সাধারণত বাঙালি পরিবারে সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর, আঁতুড়ঘরে থাকার প্রথা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এই বন্দিদশার সময়কাল সাধারণত নির্ভর করে মা এবং সন্তান কতটা ভালো ভাবে সুস্থ জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে তার উপর। কখনও কখনও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব করানো হলে, এই সময়কাল কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। আবার এই সময়কালটি আরও প্রলম্বিত হয়ে উঠতে পারে, যদি প্রসবের সময় মা এবং সন্তানের মধ্যে কেউ কিছু জটিলতার মুখোমুখি হয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে আরও বেশ কিছুটা সময় লাগে। তবে পরিস্থতি যেমনই হোক, একজন মাকে তার নিজের যত্ন নেওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় দিতে হয়। সাধারণ ভাবে মোটামুটি ৪০ দিনব্যাপী সময়সীমাকে স্বাভাবিক বলে বিবেচনা করা হয়।

আধুনিক সময়ে অবশ্য মায়েরা প্রসবের পরবর্তী সময়টাতে বিশেষ কোনও আঁতুড়ঘরে থাকার ব্যাপারে বিশ্বাসী নন। যেই মুহূর্তে তারা ভালো বোধ করেন, সেই মুহুর্তেই তারা তাদের স্বাভাবিক জীবনে প্রত্যাবর্তন করেন। এটি সাধারণত ঘটে থাকে কর্মরতা প্রচুর মায়েদের ক্ষেত্রে। পর্যাপ্ত ছুটি না থাকলে অথবা তারা যত দ্রুত সম্ভব তাদের কাজের জগতে ফিরতে চাইলে, এই মানসিক প্রস্তুতি তো নিতেই হবে।

আঁতুড়ঘরে কিংবা সাধারণ শুশ্রুষায় বাড়িতে থাকার বিষয়টি কার্যকর হয় তখনই, যখন একজন সদ্য হয়ে ওঠা মা তার স্বাস্থ্যের দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে আরোগ্যলাভ করেননি বা নীরোগ, স্বাস্থ্যবতী ও বলিষ্ঠ হয়ে ওঠেননি।চিকিৎসকরা এই পর্যাযে বাড়ির মধ্যেই বন্দি থাকার পরামর্শ দেন। পরিবারের সদস্যরা এই সময়ে নানা কাজে অপরিণত মাকে সাহায্য করেন, তার যত্ন নিতে ব্যস্ত থাকেন এবং শিশুর পরিচর্যা ও যত্নের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জোগান দিয়ে থাকেন।

কিন্তু একটা সময়ের পর নতুন মা-কে সবটুকুই নিজে হাতে সামলাতে শিখে ফেলতে হয়। কাজে যোগ দেওয়ার আগে শিশুর দেখাশোনা কী ভাবে করবেন, তারও একটা পরিকল্পনা করে ফেলতে হয়। আর এর জন্য বিশেষ ভাবে কাজ দেয় মাতৃত্বকালীন ছুটির সময়টা। বস্তুত ওটাই হল সঠিক ভাবে বাচ্চার ধাত বোঝার সময়। তাই ওই সময়ই যতটা সম্ভব শিশুর দায়িত্ব নিজে নেওয়ার অভ্যাস করতে হবে।

অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, জন্মের পর শিশুদের কিছু সময় মায়ের সঙ্গে একান্তে কাটানো প্রয়োজন। ফলে একজন মায়ের মাতৃত্বকালীন ছুটি নেওয়ার ফলে সন্তান উপকৃত হয়। মা যদি বেশিরভাগ সময়টাই বাড়িতে থাকেন, তাতে সন্তানের যত্ন বেশি ভালো হয়, এ ধারণার কোনও মানে নেই। সন্তানকে যেমন অভ্যাস করাবেন, সে তাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। তবে সন্তানের সঙ্গে সময় কীভাবে কাটাচ্ছেন, তার ওপর নির্ভর করে মায়ের সঙ্গে বাচ্চার কেমন মানসিক যোগাযোগ থাকবে, সেই বিষয়টি।

বহুজাতিক একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আবিরা বিশ্বাস। তিনি মাতৃত্বকালীন ছুটি পেয়েছেন প্রায় চার মাস। সেই মেয়াদ শেষ। ছোট্ট শিশুকে বাড়িতে রেখে কাজে ফিরতে হবে আগামী মাসে। কী করে সামলাবেন সেই সময়টা, এই ভাবনাতেই একশা হচ্ছেন তিনি। যদিও শিশুকে দেখেশুনে রাখার জন্য ভরসা দিয়েছেন তাঁর মা। তবুও এত ছোটো সন্তান, সংসার, কর্মক্ষেত্র, সদ্য মা হওয়ার ধকল সব মিলিয়ে যেন চেনা জগতে অচেনা ভাবে পা রাখা।

কর্মজীবী মায়েদের নতুন সন্তানকে রেখে কাজে ফিরতে মানসিক টানাপোড়েনে ভুগতে হয়। অনেকে বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সরকারি চাকরিজীবী মায়েরা ৬ মাস ছুটি পেলেও বেসরকারি চাকুরেদের বেলায় ৩-৪ মাসের বেশি ছুটি মেলা ভার। তবে কিছু প্রতিষ্ঠান অবশ্য সরকারি নিয়ম মেনেই ছুটি দেয়। এরপরও এই ছুটির পর কাজে যোগদানে মায়ের সবচেয়ে বেশি যে দুশ্চিন্তা, সেটি হল শিশুর দেখাশোনা কে করবে? আয়া বা বাচ্চা সামলানোর লোক পেলেও, সে শিশুর যত্ন ঠিক মতো করছে কিনা এই দুশ্চিন্তাতেও ভুগতে হয় মায়েদের।

শিশুরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুকে পূর্ণ ছয় মাস কেবল বুকের দুধই পান করানো উচিত। শিশুর বয়স ৬ মাস পেরিয়ে গেলে বুকের দুধের পাশাপাশি বাড়িতে তৈরি করা সব ধরনের খাবার শিশুকে একটু একটু করে খেতে দেওয়া উচিত। শিশু যদি ২৪ ঘণ্টায় ৬ বার প্রস্রাব করে, বুঝতে হবে, শিশু ঠিকমতো বুকের দুধ পাচ্ছে।

কর্মরতা মায়েদের কাজে ফেরার জন্য সরাসরি মায়ের বুক থেকে দুধ পান করানো সম্ভব না হলেও, মায়েরা ব্রেস্ট পাম্প ব্যবহার করেন। যন্ত্রটি কিন্তু জীবাণুমুক্ত করে ধুয়ে তবেই, দুধ পাম্প করে কয়েকটি আলাদা আলাদা কাপে করে সংরক্ষণ করতে হবে। যাতে প্রতিবার একটি কাপের দুধ শেষ করতে পারে শিশু।

শিশুর খাবার সময় হলে পরিষ্কার চামচের সাহায্যে শিশুকে মায়ের বুকের দুধ পান করাতে হবে। মায়েরা বাড়িতে থাকা অবস্থায়, শিশুকে এক পাশের বুকের দুধ পান করানোর সময় অন্য পাশের বুকের দুধ সংরক্ষণ করতে পারেন। এমনি রাখলে ৬ ঘণ্টা আর ফ্রিজে সংরক্ষণ করলে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত বুকের দুধের গুণ অটুট থাকে।

যেভাবেই সংরক্ষণ করা হোক না কেন, যখন শিশুকে দুধ পান করানো হয়, তখন একটা পাত্রে কুসুম গরম জল নিয়ে তাতে দুধের কাপ চুবিয়ে রাখতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যে দুধ হালকা গরম হয়ে যাবে, সেটি চামচের সাহায্যে শিশুকে দিতে হবে। কোনও ভাবেই ফিডারে নয়।

কর্মস্থল বাড়ির কাছাকাছি হলে যে-কোনও একসময় এসে শিশুকে বুকের দুধ দিতে পারলে খুব ভালো। মাকে বেশি বেশি করে খাবার খেতে হবে ফিডিং করার পর্যাযে এতে শিশুর জন্য পর্যাপ্ত খাবার তৈরি হবে। মাকে মানসিক ভাবে শক্ত থাকতে হবে, উৎফুল্ল থাকতে হবে, হাসিখুশি থাকতে হবে। যেহেতু মা চাকরিজীবী, কাজের ও শিশুর যত্নের ফাঁকেও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে। খুব জরুরি বিষয়, মাকে প্রতিদিন পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে স্নান করতে হবে। অনেকেই প্রতিবার খাওয়ানোর আগে স্তন ধুয়ে ফেলেন, যেটি একেবারেই ঠিক নয়। তাতে শিশু মায়ের গায়ে গন্ধ খুঁজে পায় না, মাকে চিনতে শিশুর অসুবিধা হতে পারে।

তবে এই করোনার পরিবেশে শিশুর খাবারের পাশাপাশি পরিচ্ছন্নতাও খুব জরুরি। বাইরে থেকে ফিরেই সাবানজলেই শুধু নয়, জীবাণুনাশক দিয়ে হাত জীবাণুমুক্ত করে তবেই শিশুকে কোলে নেওয়া যাবে। শিশুকে দিনের বেলা ডায়াপার না পরিয়ে রাখাই সুবুদ্ধির পরিচয়। ক্লান্ত চাকুরে মায়ের ঘুমের কিছুটা সুবিধার জন্য রাতে ডায়াপারে ভরসা রাখাই ভালো।

শিশুর যত্নের বিশেষ টিপস

  • ডায়াপার যেন অতিরিক্ত আঁটসাঁট না হয়। আরামদায়ক ও উচ্চশোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়াটা জরুরি। ডায়াপারে ঢাকা অংশে র‌্যাশ বের হচ্ছে কিনা বা লাল হয়ে যাচ্ছে কিনা, খেয়াল রাখতে হবে। এটা ভারী হলেই জায়গাটা পরিষ্কার করে নতুন ডায়াপার পরাতে হবে।
  • ছোটো শিশুরা সাধারণত সামনে যা পায়, তা-ই মুখে দেয়। তাই শিশুর সামনে থাকা প্রতিটি জিনিস পরিষ্কার থাকা উচিত। কোনও খেলনা শিশুর সামনে দিলে বিশেষ খেয়াল রাখবেন। সূঁচালো, খড়খড়ে বা এবড়োখেবড়ো খেলনা না দেওয়া উচিত। মুখে ঢুকে আটকে যেতে পারে, এমন কিছুর সামনে থেকে শিশুকে দূরে রাখতে হবে।
  • শিশুর দেখভালের দায়িত্বে যিনিই থাকুন না কেন, দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বিষয়গুলো তাঁকে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুকে খুব বেশি সময় কোলে না রেখে স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার পরিবেশ দিতে হবে।
  • বিছানা বা উঁচুতে রাখলে শিশু পড়ে গিয়ে ব্যথা পেতে পারে। আবার সরাসরি মেঝেতেও শিশুকে শুইয়ে বা বসিয়ে রাখা উচিত নয়। মেঝেতে বিছানা পেতে সমাধান করা যেতে পারে এমন সমস্যার। সারাদিন কাজের পর মায়েরা ক্লান্ত অবসন্ন থাকবেন এটা স্বাভাবিক। কিন্তু মনে রাখবেন মাতৃত্ব এক দারুণ অনুভতি। বাচ্চার বেড়ে ওঠার পর্যায়গুলো মিস করবেন না। তাই মায়ের হাসিখুশি, দুশ্চিন্তামুক্ত থাকাটা খুবই জরুরি। এতে বাচ্চাও নিশ্চিন্ত বোধ করবে।
আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...