‘তুমি কি তবে সম্বন্ধটা ভেঙে দেওয়ার কথা বলছ? জয়ের কথাটাতো একবার ভাবো। আর এটা যে সত্যি, তার প্রমাণই বা কী আছে?’ অনামিকাদেবী বেশ আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন।
‘যা কিছু বলছি, তার সবটাই সত্যি। সমস্ত খোঁজখবর নিয়ে তবেই বলছি। যে-মেয়েটিকে তোমরা মা-ছেলে মিলে এবাড়ির পুত্রবধূ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ, তার মায়ামাখা মুখের পেছনে রয়েছে এক কালিমাময় অতীত।’
এবার যেন ধাঁধায় পড়ে গেলেন অনামিকাদেবী। স্বামীকে প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠলেন, ‘কী বলছ কি তুমি?’
একটু থেমে সুপ্রকাশ উত্তর দিলেন, ‘কথাগুলো শুনে আমিও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কিন্তু বাস্তবটা বাস্তবই। ওই মেয়েটি মুর্শিদাবাদের গগনেন্দ্র চৌধুরির ভাগনি ঠিকই কিন্তু ও যে বলেছিল ওর বাবা-মা দুজনেই মৃত, এটা একেবারে ডাহা মিথ্যে। ওর বাবার কথা বলতে পারব না, তবে ওর মা কোনও নামজাদা ব্যক্তির রক্ষিতা।’
‘কোথাও কোনও ভুল হচ্ছে না তো?’
‘কেন বিশ্বাস করছ না… মুর্শিদাবাদে ওর মামার সঙ্গে কথা বলে বিয়ের সমস্ত কথাবার্তা ফাইনাল করে ফেরার পথেই ট্রেনে সুবিমলের সঙ্গে দেখা। ওর-ও তো মুর্শিদাবাদেই বাড়ি। জুঁইদের আশেপাশেই কোথায় যেন একটা! ওখানে যাওয়ার কারণ বলতে গিয়েই জানতে পারি, জুঁইয়ের মায়ের এই কুকীর্তির কথা। উনিই ওনার কুপথে অর্জিত টাকায় মেয়ের ভরণ-পোষণের সব দায়িত্ব সামলান। তাই প্রতি মাসেই বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পাঠান মেয়েকে। গগনেন্দ্র চৌধুরী তো শুধু শিখন্ডী মাত্র।’
‘কী বলছ কী তুমি, আমি তো ভাবতেই পারছি না,’ বিস্মিত স্বরে বলে ওঠেন অনামিকাদেবী।
কিছুক্ষণের জন্য চুপ থেকে জয়ের বাবা সুপ্রকাশ আবার অনামিকাদেবীকে বলতে শুরু করেছিলেন। ‘কী জানি কেন, তবু সত্যিটা ঠিক মানতে পারছিলাম না। কেমন যেন একটা খটকা লাগছিল। আর সেই কারণেই সেদিন বাড়ি ফিরে তোমাদের কিছু জানাইনি। মনে মনে ঠিক করেছিলাম, সঠিক জেনে তবেই তোমাদের বলব। সুবিমলের থেকে জানতে পেরেছিলাম যে, জুঁইয়ের মা এখন দেরাদুনে থাকেন। ঠিক করেছিলাম সেখানেই যাব। সেইমতো অফিসের টুর-এর নাম করে তিনদিন পরেই তৎকাল টিকিটে চলে গিয়েছিলাম দেরাদুন। ওখানে গিয়ে একটু খোঁজখবর করতেই জানতে পারি দেরাদুনে একটা প্রাইভেট সংস্থাতে টাইপিস্টের কাজ করতেন জুঁইয়ের মা বন্দনাদেবী। বর্তমানে তিনি ওই কোম্পানির মালিক রঞ্জন বাসুর রক্ষিতা।’
অনামিকাদেবী দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কেবল বোকার মতো তাকিয়ে থাকলেন সুপ্রকাশের মুখের দিকে। ‘এবার কী হবে? জয় যে ওকে খুব ভালোবাসে। আমার সুখের সংসারে এ কার নজর পড়ল? ও যে জুঁইকে নিয়ে কত স্বপ্ন সাজিয়ে রেখেছে। ওর এই স্বপ্ন বুনতে আমি যে নিজেই ওকে সাহায্য করেছি, আনন্দের সঙ্গে ওদের সম্পর্কের স্বীকৃতি দিয়েছি। এসব জানতে পারলে জয় যে একেবারে ভেঙে পড়বে।’
এমনিতে জয় আর জুঁইয়ের ভালোবাসার ব্যাপারে আলাদা করে বাড়িতে কিছুই জানাতে হয়নি জয়কে। কারণ কোনও কিছু বলার আগেই সবকিছু বুঝে গিয়েছিলেন অনামিকাদেবী। বছর চারেক আগে ছেলের জন্মদিনের পার্টি-তে হাজির ছিল ছেলের কলেজের বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। তাদের মধ্যে জুঁইও ছিল। সকলের থেকে আলাদাভাবেই নজর কাড়ছিল প্রাণোচ্ছল, ফুটফুটে মেয়েটি। তার উপর অন্যান্যদের তুলনায় ছেলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতাই প্রমাণ করছিল তাদের সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা।
জুঁইকে অপছন্দের কোনও জায়গাই ছিল না অনামিকাদেবীর। সুন্দরী তো বটেই, তার ব্যবহারটিও ছিল ফুলের মতো মিষ্টি। তার উপর আবার তার পিতৃমাতৃহীন হওয়াটা তাকে আরও অনামিকাদেবীর স্নেহের পাত্রী করে তুলেছিল।
কলকাতার নামিদামি স্কুল-কলেজে পড়ার কারণে ছোটো থেকেই সে হস্টেলে থেকেছে। শুধুমাত্র ছুটির দিনগুলোতে মুর্শিদাবাদে মামার বাড়ি ফিরত। ওই মামাই নাকি ভাগনিকে আদর-আহ্লাদে বড়ো করে তুলেছে। জুঁইয়ের অতীতের এইটুকু সংক্ষিপ্ত ইতিহাসই জানা ছিল তাদের।
অফিস থেকে ফিরে বাবাকে গম্ভীর দেখে কিছু বলার সাহস পেল না জয়। সোজা মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘মা, বাবার কী হয়েছে? ঝগড়া করেছ নাকি? কেমন একটা গুরুগম্ভীর মুখ করে যেন বসে আছে। ভয়ে কিছু বলারই সাহস পেলাম না। কিছু বললেই তো বলবে, তুই সবসময় আমারই দোষ দেখিস, তোর মা তো কোনও অন্যায়ই করতে পারে না। কেন ঝগড়া করো বাবা, মিটিয়ে নাও না।’
‘না রে, তুই যেটা ভাবছিস ব্যাপারটা তা নয়।’
‘তাহলে কী? বাবার অফিসের কিছু প্রবলেম?’
‘না রে। তোকে যে কীভাবে বলি?’
‘কী হয়েছে এত হেজিটেট করছ কেন? সকালে যখন অফিস গেলাম তখনও তো সব ঠিক ছিল। বাবাও তো বোধহয় অফিস টুর থেকে সন্ধেবেলাই ফিরেছে। তাহলে এইটুকু সময়ের মধ্যে কী এমন ঘটে গেল, যে আমাকে বলতে পারছ না। কী হয়েছে মা? প্লিজ, আমাকে বলো।’
‘কী বলব বলতো। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না যে, জুঁই তোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এমনও তো হতে পারে ও হয়তো ওর অতীত সম্পর্কে নিজেই কিছু জানে না। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতেও পারছি না আর মানতেও পারছি না। কিন্তু তোর বাবা যে নিজে সমস্ত খোঁজখবর নিয়ে তবেই বলছে। সে যে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে।’
‘কী যা তা বলছ! স্পষ্ট করে বলো। হেঁয়ালি কোরো না। আমি আর নিতে পারছি না।’
অনামিকাদেবী সমস্ত কিছু খুলে বললেন ছেলে জয়কে। কথাগুলো শোনার পরে বিস্ময়বিমূঢ়তা যেন তাকে একেবারে ঘিরে ধরল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে শান্তস্বরে মাকে বলল, ‘জুঁই জ্ঞানত ইচ্ছা করে আমার থেকে কিছু লুকিয়েছে, এটা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয় মা। অন্তত আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। চার-চারটে বছর ধরে আমাদের সম্পর্ক, ও আজ পর্যন্ত কোনও কিছু বলেনি বা লুকিয়েছে এরকম কোনওদিন হয়নি।’
‘ঠিক তোর মতো আমি ওকে জানি বলেই তো ব্যাপারটা মানতে পারছি না বাবু। কিন্তু তোর বাবা…।’
‘সব বুঝছি কিন্তু তুমি তো জানো মা ও কতটা ইনোসেন্ট, সহজ, সরল প্রকৃতির মেয়ে। আজ পর্যন্ত কারওর সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেছে বলেও মনে হয় না। যে জীবনের কোনও জট-জটিলতা বোঝেই না, সে এত বড়ো একটা মিথ্যে– কিছু মনে কোরো না মা আমার মানতে কষ্ট হচ্ছে। বাবার বোধহয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আর ওর মায়ের ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়েও থাকে, তাহলেও আমার কিছু এসে যায় না। তবু বলছি, তারপরেও যদি তোমার মনে হয় জুঁই আমাদের বাড়ির অনুপযুক্ত, ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক রাখাটা ঠিক নয়– তাহলে তোমার কথা ভেবে আমি ওর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিতে রাজি। কিন্তু আমি জানি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার মা কখনও নিরপরাধ কাউকে শাস্তি দিতে পারে না। এখন সবকিছুই তোমার হাতে,’ বলেই উদ্ভ্রান্তের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সুপ্রকাশ ও অনামিকাদেবীর একমাত্র আদরের সন্তান জয়।
জয় বেরিয়ে গেলেও অনামিকাদেবী বেশ কিছুক্ষণ সেই জায়গাতেই বসে রইলেন। অহরহ শুধু ছেলের মুখটা তার চোখের সামনে ভাসতে থাকল। কথাগুলো বলার সময় কীভাবে বুকে পাথর চেপেছিল সে, তার সমস্তটাই ধরা পড়ছিল মায়ের চোখে। ছেলে কতটা কষ্ট পাচ্ছে, তা ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছিলেন। ছেলে বলে হয়তো কাঁদতে পারেনি, মেয়ে হলে…।
সেদিন রাত্রে একটুও ঘুমোতে পারেননি অনামিকাদেবী। শুধু ছটফট করেছেন আর ভেবেছেন, কীভাবে এই রহস্যের শিকড়ে পৌঁছোনো যায়। সারারাত চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। সেইমতো পরদিন সকালে সুপ্রকাশবাবুকে জানান নিজের দেরাদুন যাওয়ার কথা।
প্রত্যুত্তরে সুপ্রকাশবাবু বলেন, ‘অনামিকা তুমি যাবে যখন ভেবেছ যাও। কিন্তু গিয়ে কোনও লাভ হবে বলে মনে হয় না।’
‘তবু যদি কিছু আশার আলো দেখা যায়।’
‘ঠিক আছে দু-তিন দিন বাদে যেও। আমি আজই দত্ত-দা-কে বলে টিকিটের ব্যবস্থা করছি। তবে তৎকালে গেলে খুব কষ্ট হবে তোমার।’
‘হোক কষ্ট। এই কষ্ট আমার ছেলের কষ্টের থেকে বেশি নয়। ওর জন্য আমাকে সবকিছু জানতেই হবে।’
পাশেই ডাইনিং টেবিলে বসে চা খাচ্ছিল জয়। মার কথা শুনে ধীরে ধীরে মাকে বলল, ‘মা তুমি দেরাদুন যাচ্ছ, আমি যাব তোমার সঙ্গে?’
‘না, আমি একাই যাব। আর হ্যাঁ, জুঁইকে এখনই এসব ব্যাপারে কিছু জানাবার দরকার নেই। আগে আমি ফিরি। তারপর…।’
নির্ধারিত দিন অনুযায়ী রওনা দেন অনামিকাদেবী। দীর্ঘ সফর শেষ করে যখন স্বামীর দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছোলেন, তখন তাঁর বিধ্বস্ত অবস্থা।
সামনে ছোট্ট সুন্দর একটা বাংলো, যার সামনের দিকটায় সুন্দর সুন্দর বিভিন্ন ধরনের বাহারি ফুলগাছের বাগান। গেট খুলে বাগান পেরিয়ে বাংলোর কলিংবেল বাজাতেই, একজন অল্পবয়সি যুবতি দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে চাই?’
‘বন্দনাদেবী আছেন?’
‘হ্যাঁ আছেন। আপনি ভিতরে বসুন, আমি ডেকে দিচ্ছি’, বলে চলে যাচ্ছিল সে, কী ভেবে আবার ফিরে এসে বলল, ‘কিন্তু দিদিমণি যদি জিজ্ঞাসা করে কে, কোথা থেকে এসেছেন, তাহলে কী বলব?’
‘দিদিমণিকে বলো কলকাতা থেকে অনামিকা চ্যাটার্জী এসেছে দেখা করতে, বিশেষ কিছু প্রয়োজনে।’
‘ঠিক আছে আপনি বসুন। আমি এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি।’
মিনিট দুয়েকের মধ্যে উপর থেকে নেমে এলেন বছর পঁয়তাল্লিশের একজন মহিলা। দেখতেও বেশ সুন্দর, এমনকী তার দেহের বাঁধন-টাঁধনও এই বয়সে অটুট।
‘হ্যাঁ বলুন। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক…।’
‘আমি কলকাতা থেকে আসছি। আমার পরিচয় দিলে হয়তো চিনলেও চিনতে পারেন। জয় আমার ছেলে…’ বাকি কথা বলার আর অবকাশই পেলেন না অনামিকাদেবী। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই বন্দনাদেবী বলে উঠলেন, ‘জানি, আমার মেয়ে জুঁই আপনার ছেলেকে ভালোবাসে, শুধু তাই নয় বর্তমানে ওদের বিবাহও স্থির হয়ে গেছে, তাইতো?
কথার মাঝেই থামিয়ে দেওয়ার জন্য মাফ করবেন। কিন্তু এখন আপনারা কোনওভাবে জানতে পেরেছেন জুঁইয়ের অতীতের কথা, আর তাই ছুটে এসেছেন আমার কাছে। কী জানি কেন আমার মনটা ক’দিন ধরেই বলছিল, এরকম কিছু একটা ঘটতে পারে। গত সপ্তাহেই আমার দাদার ফোনে জানতে পারি কলকাতাতে জুঁইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বাদ দিন এসব, এখন বলুন কী জানতে চাইছেন?’
জুঁইয়ের মায়ের কথাগুলো কেমন কেমন শুনতে লাগলেও অনামিকার কিছু করার ছিল না। তাকে সমস্ত কিছু জানতেই হবে। এটা তার ছেলের জীবনের ব্যাপার বলে কথা।
‘জুঁই শুধু আমার ছেলেরই নয় আমার এবং আমার স্বামীরও পছন্দের পাত্রী। ও আমাদের বলেছিল ছোটোবেলাতেই ওর মা-বাবা মারা গেছে। মামার কাছেই মানুষ। আমার স্বামী মুর্শিদাবাদ গিয়ে বিয়ের দিন পর্যন্ত ঠিক করে ফেলেছিলেন কিন্তু তার পরেই জানা গেল…।’
‘ওর মা বেঁচে আছে তাইতো? আপনি যা কিছু শুনেছেন সব সত্যি। আপনাকে শুধু এইটুকু বলতে পারি জুঁই এ সম্পর্কে সত্যিই কিছু জানে না। সুতরাং এর সঙ্গে ওকে জড়াবেন না। ও নিরপরাধ। জানি ও হয়তো আর আপনার ঘরের পুত্রবধূ হতে পারবে না। মা-বাবার কৃতকর্মের ফল সন্তানদেরই ভোগ করতে হয়। এর থেকে আর বেশি কী বলব!’
‘আমরা জুঁইকে কখনও দোষী ভাবিনি, কিন্তু আপনি এইরকম কাজ কেন করলেন? ক্ষমা করবেন, এটা আমার ছেলের জীবনের প্রশ্ন, তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হলাম।’
‘আমি তো আপনাকে নিঃসংকোচে সমস্ত কিছু বলতেই পারি, কিন্তু তাতে কি কোনও লাভ হবে? আমার জীবনের সেই ভয়ংকর সত্যিটা শুনলেও, আপনার মন থেকে আমার প্রতি জন্মানো ঘৃণা-বিতৃষ্ণা বদলাবে না। তাহলে আর শুধুশুধু অতীতের এই বিষাদ ঘেঁটে লাভ কী বলুন। আমার মেয়েটা তো আর…’ করুণভাবে বলে ওঠেন বন্দনাদেবী।
‘লাভ হোক আর না হোক, এই সম্পর্ক ভাঙার পিছনে একটা সঠিক কারণ তো জয়কে জানাতে হবে। শুধু তাই নয় নিজের মনকে স্ত্বান্না দেওয়ারও একটা ব্যাপার আছে। ছেলের দৃঢ় বিশ্বাস তার মা কোনও অন্যায় করতে পারে না, কোনও নিরপরাধীকে শাস্তি দিতে পারে না, তাই তার এই বিশ্বাস আমি ভাঙতে চাই না। প্লিজ বন্দনাদেবী চুপ করে থাকবেন না। দয়া করে সত্যিটা বলুন। আপনাকে কথা দিচ্ছি, জুঁই, এর বিন্দুবিসর্গও জানবে না,’ বেশ উত্তেজিত হয়েই বলেন অনামিকাদেবী।
‘তাহলে শুনুন, আজ থেকে অনেক বছর আগেকার কথা। একদিন আমি আর আমার স্বামী দুজনেই ভাইপোর জন্মদিন সেরে মুর্শিদাবাদ থেকে শ্বশুরবাড়ি কলডোঙায় ফিরছিলাম। সেই সময় জুঁই ছোটো ছিল। আমার দাদার তিন ছেলে জবরদস্তি করে জুঁইকে রেখে দিল কয়েকদিনের জন্য। দাদাও ভাগনিকে খুব ভালোবাসত। তাই বাধ্য হলাম জুঁইকে কয়েকদিনের জন্য রেখে আসতে।
ফেরার পথে মাঝরাস্তাতেই যত বিপত্তি। হঠাৎই বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতীর অতর্কিত আক্রমণে, বাসের সমস্ত যাত্রীই শিউরে উঠি। বাসের সিটে বসে থরথর করে কাঁপতে থাকি আমরা। সেই বিভীষিকাময় দিনটার কথা কোনওদিন বোধহয় ভোলা সম্ভব নয়। বাসের মধ্যে সর্বসাকুল্যে আট-দশ জন মহিলা ছিলাম। প্রথমেই মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে চলল লুঠতরাজ।’ বলতে বলতে হঠাৎই থেমে গিয়েছিলেন বন্দনাদেবী। অনামিকাদেবী লক্ষ্য করছিলেন কথাগুলো বলতে বলতে বন্দনাদেবীর চোখ-মুখ একেবারে ভয়ে লাল হয়ে উঠছিল।
‘তারপর? তারপর কী হল?’ বলে ওঠেন অনামিকাদেবী।
‘তারপর? তারপর শুরু হল মহিলাদের উপর নির্মম অত্যাচার। পুরুষদের চোখের সামনেই এক এক করে সব ক’টি মহিলাকে ধর্ষণ করতে থাকল ওই দুষ্কৃতীরা। আর পুরুষরা, অবশ্য পুরুষ কি কাপুরুষ জানি না, তারা তাদের প্রাণের ভয়ে চুপচাপ বসে বসে দেখল তাদের মা, বোন, স্ত্রীর সতীত্ব হরণ হতে। অবশ্য যে-দুজন এর প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন, তাদের একেবারে সেইখানেই সারাজীবনের মতো মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে একজন ছিলেন আমার স্বামী। এরকম লজ্জাজনক ঘটনার পরেও সেদিন যে কেন পৃথিবী ফাঁক হয়ে ধরাতলে মিশে যাইনি, সেটাই আশ্চর্যের।
একের পর এক দুষ্কৃতীদের পাশবিক অত্যাচারে কখন যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেও জানি না। যখন জ্ঞান ফিরল তখন চারিদিকে কান্নার রোল। মনে পড়ে গেল পরিমল মানে আমার স্বামীর কথা। কোনওরকমে উঠে বসলাম। তারপর স্বামীর খোঁজ করতে জানতে পারলাম, যে-দু’জন ব্যক্তি দুষ্কৃতীদের হাতে মারা গিয়েছিল, দুষ্কৃতীরা যাবার আগে তাদের ভাগীরথীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে। অসহায়ের মতো হাউহাউ করে কাঁদতে থাকলাম। মনে হতে থাকল ভোগ-লালসার শিকার হওয়া ঘৃণ্য এই দেহ শেষ করে দেব। নিজেও ভেসে যাব ওই ভাগীরথীর জলে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল জুঁইয়ের কথা। বাবা তো গেলই, যদি আমিও চলে যাই তাহলে ওকে দেখবে কে?’ বলতে বলতে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে জুঁইয়ের মা।
লজ্জায় মাথা হেঁট করে নেন অনামিকাদেবী। নিজের মনে বলে ওঠেন, ‘বাসের সমস্ত পুরুষরা যদি সকলেই একসঙ্গে প্রতিবাদ করত তাহলে হয়তো এধরনের ঘটনা ঘটত না। যারা চোখের সামনে নিজের মা, বোন, স্ত্রীর সম্মানহানি চুপচাপ মেনে নিতে পারে, তাদের এ পৃথিবীতে থাকাটাই গর্হিত অপরাধ। আদতে তারাই এ পৃথিবীর বোঝা।
এই ধরনের ঘটনার পর সমস্ত মানুষ প্রশাসনের নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষে কি দেশের সমস্ত মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব? তাহলে তো প্রত্যেক নাগরিকের সুরক্ষার্থে একটি করে বন্দুকধারী নিরাপত্তারক্ষী দিতে হয়, যাতে তারা বিপদের সময় তাদের উপর নির্ভর করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে। নিজেকে বন্দনার জায়গায় কল্পনা করে নিয়ে ওই বিপর্যয়ের কথা ভাবতে চেষ্টা করলেন অনামিকদেবী।
মিনিট পাঁচেক পরে বন্দনাদেবী একটু শান্ত হতে অনামিকাদেবী আবার জিজ্ঞাসা করেন, ‘তারপরে কী করলেন?’
‘কোনওমতে পৌঁছোই দাদার কাছে। ভেবেছিলাম সবাই ফেলে দিলেও দাদা ফেলবে না। দাদার আশ্রয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু হায়। যে-দাদা বোন বলতে অজ্ঞান ছিল, সেই দাদাই সমস্ত কিছু শুনে, স্ত্বান্না দেওয়ার বদলে, আমাকে তক্ষুনি সেখান থেকে চলে যেতে বলল।
দাদার এই পরিবর্তন দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। প্রশ্ন শুধুমাত্র আমার একার নয়, আমার ফুলের মতো ছোট্ট মেয়েটারও ভবিষ্যৎও জুড়ে ছিল এর সঙ্গে।
যে-ভাগনিকে আদরের ঠেলায় অস্থির হতো তার মামা, সেদিন সেই ভাগনিই কাঁটা হয়ে গলায় বিঁধছিল তার। বহু অনুনয়-বিনয় করে কিছুতেই রাখতে চাইছিল না তাকে। অবশেষে কতকগুলো প্রতিজ্ঞা করিয়ে তবেই জুঁইকে আশ্রয় দিয়েছিল।
এক, আমার এই মুখ কখনও যেন তাকে আর দেখতে না হয়।
দুই, প্রতিমাসে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জুঁইয়ের যাবতীয় খরচ যেন তার অ্যাকাউন্টে জমা করে দেওয়া হয়।
আর তিন, সেদিন থেকেই সবাই জানবে যে ওই দুর্ঘটনায় আমি এবং আমার স্বামী দুজনেই মৃত। এমনকী আমার মেয়েও কোনওদিন জানবে না যে আমি জীবিত।
আমার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সবকিছু মেনে নিয়ে মাথা নত করে বেরিয়ে এলাম। মেয়ের জন্য কষ্ট হলেও, উপায়ও তো আর কিছু ছিল না।’
‘এবার কিছুটা হলেও অাঁচ করতে পারছি, একজন একা সমর্থ মেয়ের সঙ্গে কী কী ঘটতে পারে। তবু আপনার মুখ থেকেই শুনি, দাদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে কী করলেন? কোথায় গেলেন?’ বেশ কুণ্ঠিতভাবেই বলেন অনামিকাদেবী।
প্রত্যুত্তরে বন্দনাদেবী বলতে থাকেন, ‘কী আর করব ভাই, দাদার শর্ত মতো তখন আমি মৃত। তাই আমাকে শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। সেই ফরমান অনুযায়ী হাতে হাজার তিনেক টাকা গুঁজে দিয়ে চিরতরে বিদায় দিয়েছিল আমাকে। সঙ্গে এও বলেছিল হাওড়া থেকে দূরপাল্লার কোনও ট্রেন ধরে নিতে। সেইমতো স্টেশনে পৌঁছে দেরাদুনগামী ট্রেনে চড়ে বসলাম। চলে এলাম এই শহরে। কত যে ঠোক্বর খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। পদে পদে অপমান, অভাব, অনটন কতই না সয়েছি। তার উপর মার রূপই আমার কাছে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অপরদিকে জুঁইয়ের খরচ পাঠানোরও ব্যাপার ছিল। তখন ওকে মানুষ করাটাই ছিল আমার প্রধান লক্ষ্য। আর সেই জন্য আমি যে-কোনও কাজ করতেই রাজি ছিলাম।
একজন সুন্দরী মহিলার থেকে সমাজ কাজের বদলে টাকা নয়, পরিবর্তে অন্য কিছু চাইত। কীভাবে যে ওই হিংস্র জন্তুগুলোর থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছি, তা বলার নয়। এভাবেই কেটে গেল একটা বছর। ধীরে ধীরে জুঁইও বড়ো হতে থাকল। ওর পড়ার খরচও বাড়তে থাকল। সেই সময়েই রঞ্জনবাবুর সঙ্গে পরিচয়।
আমার প্রয়োজনের কথা শুনে ওনার অফিসে টাইপিস্ট-এর পদে নিয়োগ করেন আমাকে। বোঝেনই তো সুরূপা একটি মহিলা, তার উপর আবার বাবুর নিয়োগ করা লোক হওয়ার কারণে সবসময়েই অফিসের অন্যান্য স্টাফদের থেকে নানা ধরনের নোংরা নোংরা কথা শুনতে হতো আমাকে। এক-এক সময় মনে হতো রঞ্জনবাবুকে সব জানাব, কিন্তু পরক্ষণেই জুঁইয়ের মুখটা ভেসে উঠত মুখের সামনে। জানাতে গিয়ে যদি উলটো ফল হয়, যদি কোনও কারণে চাকরিটা চলে যায়, তাই মুখ বুজে সব সহ্য করতাম।
একদিন কেবিনে বসে বসে রঞ্জনবাবু সবকিছু শুনে আমাকে ডেকে পাঠালেন। বিগত এক বছরে আমি কামাতুর পুরুষ ছাড়া কিছুই দেখিনি। হঠাৎই ওই মানুষটির সহানুভূতি পেয়ে ওনাকে আমার পূর্বের সব ইতিহাস খুলে বলি। তখন থেকেই উনি আমাকে বিশেষ স্নেহের চোখেই দেখেন।
একদিন উনি আমাকে ওনার বাড়িতে নিয়ে গেলেন, সেখানে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত ওনার স্ত্রী বহুদিন ধরেই শয্যাশায়ী। আর কোনও দিন সুস্থ হবেন না জেনেই স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তখনই আমি একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে আমার অন্য কোনও খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। শুধুমাত্র নিজেকে এই সমাজের মুখোশধারী ব্যক্তিদের থেকে বাঁচানো আর মেয়ের উচ্চশিক্ষার অভিপ্রায়েই থেকে গেলাম ওনার বাড়িতে। মনে মনে এই ভেবে খুশি হয়েছিলাম যে, এতে অন্তত জুঁইকে তো ভালোভাবে মানুষ করতে পারব।
রঞ্জনবাবুর স্ত্রীর স্বীকৃতিতেই সম্মানের সঙ্গে থেকে গিয়েছিলাম ওখানে। যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন ততদিন ওনাকে বড়োদিদির মতোই সেবা শুশ্রূষা করেছি। সুরক্ষা বলুন আর ভালোবাসাই বলুন তা তো কেবল ওনাদের থেকেই পেয়েছি। না হলে লোকে তো বেশ্যা বা রক্ষিতা কোনওটাই বলতে বাকি রাখে না। আপনিও একজন মহিলা, আপনি বলুন তো লোকে যে-যে ভাষায় আমাকে গালিগালাজ করে, আমি কি সত্যিই তার অধিকারী?’
‘মাফ করবেন বন্দনাদেবী। আমি কিছু না জেনেই আপনাকে ভুল ভেবেছি।’ ‘আবেগাপ্লুত হয়ে বন্দনাদেবীর হাত দুটো ধরে বলেন অনামিকাদেবী, ‘এবার আমি উঠব, দেখছি কত দূর কী করতে পারি!’
‘সব কিছু শোনার পরেও কি…’ কোথায় যেন আশার আলো দেখতে পায় জুঁইয়ের মা।
‘হ্যাঁ এখনই তো কিছু করার সময়। আচ্ছা খুব তাড়াতাড়ি দেখা হচ্ছে,’ এই বলে অনামিকাদেবী যে-গাড়িতে এসেছিলেন, তাতে করেই স্টেশনে ফিরে গেলেন।
কলকাতায় ফিরে সমস্ত কিছু জানান স্বামীকে অনামিকাদেবী। সঙ্গে সিদ্ধান্তও নেন যে জুঁই-ই তাদের বাড়ির পুত্রবধূ হবার যোগ্য, অন্য কেউ নয়।
‘তুমি যেটা বলছ মানছি। কিন্তু লোকে কী বলবে?’ বলে ওঠে সুপ্রকাশ।
‘লোকের কথা বাদ দাও তো। মানুষের কাজই তো শুধু অন্যের বদনাম করে বেড়ানো। জুঁই নিরপরাধ। ওর কোনও দোষ নেই। শুধু ওই কেন ওর মা-ও নির্দোষ। রঞ্জনবাবু যদি ওনাকে নিজের করে নিতে পারেন, নিজের স্ত্রীর মর্যাদায় রাখতে পারেন, তাহলে আমরা জুঁইকে ঠেলে সরিয়ে রাখব কেন? কোন অপরাধের সাজা মা-মেয়েকে দেব বলতে পার?’ উত্তেজিত হয়েই কথাগুলো বলেন উঠল জয়ের মা।
‘আমি কখন বলছি যে ওরা দোষী? কিন্তু…’
‘কিন্তু কীসের? প্রবল বর্ষণে বড়ো বড়ো কংক্রিটের অট্টালিকা পর্যন্ত বয়ে চলে যাচ্ছে, নদীর গতিপথ বদলে যাচ্ছে, সেখানে তো উনি একজন অসহায় নারী, ভাগ্যের পরিহাসে যাকে জীবনে নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও ভগবান তাকে চরম দণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। তার নিরপরাধ সন্তান কেন সেই সাজা ভোগ করবে?’
অনামিকাদেবীর গম্ভীর স্বর বাবা-ছেলের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। বাবার কাছ থেকে উঠে গিয়ে মার কাঁধে মাথা রাখে জয়। তার মা শুধু তার বিশ্বাসই বজায় রাখেনি, তাকে তার প্রাণাধিক প্রিয় ভালোবাসাও ফিরিয়ে দিয়েছে।