জরায়ু হল গর্ভাশয়, অর্থাৎ যেখানে ডিম্বানু তৈরি হয় বা গর্ভসঞ্চায় হয়। স্ত্রী যোনিপথ যেখানে শেষ হয়, সেখানেই জরায়ুর অবস্থান। আর এই জরায়ুতে যখন মারণ রোগের জীবাণু বাসা বাঁধে, তখন সেই অবস্থাকে বলা হয় জরায়ু ক্যানসার-এ আক্রান্ত। চিকিৎসা পরিভাষায় অবশ্য বলা হয়— এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যানসার।

ভারতবর্ষ তথা সারা পৃথিবীতে মহিলাদের জরায়ুর ক্যানসার কি বাড়ছে বলে মনে হয় আপনার?

জরায়ুর ক্যানসার বাড়ছে তো অবশ্যই। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, ওবেসিটি এবং আধুনিক জীবনশৈলীই জরায়ুর ক্যানসার-এর জন্য মূলত দায়ী। সমীক্ষার রিপোর্ট (আইসিএমআর) অনুসারে, প্রতি এক লক্ষ ভারতীয় মহিলাদের মধ্যে ৪.৩ শতাংশ জরায়ুর ক্যানসার-এ আক্রান্ত হন প্রতি বছরে। ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিজ-এর মধ্যে ইউনাইটেড স্টেট্স-এই, বছরে প্রায় ৪১,২০০ কেস নথিভুক্ত হয়।

জরায়ুর ক্যানসার-এর লক্ষণ কি?

এক নয়, একাধিক লক্ষণ থেকে জরায়ু ক্যানসার আক্রান্ত বলে সন্দেহ করা হয়। বিশেষকরে অনিয়মিত ঋতুচক্র, ভ্যাজাইনাল ব্লিডিং, পেলভিক পেন, অ্যানিমিয়া এবং যৌনমিলনের পরে যোনিতে যন্ত্রণা প্রভৃতি। এইসব লক্ষণ দেখলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা করান।

কী কী কারণে জরায়ু ক্যানসার-এ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়?

ইস্ট্রোজেন-এর মাত্রা বেড়ে যাওয়া, ওবেসিটি, হাইপারটেনশন, পলিসিস্টিক ওভারি সিন্ড্রোম, বন্ধ্যাত্ব, অপরিণত বয়সে বা স্বাভাবিক সময়ের আগে ঋতুমতি হওয়া, লেট মেনোপজ, ডায়াবেটিস, ফ্যামিলি হিস্ট্রি অফ কোলোনিক ক্যানসার, বয়স যখন ৩৫ বছরের বেশি, অতিরিক্ত মদ্যপান প্রভৃতির কারণে জরায়ুর ক্যানসার আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

কোন কোন পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ুর ক্যানসার নির্ধারণ করা হয়?

জরায়ু ক্যানসার-এ আক্রান্ত হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কয়েকটি মেডিকেল এগ্জামিনেশন-এর প্রয়োজন। স্পেশালিস্ট গাইনিকোলজিস্ট-এর তত্ত্বাবধানে পেলভিক এগ্জামিনেশন জরুরি। সেইসঙ্গে, ট্রান্সভ্যাজাইনাল আলট্রাসাউন্ড স্ক্যানিং, হিসটেরোস্কোপি, বায়োপসি প্রভৃতি পরীক্ষারও বিশেষ প্রয়োজন।

জরায়ুর ক্যানসার-এ ক’টি স্টেজ বা পর্যায় আছে এবং কোন পর্যায়ের কী পরিণতি হয়?

আলট্রাসাউন্ড, হিসটেরোস্কোপি, বায়োপসি, কম্পিউটারাইজ্ড টোমোগ্রাফি (সিটি) স্ক্যান, এমআরআই, ব্লাড টেস্ট প্রভৃতি করার পর, তবেই জরায়ুর ক্যানসার-এর স্টেজ নির্ধারণ করা সম্ভব। শুধুমাত্র ইউটেরাস বা জরায়ুতে ক্যানসার-এর জীবাণু পাওয়া গেলে (অল্পসংখ্যক) সেই স্টেজ-কে ফার্স্ট স্টেজ বা স্টেজ ওয়ান বলা হয়ে থাকে। যদি ইউটেরাস (জরায়ু) এবং সারভিক্স-এ (জরায়ু গ্রীবা) ক্যানসার-এর জার্ম পাওয়া যায় তাহলে তা স্টেজ টু ধরে নেওয়া হয়। সেইসঙ্গে, ইউটেরাস, সারভিক্স ছাড়াও যদি রেকটাম এবং ব্লাডার-এ ক্যানসার-এর জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে, তবে তা স্টেজ থ্রি-তে চলে যায়। আর এসবের বাইরে যখন সারা শরীরে ছড়াতে থাকে ক্যানসার-এর জীবাণু, তখন তা চলে যায় স্টেজ ফোর-এ।

জরায়ুর ক্যানসার-এর চিকিৎসা পদ্ধতি কি?

জরায়ুর ক্যানসার-এর চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে সার্জারি, রেডিয়েশন থেরাপি, কেমোথেরাপি এবং হরমোন থেরাপি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যদি মনে হয়, জরায়ু কেটে বাদ দিলেই ক্যানসার-মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, তাহলে পেশেন্ট-এর অনুমতি নিয়ে বাদ দেওয়া হয় জরায়ু। অবশ্য যদি সার্জারি-তে রিস্ক থাকে কিংবা সার্জারির আগে পরে রেডিয়েশন থেরাপির মাধ্যমে রোগ নিরাময় সম্ভব হয়, তাহলে তাই করা হয়। এছাড়া আছে কেমোথেরাপি। রেডিয়েশন এবং কেমো এই দুই থেরাপিতেই ক্যানসার সেল নিধন করা হয়। তবে তফাত হল, প্রথমটিতে ‘রে’ দেওয়া হয় (রেডিয়েশন) এবং দ্বিতীয়টিতে কেমিক্যাল ড্রাগ (কেমো) দেওয়া হয়। কিন্তু স্টেজ থ্রি কিংবা ফোর ছাড়া কেমোথেরাপির ঝুঁকি নেওয়া হয় না। আর যদি ক্যানসার স্টেজ ফোর-এ গিয়ে সারা শরীরে ছড়াতে শুরু করে, তাহলে হরমোন থেরাপির প্রয়োজন হয়।

জরায়ু ক্যানসার-এ আক্রান্ত হলে, চিকিৎসার মাধ্যমে কোন স্টেজ-এ কতটা রোগ নিরাময় সম্ভব হয়?

জরায়ুর ক্যানসার-এর যদি সঠিক চিকিৎসা করা হয়, তাহলে স্টেজ ওয়ান-এ ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ, স্টেজ টু-তে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ, স্টেজ থ্রি-তে ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ এবং স্টেজ ফোর-এ ১০ থেকে ১৫ শতাংশ রোগ নিরাময় সম্ভব হতে পারে।

জরায়ুর ক্যানসার প্রতিরোধে কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত?

  • মেনোপজের পর হরমোন ব্যবহারে সতর্ক থাকতে হবে।
  • ওরাল কন্ট্রাসেপ্টিভ পিল ব্যবহার করা ভালো।
  • শারীরিক উচ্চতা এবং বয়স অনুসারে দেহের ওজন সঠিক পরিমাণে ধরে রাখতে হবে।
  • নিয়মিত যোগ ব্যায়াম করা উচিত।
  • ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
  • ভ্যাজাইনাল ব্লিডিং হলে সঙ্গে সঙ্গে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের (গাইনিকোলজিস্ট) পরামর্শ নিন এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষানিরীক্ষা করান।
আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...