আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি, সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ..
ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথেই অর্ণবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তৃয়ার। একেবারে মুখোমুখি। একমুখ দাড়ি আর ঢলঢলে পাঞ্জাবিতে বেশ অচেনাই লাগছিল তাকে। তবু তৃয়া চিনেই ফেলে, প্রায় আঠারো বছর পরেও। সেই আগের চঞ্চল, ডায়নামিক অর্ণব বদলে গেছে অনেকটাই। অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিল তৃয়া। সেদিন দুজনে হেঁটে গিয়েছিল কিছুটা পথ। তৃয়ার মনে পড়ে যাচ্ছিল কলেজের সেই সব দামাল দিনগুলোর কথা। তখনও তো তারা হেঁটে গিয়েছিল কত কত পথ একসঙ্গে, পায়ে পা, হাতে হাত মিলিয়ে কথা ফুরোত না দুজনেরই।
অর্ণব একের পর এক সুনীল, শক্তি, কিটস, শেলি আবৃত্তি করত আর তৃয়া মুগ্ধ হয়ে শুনত। দুজনে মিলে গড়ে তুলেছিল তাদের নিজস্ব জগৎ। কখনও বা উদাত্ত গলায় গেয়ে উঠত অর্ণব –
এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায় স্বপ্ন মধুর মোহে, এই জীবনের যে–কটি দিন পাব, তোমায় আমায় হেসে খেলে…
খিল খিল করে হেসে উঠত তৃয়া। তারপর দুজনে সেই মধুর স্বপ্ন দেখত দুচোখ ভরে।
হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে অর্ণবকেই দেখছিল তৃয়া। একটু বেশিই বয়স্ক দেখাচ্ছে না! অথচ তারা তো একই বয়সি। তেমন কথা বলছে না অর্ণব আগের মতো। তৃয়াই বলে চলছে তার স্বামীর কথা, সন্তানের কথা, আরও কত কী! অর্ণবের কি কোনও গল্পই নেই?
চা খাবি? এখানে একটা আড্ডা-ঘর খুলেছে, ওই কফি হাউসের ছোটো সংস্করণ আর কি! দার্জিলিং টি-টা দারুণ বানায়। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল তৃয়া।
না রে! চা খাই না এখন আর, অল্প হাসল অর্ণব।
চা খাস না! এত নেশা ছিল! অবাক হয় তৃয়া।
সে তো কত কিছুরই নেশা ছিল, বলেই থমকাল অর্ণব।
তৃয়ার বুকের ভেতরটা হঠাৎই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগল। অর্ণব-কে তা বুঝতে না দিয়ে হালকা গলায় বলে উঠল, হ্যাঁ রে, কিছু নেশা শেষ অবধি টানা যায় না।
আচমকা দুজনের মাঝখানে একটা নিস্তব্ধতা চলে এল। এ নীরবতা ভাঙার সাধ্য তৃয়ার অন্তত নেই।
(২)
ব্যাপার কী! ক’দিন খুব অন্যমনস্ক দেখছি। মাথায় একটা হালকা চাঁটি মারল সৈকত। চমক ভেঙে সৈকতের চোখের দিকে তাকাল তৃয়া। ওর চোখ জুড়ে কৌতুক।
তৃয়াও হেসে জবাব দিল, ভাবছি।
ভাবছ! তা কী ভাবা হচ্ছে ম্যাডাম? আমার পক্ষে না বিপক্ষে? হাসতে হাসতেই বলল সৈকত।
ছেলেটা মহা ফাজিল। বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখে। অন্য কিছু ভাবারই অবকাশ পায় না তৃয়া।
যদি বিপক্ষে ভাবি… তৃয়া চোখ নামাল।
সে কি ম্যাডাম! পুরোনো প্রেম আবার এল কি ফিরিয়া?
সৈকত কি বুঝে নিল কিছু! তৃয়া সৈকতের এলোমেলো চুলগুলো আরও খানিকটা ঘেঁটে দিয়ে বলল, পাগল একটা!
হেসে উঠল সৈকত। তৃয়ার কপালে স্নেহ চুম্বন আঁকতে আঁকতে বলে উঠল- তুই জীবন ছাইড়া গেলে মাইনষে কইবে মরা জীবন রে..
সৈকত-কে আঁকড়ে ধরল তৃয়া, প্রবল ভাবে।
(৩)
আবার দেখা যদি হল সখা প্রাণের মাঝে আয়…
অ্যাই অর্ণব! এত হনহন করে যাচ্ছিস কোথায়?
তোর সঙ্গে পরে কথা বলছি তৃয়া, একটু ব্যস্ত আছি।
অবাক হয় তৃয়া। ঠিক অবাক অবশ্য নয়, গলাটা কেমন ব্যথা ব্যথা করছে। গত দুদিন ধরেই অর্ণব এটা করে চলেছে। যখনই ডাকছে তৃয়া, সময় নেই ওর। অথচ তৃয়া টের পাচ্ছে সমস্ত কলেজ জুড়ে অর্ণবের তীব্র উপস্থিতি। শুধু তৃয়া ডাকলেই…
অভিমান করে তৃয়া। এড়িয়ে চলারও চেষ্টা করে। পারে কি? উলটে কী এক অমোঘ টানে আরও কাছে কাছে চলে আসে অর্ণবের। তৃয়া অপেক্ষা করে ওই একটি মাত্র ডাক শোনার জন্য!
(৪)
সুখের সংসার বলতে ঠিক যা বোঝায় তৃয়ার সংসারটাও ঠিক তেমনই। তবু হঠাৎ হঠাৎ এই সুখের মধ্যিখানে অর্ণব নামের একটা কাঁটা অনবরত খোঁচাতে থাকে। তৃয়া রক্তাক্ত হয়, জখম হয় সৈকতও। অথচ এই রক্তক্ষরণ বন্ধের উপায় জানা নেই কারাওরই। সৈকতের ভালোবাসার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করার পরও, তৃয়া বুঝতে পারে কোথায় যেন কিছু শূন্যস্থান এখনও রয়ে গেছে। আজও কোনও অলস দুপুরে বা একাকী রাতে ছাদে দাঁড়ালে এক রাশ হিমেল বাতাস কোত্থেকে এসে, তৃয়ার সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। দু’গাল বেয়ে লোনা জল হু হু করে গড়িয়ে যেতে থাকে। তৃয়া আর আটকায় না তাকে। সে জানে এই শূন্যস্থান একমাত্র পূরণ করতে পারে অর্ণব। শুধু একটিবার দেখা হোক।
দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী ,দীর্ঘ বরষ–মাস…
ঝগড়া, ভুল বোঝাবুঝি, চিত্কার নাহ্ তাদের সম্পর্কের মধ্যে এগুলো কোনওদিনই অযাচিত ভাবে ঢুকে পড়েনি। শুধু তৃয়া যেদিন টের পেল অর্ণব স্বেচ্ছায় দূরে চলে যেতে চাইছে, আর পিছু ডাকেনি সে। হয়তো কেঁদেছে, তবে সে কান্নার খবর অর্ণব পায়নি। হয়তো অভিমান করেছে, মনে মনে অসম্ভব যুদ্ধ করেছে, আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে অর্ণবকে শুধু ধরা দেয়নি আর কিছুতেই। কোনওদিন জানতে চায়নি তৃয়া, কেন? দাঁতে দাঁত চেপে থেকে গেছে এতগুলো দিন।
বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলে সৈকতকে হয়তো ভালোবেসেছে একদিন। তবু! এখনও কলেজের ওই রাস্তাগুলো দিয়ে কোনও সময় চললে অজান্তেই ঘাড় ঘোরায় তৃয়া। কেউ কি ডাকছে? ওই তো ওই ছেলেটা! অর্ণব না! ভুলতে চেয়ে কিছুতেই আর ভুলে যেতে পারেনি তৃয়া, কিছুতেই না।
আজ এতগুলো বছর পর অর্ণবকে দেখে পুরোনো সবকিছুই আবার যেন চোখের সামনে চলে আসছিল। সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পিছিয়ে যাচ্ছিল তৃয়া… ওই তো সেদিন কলেজের সামনের সেই বিরাট খেলার মাঠে বসে তারা দুজন ভিড়, কোলাহলের মধ্যেই দুজনে দুজনাতে মগ্ন। কখনও হাতে হাত ছুঁয়ে হেঁটে যাচ্ছে চেনা-অচেনা পথ পেরিয়ে অলীক সুখের দিকে। সে হাঁটা আর আজকের হাঁটার সঙ্গে তেমন মিল খুঁজে পেল না তৃয়া। তখন হাঁটতে গিয়ে সময়ে খেয়াল থাকত না দুজনেরই। আজ বারবার হাত ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে তৃয়া। ছেলের ছুটি ১-টায়, সৈকতও আজ আগেই ফিরবে। আইনক্স-এ জঙ্গল বুক-এর টিকিট কাটা।
অবাক হয় সে। গলার মধ্যে সেই আঠারো বছর আগেকার কষ্ট কষ্ট ব্যথাটা আর নেই তো! অর্ণবের কথা জানতে ইচ্ছে করে তার। কী করে সে এখন? চাকরি জুটিয়েছে আদৌ? বিয়ে করেছে? অর্ণবের অদ্ভুত শীতলতার কাছে আজও তৃয়া নিজেকে খুলতে পারে না। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় আরও কিছুটা দূর।
তুই এখনও কবিতা লিখিস? জানতে চায় তৃয়া।
ম্লান হাসে অর্ণব, কবিতা আর ধরা দেয় না রে। হারিয়ে গেছে অক্ষর, আঠারো বছর আগে।
একদিন হারাবে অক্ষর, সেদিনও কি প্রেম থাকবে? শব্দ বদলে ভালোবাসা দেব, শুধু তুই ছুঁয়ে থাকলে মন্ত্রের মতো — উচ্চারণ করে তৃয়া।
তোর এখনও মনে আছে? এবার যেন অর্ণবের অবাক হওয়ার পালা।
ওই একটা ডায়ারিতে লিখে রেখেছিলাম, মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে, তাই হয়তো মনে আছে। চোখ নামাল তৃয়া।
অর্ণব হাসল। হয়তো বুঝে নিল শুধু এই কবিতাটিই না, অর্ণবের লেখা প্রায় সব কবিতাই হুবহু বলে দিতে পারে তৃয়া আজও।
তুই আজও গান গাস? আচমকাই জানতে চায় অর্ণব।
গা-ন! ধুর, সময় কোথায়? ছেলে যা দুষ্টু। তৃয়া হাসে। সৈকত বলে, জানিস তো! আবার শুরু করার কথা… কিন্তু!
কিন্তু কী?
আর নতুন করে কোনও কিছু শুরু করতে ইচ্ছে করে না রে। তৃয়ার গলায় সামান্য হতাশা কি ঝরে পড়ল?
অর্ণব হাসল আবার। আড়চোখে তৃয়াকে দেখল সে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে মেয়েটা। পুরোদস্তুর সংসারি হয়ে উঠেছে। আগের চাইতে অনেক বেশি সুন্দরী আর পরিণত লাগছে তাকে। ভালো লাগল অর্ণবের। এই পরিপূর্ণতা সে কোনওদিনই দিতে পারত না তৃয়াকে, কোনওদিনই না।
ইদানীং সৈকতকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে মন চায় তৃয়ার। অফিসে থাকলে ঘনঘন ফোন বেজে ওঠে সৈকতের, কখন আসবে? সৈকত বুঝতে পারে আর তাদের মধ্যে কোনও কাঁটা নেই। তার অজান্তেই কে যেন সরিয়ে নিয়েছে ওটা, তাদের মাঝখান থেকে। সৈকত স্ত্রী-র কাছে কিছু জানতে চায় না। কিছু জানারও নেই তার। সৈকত শুধু জানে তারা বাঁচবে একসঙ্গে আরও দীর্ঘ দীর্ঘ বছর।
মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন তুমি ভরিবে সৌরভে..
আর বেশি দূর এগোনো যাবে না রে, ছেলেটার ছুটির আগে স্কুলের গেটের কাছে পৌঁছোতে হবে, নইলে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। হালকা গলায় বলে উঠল তৃয়া।
ওহ্ যাবি? তা যা, হঠাৎ যেন চমক ভাঙল অর্ণবের।
সরাসরি তৃয়া-র দিকে তাকাল অর্ণব। একটু হাসল। কিছুই তো জানতে চাইলি না?
জেনে গেছি যে! তৃয়ার গলায় হাসি ঝরে পড়ল।
কী জেনে গেছিস? জানতে চাইল অর্ণব।
সে আর তোর শুনে কাজ নেই। আমি চলি রে। খুব ভালো থাকিস। বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিল তৃয়া।
হাত বাড়িয়ে আবার সেই পুরোনো স্পর্শ খুঁজে পেল অর্ণব। কিন্তু সেই অতীতের উষ্ণতার দেখা মিলল না। হাত ছেড়ে তৃয়া হাঁটতে শুরু করল, যেখানে তার ছেলে অপেক্ষা করছে। সৈকত-কেও হোয়াটসঅ্যাপ-এ মিস ইউ লিখে পাঠিয়ে দিল তৃয়া। হাঁটতে হাঁটতেই শুনতে পেল অর্ণব বলছে, একবার কিছু বলার সুযোগ দিতে পারতিস! তৃয়া? একবার শুনে যা…
তৃয়া এই ডাকটার জন্যই তো এতদিন অপেক্ষা করছিল। কিন্তু আজ আর কিছু শুনতেই ইচ্ছে করল না তার। তৃয়া তার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।