ভয়েস বক্স বা স্বরযন্ত্র আমাদের শরীরের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কারণ, এই স্বরযন্ত্রের মাধ্যমে আমরা সবাক হই। অবশ্য শুধু সবাক হওয়াই নয়, মনের আবেগ-অনুভূতিও প্রকাশ করি। বিশেষকরে লেকচারার, নেতা, সংগীতশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, আবৃত্তিকার, সঞ্চালক প্রমুখ পেশাদারদের নির্ভর করতে হয় কণ্ঠস্বরের উপর। অতএব, কণ্ঠস্বরের গুরুত্ব অপরিসীম। আর এই কণ্ঠস্বর তৈরি হয় voice box থেকে। এর অবস্থান আমাদের কণ্ঠে। কিন্তু কণ্ঠের কোনও অসুখে যদি আমাদের কণ্ঠ ভেঙে যায়, রুদ্ধ হয় কিংবা যদি পুরোপুরি নির্বাক হয়ে যাই তাহলে?

না-না, দিশাহীন হয়ে পড়া কিংবা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। সমস্যা যতই গুরুতর হোক না কেন, বর্তমান চিকিৎসা-বিজ্ঞানের দৌলতে, সবরকম সমাধানের পথ খোলা আছে। কিন্তু এই অসুখ সারানোর জন্য সচেতন থাকা জরুরি এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা শুরু করাও অত্যন্ত প্রয়োজন। সম্প্রতি কণ্ঠস্বর সংক্রান্ত সমস্যা ও সমাধানের বিষয়ে যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিলেন বিশিষ্ট ইএনটি বিশেষজ্ঞ ডা. ধ্রুব রায়।

কীভাবে বোঝা যাবে, একজন সবাক মানুষের কণ্ঠস্বরের সমস্যা হয়েছে?

হঠাৎ যদি গলা ভেঙে যায় কিংবা বাকরুদ্ধ হয়, তাহলে কণ্ঠস্বরের অসুখের সম্ভাবনার কথা ভেবে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

অনেকসময় ঠান্ডা লেগে কিংবা চিৎকার করার ফলেও গলা ভেঙে যায়। সেক্ষেত্রে অসুখ এবং সাধারণ গলা ভাঙার তফাত বোঝা যাবে কী করে?

সাধারণ গলা ভাঙার বিষয়টি সাময়িক সমস্যা। দু-এক দিন ওষুধ খেলে এবং কথা কম বললে সেরে যায়। কিন্তু গলা ভাঙা কিংবা বাকরুদ্ধ হওয়ার সমস্যা যদি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে অবহেলা না করে চিকিৎসা শুরু করা জরুরি।

গলার স্বরের অসুখ হয়েছে কিনা কিংবা কী ধরনের অসুখ হয়েছে, এটা আপনারা বোঝেন কীভাবে?

ভয়েস ডিসঅর্ডার-এর অসুখে আক্রান্ত কিনা এটা বোঝার জন্য আমরা প্রথমে ভোকাল কর্ড অর্থাৎ যেখান থেকে গলার স্বর বেরোয়, সেখানটা পরীক্ষা করি। প্রথমে দেখে নিই, প্যারালাইসিস বা দুর্বলতার কারণে স্বরের সমস্যা হয়েছে কিনা। এরপর আমরা দেখি ভোকাল কর্ডে জল জমেছে কিনা কিংবা কোনওরকম গ্রোথ হয়েছে বা ফুলে গেছে কিনা। এরপর রোগ নির্ধারণ হয়ে গেলে শুরু করি চিকিৎসা।

চিকিৎসা পদ্ধতিটাই বা কী? ওষুধ নাকি সরাসরি সার্জারির পথ বেছে নিতে হয়?

ছোটোখাটো সমস্যা হলে প্রথমে আমরা ওষুধ এবং এক্সারসাইজ-এর মাধ্যমে রোগ সারানোর ব্যবস্থা করি। কিন্তু যদি সমস্যা জটিল রূপ নিয়ে থাকে, তাহলে সার্জারি ছাড়া উপায় থাকে না। তবে বর্তমান উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থাতে সার্জারিতে কোনও ভয় নেই এবং খুব সহজেই একটা ছোট্ট অপারেশন-এর মাধ্যমে রোগমুক্ত হওয়া যেতে পারে।

ভয়েস ডিসঅর্ডার-এর এখন কতরকম সার্জারি হয়?

স্বর সংক্রান্ত অসুখ সারাতে এখন মোট তিনরকম সার্জারি চালু আছে। প্রথমটি করা হয় মাইক্রোসার্জারি পদ্ধতিতে লেসারের মাধ্যমে। চিকিৎসকদের ভাষায় যাকে বলা হয় ভিডিয়ো ল্যারিঙ্গোস্কোপি। অর্থাৎ স্বরযন্ত্রের পরিস্থিতি ভিডিয়োগ্রাফিতে দেখে নিয়ে মাইক্রোসার্জিক্যাল পদ্ধতিতে অপারেশন করা হয়। দ্বিতীয় ধরনের সার্জারিটিকে বলা হয়, আর্লি ক্যানসার সার্জারি। অর্থাৎ স্বরযন্ত্রে যদি কোনও মাংসপিণ্ড গজিয়ে ওঠে এবং তা বায়োপ্সি করে যদি দেখা যায় প্রাথমিক পর্ব, তাহলে তা আর্লি ক্যানসার স্টেজ ধরে নিয়ে সার্জারি করা হয়। এক্ষত্রে আমরা মাংসপিণ্ডকে লেসার দিয়ে কেটে ফেলে দিই কিংবা ছোটো করে শুকিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। এক্ষেত্রে রুগির কোনওরকম ক্ষতি হয় না এবং তাঁর গলার স্বরও স্বাভাবিক থাকে। তবে তৃতীয় সার্জারিটি একেবারে নতুন ধরনের। এই সার্জারির পদ্ধতিটিকে আমরা চিকিৎসকরা বলে থাকি, ‘সিওটু অ্যাকুব্লেড লেসার’। এই অ্যাকুব্লেড লেসার, সাধারণ লেসারের থেকে একটু আলাদা এবং আরও উন্নত মানের। এরমধ্যে ছুরির মতো একটা যন্ত্র থাকে। এটা ব্রেক-আপ করে লাইনের মতো কাটে। একেবারে ধারালো ব্লেড-এর মতো। এতে ক্যানসার আক্রান্ত জায়গার (মাংসপিন্ডের) আশপাশ অঞ্চল কোনওরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয় না এবং সংক্রমণ ছড়ায় না। তাছাড়া, সেলাইয়ের ঝামেলা নেই এবং রক্তপাতও তেমন হয় না। দিল্লি, মুম্বই, পুনে প্রভৃতি জায়গার মতো কলকাতাতেও এখন এই ‘সিওটু অ্যাকুব্লেড লেসার সার্জারি’র সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।

এই ধরনের সার্জারির ক্ষেত্রে কতদিন বিশ্রামে থাকতে হবে?

খুব কুইক রিকভারি হয় এই ধরনের সার্জারির ক্ষেত্রে। তাই খুব বেশি সময় রুগিকে হাসপাতালেও থাকতে হয় না এবং কাজেও যোগ দেওয়া যায় খুব তাড়াতাড়ি।

এই চিকিৎসার জন্য খরচের পরিমাণ কেমন?

রোগ কতটা জটিল রূপ নিয়েছে, তার উপরই নির্ভর করছে খরচের পরিমাণ। তবে খুব বেশি টাকা খরচ করতে হবে না যদি সঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসা করা যায়।

চিকিৎসক হিসাবে কী পরামর্শ দেবেন সর্বসাধারণের জন্য?

ধূমপান, মদ্যপান বন্ধ করতে হবে। খুব ঠান্ডা জল কিংবা ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে সঙ্গে সঙ্গে খাবেন না। যাদের বেশি কথা বলতে হয়, তারা মাঝেমধ্যে গলাকে বিশ্রাম দেবেন। খুব চিৎকার করে কথা বলবেন না। গলার কোনওরকম সমস্যা অনুভূত হলে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন। একসঙ্গে যাতে আর্থিক চাপ না পড়ে, তার জন্য আগে থেকেই চিকিৎসাখাতে অর্থ বরাদ্দ করুন এবং অবশ্যই স্বাস্থ্যবীমা করিয়ে রাখুন।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...