( এক )
মেয়েটা আজও এসেছে। ওর ব্যাগ থেকে একে একে বার করে ফেলছে জাংক জুয়েলারি, নেলপলিশ, লিপস্টিক আর শিফনের সুন্দর সুন্দর স্কার্ফ। কমবয়সী টিচাররা হামলে পড়েছে সে সব কেনার জন্য। মেয়েটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, এমনিতেই কম কথা বলে। অহনা স্টাফরুমে ঢুকে জলের বোতল খুলে ঢকঢক করে কিছুটা জল খেল, ইলেভেনের ক্লাসে এত মেয়ের মধ্যে চিৎকার করে গলা শুকিয়ে গেছে। বড়দিকে বলতে হবে ইলেভেন, টুয়েভ-এর ক্লাস দুটিতে মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা করতে।
জলের বোতল নামিয়ে রাখতেই মেয়েটার সঙ্গে চোখাচোখি হল। মেয়েটা অন্যদিনের মতোই তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত সেই দৃষ্টি। মেয়েটাকে এই জন্যই তার অপছন্দ এত। আর কারুকে না, শুধু তার দিকেই তাকিয়ে থাকে এইভাবে। প্রথমবার, অহনা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। মেয়েটি কিন্তু না হেসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল শুধু। একটু পরে অহনার মুখের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিল।
লোপা লাফাতে লাফাতে এল, এই অহনাদি, স্কার্ফটা বেশ সুন্দর না? বেগুনির উপর সাদা ফুল ছাপ। হ্যাঁ দেখতে বেশ সুন্দর, আর দামটাও রিজনেবল। অহনার ইচ্ছা করে পিয়ার জন্য গোটা দুই স্কার্ফ নিতে। কিন্তু না, এই মেয়েটার কাছে সে একটাও জিনিস কিনবে না। ওকে দেখলেই তার আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে।
তুমি এবার অনেকদিন পরে এলে, সব খবর ভালো তো? আভাদির কথায় মেয়েটি বলে, পরীক্ষা নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম।
কী সাবজেক্ট যেন তোমার?
মিউজিক নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করছি, সেকেন্ড ইয়ার।
মেয়েটিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে অহনা। খুব রোগা, কাগজের মতো ফর্সা। সাজগোজও কেমন অদ্ভুত! নীল রঙের কাজল আর রানি রঙের লিপস্টিক ওর কাগজের মতো ফর্সা শরীরে একটা বিভীষিকা বুনে দিচ্ছে। মেয়েটা কি বোঝে না, ওকে এইরকম সাজে জঘন্য লাগে!
লোপা কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকে, অহনাদি, কানের দুলগুলো দেখেছ, সব তোমার টাইপ, এসব জিনিস একমাত্র তুমিই ক্যারি করতে পারবে। অহনার দম বন্ধ হয়ে আসে। লোপা তাকে তোষামোদ করে বলছে না। আসলে এই চুয়াল্লিশেও অহনা হাঁটুর বয়সী মেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জিতে যাবার মতো স্টাইলিশ। অন্য সময় হলে এই প্রশংসাগুলো এনজয় করত সে। কিন্তু একটু আগেই লোপার কথা শুনে মেয়েটার ঠোঁটের রেখা যে-ভাবে বেঁকে উঠল, তা দেখেই অহনার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। মেয়েটার বড্ড অহংকার, একদিন টিফিনের সময় অহনা সবার জন্য খাবার অর্ডার করেছিল, পিয়ার জন্মদিন উপলক্ষ্যে। নিজে প্লেট সাজিয়ে মেয়েটার হাতে তুলে দিতে গিয়েছিল, মেয়েটা অবহেলা ভরে সেসব সরিয়ে রেখে বিক্রিবাটা সেরে ওড়নার ঝাপটা তুলে গর্বিত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গিয়েছিল, আর অহনার সারা শরীর চিড়বিড় করে উঠেছিল।
( দুই )
কী রে আবার বেরিয়েছিলি তুই দুপুরে?
গাঢ় সবুজ রঙের নেলপলিশের শিশিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল মেহুলী। বাবার কথা শুনে একবার তাকিয়ে আবার শিশিটাতে মন দিল।
উত্তর দিচ্ছিস না যে, মালতী বলছিল তুই নাকি কলেজ বাংক করলি শরীর খারাপের বাহানায়, তারপর ব্যাগ নিয়ে কোথায় বেরিয়ে গিয়েছিলি! তোর ব্যাগে ওইসব হাবিজাবি সাজগোজের জিনিস কেন? কোথায় যাস ওসব নিয়ে?
টেবিলের উপর ঠকাস করে নেলপলিশের শিশিটা নামিয়ে রাখে মেহুলী। চিৎকার করে ডাকে মালতীকে, তোমায় না মটরশুঁটির কচুরি আর আলুরদম বানাতে বলেছিলাম? বাপির আর আমার দুজনেরই প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। মালতীকে বেশি ডাকাডাকি করতে হয় না, বড়ো ট্রেতে করে সে খাবার সাজিয়ে নিয়ে আসে। মেয়ের রকমসকম দেখে শ্যামল হেসে ওঠে। খাওয়াদাওয়ার মাঝে মেয়ের সঙ্গে টুকটাক কথা হয়, মেয়ের পড়াশানোর খবর নেয় শ্যামল। কিন্তু মাঝে মাঝেই ব্যাগ ভর্তি জিনিস নিয়ে মেয়েটা কোথায় যে যায়, থই পায় না শ্যামল।
( তিন )
অহনা ভাবে মেয়েটা অনেকদিন আসে না আর। লোপারা বলছিল কবে ম্যাট ফিনিশ লিপস্টিকের অর্ডার নিয়ে গেছে, এখনও এল না। কিছুদিন আগেই তো পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলল, তাহলে কি মেয়েটা অসুখে পড়ল! অহনা দেখে মেয়েটার ওই কর্কশ অভিব্যক্তিই তার মনে বেশ ছাপ ফেলে গেছে। নিজের অজান্তেই বলে বসল, ফোন করে একটা খবর নিতে পারিস তো! তা কী আর করা হয়নি, সিমটা খুলে রেখেছে মেয়ে৷ অহনা আর কথা বাড়ায় না। লাস্ট পিরিয়ডে পড়াতে পড়াতেই দেখতে পায় কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে আকাশ। মেয়েরা উশখুশ করছে। পড়াতে পড়াতে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যায় অহনা।
অহনা বড়ো রাস্তা অবধি পৌঁছোনোর আগেই মুষলধারায় বৃষ্টি নামল। কোনওরকমে একটা ভর্তি অটোতে নিজেকে ছুড়ে দিল। কুড়ি মিনিটের রাস্তা পৌঁছোনোর আগেই ভিজে চুপচুপে হয়ে যাবে। মাঝপথে গিয়ে অটোচালক জানিয়ে দিল রাস্তায় জল জমেছে, ইঞ্জিনে জল ঢুকে যাবে, সে আর যাবে না। সহযাত্রীরা যে যার মতো ব্যবস্থা করে নিয়েছে। অহনা আশেপাশে তাকিয়ে দেখে একটাও শেড নেই, অগত্যা ছোটো ছাতাটি ভরসা করে দাঁড়িয়ে থাকে। হাওয়ার দাপটে ছাতার অবস্থাও শোচনীয়। সেই মুহূর্তেই একটা গাড়ি ব্রেক কষে তার সামনেই দাঁড়াল।
-আপনি?
– উঠে আসুন প্লিজ, এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজলে তো বিপদ বাধাবেন।
চমকে তাকায় অহনা, সেই মেয়েটা, নামটা কিছুতেই মনে করতে পারে না।
আরেকবার বলতেই অহনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর পাশের সিটে বসে পড়ল। মেয়েটাকে অসহ্য লাগলেও তীব্র একটা আকর্ষণও যে বোধ করে সে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ঝোলা-কাঁধের সেলস গার্ল মেয়েটা আর দামি গাড়ি ড্রাইভ করা মেয়েটাকে ঠিক মেলাতে পারে না অহনা। লক্ষ্য করে দেখে মেয়েটার ঠোঁট দুটো তাচ্ছিল্যে কেমন বেঁকে গেছে।
সামনেই আমার বাড়ি, গা মাথা মুছে নিয়ে কফি খেতে খেতে বৃষ্টি থেমে যাবে। অহনা জিজ্ঞেস করল, তুমি… মেয়েটি মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ আমিই আপনাদের স্কুলে যাই, ওটা বাপিকে লুকিয়ে পকেট মানির জন্য করি।
শুকনো তোয়ালেতে গা মাথা ভালো করে মুছে নেয় অহনা। মেয়েটি কিন্তু একবারও শাড়িটা পালটাবার কথা বলল না। কফির কাপ হাতে অহনা ঘুরে ঘুরে দেখছিল ইন্ডোর প্ল্যান্ট-এর কর্নারটা। মেয়েটির মুখোমুখি হতে জিজ্ঞেস করল, তোমার মা কি বাড়িতে নেই? স্থির দৃষ্টিতে অহনার মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে মেয়েটি বলে, আসুন আমার সঙ্গে।
অহনা এখন বড়োসড়ো একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে৷ মেয়েটির মায়ের ছবি। ছাইছাই রঙা শাড়ি, রানি কালারের ব্লাউজ, রানি কালারের লিপস্টিক আর নীল কাজলরেখা। অত্যন্ত রোগা আর কাগজের মতো সাদা মুখ। ফটোতে শুকনো একটা মালা ঝুলছে।
মেয়েটি চিৎকার করে বলে ওঠে,
-মালতী মাসি কতদিন মায়ের ছবির মালাটা বদলাওনি, কাল একটা নতুন মালা কিনে এনো।
অহনা বেরিয়ে আসে। মেয়েটি বলে, আমার নাম টুপুর, এটাই মনে হয় জিজ্ঞেস করছিলেন তখন? সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। অহনা পালিয়ে বাঁচে।
গভীর রাত্রে সুদীপের পাশ থেকে উঠে আসে অহনা। পুরোনো বইয়ের ভাঁজ থেকে একটা ছবি বার করে। ছাইছাই শাড়ি, রানি ব্লাউজ, রানি লিপস্টিক আর নীল কাজল পরা অহনা। টুপুর আর শ্যামলের কাছে সে মৃত। একরত্তি মেয়েটাকে ছেড়ে আসার বদলা এভাবে নিল টুপুর! গলার কাছে কষ্টটা দলা পাকিয়ে যায়।