বোতলের অনেকটা তরল একসঙ্গে গলায় ঢালে বাচ্চু। আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না। দুদিন ভালো করে খাওয়া হয়নি। সিগারেট খেলে বুকের ভেতরটা জ্বালা করে আজকাল। চলতে গেলে পা কাঁপে। অথচ বাচ্চুর চেহারা বেশ ভালোই ছিল। আগে নিয়মিত ব্যায়াম করত। পঞ্চাশ ইঞ্চি বুক ছিল। এখন সেসব স্বপ্ন মনে হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর অভাব আর দারিদ্র্য যেন ওর জীবনের সঙ্গী হয়ে গেছে। পড়াশোনাটা ভালো করে করলে হয়তো একটা চাকরি পাওয়া যেত। একসময়ে স্বাস্থ্যের গৌরবে সে অচিরেই হয়ে উঠেছিল পাড়ার হিরো। কিন্তু এই হিরোই একসময় হয়ে উঠল এক চলমান ত্রাস। একজন অ্যান্টি সোশ্যাল। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই বাচ্চুকে ভয় পেত। আর পাড়ার মেয়েদের তো নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করার উপায়ই ছিল না। অথচ জীবনটা কীরকম বদলে গেল। মা সেই কোন ছোটোবেলায় মারা গেছে। তারপর বাবাও চলে গেল। একটা ছোটো বোনকে রেখে গেল বাচ্চুর জিম্মায়। রোজগারের কোনও নিশ্চয়তা নেই। কোনওমতে দিন চলে। কখনও রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করে। আবার কখনও হয় বড়ো ব্যবসাদারের ভাড়া করা গুণ্ডা। দুবার জেলও খেটেছে বাচ্চু। বোনটা পাড়ার এক বুড়ি পিসিমার কাছেই মানুষ। এখন শরীরটাও চলে না। ক্ষমতায় এখন অন্য রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিক কারণেই এখন বাচ্চুর রোজগারও কম হয়। বোনটা তো অসুখে ভুগে ভুগে কঙ্কালের রূপ নিয়েছে।

নেশার পাত্রটা শেষ করে চোখদুটো খুলল সে। রোখ চেপে যাওয়া গলায় বলল ‘ওঠ’। পাশে বসা মনু বলল, ‘গুরু বোতলটা শেষ করে গেলে হতো না?’

ক্লান্তস্বরে বাচ্চু বলল, ‘না ওটা ফেলে দে। আজ একবার শেঠ বাজোরিয়ার কাছে যেতে হবে। কিছু টাকার দরকার বুঝলি? বোনটাকে ওষুধপত্র না দিলে ও মরে যাবে।’

‘কাজ ছাড়া কি শেঠ টাকা দেবে?’

‘ওর বাপ দেবে। ওর জন্য আমি কম খুন, জখম করেছি?’

‘ওর তো এখন পেয়ারের লোক বিল্লে, যাকে তুমি হাতে ধরে বানিয়েছ।’ প্যান্টের পকেটে রাখা রামপুরী চাকুটা একবার অনুভব করল বাচ্চু। চোখদুটো লাল। দাঁতে দাঁত চেপে রাগে গর্জন করে উঠল। তারপর বলল, ‘আমি যদি টাকা না পাই তবে দুটোকে সাফ করে দেব।’

‘গুরু তার চেয়ে চামেলির ওখানে চলো। ও যদি কিছু টাকা দিতে পারে।’

‘ওই ভোগলালসার টাকা আমি ছুঁই না। তার থেকে কাঁচড়াপাড়ায় চল দেখি আমার ছোটো মামার থেকে কিছু পাই কিনা।’

স্বপনলালের চায়ের দোকানের পিছনে ওরা এতক্ষণ বসে ছিল। দোকান থেকে বেরোতে বেরোতে কী যেন একটু ভেবে নিয়ে মনুকে বলল, ‘তুই এখন যা, আমাকে একটু একা থাকতে দে।’

নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে চামেলির বস্তির সামনে এসে দাঁড়াল বাচ্চু। রাস্তার কলের জলে দু’চার জন মেয়েমানুষ বুকে গামছা জড়িয়ে স্নান করছিল। ফুটপাথের ওপর দু’চারটে বাচ্চা খেলা করছে। অদ্ভুত এদের জীবন। দুঃখটা কেমন সহজ করে মেনে নিয়েছে। কোনও আশা নেই প্রত্যাশা নেই শুধু কোনও রকমে বেঁচে থাকা। চামেলির ঘরের বাইরে টুলের ওপর ওর স্বামী বসে চা খাচ্ছিল। একটু হেসে বলল, ‘কি খবর বাচ্চুদা?’

বাচ্চু সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘চামেলি কোথায়?’

‘ঘরেই আছে। একটু ব্যস্ত আছে।’

চামেলির এই দেহদান বাচ্চুর একটুও ভালো লাগে না। পয়সার জোর থাকলে বড়ো বড়ো উপদেশ দেওয়া যায়। চামেলির চারটে বাচ্চা, তার ওপর ওর স্বামীর কোনও রোজগার নেই। মাঝে মাঝে ভাবে বাচ্চু, জীবনটা কি এতই সুন্দর যা কোনওভাবে বাঁচিয়ে রাখতেই হয়।

একটা সিগারেট ধরাল বাচ্চু। মাথাটা খুব ধরেছে। কী করবে সে। তারপর বলল, ‘আমি ঘুরে আসছি।’

চামেলির স্বামী বলল, ‘সেই ভালো, জানি না তো কতক্ষণ লাগবে।’

রাত বারোটার পর যখন চামেলির ঘরে ঢুকল বাচ্চু, চামেলি তখন ক্লান্ত। বড়ো বড়ো হাই উঠছে। বাচ্চাগুলো জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে তেলচিটে বিছানাটাতে। চামেলি বলল, ‘হঠাৎ পথ ভুল করে এখানে?’

চৌকির ওপর বসতে বসতে বাচ্চু বলল, ‘বোনটার খুব অসুখ। তাই বেরিয়েছিলাম টাকার সন্ধানে।’

‘কী হয়েছে নীতার?’ অনেক জানার আগ্রহ চামেলির মুখে।

‘জানি না। তবে আজ ক’দিন ধরে কিছু খাচ্ছে না।’

‘ডাক্তার দেখিয়েছ?’

‘হ্যাঁ, ছোটোখাটো ডাক্তার দেখিয়েছি, কিছুই ধরতে পারছে না।’

‘কোনও বড়ো ডাক্তার দেখাও।’

একটু হাসল বাচ্চু, বলল, ‘খাবার পয়সা নেই ডাক্তার দেখাব!’

‘আমি পয়সা দেব, তুমি নীতাকে বাঁচাও।’

‘সে হয় না চামেলি। তোমার রোজগারের লজ্জা আমাকে দিনরাত কুরে কুরে খাবে।’

‘তবুও তুমি না কোরো না। আমি যদি আমার সমস্ত লজ্জা, ঘৃণা ত্যাগ করে আমার বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তবে নীতাকেও বাঁচাতে পারব। আমি বড়ো বড়ো শেঠের কাছে যাব। অনেক টাকা আনব।’

বাচ্চু হঠাৎ চামেলির মুখ চেপে ধরে, রাগে ওর শরীর জ্বলছে। বলে, ‘না। ওই পয়সাওয়ালা লোকদের ভোগের সামগ্রী হতে দেব না তোকে। এবার, যদি না পাই তবে ছিনিয়ে নেব। ওইসব বাড়ির মেয়েদের লাজলজ্জা আছে, আমাদের মা-বোনেদের নেই?’ চামেলির ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়ল বাচ্চু। মাথাটা কেমন ঘুরছে, কান গরম।

দুদিন পর বাড়ি ফিরল বাচ্চু। নীতার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ঘরের এককোণে নেতিয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চারদিন কিছু খায়নি। পাড়ার ডাক্তার জীবেনবাবু কোনও বড়ো ডাক্তারকে দেখাতে বলেছেন।

‘এখন কী করবে করো।’ পিসিমা রাগে গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাচ্চু নীতার মাথায় হাত দিল। জ্বরটা এখনও আছে। চোখের দু’ধারে শুকনো জলের দাগ। অচৈতন্যের মতো পড়ে আছে। কষ্টের ছাপ ওর মুখে।

বাচ্চু ডাকল, ‘নীতা’।

নীতা চোখ খুলে চেয়ে রইল।

‘খুব কষ্ট হচ্ছে না রে?’

নীতা কিছু বলল না।

‘একটু ফলের রস খাবি?’

নীতা মাথা নাড়ল।

‘একটু কিছু খেয়ে নে,’ মাথায় হাত বোলাল বাচ্চু।

‘ভীষণ কষ্ট হচ্ছে দাদা।’

‘কোথায় কষ্ট হচ্ছে বল।’

নীতা নিজের পেটের ওপর দৃষ্টি নামাল।

আবার বাচ্চু বলল, ‘খুব ব্যথা হচ্ছে নীতা?’

‘হ্যাঁ দাদা, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা দাদা তুই বাড়ি আসিস না কেন? আমার কথা তোর একটুও মনে পড়ে না?’

বাচ্চুর চোখ ফেটে জল এল। ওর পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘তোর জন্য বড়ো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। অনেক টাকার দরকার তাই কাজ করি।’

‘তুই কত রোগা হয়ে গেছিস দাদা। আমার জন্য তোর কত পরিশ্রম।’

‘কথা বলিস না নীতা, ব্যথা বাড়বে।’

‘আমার একটুও ভালো লাগছে না দাদা, ব্যথাটা বাড়ছে। আমি মা-বাবার কাছে যাব। মা আমাকে কত ভালোবাসবে, আদর করবে। কত সুন্দর বই কিনে দেবে। আমি বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাব। কত মজা হবে।’

জ্বরের ঘোরে ভুল বকতে থাকে নীতা। পিসিমা ঘরে ঢুকে বলল, ‘ব্যথাটা বাড়ল বুঝি? কী যে হল। আমি একটু গরম তেল মালিশ করে দেখি।’

বাচ্চু হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। নীতার অসহ্য কষ্ট আর দেখতে পারছে না। সমস্ত শরীরের ভেতর ওর অক্ষমতার জন্য একটা যন্ত্রণা বয়ে গেল। নীতাকে বাঁচতেই হবে। ওকে এরকম ভাবে মরতে দেবে না বাচ্চু। যে করেই হোক টাকা চাই।

শেঠ বাজোরিয়ার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল বাচ্চু। গেটের দারোয়ান বাধা দিতেই বলল, ‘সাহেব ডেকেছে।’

আরও কয়েকবার বাচ্চু এবাড়িতে এসেছে। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই চাকরকে বলল, ‘শেঠ সাহেবকে বল আমি এসেছি।’

চাকর ফিরে এসে জানাল, ‘সাহেব এখন বাইরে যাবে এখন দেখা হবে না।’ বাচ্চুর মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। চাকরকে হাত দিয়ে সরিয়ে জোরে জোরে পা ফেলে সোজা বাজোরিয়ার বেডরুম-এ ঢুকল। শেঠ বাজোরিয়া তখন পোশাক বদলাচ্ছিল। ওকে দেখেই বলল, ‘তুই বেডরুম-এ কেন এলি?’

সারা শরীরে এক প্রচণ্ড হিংস্রতা ঘিরে আছে বাচ্চুর। বলল, ‘শেঠ আমার কিছু টাকার দরকার।’

‘রুপিয়া কি এমনিই আসে যে বললেই দিয়ে দেব!’

‘আমার বোনের খুব অসুখ শেঠ, কিছু টাকা দাও। হাতজোড় করছি।’

‘বোনের অসুখ তো আমি কী করব? যা না সরকারি হাসপাতালে।’

‘তোমার অনেক কাজ করেছি শেঠ, আমি আবার কাজ করে শোধ করে দেব।’

‘না তোকে আমার দরকার নেই। আমি তোর মতো কুত্তাকে আর ডাকব না। বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে।’

বাচ্চু আর থাকতে পারল না। মাথায় খুন চেপে গেছে। পকেট থেকে রামপুরী চাকুটা বার করল। তারপর চিৎকার করে উঠল, ‘টাকা আমার চাই।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুই বস আমি আসছি।’ বাজোরিয়া বারান্দায় রাখা টেলিফোন তুলে বলল, ‘হ্যালো লালবাজার আমি…’ আর বলা হল না। প্রচণ্ড শক্তিতে বাচ্চু তখন ওর গলা টিপে ধরেছে। একটা গোঙানি ভেসে এল বাজোরিয়ার মুখ দিয়ে। তারপর বাচ্চুর হাতের রামপুরী চাকুর আঘাতে লুটিয়ে পড়ল বাজোরিয়ার দেহ। বাজোরিয়ার দেহটা নিথর হয়ে যেতেই বাচ্চুর হুঁশ এল। এটা সে কি করল! লোকটাকে সে মেলে ফেলল! এতটা যে খুন চেপে যাবে ও আগেও ভাবেনি। কিন্তু আর এখন কিছু ভাবার নেই। দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রুদ্ধশ্বাসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল বাচ্চু।

রাত অনেক হয়ে গেছে চারিদিক নিঃস্তব্ধ, রাস্তার কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে। শীতের রাত্রি লোক চলাচলও কম। বাচ্চু চামেলির ঘরের দরজার কড়া নাড়ল। চামেলি জেগেই ছিল। খুব সেজেছে আজ চামেলি। ভালো নাইলন শাড়ি, কপালে লাল টিপ। চামেলির স্বামী ঘরে নেই। মাল টেনে কোথাও পড়ে আছে বোধহয়, বাচ্চাগুলো এককোণে শুয়ে ঘুমুচ্ছে।

দরজা খুলেই চামেলি জিজ্ঞেস করল, ‘এত রাতে কী ব্যাপার?’

বাচ্চু বলল, ‘আমাকে একটু জল দাও চামেলি। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি।’ বাচ্চু তখনও হাঁপাচ্ছে।

চামেলি বলল, ‘বসো আমি জল আনছি।’

জল খেয়ে বাচ্চু বলল, ‘আজকে একটা খারাপ কাজ করে ফেলেছি।’

‘আবার মারামারি করেছ? না তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। তুমি না থাকলে নীতার কি হবে ভেবে দেখেছ একবার?’

চিৎকার করে উঠল বাচ্চু– ‘ওকথা বোলো না চামেলি। ওকথা বোলো না।’

তারপর চামেলির হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমি না একদিন বলেছিলে– নীতাকে বাঁচাবে।’

‘হ্যাঁ বলেছিলাম।’

‘তবে তুমি ওকে বাঁচাও চামেলি। আমার একান্ত অনুরোধ, বলো তুমি রাখবে?’

‘হ্যাঁ, সেই ভেবেই তো…। এখুনি বাজোরিয়া শেঠের গাড়ি আসবে, আমাকে নিয়ে যাবে ওর বাগান বাড়িতে দিন সাতেক থাকতে হবে, কিন্তু অনেক টাকা দেবে, জানো!’

বাচ্চুর শিরা দুটো দবদব করছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। এখন সে কী করবে? কোথায় পালাবে। কিছু কূলকিনারা পাচ্ছে না।

বাজোরিয়ার নামটা যেন তার বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটছে। ওকেই তো কিছুক্ষণ আগে নিজের হাতে খুন করে এসেছে সে। ওতো আর কোনওদিন আসবে না চামেলিকে নিতে।

চামেলি পান খেতে খেতে বলল, ‘ও এখনও এল না লোকটা। টাকাটা পেয়ে নিই, তারপর দেখো আমি নীতাকে বাঁচাবই।’

বাচ্চুর মাথা ঘুরছে। এ কী করল সে! ওই টাকাও আর পাওয়া যাবে না। শুধু বাজোরিয়ার নয়, সে যে নীতারও প্রাণ নিয়ে ফেলেছে। সমস্ত পৃথিবী কাঁপছে। হাত মুঠি করে নিজের ভেতরের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে সে বলল, ‘ওই শেঠ আর আসবে না চামেলি। আমি বাজোরিয়াকে খুন করে এসেছি নিজের হাতে।’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বাচ্চু।

‘এ তুমি কি করলে বাচ্চুদা। আমি যে অনেক কষ্টে এ টাকার বন্দোবস্ত করেছিলাম।’

‘আর বোলো না চামেলি। আমি নিজের হাতে দুটো প্রাণ নষ্ট করে দিলাম, আমাকে তুমি ক্ষমা করো।’

রাত্রির মধ্যম যাম। অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে থাকে। তারপর উদভ্রান্তের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় বাচ্চু। বড়ো রাস্তা পেরোলে ওপারেই সরকারি হাসপাতাল। আরও একটু এগোলেই মোড়ের মাথায় থানা।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...