বিশ্বে প্রতি তিন মিনিটে একটি শিশু cleft lip বা cleft palette-এর সমস্যা নিয়ে জন্মায়। অর্থ, পরিকাঠামো আর সুপ্রশিক্ষিত চিকিৎসকের অভাবে শিল্পোন্নত দেশের এমন কয়েক লক্ষ শিশুই স্বাভাবিক জীবনযাপনের সুযোগ পায় না। শুধুমাত্র ভারতেই ক্লেফ্ট লিপ আর প্যালেটের সমস্যায় ভোগা শিশুদের একটা বড়ো অংশ শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আর বিকৃত চেহারা নিয়েই সম্পূর্ণ জীবন কাটিয়ে দেয়। ভারতে ৫০০ শিশুর মধ্যে ১টি শিশু এই জন্মগত সমস্যায় ভোগে। সচেতনতার অভাব, দারিদ্র্যতা, অশিক্ষা আর চিকিৎসা নিয়ে কুসংস্কারের জেরে দশ লক্ষেরও বেশি শিশু কোনও চিকিৎসা পায় না।

ক্লেফ্ট লিপ আর প্যালেট কী?

জন্মগত সমস্যার নিরিখে ক্লেফ্ট লিপ আর ক্লেফ্ট প্যালেটেই সবথেকে বেশি আক্রান্ত হয় শিশুরা। এর ফলে বিকৃত হয় ঠোঁট আর মুখের গঠন। ওরাল ফেসিয়াল ক্লেফ্ট-এ ঠোঁটের চারপাশ বা প্যালেট বিকৃত হয় গর্ভসঞ্চারের প্রথম চার থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে। এইসময় ওপর আর নীচের ঠোঁট আর প্যালেটের টিস্যু জিভের দু’পাশ থেকে গঠিত হয়ে ওপরের ঠোঁট এবং শক্ত আর নরম প্যালেট তৈরি করে। মহিলারা তাঁদের গর্ভাবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার আগে অর্থাৎ প্রথম কয়েক সপ্তাহেই ঠোঁট আর প্যালেটের গঠনের কাজ শুরু হয়ে যায়। এই টিস্যু যদি ঠিকঠাক না জোড়ে তাহলেই বিকৃতি দেখা দেয়। এরই ফল হল ক্লেফ্ট। শিশু বিশেষে এই সমস্যার গভীরতা ভিন্ন হয়। সবথেকে বেশি ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে হয় ক্লেফ্ট লিপ বা প্যালেটের সমস্যা। ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে একতরফা ক্লেফ্ট লিপের সমস্যা দেখা দেয়।

ক্লেফ্ট প্যালেটঃ  মুখের ভিতরে তালুর অংশ ঠিকঠাকভাবে না জুড়লে ক্লেফ্ট প্যালেট তৈরি হয়। প্যালেটের দু’দিক থেকে শুরু করে নাসারন্ধ্র পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে এই বিকৃতি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে হার্ড প্যালেট-সফট প্যালেট থেকে গলা পর্যন্তও প্রসারিত হতে পারে তাতে বিকৃত হতে পারে ঠোঁটও।

ক্লেফ্ট লিপঃ  ঠোঁটের দু’দিকের গঠন ঠিক না হলে ক্লেফ্ট লিপের সমস্যা দেখা দেয়। এই ক্লেফ্ট ঠোঁট থেকে নাক পর্যন্ত (অসম্পূর্ণ) কখনও বা নাসারন্ধ্র পর্যন্ত প্রসারিত হয় (সম্পূর্ণ)

ক্লেফ্ট লিপ আর ক্লেফ্ট প্যালেটের কারণ

কী কারণে শিশুদের মধ্যে ক্লেফ্ট লিপ আর প্যালেটের সমস্যা দেখা দেয় তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। এর পিছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে।

জিনগত সমস্যাঃ  এ ব্যাপারে জিনের ভূমিকা থাকে। পরিবারের যত বেশিজন সদস্য ক্লেফ্ট-এর সমস্যায় ভোগেন গর্ভস্থ শিশুর আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও তত বাড়ে।

খাদ্যাভ্যাসঃ  ভিটামিন ডি আর ফোলিক অ্যাসিডের অভাবে গর্ভস্থ ভ্রূণের বেড়ে ওঠায় বিশেষ করে স্নায়ুর বিকাশে সমস্যা দেখা দেয়। গর্ভাবস্থায় ফোলিক অ্যাসিড সাপ্লিমেন্টস খেলে শিশুর ক্লেফ্ট সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।

ওষুধ ও রাসায়নিক ব্যবহারঃ  বেশ কিছু ওষুধ আর রাসায়নিকের আধিক্যে ফোলিক অ্যাসিডের অভাব হয় শরীরে।

সমস্যাসমূহ

শারীরিক গঠনের বিকৃতি ছাড়াও ক্লেফ্ট লিপ আর ক্লেফ্ট প্যালেটের আরও বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। সেগুলি হল–

খাবার খাওয়ায় সমস্যাঃ  ক্লেফ্ট প্যালেটের সমস্যা থাকলে শিশুদের খাবার খেতে সবথেকে বেশি সমস্যা হয়। সে কারণে ওদের পুষ্টির দিকে খুব বেশি জোর দিতে হয়। মুখের তালুর গঠন ঠিকঠাক হয় না বলে শিশুরা খাবার খেতে সমস্যায় পড়ে। অনেক সময় খাবার নাকে চলে যায়। চিবোতে বা গিলতেও সমস্যা হয়। এধরনের সমস্যাগ্রস্ত শিশুরা মায়ের দুধও খেতে পারে না। কারণ মুখ ও নাকের গঠন ঠিকঠাক থাকে না। খাবার গিলে খাওয়ার পরই তা নাক দিয়ে বেরিয়ে আসে। কথা বলতেও সমস্যা হয়।

হাসতে সমস্যা

মুখ খোলা আর বন্ধের সময় ব্যবহৃৎ পেশির গঠনে ত্রুটি থাকায় হাসতেও সমস্যা হয়।

সামাজিক ও মানসিক সমস্যা

অভিভাবক ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা এবং বন্ধুরা শিশুটির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সমস্যায় পড়েন। এর ফলে শিশুটির ওপর মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। কখনও কখনও পরিবার আর বন্ধুদের থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

কানে সংক্রমণ আর বধিরতা

কানের মধ্যবর্তী অংশ আর গলার মধ্যে সংযোগসাধনকারী নালির কোনও কাজ থাকে না বলে কানে সংক্রমণ দেখা দেয়। বারবার এমন সংক্রমণ থেকে শিশুটির শ্রবণশক্তি চলে যেতে পারে।

কথা বলা আর ভাষা শেখায় সমস্যা

মুখের তালুর অংশ আর ঠোঁট উন্মুক্ত থাকায় পেশির কার্যকারিতা কমে যায়। এর ফলে অনেক দেরিতে কথা বলা শুরু করে শিশুরা এবং কখনও কখনও কথা বলার সময় অসঙ্গতিও দেখা দেয়।

দাঁতের সমস্যা

এই ধরনের মৌখিক বিকৃতি থাকার জন্য দাঁতের গঠনও সঠিক হয় না। সেই কারণে দাঁতের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়।

চিকিৎসা পদ্ধতি

চিকিৎসা মূলত অস্ত্রোপচার। বিকৃতির ওপর নির্ভর করে, পুরোপুরি সারিয়ে তোলাও সম্ভব কিনা। ব্যক্তিবিশেষে এক থেকে সর্বোচ্চ আটটি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়ে এক্ষেত্রে। সম্পূর্ণভাবে স্বাভাবিক হতে ক্লেফ্ট সমস্যায় ভোগা শিশুর গড়ে চারটি অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়ে। এক্ষেত্রে যে-ধরনের অস্ত্রোপচার হয় সেগুলি হল –

প্রাথমিক ঠোঁটের মেরামতিঃ  শিশুর বয়স দশ সপ্তাহ হলে এই অস্ত্রোপচার হয়।

প্যালেটের মেরামতি ৯ মাস থেকে ১২ মাস বয়সের মধ্যে এই অস্ত্রোপচার হয়।

দ্বিতীয় পর্যায়ের মেরামতি প্রয়োজন হলে ৪-৬ বছর বয়সে এই চিকিৎসা হয়।

অ্যালভিওলার ক্লেফট-এর চিকিৎসা ৮ থেকে ১০ বছর বয়সের মধ্যে করতে হয়।

চূড়ান্ত মেরামতির প্রয়োজন হলে ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সে করা হয়।

এছাড়া অন্যান্য চিকিৎসাও করা হয়। যেমন – স্পিচ থেরাপি, দাঁতের গঠন মেরামতি ও মানসিক চিকিৎসা।

কুসংস্কার, অবহেলা এবং ফলাফল

ভারতবর্ষের গ্রামগুলির মূল সমস্যা কুসংস্কার আর অশিক্ষা। গ্রামীণ এলাকায় যেখানে এই ধরনের সমস্যা বেশি দেখা যায়,  সেখানে এর জন্য মাকে দায়ী করা হয় এবং ওই শিশুটির ওপর ‘শয়তান ভর’ করেছে বলে মনে করা হয়। শিশুটিকে দুর্ভাগ্যের বাহক বলে বিশ্বাস করে মানুষ। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে শিশুটির বয়স ৫ বছর হওয়ার পর বিষয়টি চিকিৎসকের গোচরে আনা হয় এবং ১৮ শতাংশ ক্ষেত্রে ১৮ বছরের পর চিকিৎসার কথা ভাবেন অভিভাবকরা। অস্ত্রোপচার শুধুমাত্র গঠনগত সমস্যা নিরসন করতে পারে। কিন্তু কার্যকরিতায় পরিবর্তন আনা যায় না। ফলে যে সমস্ত রোগীদের প্যালেটের অস্ত্রোপচার হয় না, তাদের কথা বলার সমস্যা তো থাকেই, পাশাপাশি মানসিক সমস্যা ও চোখে দেখার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। তাছাড়া বেশ কিছু অভ্যাসগত ত্রুটিও দেখা দেয় যা একটু বেশি বয়সে পুরোপুরি নিরসন করাও সম্ভব হয় না। সেকারণেই চিকিৎসকরা দ্রুত চিকিৎসা শুরুর পরামর্শ দেন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...