একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, প্রায় সব বাড়িতেই মহিলারা যতটা তার পরিবারের মানুষদের রোগ-অসুখের ব্যাপারে সচেতন, নিজের ব্যাপারে ঠিক ততটাই উদাসীন। কিন্তু সব মহিলারই, এ যুগে আত্মসচেতন হওয়া বিশেষভাবে জরুরি। যে-কোনও রোগকেই যদি একদম প্রাথমিক অবস্থায় চিহ্নিত করতে পারেন, তাহলে গুরুতর ফল ভোগ করতে হয় না। কিছু কিছু কমন সমস্যার কথা এখানে দেওয়া হল, যার ঝামেলা কম-বেশি সব মহিলাকেই কখনও না কখনও ভোগ করতে হয়েছে।

ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন

মেডিক্যাল সায়েন্স-এর এক সার্ভে অনুযায়ী, গড়ে ৯৫ শতাংশ মহিলা এই সমস্যার সম্মুখীন হন। এই ধরনের সমস্যা কমন হলেও, যতটা তাড়াতাড়ি এর নিরাময় সম্ভব তা করুন।

লক্ষণঃ  ভ্যাজাইনা অর্থাৎ যৌনাঙ্গে প্রদাহ, চুলকানি, সাদা ডিসচার্জ, ত্বক ফুলে ওঠা, বারবার প্রস্রাব পাওয়া এবং প্রস্রাব করার সময় ব্যথার অনুভূতি হলে বুঝতে হবে আপনি ভ্যাজাইনাল ইস্ট ইনফেকশন-এর শিকার হয়েছেন।

কারণঃ  বস্তুত মহিলাদের যৌনাঙ্গে কিছু ইস্ট ব্যাকটেরিয়া স্বাভাবিক ভাবেই থাকে কিন্তু হঠাৎই তা সংখ্যায় বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে সংক্রমণ ছড়ায়। এর কারণ অস্বাস্থ্যকর টয়লেট ব্যবহার, অনিদ্রা, অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ সেবন, নায়লন বা লাইক্রা ইনার ওয়্যার ব্যবহার, গর্ভধারণকালে ডায়াবেটিজ হওয়া বা বেশি সময় ধরে গর্ভনিরোধক ট্যাবলেট গ্রহণ করা কিংবা অতিমাত্রায় টক বস্তু খাওয়া।

এড়াবেন কী করেঃ  ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার দিকে নজর দিন। সুইমিং পুল থেকে উঠে বেশিক্ষণ ভেজা পোশাকে না থেকে, সঙ্গে সঙ্গে তা বদলে নিন। কটনের ইনারওয়্যার পরুন। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টি-বায়োটিক গ্রহণ করবেন না। ডায়াবেটিজ থাকলে ব্লাড সুগারের স্তর-কে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করুন। এরজন্য কোনও বিশেষজ্ঞের দেওয়া নির্দেশগুলি মেনে চলুন।

ইউরিন লিকেজ

এই সমস্যা প্রতিনিয়ত অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায় কারণ জোরে হাসতে গেলে, কাশতে গেলে বা অতর্কিত হাঁচি এসে গেলে প্রস্রাব হয়ে যায়। ডেলিভারির পরে এই সমস্যায় পড়তে হয় বহু মহিলাকেই, কারণ ইউরিনারি ব্লাডার-কে সাপোর্ট দেওয়া পেলভিক ফ্লোরগুলি ঢিলে হয়ে যায় এই সময়টাতে।

এড়াবেন কী করেঃ  একজন ভালো যোগ ইন্সট্রাক্টরের সাহায্য নিয়ে এই সমস্যা রোধ করার জন্য তলপেটের ব্যয়াম করলে উপকার পাবেন। এরফলে যোনির মাশলগুলির শিথিল ভাব কমবে। বেশি ঝাল মশলা-যুক্ত খাবার খাবেন না। এড়িয়ে চলুন চা, কফি, চকোলেট, ডেয়ারি প্রোডাক্টস্ ও অ্যাসিডিক ফ্রুট্স।

ইউটিআই

নারী শরীরের আভ্যন্তরীণ প্রত্যঙ্গই খানিকটা এই সমস্যার জন্য দায়ী। মলদ্বার ও ভ্যাজাইনার মাধ্যমে এক বিশেষ ধরনের ব্যকটিরিয়া , ইউরেথ্রা দিয়ে সোজা ইউরিনারি ব্লাডার ও ইউরিনারি ট্র্যাক-এ পৌঁছে যায়, যার ফলে মহিলাদের ইউটিআই সমস্যার শিকার হতে হয়। সহবাসের পরে পরিচ্ছন্নতা অবলম্বন না করাও এই ইনফেকশনের কারণ হতে পারে। দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব চেপে রাখলে ব্লাডারের মাসলগুলিতে বিপুল পরিমাণ চাপ পড়ে ও মাসলগুলি ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে। ফলত এই ধরনের ইনফেকশনের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।

লক্ষণঃ  ইউরিন ডিসচার্জ-এর সময় যন্ত্রণা ও প্রদাহ অনুভব করা, বারবার প্রস্রাবের বেগ আসা, থেমে থেমে ইউরিন ডিসচার্জ করা, প্রস্রাবের সঙ্গে রক্তের ফোঁটা, তলপেটে যন্ত্রণার অনুভব হওয়া মানেই বুঝবেন আপনি এই ধরনের ইনফেকশনের শিকার হয়েছেন।

এড়াবেন কী করেঃ  ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার প্রতি সজাগ থাকুন। প্রচুর জল পান করুন। মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলুন। ভিটামিন সি যুক্ত খাবারে সেই গুণ থাকে, যা এই ব্যকটিরিয়া নির্মূল করতে সহায়ক। তাই লেবু, কমলালেবু, মুসম্বি জাতীয় ফল খান।

পেটে ভার অনুভব করা

ঋতুচক্রের পরেও যদি তলপেটে ভার অনুভব করেন, তাহলে বিষয়টিকে মোটেই ফেলে রাখবেন না। কারণ এটি গভীর কোনও অসুখ, যেমন ডিম্বাশয়ে ক্যানসার অর্থাৎ কোলোরেক্টল ক্যানসারের পূর্বাভাস হতে পারে। চল্লিশোর্ধ মহিলাদের ক্ষেত্রে এই অসুখের সম্ভাবনা সবচেয়ে প্রবল। কিন্তু এর কমবয়সি মহিলারাও অনেক সময় এই সমস্যাকে প্রথমে ঋতুচক্র বা গর্ভধারণ সংক্রান্ত সমস্যা বলে হেলাফেলা করেন এবং পরে এই ক্যানসারের শিকার হন। পেটে ভার অনুভব করার পাশাপাশি কোষ্ঠকাঠিন্য, খাবারে অনীহা, ক্লান্তি ভাব, ওজন হ্রাস পাওয়ার মতো সমস্যা টের পান, সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কারণ এগুলি সবই একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত এবং তা ক্যানসারের পূর্ব লক্ষণ হতে পারে।

মেনোপজ

যে-কোনও নারীর জীবনে এটি অবশ্যম্ভাবী হলেও এর সূত্রপাতে কিছু কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়। হরমোনাল ইমব্যালেন্স-এর ফলে শরীরের তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে যাওয়া, হঠাৎ জ্বর এসে যাওয়া, ঘাম হওয়া, স্মরণশক্তি লোপ পাওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, অনিদ্রা, যৌনেচ্ছা হ্রাস পাওয়া, ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, চুল পড়া, এমনকী হৃদরোগের সূত্রপাতও হতে পারে এর ফলস্বরূপ। এই সময় ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোন উৎপন্ন হওয়ার ক্ষেত্রেও একটা ইমব্যালেন্স সৃষ্টি হয়। যার ফলে ইউটিআই এবং কাশতে গেলে ইউরিন ডিসচার্জ হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা তৈরি হতে পারে।

এড়াবেন কী করেঃ  খাদ্য-তালিকায় সবুজ শাক-সবজি, স্যালাড, অঙ্কুরিত দানা শস্য, ডাল, টাটকা ফল, জুস প্রভৃতি রাখুন। মেনোপজের সময়ে অন্তত ১২০০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম শরীরে প্রয়োজন। তাই প্রতিদিন দুধ-দই প্রভৃতি ডায়েটে রাখুন।  সুতির পোশাক পরুন কারণ এ সময় ঘাম হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। ব্রিস্ক ওয়াকিং, জগিং, সুইমিং করতেই পারেন, তবে একবার চিকিৎসকের মত নেওয়া জরুরি।

অ্যানিমিয়া

কাটা-ছেঁড়া, সার্জারি বা পিরিয়ড্স-এ রক্তপাত হওয়ার পর, খাদ্যগ্রহণে ভারসাম্য না থাকার ফলে, গর্ভধারণকালে পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড না সেবন করলে, অ্যানিমিয়া হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। মাথার যন্ত্রণা, ক্লান্তি, অনিদ্রা, মাথা ঘোরা, চোখে অন্ধকার দেখা, এ অসুখের কমন সিম্পটম। এছাড়া হৃদস্পন্দনে অসঙ্গতি, জ্ঞান হারানো, খাবারে অরুচি, চোখের নীচে কালি, নখ ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া এগুলিও প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।

এড়াবেন কী করেঃ  ব্যালেন্সড ও পুষ্টিকর খাবার, আয়রন যুক্ত শাক-সবজি, ফল, রেড মিট, বিট, আমলকী, গাজর, আপেল, বেদানা, খেজুর, বাদাম, গুড় ও শুকনো মেওয়া খান। ফলিক অ্যাসিডের মাত্রা বাড়াতে পানিফলের আটা, দুধ, মাশরুম, ব্রোকোলি ও মধু খান। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে আয়রন ও ফলিক অ্যাসিডের টেবলেটও খেতে পারেন। বছরে একবার হিমোগ্লোবিন চেক করান।

সার্ভিক্স ক্যানসার

এই ক্যানসার সাধারণত গর্ভাশয়ে হয়। কম বয়সে বিবাহ, একাধিকবার গর্ভধারণ বা গর্ভপাত হওয়া, ধূমপান, চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে গর্ভনিরোধক ওষুধ সেবন করা বা সহবাসের সময় সংক্রামিত হওয়া এর কারণ।

লক্ষণঃ  পিরিয়ড-এর সময়কাল ছাড়াই মাঝেমধ্যে রক্তস্রাব হওয়া, সাদা স্রাব, তলপেটে ব্যথা, সহবাসের সময় রক্তপাত— এই ধরনের লক্ষণ দেখলে সতর্ক হবেন, কারণ তা সার্ভিক্স ক্যানসারের প্রাথমিক পর্যায় হতে পারে।

এড়াতে কী করবেনঃ  ভিটামিন সি ও ই আপনার বিশেষ ভাবে প্রয়োজন, কারণ এগুলি অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট, যা এই রোগের প্রতিরোধক। যে-মহিলারা প্রাত্যহিক ডায়েটে ৯০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি ও ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন ই বরাদ্দ রাখেন, তাদের ওভারিয়ান ক্যানসারের সম্ভাবনা কম।

জরুরি টেস্ট

বছরে একবার অন্তত চেক-আপ। ব্লাড টিএসএইচ (থাইরয়েড স্টিমুলেটিং হরমোন) টেস্ট করা অত্যন্ত আবশ্যক কারণ এই গ্রন্থি সঠিকভাবে কাজ না করলে নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে।  পিরিয়ডের সময়কাল ছাড়াও ব্লাড স্পটিং, অতিমাত্রায় বা স্বল্প পরিমাণে ঋতুস্রাব, ডিপ্রেশন, ওজন বেড়ে যাওয়া, চুল পড়া, শুষ্ক ত্বক, ক্লান্তি— এসবই হরমোনাল ইমব্যালেন্স-এর ফল। গর্ভধারণকালেও এই টেস্ট করানো ভীষণ জরুরি। কারণ, অ্যাসমিটোম্যাটিক থাইরয়েড-এর অপর্যাপ্ত ক্ষরণে গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্ক পরিণত হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...