিয়েছিল।

‘বাবু চা’, ভোলার আওয়াজ শুনে প্রশান্ত চোখ খোলে।

‘হ্যাঁরে বউদিমণি আসেনি এখনও?’ চায়ের কাপ নিতে নিতে প্রশান্ত, ভোলাকে জিজ্ঞাসা করে।

‘না বাবু। বলেই গেছেন, দেরি করে ফিরবেন।’

‘আর প্রমিত, রশ্মি কোথায়?’

‘দিদি মনে হয় বন্ধুদের সঙ্গে পার্লারে গেছে। আর দাদা কী যেন একটা কাজের জন্য বেরোল।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে তুই যা।’

 

ভোলা এবাড়ির কাজের লোক। দীর্ঘদিন ধরে এবাড়িতে কাজ করে। প্রায় কুড়ি-একুশ বছর ধরে। বাড়ি গোসাবায়। বিয়ে-থা করেনি। সংসারে কেউ না থাকায় পাকাপাকিভাবে এখানেই থেকে গেছে। এবাড়ির সংসারের যাবতীয় সে-ই দেখাশোনা করে।

সংসারে মানুষ বলতে ছটা প্রাণী। প্রশান্ত, প্রশান্তের স্ত্রী রিমা, ছেলে প্রমিত, মেয়ে রশ্মি। আর প্রশান্তের মা উমাদেবী। সাত বছর হল বাবা কমলাপ্রসাদ গত হয়েছেন। এছাড়া সংসারের সর্বময় কর্তা ভোলা তো রয়েছেই।

ভোলা ছাড়া এই সংসার অন্ধকার। বিগত কুড়ি বছরে রিমা যে কতবার হেঁশেলে ঢুকেছে তা হাতে গুনে বলা সম্ভব। যতদিন উমাদেবী সুস্থ ছিলেন ততদিন তিনি মাঝেমধ্যেই ছেলে, নাতি-নাতনির পছন্দের খাবার বানাতেন। কিন্তু এখন আর পেরে ওঠেন না। আর বউমা রিমাও পছন্দ করে না যে বাড়ির কাজের লোক থাকতে শাশুড়ি রান্না করুক। এতে তার স্টেটাস মেনটেন হবে না। এবাড়িতে পয়সা-কড়ি থেকে শুরু করে একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা অঢেল কিন্তু তবু কোথাও যেন, কিছু একটা ফাঁক থেকে গেছে।

কড়া চা বরাবরই প্রশান্তর পছন্দের। চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রশান্ত বলে ওঠে, ‘মাথাটা ছাড়ানোর জন্য এটা একেবারে পারফেক্ট রে। তোর হাতে সত্যিই জাদু আছে রে। আচ্ছা তোকে যে যেতে বললাম, যাচ্ছিস না কেন? কী অভিপ্রায়ে দাঁড়িয়ে আছিস বলতো? কিছু বলবি?’

‘আজ্ঞে বাবু, বলছি একটু জলখাবার বানিয়ে দেব?’

‘না রে আজ আর ভালো লাগছে না। তুই যা, আমি একটু রেস্ট নিই।’ বলে কাপটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে আবার আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে আগের মতোই চোখ বন্ধ করে নেয় প্রশান্ত। কিন্তু তার অস্থির মন ছুটে চলে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থনে, যেটা সে এতদিন খনিকটা সংসারের চাপে খানিকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুলে থেকেছে। এটা তখনকার ঘটনা যখন সে ধাপে ধাপে কেরিয়ারের শিখরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে একের পর এক সফলতা অর্থনৈতিক দিক থেকে তাকে আরও সুদৃঢ় হতে সাহায্য করছে।

পরিবারে দুই বোন আর চার ভাইয়ের মধ্যে সবথেকে বড়ো ভাইয়ের একমাত্র সন্তান সে। যার কারণে পরিবারে অন্যান্য ভাইবোনদের থেকে তার আদর অনেকটাই বেশি। তার উপরে পড়াশোনায় খুব ভালো হওয়ায় পরিবারের সকলেরই নয়নের মণি।

চার ভাই আর দুই বোনের মধ্যে দারুণ ভাব। সবাই যেন একে অপরের জন্য বেঁচে থাকে। সত্যিই উদাহরণ দেওয়ার মতো একটি আদর্শ পরিবার। সম্পর্কের গুরুত্ব, বড়োদের সম্মান, আদর, ছোটোদের শ্রদ্ধা ভালোবাসা সবকিছুই যেন পরিবারটির আবহাওয়ায় ওতপ্রোত ভাবে মিশে ছিল। চার জায়ের মধ্যেও ছিল অসম্ভব মিল, সেই কারণেই বাড়ির ছোটোদেরও আর আলাদা করে কিছুই শেখাতে হয়নি। বাড়ির বড়োদের একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা দেখেই তাদের খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভাইবোনেদের মধ্যেও পারস্পরিক ভালোবাসার বীজবপন হয়ে গিয়েছিল।

যেখানে দুই ভাইয়ের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা মুশকিল, সেখানে এত বড়ো একটি পরিবারের এমন সুমধুর সম্পর্ক। কীভাবে সম্ভব? পাড়াপড়শিদের কাছে এটাই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কর্মসূত্রে সকলেই সকলের থেকে দূরে থাকে, অথচ কারওর জন্মদিন, পুজোপার্ব্বন, বিবাহবার্ষিকী, অসুখ-বিসুখ এমনকী ছোটো থেকে ছোটো ব্যাপারেও একত্রিত হতো তারা। এছাড়া নিয়ম করে একে-অপরের খোঁজখবর নেওয়া, একে-অপরের বাড়ি যাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

প্রশান্তর মেধা আর বুদ্ধির কারণে সবার ধারণা ছিলই যে বড়ো হয়ে সে পরিবারের নাম উজ্জ্বল করবেই। ঠিক সেইমতোই যখন সে আইআইটি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তখন বাড়িতে প্রায় উৎসবের আমেজ। পুরো পরিবার পিসি, কাকা-কাকি, ভাই-বোন একত্রে সকলের হইহুল্লোড়, কলরব। তার উপর কথায় কথায় ভাই-বোনেদের উদ্দ্যেশে বাড়ির বড়োদের উপদেশ–‘দাদার মতো হয়ে দেখাও’–এসব প্রশান্তর বেশ ভালোই লাগত। প্রথমবার তার দাড়ি রাখা, প্রথমবার সুট পরা, প্রথমবার গাড়ি কেনা–তার সমস্ত কিছুই পরিবারের সকলের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, এতটাই সে সকলের হৃদয়ের কাছে।

আইআইটি পাশ করার পর প্রশান্ত বছরদেড়েক প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করার পর তার প্রাইভেট কোম্পানির প্রতি আস্থাই উঠে যায়। অথচ বেশ উঁচু পোস্টেই মোটা মাইনের চাকরিই করত সে। কিন্তু তবু না জানি কেন তার মাথায় ভূত চাপল যে সে আর প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করবে না। তাই হঠাৎই একদিন চাকরি ছেড়ে দিল। ঠিক করল সরকারি কোনও প্রশাসনিক পদের জন্য আলাদা করে কোনও কোচিং-এ ভর্তি হবে। সেই অনুযায়ী আইএএস পরীক্ষার জন্য শুধু কোচিং-এই নয় কঠিন অধ্যাবসায়ও শুরু করেছিল সে।

এত ভালো একটা চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা প্রশান্তর মা-বাবা প্রথমে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সহায়তায় সে সমস্যাও দূর হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির অন্যান্যদের মতো তারাও বুঝেছিল যে প্রশান্তের মতো ব্রিলিয়ান্ট, ট্যালেন্টেড ছেলেকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তার অধ্যাবসায়ই তাকে তার যথোপযুক্ত স্থানে পেৌঁছে দেবে। প্রথমবারের পরীক্ষাতেই আইএএস-এর জন্য নির্বাচিত হল প্রশান্ত। পুরো বাড়িতে উৎসবের সমারোহ বেধে গেল। কাকা-কাকি, পিসি, ভাই-বোন সব মিলে একেবারে চাঁদের হাট। যেন বড়দার ছেলে নয়, তাদের ছেলেরাই আইএএস অফিসার হয়েছে। গর্বে তাদের বুক ভরে গেল।

ছেলে বড়ো হয়েছে, আর্থিক দিক থেকেও সে যথেষ্ট স্টেবল। সুতরাং এবার তার বিয়ে দেওয়ার সময় এসে গেছে। ঠিক সেইমতো ঘটা করে পাত্রী দেখারও কাজ শুরু করে দেয় বাড়ির বড়োরা। পাত্র সরকারি আইএএস অফিসার বলে কথা, তার উপযুক্ত পাত্রী খোঁজা তো আর চারটিখানি কথা নয়। প্রায় খান সাতেক মেয়ে দেখার পর অবশেষে রিমাকে পছন্দ হয় তাদের। বরানগরের মজুমদারবাড়ির একমাত্র কন্যা সে। পিএইচডি কমপ্লিট করে তখন সে কলেজের অধ্যাপনা করে। দেখতেও একেবারে ডানাকাটা পরির মতো। প্রশান্তরও এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায় তাকে। তাই প্রশান্তও এই বিয়ে অমত করেনি।

মাসদুয়েক পরে ধুমধাম করে বিবাহ সম্পন্ন হল। বাড়ির প্রতিটি সদস্যের কাছেই রিমা খুব প্রিয়পাত্রী ছিল। দেওর, ননদরা বউদি বলতে অজ্ঞান। কাকা-কাকিমারা তো নতুন এক মিষ্টি অনুভূতি, শ্বশুর, শাশুড়ি হওয়ার আনন্দে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সকলে আলাদা আলাদা জায়গায় থেকেও কেউ তার বউদিমণিকে আবার কেউ তার বউমাকে ফোন করে প্রায় রোজই খোঁজখবর নিত।

নতুন নতুন বিয়ে হওয়ার কারণে রিমা প্রথম প্রথম এগুলো মানিয়ে নিলেও, পরে অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করল। প্রত্যেকদিন সময়ে-অসময়ে কারওর না কারওর ফোন আসা, নিয়মকরে প্রত্যেক মাসে শ্বশুরবাড়ির কারওর না কারওর উপস্থিতি। তার উপর পুজোপার্বণ, অনুষ্ঠানে বাড়ির বড়ো ছেলে হওয়ার কারণে সকলের তাদের বাড়িতে হাজির হওয়াটা একেবারেই মানতে পারছিল না রিমা। আর সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক। ছোটোবেলা থেকে বাবা-মা আর রিমা এই ছিল ওদের সংসার। সুতরাং জয়েন্ট ফ্যামিলি যে কী জিনিস তার বোধগম্য হওয়ার কথাও নয়। এত লোকের ভিড়ে সে তো আগে কখনও হারিয়ে যায়নি। এদের দেখে মনে মনে ভাবত সকলের শ্বশুর-শাশুড়ি একটাই হয়, তার চার-চারটে শ্বশুর-শাশুড়ি, অসংখ্য ননদ দেওর–সব মিলে একেবারে ফৌজ ব্যাটেলিয়ান।

এত জনের ভালোবাসার ভারবহণ করার ক্ষমতা ছিল না রিমার। প্রশান্ত আর তার জীবনে ঘটে যাওয়া সুখ-দুঃখের সমস্ত কথাও শাশুড়ি খবর হয়ে পৌঁছে যেত ফ্যামিলির অন্যান্য সদস্যদের কাছে। আর তার পরেই উঠত ফোনের ঝড়। যার উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যেত রিমা। মনে মনে ভাবত তার স্বামী আইএএস অফিসার হওয়ায়, সমস্ত রকম সুবিধা নেওয়ার জন্যই ওদের এহেন আচরণ। তাই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে এই বাড়তি আদিখ্যেতা। ধীরে ধীরে ফ্যামিলির প্রতি রিমার এই, বীতশ্রদ্ধ মনোভাব ধরা পড়ে প্রশান্তের কাছে। প্রথম প্রথম প্রশান্ত বোঝানোর সবরকম চেষ্টা করেছে, ‘রিমা, ওদের ভুল বুঝো না। ওরা ভালোবাসার কাঙাল। ওরা আমাদের থেকে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চায় না। পরিবারে তুমি একমাত্র বউ হওয়ার জন্যই ওরা তোমাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। ব্যস তাছাড়া আর কিছু নয়। ধীরে ধীরে অন্যান্য ভাই-বোনরাও চাকরি পাবে। তাদেরও বিয়ে হবে। তখন এমনিতেই এই ভালোবাসাও সবার মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। আমরা সবাই সবাইকে হৃদয় থেকে ভালোবাসি। কারওর মনে কোনও অভিসন্ধি লুকিয়ে নেই। একটু বোঝার চেষ্টা করো। এখন সবাইকে তোমার পর মনে হলেও কয়েকদিন বাদে দেখবে তুমিই এদের ভালো না বেসে পারবে না। প্লিজ আমার কথা ভেবে একটু অ্যাডজাস্ট করো।’

কিন্তু বুঝিয়ে লাভের লাভ কিছু হয়নি। আর কতদিনই বা বোঝাত, সেটারও তো একটা সীমা অবধি আছে। উলটে বরং রিমার নেতিবাচক কথাবার্তায় ধীরে ধীরে প্রশান্ত প্রভাবিত হতে থাকে। যেই ছেলে মাকে কোনও কথা না বলে থাকতে পারত না, সেই ছেলেই তখন মায়ের কাছ থেকে ছোটো থেকে ছোটো কথাও লুকোতে শুরু করল। অন্যদিকে ছেলের এই স্বভাববিরুদ্ধ আচরণে মা-ও অনুভব করতে পারছিলেন যে তার ছেলে বদলাচ্ছে।

আজ এই বয়সে এসে প্রশান্ত ফিল করতে পারে তখন তার ব্যবহারে মা কতটা কষ্ট পেয়ে থাকবেন। কাকা-কাকিমা, ভাই-বোন মায়ের কতটা কাছের, তাদেরকে দূরে সরিয়ে রাখাটা কতটা বেদনাদায়ক। কিন্তু তবু ছেলে তো ছেলেই, তার থেকে কাছের তো আর কেউ হয় না। তাই ছেলের মন রাখার জন্য বুকে পাথর চাপা দিয়েই উমাদেবী বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে নিজেকে গোটাতে শুরু করেছিলেন।

অপরদিকে পরিবারের সকলে কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছিল। আর যার কারণেই জায়েরা বহুবার উমাদেবীকে প্রশ্নও করেছেন, ‘দিদি কিছু হয়েছে নাকি গো? কেমন যেন আড়োআড়ো-ছাড়োছাড়ো ভাব। আর আগের মতো ফোনও করো না, ফোন করলে… কী জানি মনে হয় যেন তুমি কিছু লুকোচ্ছ, মনে মনে কষ্ট পাচ্ছ! প্রশান্ত, রিমাও যেন… যাক ছাড়ো। ভালো থাকলেই ভালো। অনেকদিন আসোনি। তোমার দেওরকে পাঠাব, আসবে এখানে?’

উমাদেবী সমস্ত কিছু লুকিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে বলে উঠতেন, ‘আরে নারে সবকিছু ঠিক আছে। ওরা দুজনেই সারাদিন পরে কাজ থেকে ক্লান্ত হয়ে ফেরে। আর পেরে ওঠে না। আর আমারও তো বয়স হচ্ছে বল। শরীরটাও খুব একটা..’

তাদের এই বদ্ধমূল ধারণা যে কতটা ঠিক, তা রিমার ব্যবহারেই ধরা পড়ত। ফোন করলে ঠিক করে কথা না বলা, বিরক্তি প্রকাশ করা, কোনও কাজের বাহানা করে ফোন কেটে দেওয়া এই সমস্তই সম্পর্কের মধ্যে একটা প্রাচীর গড়ে তুলল। প্রথমে আস্তে আস্তে সকলের ফোন আসা বন্ধ হল, তারপর বাড়িতে আসাও বন্ধ করে দিল সকলে। শুধুমাত্র প্রশান্তর মা-ই দূরত্ব বজায় রেখেও ফোনের মারফত যেটুকু সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখা যায় সেইটুকুই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। পরিবারের সকলে ভালো মতোই বুঝতে পারছিলেন উমাদেবীর অসমর্থতার কথা। তাই তারা আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিলেও বড়দা, বড়োবউদির প্রতি তাদের টান কিন্তু এতটুকুও কমেনি। অপরদিকে প্রশান্তর বাবা-মার ও ঠিক তাই।

এইভাবেই কেটে গেল আরও দুটো বছর। প্রমিতের জন্ম হল। পরিবারের সবাই সব রাগ, অভিমান, দূরে ঠেলে নতুন অতিথি আসার আনন্দে মেতে উঠল। কেউ নাতিকে হার, কেউ বালা, কেউ কোমরের বিছে, কেউ পায়ের মল, কাকা-পিসিরা নানারকম খেলনা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল নবজাতক-কে, কিন্তু কোনও কিছুতেই যেন রিমা সন্তুষ্ট নয়। রিমার ব্যবহার তাদের একেবারেই ভালো লাগল না। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেককিছুই পরিবর্তন হয়েছে, পরিবারে নতুন বউমারা এসেছে, প্রশান্ত-রিমার মেয়ে রশ্মির জন্ম হয়েছে, নতুন বউ-রা তাদের ভালোবাসা দিয়ে সংসারটাকে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। যেটা বদলায়নি সেটা শুধুমাত্র প্রশান্ত-রিমার সঙ্গে পরিবারের জোড়াতালি দেওয়া সম্পর্ক।

সেইসময় প্রশান্তও এতটা ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে যে তার নিজের দোষ-ত্রুটি তার নজরে আসে না। বাড়ির বড়োরা রিমাকে উপেক্ষা করে অন্যান্য বউদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে, বেশিমাত্রায় ভালোবাসছে। এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। তার উপরে প্রশান্তর মনে পরিবারের আর-পাঁচটা মানুষের প্রতি বিষ ঢালার জন্য রিমার উসকানিমূলক কথাবার্তা তো আছেই, যে তারা তাদের সফলতাকে হিংসা করে। সে নিজে কলেজে অধ্যাপনা করে, প্রশান্ত একজন বড়ো মাপের সরকারি অফিসার। সুতরাং তারা কেন তাদের কাছে যাবে, দরকার হলে তারা ছুটতে ছুটতে আসবে। এই অহং আর চাকরি বদলির কারণেই সম্পর্ক একেবারে নিঃশেষের পথেই। সমস্ত পরিবারই প্রশান্তের কাছে বিস্মৃত এক অতীত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বৈভব আর সুখ-দুঃখের সঙ্গে একলাই থেকে গিয়েছিল তারা। ফ্যামিলির টুকটাক খবর পেত মার থেকে। দম্ভের কারণে ভাই-বোনেদের বিয়েতে পর্যন্ত যায়নি তারা।

সময়-তো থেমে থাকে না, সে তার নিয়মেই বয়ে চলে। দেখতে দেখতে কেটে গেছে তেইশটা বছর। প্রশান্তর ছেলে এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে রেলে কর্মরত। আর মেয়ে রশ্মিও গ্র্যাজুয়েশন পাশ করেছে। বর্তমানে তারই বিয়ের তোড়জোড় চলছে। বিভিন্ন জায়গায় বদলির পর অবশেষে আবার নিজের জন্মস্থান কলকাতার মাটিতে ফেরা। রিটায়ার হওয়ারও আর মোটে আড়াই বছর বাকি। জীবনের এই প্রান্তে এসে পিছনে ফেলে আসা সম্পর্কগুলো হঠাৎই যেন প্রশান্তর মন ভারাক্রান্ত করে তোলে।

প্রশান্তর বাবা কমলাপ্রসাদবাবুও গত হয়েছেন বেশ কয়েকবছর আগে। তারপর থেকেই উমাদেবী যেন নিজেকে আরও গুটিয়ে ফেলেছেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটাও কথা বলেন না। দিনের বেশিরভাগ সময়টাই ঠাকুরঘরে কাটিয়ে দেন। অন্যদিকে বাকি পুরো পরিবারের একতা তখনও সমানভাবে বজায়, কেবলমাত্র প্রশান্তর পরিবার ব্যতিক্রম।

অবসর জীবন কীভাবে কাটবে–এটা প্রশান্তর খুব চিন্তার বিষয় ছিল। ছেলে কর্মসূত্রে মুম্বইতে থাকে। মাঝেমধ্যে ছুটিতে আসে, এখন মেয়েও চলে যাবে। অফিসে তৈরি হওয়া সম্পর্কগুলোও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারের বদল হওয়া ক্ষমতার মতোই ধুয়েমুছে যাবে। কর্মসূত্রে যে-কজন ভালো বন্ধু হয়েছিল তারাও আজ কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় সেটেলড্। আর ট্রান্সফার নিয়ে আসার পর রিমাও তার নতুন কলেজ নিয়েই ব্যস্ত। প্রত্যেকদিনই ফেরার সময় কলেজের কিছু না কিছু না সঙ্গে নিয়ে আসে। খেয়েদেয়ে একটু রেস্ট নিয়েই আবার সেটা নিয়ে লেগে পড়ে। ইদানীং প্রশান্তর মনে হয় রিমা বোধহয় তাকে এড়িয়ে যাবার জন্যই ইচ্ছাকৃতভাবেই এইসমস্ত করে। একাকিত্ব বোধ থেকেই প্রশান্তর মনে এরকম ভাবনার উদয় হয়।

আজ সে বুঝতে পারে সম্পর্ক কী? ভালোবাসার ছত্রছায়ায় থাকতে গেলে আগে অন্যদের ভালোবাসতে হয়, তবেই ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব। কয়েকবছর ধরেই এই চিন্তা তাকে কুরেকুরে খাচ্ছে। অতীতে করা ভুল প্রতিটি পদক্ষেপেই খোঁচা দেয় তাকে। স্ত্রীর মিথ্যে অহংকার, পরিবারের প্রতি তাদের অপরিচিতদের মতো আচরণই সম্পর্ক ভাঙনের মূল কারণ।

মনে মনে ভাবে, আর নয়, এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। মেয়ের বিয়েকে উপলক্ষ্য করেই ভেঙে যাওয়া পরিবার আবার জোড়া দিতে হবে। এই সুযোগেই সকলের মান-অভিমান মিটিয়ে দিতে হবে। তার দৃঢ় বিশ্বাস তার পরিবারের সকলে এতটাই ভালো, যে সে একটু এগোলেই তারা সবকিছু ভুলে তাকে আবার আগের মতো কাছে টেনে নেবে।

এমন সময় ছেলেকে ওইভাবে একা বসে থাকতে দেখে উমাদেবী এগিয়ে এসে বলেন, ‘চোখ বন্ধ করে কী ভাবছিস বাবা? তোর শরীর ঠিক আছে তো?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ…’ মায়ের কথায় আচমকা হকচকিয়ে ওঠে প্রশান্ত।

‘কিছু না মা, একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। শরীর ঠিকই আছে, একটু ক্লান্ত লাগছে এই যা। তুমি ঘুমোচ্ছিলে দেখে তোমাকে আর ডাকিনি।’

‘কিছু খেয়েছিস? নাকি ভোলাকে বলব কিছু দিয়ে যেতে। রশ্মির বিয়ের জন্য তোর যা খাটাখাটনি হচ্ছে, এই সময় একটু নিজের দিকে খেয়াল রাখ বাবা। তুই পড়ে গেলে দেখাশোনার তো আর সেইভাবে কেউ নেই। প্রমিত ছোটো ছেলে ও আর বিয়ের ব্যাপারে কী বোঝে বল?। তার উপর তুই যা ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করছিস।’ উমাদেবী উৎকণ্ঠিত হয়েই কথাগুলি বলেন ছেলেকে।

‘হ্যাঁ, ভোলা চা-বিস্কুট দিয়ে গেছে। জলখাবারের কথাও বলেছিল, আমিই না বলেছি। পেটটা বেশ ভারভার লাগছে। যাক এসব ছাড়ো। মা অনেকদিন ধরেই একটা কথা তোমাকে বলব বলব করে বলতে পারছি না।’

‘কী এমন কথা রে যে আমাকে বলতে পারছিস না?’ বলে ওঠেন উমাদেবী।

‘আজ না বললে বোধহয় আর কোনওদিন বলতেও পারব না। বলছি মা, ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু মা বাড়ির আর সবাই না থাকলে সত্যিই কি ধুমধাম সম্ভব? মন থেকে কি মানতে পারছ সেটা?’ একেবারে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে প্রশান্ত।

‘কী বললি বাবা, আর একবার বল। আমি কি ঠিক বুঝলাম!’ বেশ উৎকণ্ঠিত হয়েই বলে ওঠেন উমাদেবী।

‘হ্যাঁ মা তুমি ঠিকই ধরেছ।’

ছেলের উদাসীন স্বর শুনে উমাদেবী অনুভব করতে পারছিলেন এতদিনে বোধহয় ছেলের মনের বন্ধ দরজা উন্মুক্ত হয়ে সম্পর্কের নির্মল বাতাস বইতে শুরু করেছে। সেটা যে কতটা আন্তরিক তা আর বুঝতে বাকি রইল না উমাদেবীর।

এতদিনের চেপে রাখা ব্যথা উমাদেবীর আনন্দাশ্রু হয়ে চোখ বেয়ে নামতে থাকে। স্নেহভরা দৃষ্টিতে প্রশান্তকে বলেন, ‘আমি এতদিন এই দিনটার অপেক্ষাতেই ছিলাম বাবা। এখনও দেরি হয়নি। তুই একটু চেষ্টা করলেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। সবার রাগ-অভিমান মেটানোর এটাই সবথেকে ভালো সময়। তুই যদি ওদের বলিস রশ্মির বিয়ে, ওরা নাতনির বিয়েতে মুখ ঘুরিয়ে থাকতেই পারবে না।’ আবেগাপ্লুত উমাদেবী কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎই থেমে যায়। পরমুহূর্তেই উদাসীন মুখ করে বলেন, ‘কিন্তু বউমা?।’

‘তুমি চিন্তা কোরো না মা, ওকে আমি আর মাথায় চড়তে দেব না। অবশ্য পরিবার ভাঙার পিছনে শুধু ও একা দায়ী নয়, আমিও সমানভাবে দোষী। আমিও তো বুদ্ধি-বিবেক সমস্ত বিসর্জন দিয়ে ওদেরই ভুল বুঝেছিলাম। তাই এই সম্পর্ক পুনরায় গড়ে তোলার দায় আমার উপরেও বর্তায়। মা, তোমার কাছে সবার ফোন নম্বর আছে না?’

‘হ্যাঁ, সবার নম্বর আছে। এখুনি নিয়ে আসছি’ বলে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে নিজের ঘর থেকে ডায়ারি নিয়ে এলেন।

মায়ের হাত থেকে ডায়ারিটা নেওয়ার সময় তার মনে হল যেন বংশপরম্পরায় কোনও সম্পত্তি তার হাতে তুলে দেওয়া হল। প্রত্যেক মা-বাবাই বংশপরম্পরায় কিছু না কিছু তুলে দেন সন্তানের হাতে। তাকেও তার বাবা-মা বংশপরম্পরায় ভালোবাসা দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে গ্রহণ করতে পারেনি। ডায়ারিটা প্রশান্ত এমনভাবে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছিল, ঠিক যেন ফেলে আসা সম্পর্কগুলোকে কাছে টেনে নিয়েছে সে।

‘মা আমি সবাইকে ফোন করে নিমন্ত্রণ করব। সবার থেকে তাদের ঠিকানা নিয়ে কার্ড পাঠাব। সবাই আসবে তো মা?’

‘হ্যাঁ বাবা সবাই আসবে। তুই যে তোর ভুল বুঝে হৃদয় থেকে সবাইকে ডাকছিস, সবাই সেটা বুঝবে বাবা, বুঝবে। তুই সবার থেকে দূরে সরে গেলেও তারা কেউ তোর থেকে দূরে সরে যায়নি বাবা।’ ছলছলে চোখে বলেন উমাদেবী।

প্রশান্ত ডায়ারি খুলে প্রথম নাম্বার ডায়াল করল। ‘হ্যালো’, অপরপ্রান্ত থেকে বড়োকাকার গলার স্বর শুনতে পেল প্রশান্ত।

‘কাকা, আমি প্রশান্ত’ একপ্রকার জোর করেই বলল সে।

মনে মনে ভাবতে থাকল কাকা কী ভাবছে, কাকার কী প্রতিক্রিয়া হবে কে জানে?

প্রশান্তর গলার স্বর শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ করে ছিলেন প্রশান্তর কাকা।

প্রশান্ত আবার বলে ওঠে, ‘কাকা আমি প্রশান্ত, তোমার বড়ো ছেলে বলছি।’ এতটাই করুণ ছিল সে স্বর যে উলটোদিকের মানুষটাও বোধহয় তার অন্তরের ব্যথা অনুভব করতে পারছিল। একজন অপরজনকে মন থেকে ডাকলে অপরজন সাড়া না দিয়ে পারে না।

এবার উলটোদিক থেকে বেশ ভারাক্রান্ত স্বরে জবাব আসে, ‘কেমন আছিস?’

‘আমি ভালো আছি। কাকিমা কেমন আছে? ভাই-বোনেরা ভালো আছে? আর বাড়ির অন্যান্যরা?’ কাকার স্বর শুনেই প্রশান্ত বুঝেছিল, তারাও বোধহয় তার মায়ের মতোই এই দিনটারই অপেক্ষায় ছিল।

‘সবাই ভালো আছে। আগে বল তুই কোথায় আছিস এখন? বউদি, রিমা, বাচ্চারা কেমন আছে?’

‘সবাই ঠিক আছে। সামনের মাসেই তোমার নাতনির বিয়ে। তোমাদের সবাইকে আসতে হবে। তোমরা না এলে  তোমার নাতনির বিয়েই ক্যানসেল করে দেব।’ প্রশান্ত এমনভাবে জোর খাটাতে লাগল, যেন কিছু হয়ইনি, সবই আগের মতোই আছে।

‘এমন অলক্ষুণে কথা বলতে নেই বাবা। আমরা সবাই আসব। তুই তোর কাকা-কাকি, পিসি সবাইকে একটা করে ফোন করে দে।’

‘তোমাদের ঠিকানা দাও। কার্ড পাঠিয়ে দেব।’

‘আমার নাতনির বিয়েতে তুই আমাকে কার্ড পাঠাবি তবে আমি যাব। খুব বড়ো হয়ে গেছিস না। তুই শুধু সকলকে ফোন করে দে, বাকিটা আমি দেখে নেব।’

‘ঠিক আছে। তুমি যা বলবে তাই হবে।’ বলে ফোন রেখে দিল প্রশান্ত। হয়তো তাদের অনেক কথাই বাকি থেকে গেল।

এতক্ষণ চুপচাপ ছেলের কাছে বসেছিলেন উমাদেবী। ফোন কেটে দিতেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকা কী বলল বাবা, ওরা আসবে তো?’

প্রত্যুত্তরে প্রশান্ত আনন্দের সঙ্গে বলে উঠল, ‘কত সোজা একটা ব্যাপারকে কত জটিল ভাবছিলাম না মা। আর দ্যাখ্যো কত সহজে সবকিছু মিটে গেল। এতবছর ধরে চেষ্টা করেও ফোন করতে পারিনি। কোথাও যেন একটা দ্বিধা, একটা ইগো কাজ করত। সবাই আসবে মা সবাই আসবে।’

সত্যি বলছিস বাবা?’ আনন্দে উমাদেবীর চোখ জলে ভরে গেল। পাছে ছেলে দেখে ফেলে তাই সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন নিজের ঘরে।

এক এক করে প্রশান্ত পরিবারের সকলকে ফোন করে। সকলের থেকে প্রায় একই ধরনের উত্তরই পায় সে। নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে কখন যে তার চোখ জলে ভরে গিয়েছিল সে নিজেও জানে না। কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পর আবার আগের মতো আরামকেদারায় দেহ এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল।

ঠিক সেই সময়েই রিমার ছোঁয়ায় প্রশান্ত চোখ খোলে। বলে, ‘তুমি কখন ফিরলে?’

প্রশ্নের উত্তরে রিমা বলে, ‘তুমি আর মা যখন বসার ঘরে বসে কথা বলছিলে তখনই এসেছি। তোমরা কথা বলছ দেখে তোমাদের ডাকিনি। সোজা উপরের ঘরে চলে গিয়েছিলাম।

‘ঠিক আছে বসো। তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।’

‘বলো কী বলবে?’

‘আমি অনেক কষ্টে পরিবারের সবাইকে বিয়েতে আসার জন্য রাজি করেছি রিমা। আশা করি এইবার তুমি কোনও গন্ডগোল বাঁধাবে না। পরিবারের সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। আমরা দুজনে যে ভুল করেছি, সেই ভুল শুধরে নিতে তুমিও আমাকে সাহায্য করবে।’

‘তুমি কি কিছুই বোঝো না গো? তোমার থেকে কেন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই? নিজেকে সারাদিন কাজে কেন ব্যস্ত রাখি? তোমার আর মার কষ্টটা যখন বুঝতে পারি, তখনই একটা অপরাধবোধ তাড়া করে বেড়ায় আমাকে। আমি নিজেও এটাই চাইছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দাও প্রশান্ত। তুমি দেখো আমি আবার সকলের মন জয় করে নেব।’ প্রশান্তর হাতদুটো ধরে একটু কাছে ঘেঁষে আসে রিমা।

বিগত কয়েক বছরে রিমার স্বভাবে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সবসময় নিজের বাচ্চাদের ও মিলেমিশে থাকার পরামর্শ দিত। তার ছেলে মেয়ের সম্পর্ক-ও যদি ভবিষ্যতে কোনও মেয়ের কারণে নষ্ট হয় সে আর প্রশান্ত কী সেটা মেনে নিতে পারবে। যে-ভুলটা সে এতদিন করে এসেছে, কাকা-কাকি, পিসি, ভাই-বোন সবার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে প্রশান্তকে সেই জিনিস তো আবার ঘটতে পারে, এই ভয়টাই বাসা বেঁধেছিল রিমার মনে। এমনিতেই আজকাল সম্পর্কের বাঁধন খুব আলগা। সেখানে শুধুমাত্র তার শ্বশুরবাড়ির পরিবারটিই ব্যতিক্রম মাত্র। যেখানে সে নিজেই ছেদ ঘটিয়েছিল। তাই বোধহয় সে নিজেও আজ তার ভুলটা শোধরাতে চায়।

অবশেষে বিয়ে প্রায় আসন্ন। দিন-দুয়েক মাত্র বাকি। এক এক করে হাজির হল সমস্ত পরিবার। বাড়ির সকলকে দেখে হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিল রিমা। সত্যিই বড়োদের আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি রাখেনি সে। নিজে হাতে সেবা করেছে সকলের। আগের মতো সকলে তাকে কাছেও টেনে নিয়েছে। আজ প্রশান্তর সংসার একেবারে পরিপূর্ণ। সবাই একেবার আনন্দে আটখানা। প্রশান্তর বাড়ি একেবারে চাঁদের হাট।

এইসব দেখে প্রশান্ত মনে মনে ভাবে আজ তার ভালোবাসার বাগান একেবারে ফুলে, ফুলে, সুগন্ধে ভরে গেছে। একেই বোধহয় বলে রক্তের টান। আনন্দে তার চোখ জলে ভরে যায়।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...