এক
বট গাছটার শিকড়ের কিছু অংশ নদীর গর্ভে, বাদবাকি মাটিকে ধরে রেখেছে। নদীর জল আছড়ে পড়ে আঘাত করছে সেই মাটিকে প্রতিটি জলের তোড় দিয়ে। মাটির বুকের প্রাণকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। বট গাছটার পিছনে ফাঁকা মাঠটার ওপর কালীথান। দরজাবিহীন টিনের দোচালা মন্দির, তার মাঝখানে বিরাট শ্যামাকালী। আবছা অন্ধকারে তাকে দেখলে, গায়ের রক্তের তাপ কিছুটা কমে যায়। মন্দিরের ফাঁকা মাঠটা পেরিয়ে বিরাট বাঁশঝাড়, তারপর জেলেদের গ্রাম ছাতিয়াতে ঢোকবার মাটির রাস্তা। গ্রামের গা ঘেঁষে টাঙ্গন একটু বৃত্তাকারে ঘুরে এই মহানন্দাতে এসে মিশেছে। মোহনার কাছেই আইহো হাট, ঝকমকে কাচের চুড়ি, শয়ে শয়ে ধান পাটের গরুর গাড়ি ভর্তি হয়ে থাকে।
মহানন্দার ওপারে বাংলাদেশের রাজশাহি জেলা। আর ছাতিয়া, কালীথান, টাঙ্গন, মহানন্দার এপার-সব মালদহ। ওপারের বাস্তুভিটা হারানো মানুষ এপারে। আর এপারের প্রায় তীরের কাছাকাছি মহানন্দার বুকে বিএসএফ-এর প্রাচীর।
ছাতিয়া গ্রামে অন্ধকার ভোর রাত থেকেই ব্যস্ততা। সার সার মাছ ট্রাকে করে আইহো গ্রামের হাটের বুক চিরে, চওড়া পাকা পিচের রাস্তা দিয়ে টাঙ্গনের উপর পাকা সেতুকে ছুঁয়ে, চলে যায় মালদা টাউনে।
কালীথানকে একটু পিছনে ফেলে, মাধো, ভাইয়ের হাত ধরে টাঙ্গনের পাশে দাঁড়ায়, চিৎকার করে ডাকে, ‘ওবাপ স্যারা রেত তো, বাঁশের খড়া গেড়ে শরীর কালি করলা, তা ওনারা জ্যালে পড়ল?’
মাধোর বাবার মুখ হাসিতে ভরে ওঠে ‘ওরে মাখাকি। সারা রেত লৌকার মধ্যি জেগি কি আমি এ্যাকাশের তারা দ্যাখলাম, নাওয়ে আয়ঃ দ্যাখ।’
মাধো তর তর করে নেমে আসে নৌকার কাছে। নাওয়ে ভর্তি মাছ দেখে, আনন্দে তার চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। আনন্দের উচ্ছ্বাসে বলে ওঠে, ‘আমি লয় মাখাকি, বলি তোর ম্যাথার কুনো বুদ্ধি লেই। তা তুই তো, দশ বুছরেই বাপখেয়ি বুদ্ধিটার শোকনো মোরভূমি কইরি ফেলছিস। ম্যাথায় কি তোর কিছু লেই? আগি না গেলে মহাজনের লুড়ি তো সব লিয়ে যাবে।’
মাধোর বাবা অস্বস্তি বোধ করে বলে, ‘আমি কি সুত্যি সুত্যি গাল দিই। ভালোবেইসে
একটু ডাকি।’
‘নে নে আর কাঁদতি হবে না। মা মইরে গেলি তুই যে আবার বে না করি কোনও অভাগি মাগিকে বছর বছর বিয়াতে দেস্নি এই আমাদির ভাগ্যি।’
মাধোর বাবা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্ষেপে ওঠে তার মেয়ে, ‘কিগো বাবা, তুমার ক্যানে গাঙের মাটি সাধাইছে নাকি যে কিছু শুনবার পারো না?’
মাধো আর তার ভাই নৌকায় উঠে বসতেই তাদের বাবা খড়ার পোতা বাঁশের থেকে দড়ি খুলে দেয়। নৌকা এগিয়ে যায় আইহো হাটের দিকে। হঠাৎ পেছন ফিরতেই মাধোর খেয়াল পড়ে, খড়ার জাল জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়নি। কাছের পারে সে নৌকা থেকে নেমে পড়ে, ‘বাপরে তুই চাইলো যা। আমি খড়ার জ্যাল জলে ডুইবে দে, হাটে যাবুখন।’
খড়ার বাঁশের দড়ি আস্তে আস্তে সে ছাড়তে শুরু করে। ধীরে ধীরে দুই বাঁশের মাঝে ত্রিকোণাকৃতি বাঁধা জাল জলের ভেতর ডুবে যায়। দূরে তার বাবার নৌকা নদীর বাঁকের মুখটা দিয়ে বেঁকে যাচ্ছে। এক্ষুনি ওটা হারিয়ে যাবে।
মাধো পারের ওপরে উঠে আসে। তার দু’পা কাদায় ভর্তি। জেলের মেয়ের কাছে এটাই সোনার সাজের মতো প্রিয়। সে সযত্নে ও সস্নেহে দেখে কাদার রং। হাঁটতে হাঁটতে আসে কালীথানের কাছে, মাটিতে হাঁটুগেড়ে বসে, মাথা ছোঁয়ায়। তার মুখে হাসি, মনে মনে গত রাতের স্বপ্নকে একটু ঝালিয়ে নেয়। গতরাতে থানের কালী তাদের হোগলা দেয়ালের মাটি নিকোনো ঘরে গিয়ে তাকে বর দিয়ে এসেছে, ‘তুই কুনো দিন বেধবা হবি না মেধো।’
মাধো চারিদিকে দেখে নেয়, না চারপাশে কেউ নেই। মনে মনে ভাবে, পুজো দেওয়া, মানত করা ছাড়া কে আর আসবে। কিন্তু সে প্রতিদিন এখানে আসে, নিস্তব্ধ মাঠে মাটির বিশাল কালীমূর্তির সঙ্গে কথা বলে। উত্তরটাও নিজেই আশা করে নেয়।
সে সোজাসুজি কালীমূর্তির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে। তারপর লজ্জায় চোখ নামিয়ে বলে ওঠে, ‘মা, তুই দ্যাখছি, আমার মতো বেহায়া। নুজ্জা শরমের মাথা খেইয়ে বসে আছিস।’
মাধো আর মূর্তির দিকে না তাকিয়ে দৌড়ে মাঠটা পার হয়ে যায়। বাঁশবনে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কালীথানের দিকে তাকায়। নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কানে আসছে, বটগাছের কয়েকটা শেকড় অসহায়ের মতো জলের দাপট সহ্য করছে। সে থানের দেবতার উদ্দেশ্যে বলে, ‘তুই থাক মা আমি হাটে যাই। না গেলি, বুড়ো বাপ বেটা এ্যাকা গাইড়ে পইরে না যায়।’ বলেই তাড়াহুড়ো করে বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে শুকনো পাতার উপর দিয়ে ‘মরমর’ শব্দ তুলে, বাঁদিকে কোনাকুনি ভাবে এগিয়ে যায়। ভোরের হাওয়ায় বাঁশঝাড়ের ভেতর, বাঁশের পারস্পরিক ঘর্ষণের এক অপার্থিব শব্দ তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে থাকে।
মাধো কোনও দিকে খেয়াল না করে, তাড়াতাড়ি হাঁটতে হাঁটতে প্রায় পৌঁছে যায়, আইহো হাটের কাছে। দূর থেকে হাটের মানুষের শব্দ তার কানে আসে।
শহুরে মহাজনরা আসবার পর থেকে, আইহো হাট এখন এই মঙ্গল, শনিবার ছাড়াও অন্যান্য দিন বসে এবং একমাত্র এই জেলেদের মাছের জন্যেই। দরদাম নিয়ে কথাবার্তায় ভর্তি হয়ে থাকে হাটের প্রতিটি আনাচ-কানাচ।
মাধো ভিড়ের মাঝখান থেকে খুঁজে বার করে তার বাবাকে। তার বাবা এক মহাজনের সঙ্গে যে দরদাম ঠিক করে ফেলেছে, তা বাজার চলতি দরের থেকে কম নয়। মাধো মনে মনে বাবার প্রশংসায় গর্ববোধ করে। হঠাৎ খেয়াল পড়়ে টাকা ধুতির খোটে গুঁজে একদৃষ্টে তার বাবা, তাকেই দেখছে।
মাধোর বাবা একদৃষ্টে মাধোকে দেখেই চলেছে, মেয়ের মুখের হাসি দেখতে দেখতে মাধোর মার কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটা পুরোপুরি মায়ের মতন আদল পেয়েছে, যদি তার মতো স্থির হতো।
মাধো তার বাবার বুকে হাত রেখে বলে, ‘বাপরে’ বাড়ি চল। ক্ষিদিতে প্যাটে যান্ আগুন জ্বলছে।’
মাধোর বাবা ধাতস্থ হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই বলে, ‘মাধো তোর বে না দিতি পারলি, আমার আর নিশ্চিন্তি নেইরে।’
‘তোর খালি এ্যাক কথা, এহন্ চল।’
‘কালু হালদারের ছাওয়াল সোদরের সাথে তোর মা’র পাদানো বেডা দিতি পারলি…’
তার কথা শেষ করবার আগেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে মাধো, ‘কালু জেঠ্যার ব্যাটার নাম সোদর নয়, সোন্দর। একডা কুথা বলতি পারনা, তবুও বলতি হবে।’
মাধোর বাবার হাসি পায়, মিষ্টি হাসির রেশ মুখে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে মহানন্দার দিকে। নদীর পারে এসে দাঁড়ায় মাধো। ভরাবর্ষায় নদীর বুকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে তার মুখে পড়ে, মুখটা জল শালুক ফুলের মতো চকচক করছে।
নৌকাতে উঠে বসে মাধো আর তার বাবা। নৌকা একপাশে একটু নীচু হয়ে দুলে ওঠে।
দুই
আজকের খড়ার জাল পোতা হচ্ছে, মোহনার কাছে। মোহনায় এসে মিশে একাকার হয়ে গেছে টাঙ্গন, মহানন্দার বুকে। মাধোর বাবা বিড়ি ধরাবার চেষ্টা করে চলেছে, ‘বুইঝলি মেধো আইজকাল শালার পোগুলো, বিড়িতে পর্যন্ত ভেজাল দিচ্ছে। হারামজাদাগুলো, একডু লেশা পর্যন্ত করতি দ্যাবে না।’
‘লেশা না করি কাম কর। জ্যালটা ট্যানান হলি না, কিছু না। বাপ আমার সাহেব হইয়ি লেসার অভাবে বেবাগী হয়ে বুক ভাসাচ্ছি।’
‘থাম তো। তুর ওই এক খ্যাঁকখ্যাঁকানি সুভাব ধরিছে। তুর মা তো এ্যামনডা ছেল না।’
মাধো ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘আহারে আমার বউ সোহাগি বাপরে। মা’র যদি তুর পেতি ট্যান থাকত তোবে তুর কপালে নাথি মেরি যেতি পারত?’
‘ওরে মাখাকি মাগি থামবি’, উত্তেজিত মাধোর বাবা হাঁপাতে থাকে।
দূর থেকে ছোটো নৌকা করে কে যেন একজন আসছে। কাছে আসতেই মাধোর বাবা বুঝতে পারে সুন্দর।
‘ও সোদর ইধার পানি একবার আয় দেখিন।’
মাধোর মধ্যে অস্বস্তি এসে উপস্থিত হয়। ‘হেই বাপঃ আবার সোন্দর কেনে?’
সামনে চলে আসে সুন্দর, ‘কি গো কাকা। ইধার পানি, খড় পুতলি ক্যানে গো, জল দ্যাবতা এখ্যানি কেরপা করে না।’
‘আমার কি বাপ। মাছ ধরতি-ধরতি দাড়িতে পাক ধরি গেল। আমি কি জানি না কুথায় ত্যানারা ধরা দেন। কিন্তুক বাপ, ওই যে এ্যাকখ্যান কুথা আছে না, ‘মাগির কুথায় মাগ চলে সে সংসারে আগুন জ্বলে’ আমার হইছি তাই।’
মাধোর বাবা ও সুন্দর হো হো করে হেসে ওঠে। জলের বুকে হাসির শব্দ প্রতিফলিত হয়ে মাধোর বুকে ধাক্বা মারে। নকল গাম্ভীর্যে সে গম্ভীর হয়ে ওঠে। সুন্দরের চওড়া বুকে অল্প লোমস আভা। মুখে অল্প খোঁচা খোঁচা না কামানো দাড়ির হাসি মুখে নদীর জলের প্রতিফলিত আলো পড়ছে, মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে এই অপরূপ শোভা দেখতে থাকে মাধো। হঠাৎ, তার সংবিৎ ফিরে আসতে, সে লজ্জা পেয়ে বলে ওঠেঃ
‘বাপ, আমি যাইরে’
‘ক্যান। এ্যাখনি যাবার তাড়া লাগল ক্যানে? সোদরের সাথে বসে, বে’র ব্যাপারে দু’দণ্ড কুথা বললি হতো না?’
‘তর আর মুখে কিছু আটক্যায় না। তুইনা বাপ, আমি তোর ম্যাইয়া।’
মাধোর বাবা আবার হো হো করে হাসতে থাকে। এবার তার সঙ্গে তাল মেলায় না সুন্দর। একটা না বলা লজ্জা তার মুখ আলো করে তোলে। একবারের জন্যে মাধোর সাথে তার চোখে চোখ স্থির হয়ে যায়।
মাধো মৎস্যকন্যা হয়ে সাঁতার কেটে উঠে আসে তার ডিঙি নৌকায়। একটা সুদীর্ঘ চুম্বন এঁকে দেয় তার প্রশস্ত বুকে। মাধোর গায়ের মাছোয়ালি গন্ধে এক অপূর্ব শিহরণ তার সারা শরীরে খেলে যায়। জলের ধাক্বায় নৌকা দুলে ওঠে। সুন্দরের মৎস্যকন্যা সেই ধাক্বায় এক্বেবারে মানুষ মাধো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাৎক্ষণিক স্বপ্নভঙ্গের জন্যে, সুন্দর একটু চমকে যায়।
মাধো তার বাবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে, ওই হাবাগবারে মালা দেবার আগি গাঙের জল প্যাটে ঢুকিয়ে মরা ভ্যালোরে বাপ, দৌড়ে উঠে পড়ে পাড়ে। তারপর নদীর ধার ধরে এগোতে থাকে কালীথানের দিকে।
আইহো ব্রিজের কাছে একটু দাঁড়ায় মাধো। হঠাৎ কি খেয়াল হয়, সে পার থেকে আসে জলের কাছে, তারপর গিয়ে দাঁড়ায় ব্রিজের তলায়। নরম মাটিতে তার পায়ের পাতা ঢুকে গেছে, মাথার উপর দিয়ে সিমেন্টের ঢালাই পথ দিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়ি। মাধো চারপাশ দেখেঃ কেউ ধারে কাছে নেই। তারপর আস্তে করে ডেকে ওঠে, ‘সোন্দব…’। ব্রিজের উলটানো ঢালু তলে। সোন্দর নাম বার বার প্রতিধবনিত হতে থাকে। মাধো জোরে ডেকে ওঠে, ‘সোন্দর…’। ব্রিজের উলটানো ঢালু তলে। সোন্দর নাম বার বার প্রতিধবনিত হতে থাকে। মাধো জোরে ডেকে ওঠে ‘সোন্দর…’। সোন্দর নামটা জোরালো প্রতিধবনিত হতে হতে, এসে মিশে যায় মাধোর বুকে। সে ভীষণভাবে লজ্জা পায়। আস্তে আস্তে সুন্দর নামের ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেলে। নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে মাধো আবার নিজেকে খুঁজে পেয়ে, উঠে আসে পাড়ে। বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যায় কালীথানের দিকে।
কালীমূর্তির দিকে তাকিয়ে মাধো ভীষণ লজ্জা পায়। তার মুখ দিয়ে শুধু বেরিয়ে আসে ‘মা সোন্দর’।
থানের উপর চারপাশের গাছের পাতা পড়ে একাকার হয়ে আছে। সে ঝাড়তে শুরু করে দেয়। তার কাজ শেষ হলে, টাঙ্গন নদীর জলে হাত ধুয়ে, একটা শুকনো খড়ি নিয়ে থানের বুকে কয়েকটা বিচিত্র রকমের কাটাকুটির মতো দাগ কেটে, নিশ্চিন্ত হয়ে প্রণাম করতে করতে বিড়বিড় করে চলেছে
‘থানের বুকে এ্যাইকা দিলাম ফাঁড়াকাঠি, ক্যাইটা গেল জেবনের ঝুঁকি-ঝাঁকি জানি মাগো তুমি থাকতে সোন্দরের বেপদটা কি।’
এক সময় তার দীর্ঘ প্রণামের পালা চুকিয়ে সে উঠে পড়ে, থানের উদ্দেশ্যে ‘আসিরে মা’ বলে হাঁটা শুরু করে ঘরের দিকে।
তিন
বর্ষার ধূসর মেঘ আজকাল আর দেখা যায় না। শরতের পেঁজা তুলোর মতো স্তূপ স্তূপ মেঘ, স্বচ্ছনীল আকাশের বুকে প্রেমিকের মন নিয়ে খেলা করে বেড়ায়। মাঝে মাঝে সূর্যরশ্মি সেই মেঘের মুখে চুম্বন করে। লজ্জায় স্বর্ণাভ হয়ে যায় দেহ। প্রাণ-মন-দেহ ভরা না-বলা আনন্দের স্পর্শ উপচিয়ে পড়ে মেঘের কোল থেকে মাটির বুকে। একটা না বোঝাতে পারা প্রাণের আনন্দ খেলা করে সবার হৃদয়ে।
প্রতিটি দিনের মতো, আজকের দিনটি নয়। হঠাৎ অফুরন্ত আনন্দের মাঝখানে সাময়িক বিরহের ছোঁয়া। এই বিরহই জেলেদের আগাম আনন্দের উৎস।
গতকাল মাঝরাত থেকে মাঝে মাঝে ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। জেলেরা অন্ধকার থেকেই ফারাক্বার জলে ইলিশ মাছ ধরবার ছোটো নৌকা নিয়ে মাছের ঝাঁকের দিকে ছুড়ে মারছে হাত-জাল।
মেঘলা আকাশে মাঝে মাঝে মেঘের বুক বিদীর্ণ করে দিচ্ছে বিদ্যুতের চমক। নদীর জল ফুলে ফুলে উঠছে, দুলছে ইলিশ ধরবার ছোটো ছোটো নৌকাগুলি।
মহিম একদৃষ্টে দেখে প্রকৃতির এই বিচিত্র ক্রোধ। সে অভিজ্ঞতার স্মৃতির বুকে মুখ রেখে ভয়ে আঁতকে ওঠে। ‘শুনো গো ভাইসব। গাঙের পানিতে অপদ্যাবতা ভর কইরেছে, রাগে ফুঁইসছে পানি, স্যাবধান, ম্যাঘের পানে চোখ মেলি দ্যাহঃ বেপদ।’
ঝড়, জল, বৃষ্টি জেলের জীবনের নিত্যসঙ্গী, জলের উত্তাল বিদ্রোহের বুকে জেলে খুঁজে পায় জীবনমৃত্যুর চিরন্তন ছন্দ। বিচিত্র পরিবেশের বুকে ঝালিয়ে নেয় পুরোনো অভিজ্ঞতা কিংবা নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে।
জীবনমৃত্যুর এই কঠিন মুহূর্তে ও চরম বাস্তবতার ছোঁয়ায় হাত-জালগুলো ছড়িয়ে পড়ছে নদীর বুকে। উঠে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। নৌকার অপরিসর পরিবেশে, আধো-অন্ধকারকে শেষ তিন সাক্ষী রেখে চিরদিনের জন্যে ঘুমিয়ে পড়ছে মাছগুলো।
হাত-জালের ভারে, সুন্দরের পেশিবহুল হাত বারবার ফুলে উঠছে। গামছা দিয়ে শক্ত করে চুল বাঁধা যুবকমুখ, কঠিনতার ছোঁয়া পেয়ে গম্ভীর হয়ে উঠছে। উত্তাল জলের দাপটে বারবার দুলে উঠছে, তার ছোটো নৌকা। ঝোড়ো হাওয়ায় বিচিত্র গতিতে, নদীর জলেতে ধরছে ঘূর্ণির পাক। ধোঁয়ার মতো পাকিয়ে ওঠা ঢেউ, কেউটের মতো রাগে গজরাচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে জেলেদের বিরুদ্ধে প্রকৃতির এই স্বঘোষিত যুদ্ধেঃ কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
চার
সারাদিন ঝড়-ঝঞ্ঝার পর, এখন থেমে আসছে তার দাপট। তবুও ঝিরিঝিরি শিশিরের মতো অনবরত ঝরে পড়ছে বৃষ্টি। একে শীতকাল তার ওপর ঝঞ্ঝা। যেন বিকেল পাঁচটার সময়েই ঘনিয়েঞ্জআসছে, প্রথম রাতের গভীরতা। চারিদিক নিস্তব্ধ। এই নিস্তব্ধতাকে সাক্ষী রেখে, টাঙ্গনের বুক দিয়ে ফিরে আসছে জেলেদের বিষণ্ণ নিশ্চল নৌকাগুলি।
মাধো কালীথানের কাছে উদ্গ্রীব দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে, ফিরে আসা নৌকাগুলিকে। জেলের মেয়ে, সে জানে, বিচিত্র ক্ষুব্ধ এই অস্বাভাবিক প্রকৃতি জেলের জীবন না নিয়ে থামে না। সারাটা দিন, অগুনতি মানত আর খড়িকাঠ দিয়ে বিপদমুক্তি মন্ত্র বলতে বলতে তার গলা ধরে গেছে। সে আর থাকতে না পেরে চীৎকার করে ওঠে, ‘ও মহিম চাচাঃ সব লৌকা কই গো?’
তার ডাক নদীর ওপার থেকে প্রতিধবনিত হয়ে ফিরে এসে কালীথানের বিচিত্র পরিবেশের মধ্যে প্রতিঘাত পেয়ে অশরীরী হয়ে যায়। এই অশরীরী অনুভূতি, মাধোর সারা দেহে মনে এনে দেয় এক অলক্ষুনে চিন্তা। কোনও উত্তর না পেয়ে সে আর থাকতে না পেরে পাগলের মতো বারবার ডেকে চলে ‘সোন্দরের লৌকা কইঃ’
জেলেদের ফিরে আসা সারি সারি নৌকা, মাধোর ভয়ে তার থেকে দূরে দূরে সরে যায়। নৌকার বুকে লণ্ঠনের অল্প দুলে চলা আলোয় মাঝিদের বিষণ্ণ মুখ দেখতে দেখতে মাধো কঠিন হয়ে ওঠে। নদীর ধার থেকে উপরে উঠে এসে, সোজাসুজি থানের কালীর মূর্তির দিকে তাকায়। তার চোখে এক অস্বাভাবিক ক্রোধ জেগে উঠছে। হঠাৎ, সে কালীথানের থমথমে পরিবেশের উপর চীৎকার করে বলে চলে ‘ মাগো তুই বল। আগুন সাক্ষী করি মন্ত্র না পড়লিই কি বে হয় না। তুই তো জানিস সোন্দর আমার বর। হ্যাঁ—আমার। কারুর সাধ্যি লাই তারে আমার কাছ থিকা ক্যাইরা লায়।’
মাধো পাগলের মতো এক কথা বারবার বলতে থাকে। তারপর একটু শান্ত হয়ে আবার তাকায় থানের মূর্তির দিকে।
‘তুই শুন রক্তখাকিঃ আমারে তুই কেছুতেই বেধবা করতি পারবি না।’ বলে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে মাঠ ছাড়িয়ে বাঁশবনের দিকে। বনের ভিতর ঢুকে কালীথানের দিকে মুখ করে থমকে দাঁড়ায়। সে চোখের ভিতর সহস্র ক্রোধ মেশানো দৃষ্টিতে শেষবারের মতো তাকায় থানের দিকে।
সন্ধ্যার পড়ন্ত অন্ধকার থানকে আস্তে আস্তে গিলে ফেলছে। মাধো একদৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে আছে। এই রকম ভাবে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে সে দেখতে পায়, সন্ধ্যার শেষ আবেশের অন্ধকারের বুকে এক সময় হারিয়ে যায় থান।
বাঁশঝাড়ের বুকে জোনাকির আলো আর হিমেল হাওয়ার টান, নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনতে শুনতে সে হঠাৎ বলে ওঠে, ‘বাপরে, তুই ঠিক বলিস বাপ আমি মাখাকি একডা বোকা ম্যাইয়া। যে-নদী জেবন দেয়, তারে না বেশ্বাস করি, আমি বেশ্বাস করছিলাম একটা মাটির ডেলারে।’
তার কথাগুলো বনের মধ্যে কোনও জাগরণ তোলে না। কিন্তু মনে হয় যেন কিছু অপার্থিব মানুষের ফিশফিশানির শব্দ। মাধো বাঁদিক ধরে কোনাকুনি এগিয়ে যায় হাটের দিকে।
সন্ধে চলে যাওয়া প্রথম রাতের অন্ধকার হাটকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। একটা জন-মনিষ্যি পর্যন্ত নেই। একা হাটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে ভাবে, ‘এ্যাই হ্যাট আইজ থিকা, আমার কাছে স্বগ্গো।’
মাধো হাটের মাটিতে ধানের মতো মাথা ঠুকে প্রণাম করে। হাটের ধারের মহানন্দার পারে এসে দাঁড়ায়। ওপারের বাংলাদেশ এখন দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নদীর বুকে ভেসে যাওয়া নৌকার হ্যারিকেনের আলো— জলের বুকে মৃদুতালে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। মাধো একদৃষ্টে সব কিছু তাকিয়ে দেখতে থাকে। এক সময় তার মনে হয়—‘এ্যাই গাঙের বুকেই জাইলার জেবন। সোন্দর তুই বেঁইচে আছিস সোন্দর। এ্যাই দ্যাখ— আমি তোর বউ মেধো, তোরে অ্যামার বুকের কাইছে থিকা, গাঙের জলের কাছ থিকা, কেউ কুনদিন ক্যাইরা নিতে পারব না।’
নদীর পারে কিছুক্ষণ দাঁড়াবার পর মাধো স্বাভাবিকভাবে ধীরে ধীরে গ্রামের পথ ধরে তার ঘরের দিকে হেঁটে চলে।