আজ ক’দিন ধরেই মনটা কেমন যেন হু-হু করছে। কাগজে আজকাল এমন সব খবর বেরোয়, সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মেয়ের মা হয়ে তাতে বুক কাঁপাই স্বাভাবিক। কোনও এক অশনিসংকেতের আভাসে বুকের ভিতরটা মাঝেমধ্যেই কেঁপে কেঁপে ওঠে। তার উপর সকাল থেকে আকাশটাও কেমন যেন মুখভার করে রয়েছে। টানাহ্যাঁচড়া করে কোনওরকমে শরীরটাকে বিছানা থেকে বাথরুম পর্যন্ত নিয়ে গেলাম। স্কুলে যেতে হবে যে। আজ আর ছাদে যেতে ইচ্ছে করল না। বারান্দাতেই ভিজে জামাকাপড় মেলতে মেলতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আবার চোখ চলে গেল রাস্তার ওপাশে রায় কাকিমাদের পুরোনো আমলের সেই বিশাল বাড়িটার দিকে। অবশ্য বাড়ির সঙ্গে ‘পোড়ো’ কথাটা জুড়ে দিলেও খুব একটা ভুল বলা হবে না। একপাশ ভেঙে পড়ে গেছে। ইটগুলো যেন দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে গিলে খাওয়া চেহারা নিয়েছে। চতুর্দিকে আগাছা। বড়ো বড়ো বটের শিকড় বাড়ির দেয়াল ফাটিয়ে মাথা চারা দিয়ে উঠেছে। একটা অংশে বোধকরি নিশাচর প্রাণীরাও নির্বিঘ্নে বসবাস করছে। রাতে তাদের ডাকও কানে আসে। এই ভাঙাচোরা বাড়িটার একটা কোণাতেই কোনওরকমে বেঁচে আছেন কাকিমা।
অথচ শাশুড়ি-মার থেকে শুনেছিলাম এককালে নাকি ওই বাড়ি ছিল দেখার মতো। দুর্গাপুজোর সময় হাজারো লোকের সমাগম হতো এখানে। ফি-বছর চন্দননগরের আলোর ভেলকি, আতসবাজির রোশনাই আর সাবেকি পুজো দেখতে মানুষের ঢল নামত।
সে বছরও এক বিদেশি মহিলা এসেছিলেন পুজো নিয়ে ডকুমেন্টারি বানাবার জন্য। নাম ইলোরা ফ্লোরেন্স। আশ্চর্যের কথা, যে কাকু, কাকিমার সন্তান না হওয়া সত্ত্বেও গঞ্জনা দেওয়া দূরে থাক, এতটুকু খারাপ ব্যবহার পর্যন্ত করেননি, সেই মানুষটিই কিনা চিরতরে কাকিমাকে ছেড়ে ওই ইলোরার সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। তারপর আর দেশে ফেরেননি।
শাশুড়ি যতদিন বেঁচেছিলেন, ততদিন তবু গালমন্দ করারও একটা লোক ছিল। এখন একেবারে একা। এক দেওর ছিল বটে। শাশুড়ি মারা যাওয়া ইস্তক সে দেওরও এমুখো হয়নি। ডাক্তারি পড়তে গিয়ে বিদেশবিভুঁইতেই পাকাপাকি ভাবে থেকে গেছে। শুনেছি তার দুই ছেলেমেয়েই নাকি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়র হয়েছে। এই অভাগির খবর নেওয়ার সময়ই বা তাদের কোথায়। আর খবর নেবেই বা কেন, যেখানে কাকুই…!
তিনকুলে আর কেউ নেই কাকিমার। তবু ওই বাড়ি আগলে পড়ে রয়েছেন। কী আশা নিয়ে মহিলা বেঁচে আছেন, ওপরওয়ালাই জানেন! বয়স প্রায় নব্বই ছুঁই-ছুঁই। কোমর ভেঙে গেছে। চোখেও ভালো দেখেন না। দুগ্গা ঠাকুরের মতো পানপাতা মুখ, আর কোমর ছোঁয়া ঢেউ খেলানো চুলে, এককালে ডাকসাইটে রূপসী ছিলেন কাকিমা। একসময়ে এই কাকিমার প্রেমেই পাগল ছিলেন রায় কাকু। সেই কাকুই কিনা পুরোনো টান ভুলে বিদেশিনির মোহে দেশছাড়া হয়ে গেলেন! ছেড়ে গিয়েছিলেন কেবলমাত্র একখানা চিঠি। যাতে স্থাবর-অস্থাবর সমস্ত সম্পত্তি তিনি কাকিমাকে দিয়ে গিয়েছিলেন।
কাকিমার কথা ভাবলে খুব খারাপ লাগে। কত অভিমান যে পাথরের মতো বুকে চেপে বসে আছে কাকিমার। এখনও অপেক্ষা করে আছেন, যদি কখনও স্বামী ফিরে আসেন। শেষ দেখাটুকু যদি দেখে যেতে পারেন। মনে মনে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি কাকু যেন সত্যিই ফিরে আসেন, এই শেষবেলায় যেন কাকিমা দেখে যেতে পারেন ওনাকে।
সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় রিচার চিল চিৎকার শুনে ছুটতে ছুটতে নীচে নেমে এসে দেখি বাবার সঙ্গে খুনশুটি চলছে। আঠারো পেরিয়ে সবে উনিশে পড়বে এই শ্রাবণে, কিন্তু আচার ব্যবহারে এখনও শৈশবেই যেন আটকে আছে মেয়েটা। দেখেই মাথাটা গরম হয়ে গেল।
‘কতবার বলেছি না তোমাকে, মেয়েদের এভাবে গলা চড়িয়ে কথা বলতে নেই। কিন্তু তুমি শুনলে তো। তুমি তো ঠিকই করে নিয়েছ আমার কোনও কথাই শুনবে না।’
দুজনের কেউ-ই খুব একটা আমল দিল বলে মনে হল না। নিজেরা নিজেদের মতো এককোণে দাঁড়িয়ে একে- অপরের কানেকানে ফিসফিস করতে থাকল। অদ্ভুতভাবে দুজনেরই ঠোঁটের কোণায় তাচ্ছিল্যের হাসি। সহ্য করতে না পেরে চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘ভদ্রতা, সভ্যতা তো হারিয়েই বসে আছ। তা এবার কী পাকাপাকি ভাবে পড়াশোনাটাও ছেড়ে দিলে। আর ভাস্কর তোমাকেও বলিহারি যাই, উঠতি বয়সের মেয়ের সঙ্গে কেউ এভাবে…’ চেষ্টা করেও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। রাগের মাথায় কদর্য সত্যিটা খানিকটা হলেও বেরিয়েই এল।
বরাবরই আমি শান্ত প্রকৃতির। কোনও চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুনলেই হাত-পা কাঁপতে থাকে। সেখানে এমনভাবে সহজ সত্যটা বেরিয়ে আসায় বুকের ভিতর কেমন যেন অস্থির করতে থাকল। মনটা দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে। এত কিছুর পরেও দুজনের চোখে-মুখে প্রতিক্রিয়ার লেশমাত্র নেই। ক্রমশ নিরস্ত হয়ে পড়ছিলাম। সবার মাঝে থেকেও একাকীত্ব ঘিরে ধরছিল আমায়। ভীষণ অসহায়বোধ করছিলাম। নিজের অজান্তেই দু-চোখ ছলছল করে উঠল আমার।
‘নূপুর হঠাৎ এত ওভার রিঅ্যাক্ট করছ কেন? কী হয়েছে তোমার?’– আমার দু-কাঁধে হাত রেখে, ‘আমি তো আগাগোড়া এভাবেই…। রিচা যতই বড়ো হোক না কেন, ওতো আমার কাছে সেই ছোট্ট তাতাই-ই রয়ে গেছে। বাবা-মায়ের কাছে বাচ্চারা সারাজীবন ছোটোই থাকে।’
‘হ্যাঁ, কিন্তু…’ হঠাৎই মুখে যেন কেউ তালা লাগিয়ে দিল। পুরুষদের যতই বয়স বাড়ুক, তারা কি কমবয়সি কোনও নারীর সঙ্গলাভের প্রলোভন এড়িয়ে যেতে পারে? অন্তরের কথা অন্তরেই থেকে গেল। শত চেষ্টা করেও কিছুতেই কুরুচিকর সত্যিটা বলে উঠতে পারলাম না। অথচ সেই সত্যিটাই আমাকে নিরন্তর কুরে কুরে খাচ্ছিল। মনে মনে শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম আমি।
‘আজকাল তুমি অল্পেই রেগে যাচ্ছো। সব সময় খিটখিট করছ। কী হয়েছে? জানি না কেন, মনে হচ্ছে তুমি ভিতরে ভিতরে কিছু একটা নিয়ে খুব বিব্রত হয়ে আছো।’ আমার হাতটা ধরে সোফায় বসাল ভাস্কর।
‘সমস্যাটা কী? পরিষ্কার করে না বললে বুঝব কেমন করে!’
‘কিচ্ছু না।’ এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আজকাল ভাস্করের এই আদিখ্যেতাগুলোকে বড়ো মেকি মনে হয়। মনে হচ্ছিল ঘর থেকে বেরিয়ে যাই। যত তাড়াতাড়ি বাড়িটা ছেড়ে বেরোনো যায় ততই ভালো। স্কুলের ছেলেমেয়েগুলোর প্রতি তো কিছু কর্তব্য রয়েছে আমার। বাদ-বিবাদে এমনিতেই খানিক দেরি হয়ে গেছে। রেডি হয়ে বেরোতে হবে এক্ষুনি। যেই উপরের ঘরের দিকে পা বাড়াতে যাব, অমনি রিচা পিছন থেকে হাতটা টেনে ধরল, ‘মা, আগে খেয়ে নাও। তারপর তৈরি হয়ে একেবারে বেরিয়ো।’
‘হাতটা ছাড়। আমার খিদে নেই।’
‘খিদে নেই বললে তো চলবে না।’ একপ্রকার জোর করেই টেবিলে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিল রিচা।
‘মা, কেন জানি না, মনে হয় তুমি সবসময় আমার বিয়ে নিয়ে টেনশন করো। কিন্তু কেন মা? আমার এখন কতই বা বয়স! তাছাড়া আমাকে দেখতে শুনতেও খারাপ না যে আমার জন্য পাত্র খুঁজতে অসুবিধা হবে! কী বলো বাবা?’
‘একদম ঠিক বলেছিস। তোর মতেই আমার মত। অ্যাতো তাড়াহুড়ো কীসের আমি তো সেটাই বুঝতে পারছি না!’
ক্ষণিক আগেই যিনি আমার চিন্তায় মরে যাচ্ছিলেন, রিচার কথায় সে-সব কাটিয়ে একেবারে চনমনে হয়ে উঠলেন।
‘তবে রিচা, একটা কথা কিন্তু ঠিক। তুই যেভাবে আড়েবহরে বেড়ে চলেছিস, তাতে করে সুপাত্র পাওয়া সত্যিই মুশকিল হবে।’
‘মা, দ্যাখো না বাবা সবসময় আমাকে মোটা-মোটা বলে।’ আমার প্লেটে রুটি, আলুর দম আর গাজরের হালুয়া দিতে দিতে বলল রিচা। ‘জানো মা, আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি বলে বাবা আমাকে একটুও খেতে দিল না। আমার থেকে সব কেড়ে নিয়েছে। মাসি এই ডিশটা কত ভালো বানায় বলো। কাল কাজল মাসির কাছে আবদার করেছিলাম বলেই মাসি ওটা বানিয়েছিল। আর আমিই খেতে পারলাম না। সেই জন্যই তো বাবার সাথে ঝগড়া করছিলাম। তুমিই বলো, আমি কি এতই মোটা?’
রিচার কোনও কথার জবাব না দিয়েও আচার-ব্যবহারে বুঝিয়ে দিলাম যে, ওর এই সমস্ত কথা আমার একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না। গলা দিয়ে খাবার নামছিল না। থালা সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
‘উঠে পড়লে যে, কিছুই তো খেলে না। সব পড়ে রইল। হালুয়াটাতে তো হাতই দিলে না।’
‘সকাল সকাল মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘একটু অন্তত…’
‘ছেড়ে দে রিচা, তোর মা বোধহয় ডায়েটিং-এ আছে। ফিগার মেনটেইন করতে হবে না!’ ভাস্করের কথা শুনে রিচা হাসতে শুরু করল। দুজনের আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল কেউ যেন ফুটন্ত তেল ঢেলে দিয়েছে আমার সারা শরীরে। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে উপরে উঠে যাচ্ছিলাম। হঠাৎই কী মনে হল সিঁড়ির মুখটাতেই থেমে গেলাম। ‘রিচা, তুমিও রেডি হয়ে নাও। যাবার পথে কলেজে ড্রপ করে দিয়ে যাব।’
‘রিচাকে আমি ছেড়ে দেব। তুমি যাও। কেউ যদি আমার ফুলের মতো মেয়েটাকে বিয়ে করবে বলে, তুলে নিয়ে যায়।’ বলেই দুষ্টুমিভরা হাসি হেসে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রিচাকে কাছে টেনে একেবারে দু-হাত দিয়ে জাপটে ধরল ভাস্কর। দৃশ্যটা সহ্য করতে না পেরে একপ্রকার ছুটতে ছুটতে উপরের ঘরে চলে গেলাম। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই রেডি হয়ে সোজা স্কুলের পথে রওনা দিলাম।
কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারলাম না। সারাক্ষণ ভাস্করের রিচাকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্যটা ঘুরপাক খেতে থাকল চোখের সামনে। বাবা, মেয়ের মধ্যে এমন গাঢ় বন্ধুত্ব থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক, কিন্তু ভাস্কর তো রিচার নিজের বাবা নয়… সৎ বাবা। এই কথাটা চেষ্টা করেও একটি মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারিনি।
পুরোনো স্মৃতিগুলো মনের আনাচেকানাচে ভেসে বেড়াতে থাকল। সতেরো বছর আগেকার কথা। রিচা তখন মাত্র দুই। একদিন বিকেলে মেয়েকে নিয়ে খেলা করছি, এমন সময় ভাস্করই দুঃসংবাদটা নিয়ে এল। রোড অ্যাক্সিডেন্ট-এ দেবাশিস মারা গেছে।
ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। ওই একটা দুধের শিশুকে নিয়ে একা কীভাবে সামলাব। সংসারে তো দ্বিতীয় আর কেউ নেই। বাচ্চা সামলে স্কুল করব কীভাবে? ওদিকে স্কুল ছেড়ে দেব যে, সে উপায়ও নেই। জমানো পুঁজিতে কতদিনই বা চলবে। একদিন না একদিন তো কলসি খালি হবেই। ওপরওয়ালা যেমন এক হাতে কেড়ে নেয় তেমনি বোধহয় অপর হাতে দেয়ও। তখন এই কাজলদিই আশার আলো দেখিয়েছিল। ওর হাতেই মেয়ের সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে স্কুল সামলেছি।
তারপর যা হয় আর কী, সময় ধীরে ধীরে সব শোক ভুলিয়ে দেয়। অর্থনৈতিক সাপোর্ট-টা ছিল বলে পথ চলতে খুব একটা অসুবিধা হয়নি। ভাস্করকে সময়ে-অসময়ে পাশে পেয়েছি।
ভাস্কর দেবাশিসের-ই অফিসের বন্ধু। সেই সূত্রেই আগে আলাপ ছিল। দেবাশিসের পাওনাগন্ডা মিটিয়ে দেবার ব্যাপারে ভাস্করই অফিসের সঙ্গে মধ্যস্থতা করিয়েছিল। সেখান থেকেই সম্পর্ক গড়ে ওঠা। দেবাশিসের পরে আমার আর রিচার সমস্ত দায়ভার ও নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিল। তারপর বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। কিন্তু মানুষের মুখ আর মুখোশে যে বিস্তর ফারাক সেটা কালে কালে বুঝছি। তখন ওর মিষ্টি কথায় ভুলে গিয়েছিলাম। ওর ছবিটা সত্যি-ই অন্যরকম ছিল। আমার আঘাত লাগলে ওর চোখেমুখে ব্যথা প্রকাশ পেত। ভাবটা এমন যেন আমাকে পেয়ে ও পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ। আমাকে নিয়ে বেশ অহং কাজ করত ওর মধ্যে। ওর বন্ধুবান্ধব সার্কেলের মধ্যে আমি ছিলাম সবথেকে সুন্দরী। অবশ্যই ওর কথায়। তার উপর স্কুলে চাকরি করি। সব সময় আমার মধ্যে ডুবে থাকত ও। আমার গায়ে নাকি অদ্ভুত একটা মিষ্টি গন্ধ আছে। যেটা ওকে টানত।
আমার সুখের কথা ভেবে দ্বিতীয়বার বাচ্চার জন্যও বলেনি আমাকে। কী করে বুঝব যে এগুলো নাটক ছাড়া আর কিছু ছিল না। আজ বুঝতে পারছি ওটা আমার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। বুকের ভিতরটা টনটন করতে থাকে মেয়েটার জন্য। কী যে করছে… কলেজে গেল কিনা? নাকি বাড়িতেই রয়ে গেল দুজনে।
কাজলদি-টাও তো আর পেরে উঠছে না। অসুখে একেবারে কাবু হয়ে পড়েছে। কাজটা ছেড়েই দিত হয়তো, শুধু মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে দু-বেলা একটু রান্না করে দিয়ে যায়। মেয়ের যে আবার মাসি ছাড়া কারও হাতের রান্না মুখে রোচে না। না হলে আগের মতো যদি দিদি সারাদিন থাকত, তাহলে তো চিন্তার কোনও কারণ-ই ছিল না।
টিচার্স রুমেই চোখবুজে বসেছিলাম। সম্বিৎ ফিরল ফিজিক্স টিচার কাবেরীদির ডাকে।
‘শরীরটা খারাপ নাকি নূপুরদি?’
‘ওহ্। কাবেরীদি। ওই একটু…’
‘না, মানে ক্লাস নিতে যাওয়ার সময়ও দেখলাম এইভাবে চোখবুজে বসে আছেন। তাই জিজ্ঞাসা করলাম। ক্লাসও তো নিতে যাননি আজকে।’
‘আরে না না ঠিক আছে। মাথাটা ধরেছে বুঝলে।’
‘সুতপাকে বলব চা দিয়ে যেতে?’
‘আরে আপনি বসুন। আমি বলছি।’
চা দিয়ে যাওয়ার পরে মনটা অন্যদিকে ঘোরাতে একটা দৈনিক পত্রিকা নিয়ে বসলাম। কাগজটা হাতে নিতেই মাথাটা যেন দপদপ করতে লাগল। প্রথম পাতাতেই বড়ো বড়ো হরফে লেখা ‘বাবার দ্বারা মেয়ে ধর্ষিতা’। বিগত পাঁচ মাস ধরে ক্লাস এইটের এক ছাত্রীকে তার বাবা ধর্ষণ করে গেছে। এতদিন বাবার ভয়ে মুখ খুলতে পারেনি সে। অবশেষে শিক্ষককে চিঠি দিয়ে তার নির্মম কাহিনি তুলে ধরেছে কিশোরীটি। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল, ‘হায় ভগবান।’ এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা! মানুষ কি তাদের বিকৃত কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে…। না আর ভাবতে পারছি না। মাথাটা অসহ্য যন্ত্রণা করছে। ক্লাস পর্যন্ত নিতে যাইনি।
না না এসব কী ভাবছি আমি। সবাই কি সমান? সমাজের কয়েকটা বিকৃত মানুষের জন্য ভাস্করকেও এমন ভাবার… না না… এত নেগেটিভ ভাবছি কেন? নিজেকে বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ক্ষণিকের জন্য বোঝাতে পারলেও, পরমুহূর্তেই আবার মনে হচ্ছে– কিন্তু সেদিনের দুপুরের ঘটনা।সেটা কেমন করে ভুলব?
ভাস্কর যে এখন মাঝেমধ্যেই ছুটি নেয়, সেটা বিলক্ষণ আমি জানি। শরীর একটু খারাপ লাগলেই ব্যস আর অফিসের নাম মুখেও আনে না। সারাক্ষণ মেয়ের সঙ্গে হাহা-হিহি চলতেই থাকে। তখন দেখে মনেই হয় না, এই লোকটা অসুস্থতার কারণে অফিস যায়নি।
টিচার্স-ডে-র দিন বেশ কয়েকঘন্টা আগেই বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। অন্যান্য দিনের মতোই বাড়িতে কেউ নেই ভেবে দরজা খুলে নিজের ঘরে গিয়ে দেখি রিচা বেহুঁশ হয়ে ঘুমোচ্ছে আর ভাস্কর নীচু হয়ে ওর গালে চুমু খাচ্ছে। আমাকে দেখে কেমন যেন চমকে উঠল ভাস্কর। তারপরেই হন্তদন্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেদিন থেকেই মনের মধ্যে একটা অশঙ্কা বাসা বেঁধেছে। সৎবাবা আর মেয়ের মধ্যে কোনও অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি তো?
রিচাকে ভালো-মন্দের শিক্ষা দিতে দিতে ফেড-আপ হয়ে গেছি। কতবার ইনিয়েবিনিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছি নারী-পুরুষের মধ্যে ন্যূনতম ব্যবধান থাকাটা জরুরি। কিন্তু ও মেয়ে বুঝলে তো! বরং দিন দিন আবিষ্কার করছি আমাদের তিনজনের সংসারে আমিই অপাঙ্ক্তেয়। রিচার কাছে ভাস্করই সব, আমি কিছু বলতে গেলেই ওর ব্যাপারে হস্তক্ষেপ হয়ে যায়। সেই কারণেই কখনও ছাদে, কখনও বাগানে দুজনের ফিসফিসানি চলতেই থাকে। কখনও কখনও লোকলাজ ভুলে প্রকাশ্যেই একে-অপরকে আলিঙ্গন করতে শুরু করে।
আমার অজান্তেই গাল বেয়ে জল নেমে আসছিল। ইচ্ছে করছিল ডাক ছেড়ে কাঁদি। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে এটা একেবারেই শোভনীয় নয়। কোনওমতে নিজেকে সামলে রাখলাম।
সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব মেয়েটাকে পাত্রস্থ করার। সেইমতো অফিস কলিগ থেকে শুরু করে কাছের আত্মীয়স্বজন সকলকেই বলে রেখেছি ছেলে দেখার জন্য।
দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ যেতে দেখলাম পাঁচটা বেজে গেছে। বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। এই কয়েকদিনে ‘বাড়ি’-র পরিভাষাটাই বদলে গেছে আমার কাছে। কেমন যেন একটা অনীহা তৈরি হয়েছে এই শব্দটার প্রতি। স্নেহ, ভালোবাসা, একে-অপরের প্রতি বিশ্বাস, ত্যাগ না থাকলে ঘরের মানেটাই বদলে যায়। সেই ঘরে কারই বা ফিরতে ভালো লাগবে? কিন্তু ফিরতে তো হবেই, এই ভেবে উঠে দাঁড়ালাম।
বিয়ে ঠিক না হওয়া পর্যন্ত মেয়েটাকে অন্য কোথাও রাখার ব্যবস্থা যদি করা যেত। অনেক ভেবে ঠিক করলাম যদি কোনও লেডিস হোস্টেলে থাকার একটা বন্দোবস্ত করা যায় বা কোথাও পড়তে পাঠিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে নিশ্চিন্ত হতে পারি। এছাড়া কোনও পথও যে খোলা নেই। কিন্তু ভাস্করকে কী বলব। রিচাকে হঠাৎ করে বাড়ির থেকে দূরে কেন রাখব তার একটা যথাযথ কারণ তো দেখাতে হবে। রিচাকে বাড়ির থেকে দূরে রাখব– এটা কিছুতেই ও মেনে নেবে না। অযথা অশান্তি করবে।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে বাড়ি পৌঁছে গেছি টেরই পাইনি। গাড়িটা পার্ক করে ঘরে ঢুকতে যাব দেখি ভাস্কর বারান্দায় পায়চারি করছে। পরনে কুর্তা পাজামা। বারবার গেটের দিকে তাকাচ্ছে আর দু-হাতের আঙুল মোচড়াচ্ছে। মনে হল কোনও কিছু নিয়ে খুব চিন্তিত। আজ বলে নয়, আগাগোড়াই দেখেছি টেনশন হলেই এইরকম আচরণ করতে থাকে। একবার মনে হল জিজ্ঞাসা করি টেনশনের কারণটা কী? কিন্তু পরমুহূর্তেই আর ইচ্ছে হল না, ভাস্করকে না দেখার ভান করে সোজা নিজের ঘরে চলে গেলাম। মনে হল ডাকল। গুরুত্ব না দিয়েই ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। কখন যে চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারিনি।
‘নূপুর ওঠো না। কথা আছে।’ বলে আমাকে একপ্রকার ধাক্বা দিয়েই ঘুম থেকে উঠিয়ে দিল ভাস্কর।
‘কী হয়েছেটা কী? কী এমন কথা যে একটু ঘুমোতে দেওয়া গেল না। এবাড়িতে কি এটুকুও স্বাধীনতা নেই আমার?’
‘নূপুর প্লিজ, শোনো তো।’ হঠাৎ করে ‘প্লিজ’ শব্দটা বেশ অবাক করে তুলেছিল আমায়।
‘এই ভাবে বোকার মতো তাকিয়ে থেকো না, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও। নীচে অতিথিরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।’
আরও অবাক হয়ে গেলাম। ‘অতিথি?’
‘হ্যাঁ, অতিথি। রিচার হবু স্বামী আর তার মা-বাবা এসেছেন।’
‘কী?’ বিস্ময়ের পর বিস্ময়।
‘আগে বলোনি কেন?’
‘আমি আর রিচা তোমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার প্ল্যান করেছিলাম। সেইজন্যই আগে থেকে কিছু জানাইনি। রিচা নিজেই পছন্দ করেছে ছেলেটাকে। দিন কুড়ি-বাইশ আগে যেদিন প্রথম ছেলেটার কথা জানাল, সেদিনই ঠিক করেছিলাম আগে নিজে যাচাই করব ছেলেটা কেমন। যদি রিচার যোগ্য পাত্র হয় তবেই তোমাকে জানাব। নচেৎ এমনিতেই তুমি যা টেনশন করো। তোমাকে আর বাড়তি চাপ দিতে চাইনি আমি।’
ভালোমন্দ বোধটাই বোধহয় হারিয়ে ফেলেছিলাম। তা নাহলে পৃথিবীর সবথেকে মিষ্টি সম্পর্ক নিয়ে এমন সন্দেহ মনে ঠাঁই দিই। … ছিঃ.. ছিঃ। শুধুমাত্র আমার বুদ্ধিবিভ্রম-এর জন্য এমন একটা সরল সম্পর্ককে কিনা… আসলে দোষটা আমারই। কোনওদিন ভাস্করকে দেবাশিসের জায়গায় বসাতে পারিনি। আমারই ভালোবাসায় কোথাও একটা ফাঁক থেকে গিয়েছিল। মানুষটার কাছে আমাদের খুশির থেকে বড়ো আর কিছু নেই। অথচ তাকেই, কী ভুলটাই না ভেবেছিলাম আমি। মরমে মরে যাচ্ছিলাম।
ভাস্করের প্রতিটি কথায় তখনও মেয়ের প্রতি উদ্বেগ আর ভালোবাসা ঝরে পড়ছিল। ও-ওর মতোই সহজ ভাবে বলে যাচ্ছিল। ‘পনেরো দিন ধরে সমানে এর-ওর থেকে সুজয়ের সম্পর্কে খোঁজখবর করেছি। বছর দেড়েক হল ডাক্তারি পাশ করেছে। আরজি কর মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি করছে। ভীষণ ভালো ছেলে। সকলের সঙ্গে কথা বলে আশ্বস্ত হয়ে তবেই ওদের আসতে বলেছি। দ্যাখো এবার তোমার কেমন লাগে। তারপরে না হয় বিয়ের কথা এগোনো যাবে। আফটার অল মেয়ের মা বলে কথা, তোমারও তো একটা মতামত থাকবে।’ বলে আমার গাল দুটো একটু টিপে মুচকি হাসল। পরক্ষণেই আবার সিরিয়াস হয়ে গেল। চোখের কোণায় চিকচিক করছে জল। ‘মেয়েটা চলে গেলে ঘরটা খুব ফাঁকা হয়ে যাবে না, নূপুর।’
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। গাল বেয়ে জলের ধারা নেমে এল। আজ বুঝছি এ পৃথিবীতে আমার থেকে বড়ো সুখী আর কেউ নেই। খামোখাই ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করছিলাম।
নীচে রিচার গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম। ভাস্কর অধৈর্য হয়ে বলে, ‘চলো নূপুর, ওরা অপেক্ষা করছে যে!