নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য মহিলারা আজকাল কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকেন না। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য সাহসও রাখেন মহিলারা। কিন্তু সামাজিক বাঁধন আর আইনি জটিলতা, মহিলাদের স্বপ্নপূরণে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে অনেকসময়। তবে প্রতিবন্ধকতা যেমন আছে, ঠিক তেমনই অধিকারও রয়েছে। অতএব, অধিকার প্রতিষ্ঠা করে প্রতিবন্ধকতা কাটাতে হবে। জেনে নিন কয়েকটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা এবং অধিকারের বিষয়ে।

প্রতিবন্ধকতা

১)  অসুস্থ সম্পর্ককে মেনে নেওয়াঃ  স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির লোকেদের থেকে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা কিংবা অত্যাচারিত হলেও, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কিংবা শাস্তির উদ্যোগ সহজে নিতে পারেন না মহিলারা। কারণ, সব মহিলারা স্বনির্ভর নন, তাই সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটিয়ে অন্যত্র বসবাস করতে পারেন না সহজে। অতএব, এই বিষয়ে হিন্দু বিবাহ আইন মোতাবেক বিবাহবিচ্ছেদ করার অধিকার থাকলেও, উপায় না থাকার জন্য তা বলবৎ করতে পারেন না অনেক মহিলা।

২)  বিয়ের পরে অন্যের বাড়িতে বসবাসঃ  ছোটোবেলা থেকে মেয়েদের শেখানো হয় যে, বিয়ের পরে তোমাকে অন্যের বাড়িতে থাকতে হবে। তাই, সহনশীল হতে হবে, মাথা নত করে থাকতে হবে, ঝগড়া-অশান্তি হলেও শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে আসতে নেই ইত্যাদি। অতএব, মেয়েদের ব্যক্তি স্বাধীনতা শেষ, প্রতিবাদ বন্ধ। শুধু অত্যাচার সহ্য করে অন্যদের অন্যায় মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই।

৩)  কন্যাপক্ষের লোক মানেই পদানত হয়ে থাকাঃ  মেয়ের বাড়ি মানেই শুধু দিতে হবে। নগদ টাকা, উপহার, ইত্যাদি দেওয়ার রীতি এখনও চালু রয়েছে আমাদের সমাজে। নানা অজুহাতে মেয়েদের বাড়ির থেকে দান সামগ্রী নেওয়ার এই নির্লজ্জ নিয়ম কবে বন্ধ হবে তা জানা নেই। শুধু কি তাই, কন্যাপক্ষের লোক মানেই সবসময় আজ্ঞাবহ হয়ে থাকতে হবে। ছেলের বাড়ির লোক শত অন্যায় করলেও টুঁ শব্দটি করতে পারবেন না মেয়ের বাড়ির লোকেরা, উল্টে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে তাদের।

৪)  শখ-আহ্লাদ পূরণ করতে না পারাঃ  শাড়ি, গয়না কিংবা কাউকে কিছু দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও, স্বামী কিংবা শ্বশুরবাড়ির লোকেদের অনুমতি ছাড়া তা করলে অশান্তি ভোগ করতে হবে। অতএব, মনের ইচ্ছেকে দমিয়ে রাখতে হবে।

৫)  স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতাঃ  পুরুষদের যে-স্বাধীনতা আছে, মেয়েদের তা নেই। এখনও মেয়েরা বাড়ির বাইরে বেশি রাত পর্যন্ত থাকতে পারে না। বাড়ির লোক ছাড়া একা একা কোথাও বেড়াতে যেতে পারে না কিংবা অন্যত্র রাত্রিযাপন করতে পারে না। এটাকে স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতাই বলা যায়।

৬)  শিক্ষাগত প্রতিবন্ধকতাঃ  বড়ো শহরে না হলেও, মফস্সল কিংবা অনেক গ্রামে আজও মেয়েরা শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়। ইচ্ছে থাকলেও উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় নানা কারণে। দশ-বারো ক্লাস পাশ করলেই তো বিয়ে দেওয়া যায়, তাই আর বেশি শিক্ষার কি প্রয়োজন আছে?– এমনই ধ্যানধারণায় বিশ্বাসী অভিভাবকদের জন্য শেষ পর্যন্ত উচ্চশিক্ষা লাভ করতে পারেন না অনেক মেয়ে।

৭)  বিচারের প্রহসনঃ  এখনও অনেক গ্রামে মোড়ল কিংবা পঞ্চায়েত প্রধানের দ্বারা মেয়েদের ভাগ্য নির্ধারিত হয়। বাড়িতে কিংবা বাড়ির বাইরে অত্যাচারিত হলে যদি কোনও মেয়ে অপরাধির শাস্তি চায় তাহলে গ্রামের মোড়ল কিংবা পঞ্চায়েত প্রধানই বিচার করবে। আর সেই বিচারে বেশিরভাগই দেখা যায়, উলটে অভিযোগকারিণীর অভিযোগকেই মিথ্যে প্রমাণ করা হয় কিংবা তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়।

৮)  পোশাকের প্রতিবন্ধকতাঃ  মেয়েরা যদি খোলামেলা পোশাক পরে তাহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। শহরে যদিওবা এ ব্যাপারে মেয়েরা কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করে, গ্রামের মেয়েরা তা পারে না। আর কোনও গ্রাম্য মেয়ে যদি একটু সাহস দেখায় এ বিষয়ে, তাহলে ‘স্বেচ্ছাচারি’, ‘নষ্ট মেয়ে’ ইত্যাদি শব্দগুলি হজম করতে হয় এবং বিয়ের সম্বন্ধ ভেঙে যায়।

৯)  প্রেমের প্রতিবন্ধকতাঃ  বিবাহপূর্ব প্রেম কিংবা যৌনসম্পর্ককে আজও আমাদের সমাজ ঘৃণার চোখে দেখে। বেশিরভাগ মেয়ে এখনও তাই প্রেম করে লুকিয়ে। আর সমলিঙ্গে প্রেম? সে তো খুন করার সমান অপরাধ বলে ধরে নেওয়া হয় আজও।

১০)  ভয়ঃ  একা চলাফেরার ভয়, শ্লীলতাহানি কিংবা ধর্ষণের ভয়, বিবাহবিচ্ছেদ হলে একা জীবনযাপনের ভয় প্রভৃতি মেয়েদের মানসিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি করে।

সময় বদলালেও, এমন নানা প্রতিবন্ধকতায় এখনও জর্জরিত মেয়েরা। তাদের আলোকিত করার জন্য এখানে জানানো হল, কী কী অধিকার তাদের দিয়ে রেখেছে ভারতীয় আইন ব্যবস্থা।

আইনি অধিকার

  •  ধর্ষিতার গর্ভপাতের অধিকারঃ  খুনের দায়ে জেল হয়েছিল এক ধর্ষিতার। আর ধর্ষণের ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়েন ওই মহিলা কিন্তু জেল কর্তৃপক্ষ তাঁকে গর্ভপাতের সুযোগ না দেওয়ায় তিনি আদালতের দ্বারস্থ হন। মধ্যপ্রদেশ উচ্চ আদালত আইন মোতাবেক ওই ধর্ষিতার ইচ্ছেপূরণের সম্মতি দেন।
  • অ্যান্টি রেপ বিলঃ  মহিলাদের সুরক্ষার জন্য তৈরি অ্যান্টি রেপ বিল ২০১৩ সালের এপ্রিল মাসে রাষ্ট্রপতি অনুমোদন করেছেন। এই বিল মোতাবেক, ধর্ষণের অপরাধে ন্যূনতম ২০ বছর কারাবাস, এমনকী মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। এছাড়া, শ্লীলতাহানি, ভয় দেখিয়ে মহিলাদের সংবেদনশীল অঙ্গ স্পর্শ করা, অত্যাচার করা প্রভৃতিও জামিন অযোগ্য অপরাধ এবং পাঁচ থেকে দশ বছর পর্যন্ত কারাবাস হতে পারে এই ক্ষেত্রে।
  • কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থার শাস্তিঃ  ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল থেকে কার্যকরি হয়েছে সংশোধিত এই ‘সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট অফ উইমেন অ্যাট ওয়ার্কপ্লেস’ আইন। আর এই আইন অনুসারে, কর্মরত কোনও মহিলা কর্মীকে কৌশলে, ক্ষমতাবলে কিংবা বলপ্রয়োগ করে শারীরিক মিলনে বাধ্য করা দণ্ডনীয় অপরাধ। এমনকী, মহিলা কর্মীর শরীরের সংবেদনশীল অংশ স্পর্শ করা, যৌনাঙ্গ প্রদর্শন করা, যৌন উত্তেজক কিছু খাওয়ানো কিংবা যৌন উত্তেজনামূলক (পর্নোগ্রাফি) ছবি দেখানো ইত্যাদিও দণ্ডনীয় অপরাধ।
  • সন্তানের দেখাশোনার জন্য ছুটিঃ  মহিলা সরকারি কর্মচারি মোট ৭৩০ দিন ছুটি নিতে পারেন সন্তানের দেখাশোনার জন্য। বাচ্চার ১৮ বছর বয়সের মধ্যে পরীক্ষা, অসুস্থতা প্রভৃতি কারণে মা ছুটি নিতে পারেন এবং এরজন্য কোনও বেতন কাটা যাবে না।
  • বিধবার অধিকারঃ  স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী শ্বশুরবাড়িতে থাকতে পারেন এবং সম্পত্তির অধিকারও তাঁর বলবৎ থাকবে। এক্ষেত্রে শ্বশুর, শাশুড়ি কিংবা মৃত স্বামীর ভাই-বোন যদি বিধবাকে বঞ্চিত করেন সম্পত্তির অধিকার থেকে, তাহলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে।
  • লিভ ইন রিলেশনশিপ সংক্রান্ত সুবিধাঃ  যদি কোনও পুরুষ এবং মহিলা দীর্ঘদিন স্বামী-স্ত্রীর মতো একসঙ্গে বসবাস করেন, তাহলে তাদের বিবাহিত দম্পতি ধরে নেওয়া হবে এবং সেক্ষেত্রে ওই মহিলা স্বাভাবিক স্ত্রীর মতো সবরকম অধিকার পাবেন।
  • ভরণপোষণের অধিকারঃ  বিবাহবিচ্ছেদের পরে স্বামীকে স্ত্রী এবং সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হবে আজীবন। এক্ষেত্রে কোনও স্ত্রী যদি চান, এককালীন অর্থ আদায় করে নিতে পারেন বিচ্ছেদ হওয়া স্বামীর থেকে।
  • পণ সংক্রান্ত আইনঃ  বিয়ের আগে কিংবা পরে স্ত্রীর বাবা-মায়ের পরিবার থেকে অর্থ কিংবা জিনিসপত্র দাবি করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। স্বামী কিংবা শ্বশুর বাড়ির লোকেরা যদি পণের জন্য স্ত্রীকে মানসিক কিংবা শারীরিক অত্যাচার করেন, তাহলে অত্যাচারকারী স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকেরা ৪৯৮এ ধারা অনুযায়ী কঠিনতম শাস্তি পাবেন।
  • প্রতিবাদের অধিকারঃ  চাইলে মহিলারা যে-কোনও বিষয়ে মুখ খুলতে পারেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে জোরদার প্রতিবাদ করতে পারেন। এ বিষয়ে মহিলারা পুরুষদের থেকে আইনমাফিক বেশি সুবিধে পাবেন। কারণ, আইন এখন মেয়েদের পক্ষে।
  • সন্তানলাভ অর্থাৎ মা হওয়ার অধিকারঃ  প্রাপ্তবয়স্ক যে-কোনও মহিলা স্বইচ্ছায় মা হতে পারেন। এক্ষেত্রে তিনি যদি অবিবাহিতও হয়ে থাকেন, তাতে কিছু অসুবিধা নেই। তাই এখন মা চাইলে একাই সন্তানের অভিভাবক হতে পারেন, বাবার প্রয়োজন নেই।
আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...