কোনও মানুষ নিখুঁত হয় না। কারও চোখ তো কারও নাক কিংবা ঠোঁটের গঠনগত সমস্যা থাকে। আর এখানেই একজন মেক-আপ আর্টিস্টের কামাল। নিপুণ হাতের জাদুতে সমস্যা গায়েব। মেক-আপ আর্টিস্টের হাতে যে-কোনও সাধারণ চেহারার নারীই হয়ে উঠতে পারেন অসাধারণ।
একদা সৌন্দর্যচর্চায় মহিলামহলের একচ্ছত্র অধিকার ছিল। পুরুষরা আবদ্ধ ছিল পোশাকি বাহারে। পরিস্থিতিটা একেবারে বদলে গেছে। মেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পুরুষরাও ভিড় জমাচ্ছেন বিউটি পার্লারগুলোতে, মেক-আপ আর্টিস্ট-এর কাছে।
রুপোলি পর্দার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের হতবাক হয়ে আমরা দেখি আর ভাবি, তাঁরা কত সুন্দর, নিখুঁত। কিন্তু আদপে কি তাই? কখনওই ভগবান পৃথিবীতে কোনও মানুষকে নিখুঁত করে পাঠান না। প্রত্যেক সফল সেলিব্রিটির সৌন্দর্যের পিছনে রয়েছে একজন মেক-আপ আর্টিস্ট-এর হাতের কারসাজি। অর্থাৎ এটা বলতেই পারি সেলেবদের জনপ্রিয়তার নেপথ্যে একজন মেক-আপ আর্টিস্ট-এর অবদান অভাবনীয়।
কী কী গুণ থাকা প্রয়োজন – এই পেশায় আসতে গেলে বিশেষ কোনও এডুকেশনাল যোগ্যতার প্রয়োজন না হলেও, বিশেষ কিছু গুণের অধিকারী হওয়া দরকার। একজন মেক-আপ আর্টিস্ট-এর সব থেকে বড়ো গুণ হল তাঁর দৃষ্টিশক্তি, অর্থাৎ একটা মানুষকে দেখলেই তাঁরা বুঝে যাবেন সেই মানুষটার মেক-আপ কেমন হবে। তাঁর চোখ, ঠোঁট বা মুখের সঙ্গে কী ধরনের মেক-আপ যাবে। অর্থাৎ একজন মেক-আপ আর্টিস্টের মূল মন্ত্রই হল তাঁর নিজস্ব ক্রিয়েটিভিটি, যার উপর নির্ভর করবে আর্টিস্টের সাফল্য।
এই প্রফেশনে আসবেন কেন – এই পেশায় প্রচুর কাজের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে বর্তমান সময়ে। যদি আপনি সৌন্দর্যচর্চাকে পেশা হিসাবে নিতে চান তাহলে প্রথমেই আপনাকে জেনে নিতে হবে মেক-আপ ব্যাপারটা ঠিক কী? কীভাবে এটা করে? সর্বোপরি কাজটাকে ভালোবাসতে হবে। বাজারে কোন ধরনের মেক-আপ এখন ইন। এই সব কিছুই আপনাকে জেনে এবং বুঝে নিতে হবে কাজের শুরুতেই। প্রথমে আপনার কেরিয়ারে, আপনি কোনও পার্লার থেকে অথবা কোনও প্রফেশনাল মেক-আপ আর্টিস্টের তত্ত্বাবধানে, মেক-আপ সংক্রান্ত যাবতীয় খুঁটি-নাটি বিষয় শিখে নিতে পারেন।
অনেকেই মনে করেন এই পেশায় সাফল্য খুব সহজেই পাওয়া যায়। এমন ধারণা থাকলে মনে করিয়ে দিই– এই ধারণা একেবারেই ভুল। অন্যান্য পেশায় যেমন মানুষ বহুদিন স্ট্রাগল করার পর নিজের অস্তিত্ব তৈরি করে, এই প্রফেশনেও ঠিক তাই। সুতরাং এই পেশায় আসতে গেলে ক্রিয়েটিভিটির পাশাপাশি ধৈর্যও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একজন প্রফেশনাল মেক-আপ আর্টিস্ট-এর হাতের ছোঁয়ার উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল আজকের চলচ্চিত্র জগৎ। নায়িকার মুখের ছোটোখাটো খুঁত ঢেকে, তিনিই লক্ষ দর্শকের সামনে এক অপূর্ব মুখ-কে হাজির করার নেপথ্য শিল্পী। কিন্তু এই মেক-আপ শিল্পের উপর নির্ভর করে আছে অন্য একটি বিপনণের দিক, আর সেটা হল আজকের প্রসাধনী বাজার। কারণ সাধারণ মানুষ রুপোলি পর্দার নায়ক-নায়িকার সাজগোজ, রুপচর্চার দ্বারা ভীষণরকম প্রভাবিত হন। তাঁরাই পরোক্ষে এইসব প্রসাধন সামগ্রির ব্র্যান্ডিং করে থাকেন। কাজেই শুধু মেক-আপ আর্টিস্ট তাঁর কাজের জন্যই সমাদৃত হন না, উপরন্তু তিনি প্রসাধন সামগ্রী বিক্রির দিকটিও প্রসারিত করেন। একজন পেইন্টার খালি ক্যানভাসের মধ্যে তুলির টানে নিজের মনের মতো ছবি আঁকি-বুঁকি করতে পারেন। কিন্তু একজন মেক-আপ আর্টিস্টের পক্ষে তা কখনওই সম্ভব নয়। কারণ তার কাছে থাকে একটি রক্ত-মাংসের মুখ। সুতরাং, তার মধ্যে খুঁতও বিদ্যমান। আর এই খুঁতকেই নিখুঁত করে সাজিয়ে তোলাই হল একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ।
কাজের সুযোগ কতটা – মেক-আপ হল আর্ট অর্থাৎ একধরনের শিল্পকলা। বর্তমানে মেক-আপ আর্টিস্টদের কদর আকাশছোঁয়া। অভিনেতা-অভিনেত্রী, মডেল, মিউজিশিয়ান এমনকী বেশ কিছু পলিটিশিয়ানও বাদ যাননি এই সৌন্দর্যচর্চার প্রলোভন থেকে। একজন মেক-আপ আর্টিস্টকে একজন ম্যাজিশিয়ানের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কারণ ম্যাজিশিয়ান যেমন মুহূর্তের মধ্যে বদলানোর ক্ষমতা রাখেন ঠিক তেমনই মেক-আপ আর্টিস্টও পারেন বদলাতে। কিছু ক্ষেত্রে সেলেবরা পার্সোনালি মেক-আপ আর্টিস্ট অ্যাপয়েন্ট করেন। সুতরাং ঠিকঠাক কাজ জানলে কজের সুযোগ বর্তমানে বেশ ভালোই।
কতটা লাভবান হবেন – অন্যান্য পেশার মতো এই পেশাতেও যথেষ্ট প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। কিন্তু আপনার কাজ যদি নিখুঁত হয়, যদি কাজ সম্বন্ধীয় সেন্স ঠিক থাকে, এবং আপনার পরিচিতি লেভেলটা ভালো থাকে, তাহলে আপনার কাজ পেতে অসুবিধা হবে না। শুরুতে আপনি মাসে ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ টাকা পর্যন্ত উপার্জন করতে পারেন। পরবর্তীকালে পরিচিতি লেভেলটা আরও বেড়ে গেলে, আপনার ইনকাম ১৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
টলিগঞ্জের মেক-আপ প্রফেশনাল নন্দদুলাল মজুমদার টিপস দিচ্ছেন এটিকে কেরিয়ার হিসাবে বাছার জন্য।
এই পেশাটাকে ঠিক কীভাবে দেখা উচিত?
দেখুন মেক-আপ হল একধরনের আর্ট, যেটার দ্বারা আমরা খুব সহজেই সাধারণকে অসাধারণ করে তুলতে পারি। সেলিব্রিটি থেকে শুরু করে পলিটিশিয়ান সকলেই আসেন আমাদের কাছে নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে নিতে। সুতরাং এই প্রফেশনে এসে আমি গর্বিত।
একজন মেক-আপ আর্টিস্ট হতে গেলে কী ধরনের যোগ্যতার প্রয়োজন?
একজন মেক-আপ আর্টিস্ট হতে গেলে সেই অর্থে কোনও যোগ্যতার প্রয়োজন না হলেও, দরকার মেক-আপ সম্বন্ধীয় সঠিক জ্ঞান, দৃষ্টিশক্তি এবং ক্রিয়েটিভিটি। এটা ঠিক শিখে হয় না, ভিতর থেকে আসে। সর্বোপরি আপনাকে কাজটা ভালোবাসতে হবে।
ঠিক কী ধরনের বিশেষ গুণ থাকলে অন্যদের থেকে ব্যতিক্রমী হয়ে ওঠা যায় এই পেশায়?
পার্লারগুলি ছাড়া ভারতে সেই অর্থে কোনও মেক-আপ-এর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। সুতরাং ব্যতিক্রমী হতে গেলে সারা পৃথিবীতে কী ধরনের মেক-আপ করা হচ্ছে, সেগুলির দিকে নজর দিতে হবে। এছাড়া কমিউনিকেশনের একটা ব্যাপার তো থেকেই যায়।
বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য কি কোনও সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়া জরুরি?
অবশ্যই, কারও তত্ত্বাবধানে না থাকলে তো আপনি কাজটাই শিখতে পারবেন না।
এই পেশা কতটা আর্থিক নিরাপত্তা দেয়?
সব পেশার মতো এই পেশাতেও যথেষ্ট স্ট্রাগল করতে হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে আপনার পরিচিতি যত ডেভলপ করবে, উন্নতির রাস্তাটাও প্রসারিত হয়ে যাবে।
এই পেশায় কাজের সম্ভাবনা কী কী?
বর্তমানে মেক-আপ আর্টিস্টদের বাজার তুঙ্গে। সিনেমার পাশাপাশি বিভিন্ন চ্যানেলে চলছে একের পর এক সিরিয়াল। অতএব সেখানেও মেক-আপ আর্টিস্টের চাহিদা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে গেছে। মডেলিং-এর ক্ষেত্রে এবং ফ্যাশন শো-এ মেক-আপ আর্টিস্ট মাস্ট। এছাড়াও আগে বিয়ের কনেকে পাড়ার বউদিদের দিয়েই সাজানো হতো, কিন্তু এখন পরিস্থিতি অনেকটাই পালটে গেছে। সেখানেও প্রয়োজন বাড়ছে মেক-আপ আর্টিস্ট-এর। সুতরাং আগের তুলনায় এখন কাজের সুযোগ অনেক বেশি।