ঘটনাটা ১৯৮১ সালের। সুজয় তখন ব্যাচেলার। চাকরি পেয়ে কলকাতা থেকে দিল্লি এসেছে বেশ কিছুদিন হল। অ্যান্ড্রুজগঞ্জে অমিতের সাথে মেসে থাকে। বাড়ি থেকে এসে মনটাও বেশ খারাপ লাগছিল। দিল্লিতে অমিতের বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে। একদিন সুজয় অমিতকে বলল দ্যাখ, একটু আশেপাশে বেড়াতে গেলে হয়। অমিতও রাজি হয়ে গেল। পরেরদিনই বেরিয়ে গেল হরিদ্বার ও ঋষিকেশের উদ্দেশে।

হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যখন যাচ্ছিল তখন বেশ ভালোই লাগছিল। সে সময় হরিদ্বারের চণ্ডী পাহাড়ে বা মনসাদেবী পাহাড়ে রোপওয়ে হয়নি। পায়ে হেঁটেই উঠতে হতো। প্রথম দিন মনসাদেবী পাহাড়ে চড়ে সুজয় বেশ আপ্লুত হল। একটা বেশ নতুন অনুভূতি। তাই অমিতকে বলল চল কাল খুব সকাল সকাল আমরা চণ্ডী পাহাড়ে চড়তে যাব।

দ্যাখ, অত সকালে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

কিছু হবে না। চল তো।

পরের দিন সকালে চণ্ডী পাহাড়ে উঠতে গিয়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করল। আর অন্য কোনও লোকজনই ওদের আশেপাশে নেই। তাই একটু অবাক হল। চণ্ডী পাহাড়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ দেখতে পেল, কে যেন চিত্কার করে হিন্দিতে তাদের ডাকছে। ওপরে তাকিয়ে দেখল একজন সাধু কমণ্ডলু হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের উঁচু একটা জায়গায় আর তাদের নিষেধ করছে ওপরে যেতে। সেই সাধুটি চণ্ডী পাহাড় থেকে নামার সিঁড়ির ওপরের দিকে একজায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল।

তার হিন্দি থেকে যা বোঝা গেল, তা হল সাধুবাবা তাদের ওপরে উঠতে এখন নিষেধ করছে। ওরা দুজনেই কিছু বুঝতে না পেরে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। এর মিনিট পাঁচেক পর আবার সেই সাধু চিত্কার করে তাদের জানাল যে, তারা এখন ওপরে উঠতে পারে। এসবের কিছু মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে দুই বন্ধু আবার যাত্রা শুরু করল। হঠাৎ নজরে পড়ল, সিঁড়ির দুপাশের গাছপালা কেউ যেন দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে চলে গেছে। কিছু গাছপালা সিঁড়ির মাঝখানেও পড়ে আছে। দেখে মনে হবে কিছুক্ষণ আগে এখানে কেউ তোলপাড় করে গেছে। ওপরে উঠতে উঠতে সিঁড়ির মাঝপথেই দেখা হয়ে গেল সেই সাধুর সঙ্গে।

সাধু হিন্দিতে যা বললেন তা তরজমা করলে এরকম দাঁড়ায় দেখে তো তোমাদের লেখাপড়া জানা শিক্ষিত লোক বলে মনে হয়। এই পাহাড়ে অনেক জন্তু, জানোয়ার আছে। কাকভোরে এই পাহাড়ে আসা ঠিক নয়, এটাও কি তোমরা জানো না? দেখছ না আর অন্য কোনও লোক এই ত্রিসীমানায় নেই। তোমরা আজ বেঁচে গেলে। একটু আগে বুনো হাতির দল এখান দিয়ে যাওয়ার সময় সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। আমি তোমাদের সতর্ক না করলে তোমরা ওই হাতিদের আক্রমণের শিকার হতে। এর পর থেকে আর এরকম ভুল কোরো না। সন্ধের পরেও এদিকে আসবে না। আর হ্যাঁ, তোমরা নতুন মনে হচ্ছে এখানে। ঋষিকেশ যাওয়ার পথে যে-জঙ্গলটা অতিক্রম করে যেতে হয়, তার ভেতরে ঢুকতে যেও না। যদিও পাশেই একটা ছোটো গ্রামে কিছু লোক বসবাস করে, তবে সেখানে না যাওয়াই ভালো। একথা বলেই সাধু সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল।

চণ্ডী পাহাড় থেকে ফিরে হর-কি-পৌরিতে স্নান সেরে দাদা বউদির হোটেলে সুস্বাদু খাবার খেয়ে দুজনেই হোটেলে ফিরে একটা ঘুম দিল। ঘুম থেকে উঠে দুজনে মিলে ঠিক করল আগামীকাল তারা গাড়ি নিয়ে ঋষিকেশ রওনা হবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। পরের দিন গাড়িতে রওনা হল ঋষিকেশের উদ্দেশে।

অমিত পাকা ড্রাইভার, খালি রাস্তা পেয়ে গাড়ির গতিবেগ বাড়িয়ে দিল। সুজয় বলল অমিত অত জোরে চালাস না। তার ওপর গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়ে রাস্তাও পেছল হয়ে আছে।

তুই ভাবিস না, আমি দিল্লির রাস্তায় চালিয়ে অভ্যস্ত। তুই একদম ভাবিস না।

কিছুদূর যাবার পর একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল। দুপাশে কয়েকটা হরিণও চোখে পড়ল। বাঁদরের পাল খাবারের উদ্দেশে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুজনেই এই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে মোহিত হয়ে পড়েছিল। যখন দুজনেই গল্পে মশগুল, হঠাৎ অমিত ব্রেক কষল। হঠাৎ করে এমন ব্রেক মারাতে দুজনেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল।

গাড়ির সামনে হঠাৎ একজন বৃদ্ধ এসে গেছে। তাকেই বাঁচাতে এই ব্রেক মারতে হল। মনে হল বাঁচাতে পেরেছি। চল নীচে নেমে দেখি। দুজনেই তাড়াতাড়ি দরজা খুলে গাড়ির সামনে গিয়ে দেখল এক বৃদ্ধ পড়ে আছে গাড়ির সামনে।

চামড়া ঝুলে কুঁচকে গেছে। চোখের দৃষ্টি ঘষা কাচের মতো। মাথার চুলগুলো বেশিরভাগই পেকে সাদা। খুব বাঁচা বেঁচে গেছে। না, কোনও ক্ষতি হয়নি। উঠে বসার চেষ্টা করছে বৃদ্ধ লোকটি। গায়ে ছেলে ছোকরাদের হাফ শার্ট ও পরনে একটা

থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট। এসব বেশি বয়সের জন্য বেমানান। কাঁপছে তার শরীর। সুজয় ও অমিত দুজনে তাকে তুলে বসাল। গাড়ি থেকে জলের বোতল বের করে খেতে দিল। মুখে, চোখে একটু জল ছিটিয়ে দিল। লক্ষ্য করল, লোকটা ঢকঢক করে বোতলের অর্ধেকের বেশি জল শেষ করে দিল। টেনে টেনে আস্তে আস্তে করে বলল ভুখ লাগা হ্যায়।

লোকটিকে দুজনে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশে একটি গাছের নীচে হেলান দিয়ে বসাল। জায়গাটা বেশ ছায়াময়। বাতাসও বইছে। সুজয় গাড়ি থেকে কেক, বিস্কুট, জুস এনে খেতে দিল। গোগ্রাসে খেতে লাগল লোকটা। মুহূর্তের মধ্যে সব খাবার শেষ করে দিল। একটু সুস্থ হতেই বলল ম্যায় নেহি বাঁচ পঊঙ্গা (আমি বাঁচব না)। এরপর লোকটি হিন্দিতে যা যা বলল তার তরজমা করলে এরূপ দাঁড়ায়

কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হয় মরে যাব।

কেন? তোমার তো চোট লাগেনি, অমিত প্রশ্ন করল।

যা দেখেছি, আমার চোখের সামনে যে আশ্চর্য রোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে, তার ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।

সুজয় জিজ্ঞাসা করল, কী ঘটনা? তুমি সুস্থ না হলে আমরাও যেতে পারছি না। আমরা জানতে চাই, কী সে রোমহর্ষক ঘটনা! আমাদের দুজনেরই শুনতে খুব ইচ্ছে করছে।

লোকটি কিছুক্ষণ গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে রইল, তারপর সহসাই চোখ মেলে তাকাল। বড়ো বড়ো দুটো চোখে আতঙ্কের ছায়া স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বলতে শুরু করল…

কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হয় আমি মারা যাব। আমি যা দেখেছি, যা আমার চোখের সামনে ঘটেছে। এর কোনও ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই।

অমিত জিজ্ঞাসা করল কি ঘটনা? আমাদের বলুন।

সুজয় বলল, বুঝতে পারছি আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ঘটনাটা না শুনে যাওয়াটা ঠিক হবে না। লোকটা যেমন হিন্দি বলছেন তাতে একদম অশিক্ষিত বলে মনে হচ্ছে না তাঁকে। আপনি বলুন। আমরা শুনতে চাই।

আমার নাম রতন সিং। এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে আমার খামারবাড়ি ছিল। পাহাড়ে আমার কিছু নিজের জমি আছে এবং কিছুটা লিজে নিয়েছি। সেখানে এই ঠান্ডায় বাঁধাকপি, ফুলকপি আর টম্যাটো লাগিয়েছিলাম। প্রতিবছর বেশ ভালো ফলন হয়। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। একা সব সামলাতে পারি না বলে চাষবাসে সাহায্য করার জন্য কয়েকজন লোকও রেখেছিলাম। আমার ছোট্ট পরিবার, স্ত্রী আর একটি ছেলে। আমার বাড়িটা পাহাড়ের ঢালেই ছিল। ওপরে টালির ছাদ দেওয়া। সামনে সুন্দর ফুলের বাগান।

একদিন সন্ধেবেলা সব কাজকর্ম সেরে ফিরছি, হঠাৎ নজরে পড়ল আকাশ থেকে কী যেন একটা নীচের দিকে ধেয়ে আসছে। লাল রঙের আগুনের গোলক ছিল সেটা। আমার বাড়ির থেকে প্রায় দুশো গজ দূরে একটা ঝোপের মধ্যে এসে পড়ল সেটা। ঝপাৎ করে বেশ জোরে একটা শব্দ হল। ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম আগুন না লেগে যায় চারিদিকে। কিন্তু না, তা হল না। মনে হল আগুনের পিণ্ডটা যেন নিভে গেছে। জায়গাটা দেখে রাখলাম। ঠিক করলাম, পরের দিন সকালে গিয়ে দেখতে হবে ওটা কী ছিল! শব্দটা শুনে মনে হল না যে ওটা ভেঙে গেছে। এমনকী আশেপাশে আগুনও ধরে যায়নি। এত রাতে জীবজন্তুর ভয়ে ওই ঝোপের দিকে যেতে সাহস হল না।

রাতটা বেশ দুঃশ্চিন্তা ও আতঙ্কে কাটালাম। স্ত্রী ও ছেলেকে রাতে ওই ঘটনার কথা জানাইনি। ভোর হতেই সূর্য ওঠার আগে পৌঁছে গেলাম ওই ঝোপের কাছে। চারিদিকে ফুলের বাহার দেখে মনটাও আনন্দে ভরে গিয়েছিল। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। ওখানে একটা বেশ বড়ো স্বচ্ছ পাথরখণ্ড দেখতে পেয়ে অবাক হলাম। স্বচ্ছ পাথর খণ্ডের মধ্যে কালচে রঙের কী যেন দেখা যাচ্ছিল।

পাথরটা যেন কেমন আমায় টানছিল। একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করলাম। দৌড়ে গিয়ে ওটা হাতে তুলে নিলাম। দেখে মনে হল মহাজাগতিক কোনও বস্তু এই প্রথম হাতে নিয়েছি। অনন্ত কোটি গ্রহাণুর কোনও একটির থেকে হয়তো খসে পড়েছে বলে নানারকম উদ্ভট কল্পনা মাথায় আসছিল। শরীরটা কেমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। ইতিমধ্যেই সূর্য‌্য উদয় হয়েছে।

পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে আলো এসে আমার হাতের স্ফটিক খণ্ডটার ওপর পড়াতে ওটা যেন আরও ঝলমলে হয়ে উঠল। ভেতরের কালো জিনিসগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আগে যেগুলোকে কালো মনে হচ্ছিল সেগুলো সূর্য‌্যের আলোয় মনে হল বেদানার বীজের মতো লালচে রঙের। মনে মনে ভাবলাম, এগুলো অন্য কোনও গ্রহের গাছের বীজ নয়তো! আজকাল তো পৃথিবীর মতো দেখতে আরও অন্য গ্রহেও জীবন আছে বলে নানা পরীক্ষা চলছে। ভাবলাম তেমনও হতে পারে।

এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে স্ফটিকটা ভেঙে ফেললাম। ঘাসের ওপর ওটার টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়ল। বীজগুলোও চারিদিকে ছড়িয়ে গেল। ওগুলো দেখতে এতই অদ্ভুত ছিল যে, সেগুলো থেকে কেউ চোখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। আমিও ওখান থেকে চারটে বীজ তুলে নিয়ে আমার ফতুয়ার পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম। পাথরগুলো এতই অসাধারণ ছিল যে সূর্য‌্যের আলোতে ওগুলো থেকে যেন দু্যতি ছড়িয়ে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল ওগুলো চুনি, পান্নার মতো দামি পাথর। ঠিক তখনই মাথার মধ্যে একটা ইচ্ছে জাগল। এগুলো যদি কোনও গাছের বীজ হয় তবে বীজগুলো রোপণ করেই দেখা যাক না। রোজ জল দিয়ে দেখব গাছ জন্মায় কিনা।

তখনও বুঝতে পারিনি যে, ওই বীজ রোপণ করাটাই আমার কাল হবে। চলে গেলাম আমার অন্য একটা জমিতে যেখানে অন্যান্য ফসল ফলাতাম। পাহাড়ের একটা ঢাল দেখে সেখানে গিয়ে খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ে একটা বীজ পুঁতে দিলাম। জায়গাটা জল দিয়ে ভিজিয়ে ফিরে গেলাম নিজের আস্তানায়। ভাবলাম পরের দিন এসে আবার জল ঢেলে দেব।

পরের দিন সকালে উঠেই জল দিতে চলে গেলাম সেই জায়গায়। ওপর থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। পাহাড়ের নীচে আমার জমিটাতে আমার স্ত্রী, ছেলে ও কাজের লোকেরা জমি ও গাছের পরিচর‌্যা করে চলেছে। গতকালের বীজের জায়গাটায় পৌঁছে অবাক হয়ে গেলাম। গতকাল যে-বীজটা লাগিয়ে গিয়েছিলাম, সেটা থেকে একটা চারাগাছ হয়েছে। গাছের পাতাগুলো ভেলভেটের মতো। মনমাতানো তার অদ্ভুত রং। আমি এর আগে এমন গাছ কখনও দেখিনি। অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম গাছটার দিকে। তারপর জল ঢেলে ফিরে গেলাম অন্যান্য মজুরদের কাজকর্ম দেখতে।

পরের দিন আবার যখন সেখানে গাছটাতে জল দিতে গেলাম, অবাক করা কাণ্ড দেখতে পেলাম। দেখলাম গাছটা এই একদিনে আরও প্রায় তিন-চার হাত লম্বা হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকল গাছটার প্রতিদিন বেড়ে ওঠা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে গাছটা বিশাল রূপ নিল। সূর্য‌্যের আলোয় দেখতে পেলাম গাছের পাতাগুলো অদ্ভুতরকম দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সূর্য‌্যের রক্তিম ছটায় পাতাগুলো লাল হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন আগুন ছড়াচ্ছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। গাছটা যেন আমাকে কেমন সম্মোহিত করে ফেলেছে। লাল রঙের ফুলও ফুটেছে।

গাছটাকে উঁচু পাহাড় থেকে কেমন লাগছে দেখতে দেখার জন্য একটু উঁচু জায়গায় উঠে গেলাম। গাছটাকে দেখতে দেখতে চোখ চলে গেল আমার খেতের দিকে। সেখানে আমার বউ, বাচ্চাকে দেখলাম ফসলের পরিচর‌্যা করে চলেছে। একবার ভেবেছিলাম, বাড়ির লোকেদের এই গাছটার কথা বলে দেব। আবার পরক্ষণেই ভাবলাম কয়েকদিন বাদেই সব জানিয়ে একটু অবাক করে দেব ওদের। পাহাড়ের চড়ায় উঠে গাছটাকে দেখলে দেখতে পেতাম এক অদ্ভুত দৃশ্য। মনে হতো গাছটা থেকে যেন সূর্য‌্যের সাত রং ছিটকে পড়ছে। দেখে মনে হতো, গাছটা রং বদলাচ্ছে। সকালে এক রং, দুপুরে অন্য রং আর বিকেলে আর এক অন্য রং। এমনকী সূর্য‌্যাস্তের পরও গাছের আশপাশটায় তীব্র আলো ছড়িয়ে থাকত। এরপর হঠাৎই ঘটল এক অঘটন।

সেদিনও আমি পাহাড়ের অন্য একটা চড়া থেকে গাছটাকে দেখছিলাম। কিছু বোঝার আগেই বিনা শব্দে বিস্ফোরিত হল গাছটা। গাছের ডালপালা, পাতা সবকিছু চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র কাণ্ডটা দাঁড়িয়ে আছে সোজা হয়ে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম গাছের কাণ্ডটার ভেতরের গর্ত থেকে গুবরে পোকার চেয়ে বড়ো বড়ো কিন্তু লাল রঙের পোকা বেরিয়ে আসছে লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটি। এ যেন আগ্নেয়গিরির লাভা। শেষ-ই হচ্ছে না। পোকাগুলো পিল পিল করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। পোকাগুলো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচের দিকে নেমে চলেছে। যেখান দিয়ে যাচ্ছে সেখানকার সব গাছপালা, ঝোপঝাড়, সবকিছুকে এমনকী ছোটো প্রাণীগুলোকেও নিমেষে ধ্বংস করে এগিয়ে চলেছে।

এই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে গেলাম, যখন দেখলাম ওই পোকাগুলো ঢালটা পেরিয়ে আমার খেতের দিকে, আমার বউ-বাচ্চার দিকে এগিয়ে চলেছে। চিত্কার করে

বউ-বাচ্চাকে সাবধান করার জন্য ডাকতে লাগলাম। কিন্তু আমার ডাক ওদের কানে পৌঁছোনোর আগেই আমার বউ, বাচ্চা, খেত সব কিছুকেই বন্যার জলের মতো ধ্বংস করে এগিয়ে যেতে লাগল প্রাণীগুলো। এ ধ্বংসলীলা সহ্য করার মতো শক্তি আমার ছিল না। ওগুলো যখন আমার জমি পেরিয়ে গেল, তখন দেখলাম কয়েকটা কঙ্কাল পড়ে আছে আর কিছু নেই। আমার ফসল, স্ত্রী, বাচ্চা কেউ আর বেঁচে নেই।

তবুও সাহস করে দৌড়ে নামতে গেলাম, আর তখনই দেখতে পেলাম পোকাগুলো শব্দ করে ফাটছে আর একরকম লালাজাতীয় রস বের করে মরে যাচ্ছে। এই বিভীষিকা মনের মধ্যে আর সহ্য করতে পারছিলাম না। পোকাগুলোই বা কেন মরল, বুঝতে পারলাম না। ভাবছিলাম ওগুলো তো মরল। একটু আগে মরলে আমার পরিবার ও ফসলগুলো বেঁচে যেত। কিন্তু আমাকে শেষ করে দিয়ে গেল।

অনুশোচনায় ভুগতে লাগলাম, আমি নিজেই এই বীজ বপন করেছি এই কথা ভেবে। আর এই বীজই আমার সব কিছু কেড়ে নিল। হাতের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। দেখলাম আমার হাতের চামড়া কুঁচকে গেছে নব্বই বছরের বৃদ্ধের মতো। দৌড়ে বাড়ি গেলাম। আয়নার সামনে নিজেকে দেখে চমকে উঠলাম। দেখে মনে হল আমি আর টগবগে ৩৫ বছরের যুবক নেই। আমার বয়স বেড়ে নব্বই হয়ে গেছে। এমনকী আমার কালো চুলগুলোও সাদা হয়ে গেছে। আমি নিজের এই দশা দেখে অসহায় বাচ্চার মতো কাঁদতে লাগলাম।

তখন মনে পড়ল, গাছটায় যখন বিস্ফোরণ হয় তখন ওখান থেকে নীলাভ আলো এসে আমার গায়ে লেগেছিল। নিজের এই অবস্থা দেখে নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছিল। একবার ভাবলাম আত্মহত্যা করি কিন্তু শেষ অবধি করতে পারলাম না…। এই কথাগুলো বলার পর লোকটি হঠাৎ স্থির হয়ে গেল।

গাছে হেলান দেওয়া অবস্থাতেই মারা গেল। হাতের মুঠোটা আপনা থেকেই খুলে গিয়ে কয়েকটা লাল স্ফটিকের মতো পাথর গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। দেখে মনে হচ্ছিল বেদানা ফলের বীজের মতো। ওগুলো বেশ চিকমিক করছিল।

সুজয় আর অমিত একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সেদিকে। এটা কি গল্প ছিল, না সত্যি ঘটনা? নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না! সুজয় ওই বীজগুলোর দিকে হাত বাড়াতে যেতেই অমিত হাতটা চেপে ধরল সুজয়ের। চিত্কার করে উঠল, ওগুলো ছুঁতে যাস না। বিষবৃক্ষের ফল হতে পারে!

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...