আজ ক’দিন ধরেই মনটা কেমন যেন হু-হু করছে। কাগজে আজকাল এমন সব খবর বেরোয়, সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মেয়ের মা হয়ে তাতে বুক কাঁপাই স্বাভাবিক। কোনও এক অশনিসংকেতের আভাসে বুকের ভিতরটা মাঝেমধ্যেই কেঁপে কেঁপে ওঠে। তার উপর সকাল থেকে আকাশটাও কেমন যেন মুখভার করে রয়েছে। টানাহ্যাঁচড়া করে কোনওরকমে শরীরটাকে বিছানা থেকে বাথরুম পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। স্কুলে যেতে হবে যে। আজ আর ছাদে যেতে ইচ্ছে করল না। বারান্দাতেই ভিজে জামাকাপড় মেলতে মেলতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার চোখ চলে গেল রাস্তার ওপাশে রায় কাকিমাদের পুরোনো আমলের সেই বিশাল বাড়িটার দিকে। অবশ্য বাড়ির সঙ্গে ‘পোড়ো’ কথাটা জুড়ে দিলেও খুব একটা ভুল বলা হবে না। একপাশ ভেঙে পড়ে গেছে। ইটগুলো যেন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে গিলে খাওয়া চেহারা নিয়েছে। চতুর্দিকে আগাছা। বড়ো বড়ো বটের শিকড় বাড়ির দেয়াল ফাটিয়ে মাথা চারা দিয়ে উঠেছে। একটা অংশে বোধকরি নিশাচর প্রাণীরাও নির্বিঘ্নে বসবাস করছে। রাতে তাদের ডাকও কানে আসে। এই ভাঙাচোরা বাড়িটার একটা কোণাতেই কোনওরকমে বেঁচে আছেন কাকিমা।
অথচ শাশুড়ি-মার থেকে শুনেছিলাম এককালে নাকি ওই বাড়ি ছিল দেখার মতো। দুর্গাপুজোর সময় হাজারো লোকের সমাগম হতো এখানে। ফি-বছর চন্দননগরের আলোর ভেলকি, আতসবাজির রোশনাই আর সাবেকি পুজো দেখতে মানুষের ঢল নামত।
সে বছরও এক বিদেশি মহিলা এসেছিলেন পুজো নিয়ে ডকুমেন্টারি বানাবার জন্য। নাম ইলোরা ফ্লোরেন্স। আশ্চর্যের কথা, যে কাকু, কাকিমার সন্তান না হওয়া সত্ত্বেও গঞ্জনা দেওয়া দূরে থাক, এতটুকু খারাপ ব্যবহার পর্যন্ত করেননি, সেই মানুষটিই কিনা চিরতরে কাকিমাকে ছেড়ে ওই ইলোরার সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। তারপর আর দেশে ফেরেননি।
শাশুড়ি যতদিন বেঁচেছিলেন, ততদিন তবু গালমন্দ করারও একটা লোক ছিল। এখন একেবারে একা। এক দেওর ছিল বটে। শাশুড়ি মারা যাওয়া ইস্তক সে দেওরও এমুখো হয়নি। ডাক্তারি পড়তে গিয়ে বিদেশবিভুঁইতেই পাকাপাকি ভাবে থেকে গেছে। শুনেছি তার দুই ছেলেমেয়েই নাকি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র হয়েছে। এই অভাগির খবর নেওয়ার সময়ই বা তাদের কোথায়। আর খবর নেবেই বা কেন, যেখানে কাকুই...!